Wednesday, 20 March 2024

স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা - চতুর্থ খণ্ড (সমালোচনামূলক লেখা)

১) "ভক্তিযোগ প্রেমের এই উচ্চতম বিকাশের বিজ্ঞানস্বরূপ।" (পৃষ্ঠা ৪১)

"ভারতবাসীর মনের ইতিহাস পর্যবেক্ষণ করিলে জানা যায়, কি জড়বিজ্ঞান, কি মনোবিজ্ঞান, কি ভক্তিতত্ত্ব, কি দর্শন—সর্ব বিভাগেই উহা চিরকাল এই বহুর মধ্যে এক সর্বগত তত্ত্বের অপূর্ব অনুসন্ধানে নিয়োজিত।" (পৃষ্ঠা ৪৮)

"যদি কোন ব্যক্তি আমাকে গতিবিজ্ঞান, রসায়ন বা অন্য কোন জড়বিজ্ঞান সম্বন্ধে কিছু শিখাইতে ইচ্ছা করে, সে যে চরিত্রেরই হউক, তাহাতে ক্ষতি নাই; সে অনায়াসে উহা শিক্ষা দিতে পারে। ইহা সম্পূর্ণ সত্য—কারণ জড়বিজ্ঞান শিখাইতে যে জ্ঞানের প্রয়োজন তাহা কেবল বুদ্ধিবিষয়ক বলিয়া বুদ্ধিজাত শক্তির উপর নির্ভর করে; এরূপ ক্ষেত্রে আত্মার কিছুমাত্র বিকাশ না থাকিলেও একজনের দারুণ-বুদ্ধিশক্তি থাকিতে পারে। কিন্তু অধ্যাত্মবিজ্ঞানে—যে ব্যক্তি অশুদ্ধচিত্ত, তাহার হৃদয়ে কোনপ্রকার আধ্যাত্মিক আলোক প্রতিভাত হওয়া অসম্ভব। সে কি শিক্ষা দিবে? সে তো নিজেই কিছু জানে না। চিত্তের শুদ্ধিই আধ্যাত্মিক সত্য।" (পৃষ্ঠা ৯১)

"বিজ্ঞানবাদী বলেন, আমি বদ্ধ বলে যে জ্ঞান হয়, সেটাই ভ্রম। বেদান্তবাদী বলেন, তুমি মুক্ত ও বদ্ধ দুই-ই। ব্যাবহারিক ভূমিতে তুমি কখনই মুক্ত নও, কিন্তু পারমার্থিক বা আধ্যাত্মিক ভূমিতে তুমি নিত্যমুক্ত।" (পৃষ্ঠা ১৮২)

"ধর্মবিজ্ঞানের মধ্যে একমাত্র রাজযোগই প্রমাণ করে দেখানো যেতে পারে, আর আমি নিজে প্রত্যক্ষ উপলব্ধি করে যা ঠিক বলে জেনেছি, শুধু তাই শিক্ষা দিয়ে থাকি। বিচার-শক্তির সম্পূর্ণ বিকাশপ্রাপ্ত অবস্থাই প্রাতিভ জ্ঞান, কিন্তু তা কখনও যুক্তিবিরোধী হতে পারে না।" (পৃষ্ঠা ১৮৮)

"কেবল যদি তিনি আধ্যাত্মিক সত্য আবিষ্কার করেন, আমরা তাঁকে ঋষি বা অবতার বলি; আর যখন সেটা জড়জগতের কোন সত্য হয়, তখন তাঁকে বৈজ্ঞানিক বলি। যদিও সকল সত্যের মূল সেই এক ব্রহ্ম, তথাপি আমরা প্রথমোক্ত শ্রেণীকে উচ্চতর আসন দিয়ে থাকি।" (পৃষ্ঠা ১৮৯)

"ব্রহ্মবিদ্যাই পরা বিদ্যা; অপরা বিদ্যা হচ্ছে বিজ্ঞান। মুণ্ডকোপনিষৎ অর্থাৎ সন্ন্যাসীদের জন্য উপদিষ্ট উপনিষৎ এই উপদেশ দিচ্ছেন।৩৯ দুই প্রকার বিদ্যা আছে—পরা ও অপরা। তন্মধ্যে বেদের যে অংশে দেবোপাসনা ও নানাবিধ যাগযজ্ঞের উপদেশ—সেই কর্মকাণ্ড এবং সর্ববিধ লৌকিক জ্ঞানই অপরা বিদ্যা। যে বিদ্যা দ্বারা সেই অক্ষর পুরুষকে লাভ করা যায়, তাই পরা বিদ্যা। সেই অক্ষর পুরুষ নিজের মধ্যে থেকেই সমুদয় সৃষ্টি করছেন—বাইরে অপর কিছু নেই, যা জগৎকারণ হতে পারে।" (পৃষ্ঠা ১৯১)

"আধুনিক বিজ্ঞান বাস্তবিকই প্রকৃত ধর্মের ভিত্তিকে আরও দৃঢ় করেছে। সমুদয় ব্রহ্মাণ্ডটা যে এক অখণ্ড বস্তু, তা বিজ্ঞানের দ্বারা প্রমাণ করা যেতে পারে। দার্শনিক যাকে ‘সত্তা’ (being) বলেন, বৈজ্ঞানিক তাকেই ‘জড়’ (matter) বলে থাকেন; কিন্তু ঠিক ঠিক দেখতে গেলে, এদের দুজনের মধ্যে কোন বিরোধ নেই, কারণ তত্ত্বতঃ দুই-ই এক জিনিষ।" (পৃষ্ঠা ১৯৯)

"ইন্দ্রিয়জ জ্ঞান যে সম্পূর্ণ ভ্রম, পদার্থবিজ্ঞান তা প্রমাণ করে দেয়; আমরা কোন জিনিষকে যেমন দেখি, শুনি, স্পর্শ ঘ্রাণ বা আস্বাদ করি, স্বরূপতঃ জিনিষটা বাস্তবিক তা নয়।" (পৃষ্ঠা ২০৬)

"প্রত্যেক বিজ্ঞানেরই নিজস্ব বিশেষ প্রণালী ও বিশেষ যন্ত্রের প্রয়োজন। একজন জ্যোতির্বিদ্ রান্নাঘরের সমস্ত হাঁড়িকুড়ির সাহায্য নিয়ে শনিগ্রহের বলয়গুলি দেখাতে পারেন না, তার জন্য দূরবীক্ষণযন্ত্র প্রয়োজন। সেইরূপ ধর্মের মহান্ সত্যাসমূহ দেখতে হলে, যারাঁ পূর্বেই সেগুলি প্রত্যক্ষ করেছেন, তাঁদের প্রণালীগুলি অনুসরণ করতে হবে। যে বিজ্ঞান যত বড়, তার শিক্ষা করবার উপায়ও তত নানাবিধ।" (পৃষ্ঠা ২১৩)

"ইন্দ্রিয়গুলো দিবারাত্র তোমায় (ভুলজ্ঞান এনে দিয়ে) প্রতারিত করছে। বেদান্ত অনেককাল আগে এটি আবিষ্কার করেছেন। আধুনিক বিজ্ঞান সবেমাত্র ঐ তত্ত্বটি বুঝতে আরম্ভ করেছে।" (পৃষ্ঠা ২২৩)

"বড় বড় ধর্মাচার্যদের কাছে জড়বিজ্ঞান শিখতে যেও না, তাঁদের সমগ্র শক্তি আধ্যাত্মিক বিষয়ে প্রযুক্ত হয়েছে।" (পৃষ্ঠা ২৩৩)

"যেখানে বুদ্ধিবিচারের শেষ, সেইখানেই ধর্মের আরম্ভ।" (পৃষ্ঠা ২৪০)   

"আমরা যাতে এই বন্ধনের বাইরে যেতে পারি, বিজ্ঞান ও ধর্ম দুই-ই আমাদের সে-বিষয়ে সাহায্য করতে চেষ্টা করছে। তবে ধর্ম বিজ্ঞানের চেয়ে প্রাচীন, আর আমাদের এই কুসংস্কার রয়েছে যে, ধর্ম বিজ্ঞানের চেয়ে পবিত্র। এক হিসাবে পবিত্রও বটে, কারণ ধর্ম নীতি বা চরিত্রকে (morality) তার একটি অত্যাবশ্যক অঙ্গ বলে মনে করে, কিন্তু বিজ্ঞান তা করে না।" (পৃষ্ঠা ২৫১)

"নিয়মের বাহিরে যাইবার জন্যই আমরা প্রথমে নিয়ম মানিয়া চলি, নিয়ম মানিয়া না চলাই হইল সমগ্র জীবনের সংগ্রাম। এই কারণেই আমি ‘ক্রিশ্চান সায়াণ্টিস্ট’দের প্রতি সহানুভূতি প্রকাশ করিয়া থাকি; তাঁহারা মানবের স্বাধীনতা ও আত্মার দেবত্ব সম্বন্ধে শিক্ষা দিয়া থাকেন। আত্মা সর্বপ্রকার পারিপার্শ্বিকতার ঊর্ধ্বে।" (পৃষ্ঠা ২৬৪)

"আমাকে প্রশ্ন করা হয়—তোমাদের ধর্ম, সমাজের কোন্ কাজে লাগে? সমাজকে সত্য-পরীক্ষার কষ্টিপাথর করা হইয়াছে; কিন্তু ইহা অত্যন্ত অযৌক্তিক। সমাজ আমাদের ক্রমোন্নতির একটি সোপান মাত্র—ইহা অতিক্রম করিয়া যাইতে হইবে। নতুবা বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের গুণাগুণ এবং প্রয়োজনীয়তাও শিশুর প্রয়োজনের মাপকাঠিতে বিচার করিতে হয়। ইহা অত্যন্ত আসুরিক।" (পৃষ্ঠা ২৬৮)

মতামত: প্রতিটি অবান্তর যুক্তি-বিবর্জিত মন্তব্য। যে কোনো উপায়ে, বিভিন্নরকম কু-যুক্তির উপস্থাপনা করে বিজ্ঞানের ওপর ধর্মের জয়যাত্রা সুনিশ্চিত করতে উদ্যত স্বয়ং স্বামী বিবেকানন্দ।

ধর্মবিশ্বাসীরা আমাদের আশেপাশের কতিপয় বিজ্ঞান শিক্ষক, বিজ্ঞানী বা চিকিৎসকদের স্বামী বিবেকানন্দের প্রতি অনুরাগকে সম্বল করে ওঁকে অভ্রান্ত হিসেবে তুলে ধরতে চান কিন্তু বাস্তবে এই মানুষগুলোও স্বামী বিবেকানন্দকে নিয়ে প্রচারের শিকার। 

এঁরা সামাজিক বা পারিবারিক ধর্মীয় বিশ্বাসের কারণেই স্বামীজীর প্রতি অনুরক্ত, তার বেশি কিছু নয় (এরকম মনে করার কোনো কারণ নেই যে এঁরা স্বামীজীর প্রতিটি লেখা খুব খুঁটিয়ে পড়ে তারপর তাঁর প্রতি অনুরক্ত হয়েছেন) আর স্বামীজীর এই বক্তব্যগুলো ওঁদের সামনে রাখলে ওঁরাও এইসব আজগুবি, অবান্তর, কাঁঠালের আমসত্ত্ব মার্কা কথাবার্তাগুলোকে মান্যতা দিতে পারবেন না।

২) "ভগবৎ-প্রেমের এই পবিত্র উন্মত্ততাই কেবল আমাদের সংসার-ব্যাধি চিরকালের জন্য আরোগ্য করিতে পারে।" (পৃষ্ঠা ৬২)

"স্বর্গে বিবাহ করা নেই, বিবাহ দেওয়াও নেই—তাই যদি হয়, এখনই তা আরম্ভ করে দাও না কেন? এইখানেই বিবাহ তুলে দাও না কেন? সন্ন্যাসীর গৈরিক বসন মুক্তপুরুষের চিহ্ন। সংসারিত্ব-রূপ ভিক্ষুকের বেশ ফেলে দাও। মুক্তির পতাকা—গৈরিক বস্ত্র ধারণ কর।" (পৃষ্ঠা ২৪১)

মতামত: স্বামী বিবেকানন্দের বহু বক্তব্য এমনই দ্বিচারিতায় পরিপূর্ণ। দ্বিতীয় খণ্ডে উনি নিজেই বলেছেন, "তিব্বতে বিবাহ নাই, সুতরাং সেখানে প্রেমের ঈর্ষাও নাই; কিন্তু তথাপি আমরা জানি, বিবাহ অপেক্ষাকৃত উন্নত সমাজের পরিচায়ক।" (পৃষ্ঠা ১১৬)

বিবাহ যদি উন্নত সমাজের পরিচায়ক হয় তাহলে বিবাহ / সংসারের প্রতি স্বামীজীর এতো ক্ষোভ কেন?

৩) "খাদ্য সম্বন্ধে দ্বিতীয় দোষের নাম ‘আশ্রয়দোষ’। পাশ্চাত্যগণের পক্ষে এটি বুঝা আরও কঠিন। ‘আশ্রয়দোষ’ অর্থে বুঝিতে হইবে, যে ব্যক্তির নিকট হইতে খাদ্য আসিতেছে, তাহার সংস্পর্শে খাদ্যে যে দোষ জন্মে। এটি হিন্দুদের একটি রহস্যপূর্ণ মতবাদ। ইহার তাৎপর্য এই যে, প্রত্যেক ব্যক্তির দেহের চতুর্দিকে এক প্রকার জ্যোতি রহিয়াছে। ঐ ব্যক্তি যাহা কিছু স্পর্শ করে, তাহাতেই যেন তাহার প্রভাব, তাহার মনের—তাহার চরিত্রের বা ভাবের কিছু অংশ লাগিয়া থাকে। প্রত্যেক ব্যক্তির দেহ হইতে তাহার শক্তির মত চরিত্রবৈশিষ্ট্যও যেন বহির্গত হইতেছে, আর ঐ ব্যক্তি যাহা কিছু স্পর্শ করে, তাহাই তাহা দ্বারা প্রভাবিত হয়। অতএব রন্ধনের সময় কে আমাদের খাদ্য স্পর্শ করিল, সে-দিকে বিশেষ দৃষ্টি রাখিতে হইবে। কোন দুশ্চরিত্র বা মন্দ ব্যক্তি যেন উহা স্পর্শ না করে। যিনি ভক্ত হইতে চান, তিনি যাহাদিগকে অসচ্চরিত্র বলিয়া জানেন, তাহাদের সহিত একসঙ্গে খাইতে বসিবেন না, কারণ খাদ্যের মধ্য দিয়া তাঁহার ভিতর অসদ্ভাব সংক্রামিত হইবে।" (পৃষ্ঠা ৭১)

মতামত: সরাসরি সমাজের বহু প্রাচীন, অমানবিক, বর্বর "অস্পৃশ্যতা" প্রথাকে নির্লজ্জ সমর্থন। যদিও ওপরের উক্তিটি স্বামী বিবেকানন্দের নয়, বিশিষ্টাদ্বৈতবাদী প্রচারক রামানুজাচার্যের; তারপরেও স্বামীজী এই মতেরই সমর্থক ছিলেন কারণ উনি নিজেই বলেছেন, "তাহা হইলেও বলিতেছি, রামানুজকৃত ব্যাখ্যাটিকে অবহেলা করা চলিবে না।" (পৃষ্ঠা ৭২)

(আগ্রহী পাঠক মনুসংহিতার ৪র্থ অধ্যায়ের ২১৮ থেকে ২২৪ নম্বর শ্লোক পড়ে দেখতে পারেন।)

৪) "শরীরের কোন অংশে স্নায়ুবিশেষ নড়িতেছে কিনা দেখিবার জন্য একটি প্রাণীকে কাটিয়া দেখা—কি বীভৎস ব্যাপার ভাবুন দেখি! এমন সময় আসিবে, যখন সকল দেশেই—যে ব্যক্তি এরূপ করিবে, সে দণ্ডনীয় হইবে। আমাদের দেশে বৈদেশিক সরকার এরূপ কার্যে যতই উৎসাহ দিক্‌ না কেন, হিন্দুরা যে এ-বিষয়ে সহানুভূতি করেন না, তাহাতে আমি খুশী।" (পৃষ্ঠা ৭৫)

মতামত: বিজ্ঞানের ওপর প্রটেস্টান্টদের ফতেয়া নিয়ে স্বামী বিবেকানন্দ সমালোচনা করে বলেছেন, "এইরূপ গ্রন্থ বা শাস্ত্র-উপাসনা সর্বাপেক্ষা নিকৃষ্ট পৌত্তলিকতা—ওটা আমাদের হাত-পা একেবারে বেঁধে রেখে দেয়। এদের মতে কি বিজ্ঞান, কি ধর্ম, কি দর্শন—সবকিছুই ঐ শাস্ত্রের মতানুযায়ী হতে হবে। প্রটেস্টাণ্টদের এই বাইবেলের অত্যাচার সর্বাপেক্ষা ভয়ানক অত্যাচার।" (পৃষ্ঠা ১৮১) অথচ নিজেই হিন্দু ধর্মকে ব্যবহার করে বিজ্ঞানের ওপর ফতেয়া জারি করলেন। 

তিনি জীবনবিজ্ঞানে ব্যাঙ ব্যবচ্ছেদ বা চিকিৎসা বিজ্ঞানের স্বার্থে ইঁদুরকে ব্যবহারের বিপক্ষে গিয়ে দাঁড়ালেন। যিনি বিশ্বাস করেন যে "মানসিক শক্তির দ্বারা লোকের রোগ সারাইতে আমি দেখিয়াছি।"  (পৃষ্ঠা ৩৩২, তৃতীয় খণ্ড) তাঁর পক্ষে আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের এরকম অবান্তর বিরোধিতা করাটাই স্বাভাবিক। 

আমাদের মতো যুক্তিবাদীদের মত হল, বিজ্ঞান কোনোদিনই কোনো দেশ, ধর্ম, জাতি বা বর্ণের সম্পত্তি হতে পারে না; বিজ্ঞানের চরিত্র সর্বদা আন্তর্জাতিক; বাকি যে সব চিকিৎসকরা খুব গর্ব করে স্বামী বিবেকানন্দের প্রতি তাঁদের আনুগত্য প্রচার করেন, এই তর্কের সমাধানটা না হয় তাঁদের ওপরেই ছেড়ে রাখলাম। 

৫) "আমি দেখিয়াছি—অতি ভয়ানক অসুরপ্রকৃতি ব্যক্তিগণও অদ্ভুত অদ্ভুত অলৌকিক কার্য করিয়াছে, তাহারা মাটি হইতে ফল উৎপন্ন করিয়া দিবে। আমি দেখিয়াছি অনেক মূর্খ ও পিশাচপ্রকৃতি ব্যক্তি ভূত ভবিষ্যৎ বর্তমান ঠিক ঠিক বলিয়া দিতে পারে। আমি দেখিায়াছি, অনেক মূর্খ একবার মাত্র দৃষ্টিপাত করিয়া অতি ভয়ানক রোগ সারাইয়া দিয়াছে। এগুলি শক্তি বটে, কিন্তু অনেক সময়েই এগুলি পৈশাচিক শক্তি।" (পৃষ্ঠা ৯৭)

মতামত: বিজ্ঞান সচেতনাকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়ে অজ্ঞানতা, কুসংস্কারের বদ্ধ জালে পুরো ভক্তকুলকে ছুঁড়ে ফেলে দিতে উদ্যত স্বয়ং স্বামী বিবেকানন্দ। স্বামীজী জ্যোতিষকে মান্যতা দিতে চান, মান্যতা দিতে চান ঝাড়ফুঁক, তুকতাক, তাবিজকে। বাস্তবটা কিন্তু এতো সহজ নয়। এইসব বাবাজীরা নিজের ভক্তদের সামনে যতই বিজ্ঞানের ওপর ধর্মকে প্রতিষ্ঠিত করতে চান না কেন, বাস্তবে তাঁরাও শরীর খারাপ হলে চিকিৎসকদেরই শরণাপন্ন হন। 

https://www.anandabazar.com/west-bengal/bengal-cm-mamata-banerjee-visit-hospital-to-see-swami-smarananandaji-maharaj-of-ramkrishna-math-dgtl/cid/1501345

৬) "পাশ্চাত্যের লোকেরা বলিয়া থাকে, মূর্তির সম্মুখে হাঁটু গাড়িয়া বসা বড়ই খারাপ, কিন্তু তাহারা কোন নারীর সম্মুখে হাঁটু গাড়িয়া বসিয়া তাহাকে অনায়াসে বলিতে পারে, ‘তুমি আমার প্রাণ, তুমি আমার জীবনের আলো। তুমি আমার নয়নের মণি, তুমি আমার আত্মা’—এই-সব। তাহাদের যদি চারিটি করিয়া পা থাকিত, তবে তাহারা চার পায়ের হাঁটু গাড়িয়া বসিত! ইহা নিকৃষ্টতর পৌত্তলিকতা বা পৌত্তলিকতা অপেক্ষা নিকৃষ্ট। পশুরা ঐরূপে হাঁটু গাড়িয়া বসিবে। একটি নারীকে ‘আমার প্রাণ, আমার আত্মা’ বলার অর্থ কি? এ ভাব তো পাঁচ দিনের মধ্যেই উবিয়া যায়, এ কেবল ইন্দ্রিয়গত আসক্তি মাত্র। তাই যদি না হইবে, তবে পুরুষ পুরুষের নিকট ঐরূপ হাঁটু গাড়িয়া বসে না কেন?" (পৃষ্ঠা ১১১)

মতামত: সমকামী প্রেম হলে একজন পুরুষ আরেকজন পুরুষের সামনে হাঁটু গেঁড়ে বসতেই পারেন; সমকামিতাকে ‘বিদেশি প্রভাব’ বলে দাগিয়ে দেওয়ারও কোনো ভিত্তি নেই কারণ বহু হিন্দু শাস্ত্র ও পুরাণেও সমকামিতার উল্লেখ আছে। যদিও মনুবাদী স্বামী বিবেকানন্দ সমকামী প্রেমকে মান্যতা দিতে রাজি নন।

মনুসংহিতাতে লেখা আছে, "আর যদি কোনও কন্যা অন্য কন্যাকে অঙ্গুলি-প্রক্ষেপে নষ্ট করে, উহার দুই শত পণ দণ্ড করিবেন এবং শুল্ক দ্বিগুণ দেওয়াইবেন ও দশবার বেত্রাঘাত করিবেন।" (৮/৩৬৯) 
(মনুসংহিতা, ডঃ মানবেন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় শাস্ত্রী, পৃষ্ঠা ৭৩৭)

"যে প্রগল্ভা স্ত্রী, কন্যাকে এইরূপে নষ্ট করে, ঐ স্ত্রীর মস্তক মুণ্ডন করাইয়া দিবেন; দুই অঙ্গুলিচ্ছেদ করিবেন, গর্দভে চড়াইয়া রাজমার্গে ভ্রমণ করাইবেন; দোষের নূন্যাধিক্যানুসারে প্রকারত্রয় জানিবে।" (৮/৩৭০) 
(মনুসংহিতা, ডঃ মানবেন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় শাস্ত্রী, পৃষ্ঠা ৭৩৮)

"যে কোনো স্থানে হউক, পুরুষ মৈথুন করিয়া শকটে ও জলে এবং দিনে স্ত্রীতে মৈথুন করিয়া সেই বস্ত্রের সহিত তৎক্ষণাৎ স্থান করিবে।" (১১/১৭৫)
(মনুসংহিতা, ডঃ মানবেন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় শাস্ত্রী, পৃষ্ঠা ৯৫৯) 

"A twice-born man who commits an unnatural offence with a male, or has intercourse with a female in a cart drawn by oxen, in water, or in the day-time, shall bathe, dressed in his clothes." (The Sacred Books of the East, F. Max Muller, Page - 466)

https://www.anandabazar.com/editorial/old-indian-mythology-have-some-hints-of-homosexuality-but-still-people-thinks-its-foreign-culture-1.864964  

৭) "আমাদের মধ্যে প্রত্যেকেই আমাদের অতীত অভিজ্ঞতার ফলস্বরূপ বিশেষ বিশেষ প্রকৃতি লইয়া জন্মগ্রহণ করিয়াছি। হয় বলুন—উহা আমাদের পূর্বজন্মের কর্মফল, নয় বলুন—পুরুষানুক্রমে আমরা ঐ প্রকৃতি পাইয়াছি। যে ভাবেই আপনারা উহা নির্দেশ করুন না কেন, এই অতীতের প্রভাব আমাদের মধ্যে যেরূপেই আসিয়া থাকুক না কেন, ইহা সম্পূর্ণ নিশ্চিত যে, আমরা আমাদের অতীত অবস্থার ফলস্বরূপ। এই কারণেই আমাদের প্রত্যেকের মধ্যে বিভিন্ন ভাব, প্রত্যেকের দেহমনের বিভিন্ন গতি দেখিতে পাওয়া যায়। সুতরাং প্রত্যেককেই নিজ নিজ পথ বাছিয়া লইতে হইবে।" (পৃষ্ঠা ১১৭)

মতামত: পূর্বজন্মের কর্মফল আর জন্মান্তরবাদ নামক কুসংস্কারগুলো থেকে আমাদের সমাজ থেকে দূরীভূত হলেই কতিপয় উচ্চবর্ণের ধনী ব্যক্তির দ্বারা সংখ্যাগরিষ্ঠ নিম্নশ্রেণির শ্রমজীবী মানুষের ওপর শোষণের পথ বন্ধ হবে; যুগে যুগে এভাবেই শাসকদের সাথে হাতে হাত মিলিয়ে সাধারণ মানুষকে ঠকিয়ে এসেছেন এই ধর্মব্যবসায়ীরা, তার বদলে তাঁদের সামন্ত প্রভুদের থেকে পেয়েছেন উদার আর্থিক সাহায্য। আমরা সকলেই জানি যে কোনো কাজ না করে, শুধু সারাদিন ঠাকুর, ঠাকুর করার পরেও এই ধর্মব্যবসায়ীদের দু'বেলা অন্নসংস্থানে কোনসময় কোনো ঘাটতি হয় না।

উপরের উক্তি প্রমাণ করে, সেই একইপথের যাত্রী স্বামী বিবেকানন্দ।  

৮) "ভারতে কিন্তু ধর্ম বিষয়ে ভিন্ন মত অবলম্বন করার দরুন কখনও কাহার উপর অত্যাচার করা হয় নাই।" (পৃষ্ঠা ১২২)

মতামত: সর্বৈব মিথ্যা কথা। সতীদাহ থেকে শুরু করে বাল্যবিবাহ, কুলিন ব্রাহ্মণদের একাধিক স্ত্রী থেকে দেবদাসী বা বিধবা মহিলাদের পুনরায় বিবাহের অন্তরায় পরিস্থিতি হিন্দুরা ধর্মকে ব্যবহার করেই সৃষ্টি করেছিল।

৯) "দিব্য প্রেরণা ও প্রতারণার মধ্যে পার্থক্য কিরূপে বুঝা যাইবে? প্রথমতঃ দিব্যজ্ঞান কখনও যুক্তিবিরোধী হইবে না। বৃদ্ধাবস্থা শৈশবের বিরোধী নয়, উহার বিকাশমাত্র। এইরূপে আমরা যাহাকে প্রাতিভ বা দিব্যজ্ঞান বলি, তাহা যুক্তিবিচারজনিত জ্ঞানের বিকাশমাত্র। যুক্তিবিচারের ভিতর দিয়াই দিব্যজ্ঞানে পৌঁছিতে হয়। দিব্যজ্ঞান কখনই যুক্তির বিরোধী হইবে না। যদি হয়, তবে উহাকে টানিয়া দূরে ফেলিয়া দিন।" (পৃষ্ঠা ১২৩) 

আবার স্বামীজী নিজেই বলেছেন, "ধর্ম—মতমতান্তরে নাই, তর্কযুক্তিতে নাই; ধর্ম—হওয়া; ধর্ম অপরোক্ষানুভূতি।" (পৃষ্ঠা ১৩০)

বক্তব্য দুটি সম্পূর্ণ পরস্পর বিরোধী।

১০) "দিব্যপ্রেরণাসম্পন্না নারী যত আছে, ঐরূপ পুরুষও তত আছে। যদিও মেয়েদের এইটুকু বিশেষত্ব যে, তাঁহাদের মধ্যে বিশেষ প্রকার মূর্ছা ও স্নায়ুরোগ বেশী।" (পৃষ্ঠা ১২৪)

মতামত: আবার একটি নারীবিদ্বেষী মতামত, এর কোনো বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই। বেশ কিছু স্নায়ুর রোগ নারীদের অপেক্ষা পুরুষদের বেশি হয় আর কিছু স্নায়ুর রোগ পুরুষদের অপেক্ষা নারীদের বেশি হয়। মূর্ছা রোগীদের ক্ষেত্রেও ব্যাপারটা একইরকম।

https://www.ncbi.nlm.nih.gov/pmc/articles/PMC4829467/#:~:text=Several%20neurological%20conditions%20are%20associated,and%20Multiple%20sclerosis%20in%20women.

https://www.ncbi.nlm.nih.gov/pmc/articles/PMC7561535/#:~:text=In%20another%20study%20%5B21%5D%20the,often%20in%20the%20NTG%20phase.

১১) "আমাদিগকে সর্বদা স্মরণ রাখিতে হইবে যে, ঈশ্বর প্রেমস্বরূপ—তিনি এ-সব অদ্ভুত ব্যাপারের ভিতর নাই। ‘উষিত্বা জাহ্নবীতীরে কূপং খনতি দুর্মতিঃ’—সে মূর্খ, যে গঙ্গাতীরে বাস করিয়া জলের জন্য একটা কূপ খুঁড়িতে যায়। সে মূর্খ, যে হীরার খনির নিকট থাকিয়া কাচদণ্ডের অন্বেষণে জীবন অতিবাহিত করে। ঈশ্বরই সেই হীরক-খনি। আমরা ভূতের অথবা এইরূপ সমুদয় উড়ন্ত পরীর গল্পের প্রতি বৃথা আসক্ত হইয়া ভগবানকে ত্যাগ করিতেছি—ইহা বাস্তবিক আমাদের মূর্খতা।" (পৃষ্ঠা ১২৪)

মতামত: আবার দ্বিচারিতা। তৃতীয় খণ্ডে স্বামীজী নিজেই বলেছেন, "যোগীদের মধ্যে কেহ কেহ দাবী করেন যে, এই শরীর তরল বাষ্প ইত্যাদিতে পরিণত হইবে। তুমি শরীর দ্বারা যাহা খুশী করিতে পারিবে—ইহাকে ছোট করিতে পার, এমন কি বাষ্পেও পরিণত করিতে পার, এই দেওয়ালের মধ্য দিয়া যাতায়াতও সম্ভব হইতে পারে—এই রকম তাঁহারা দাবী করেন। আমার অবশ্য তাহা জানা নাই। আমি কখনও কাহাকেও এরূপ করিতে দেখি নাই। কিন্তু যোগশাস্ত্রে এই-সব কথা আছে। যোগশাস্ত্রগুলিকে অবিশ্বাস করিবার কোন হেতু নাই।" (পৃষ্ঠা ৩৩৬)

ওঁর এই বক্তব্যটা ভূত বা উড়ন্ত পরীর গপ্পোর থেকে কম কিসে!

১২) "এই জগৎটা একটি ছোট শিশুর খেলার মত; আমরা যখন তা জানি, তখন জগতে যাই হোক না কেন, কিছুতেই আমাদের চঞ্চল করতে পারবে না।" (পৃষ্ঠা ১৬২)

মতামত: আমাদের চারপাশে বহু মানুষ অর্থের অভাবে দুবেলা পেট ভরে খেতে পায় না, কারো বা সন্তান দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত, একটু চিকিৎসা করানোর মতো অর্থও জোগাড় করে উঠতে পারেন না - তারপরেও নাকি "জগৎটা ছোট শিশুর খেলার মত"! 

আসলে এই বাবাজীরা কোনোরকম কাজ না করেও শুধুমাত্র শাসক শ্রেণির তাঁবেদারি করে আর ভক্তদের সামনে আত্মা, পুনর্জন্ম আর পূর্বজন্মের কর্মফলের গাজর ঝুলিয়ে নিজেদের জন্য অন্নসংস্থান সহ বিভিন্ন প্রয়োজনীয় কাজের জন্য অর্থ জুগিয়ে নিতে পারেন; বাকিদের ক্ষেত্রে তা সম্ভব নয় - তাই এইসব বাবাজীদের মুখেই এরকম অমানবিক, অবাস্তব কথাবার্তা শোভা পায়। 

১৩) "শ্রীরামকৃষ্ণদেব জগতের ভিতর পাপ বা অশুভ দেখতে পেতেন না—তিনি জগতে কিছু মন্দ দেখতে পেতেন না, কাজেই সেই মন্দ দূর করবার জন্য চেষ্টা করারও কোন প্রয়োজন বোধ করতেন না।" (পৃষ্ঠা ১৬৭)

"শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসের ভিতর মানুষ-ভাবটা মরে গিছল, কেবল ঈশ্বরত্ব অবশিষ্ট ছিল। বাস্তবিকই তিনি পাপ দেখতে পেতেন না—যে-চোখে মানুষ পাপ বা অন্যায় দেখে, তার চেয়ে তাঁর দৃষ্টি পবিত্রতর ছিল।" (পৃষ্ঠা ২৩৩)

মতামত: সর্বৈব মিথ্যা কথা। "রামকৃষ্ণদেব রোগ যখন খুব বাড়াবাড়ি, ডাক্তার কোটস নামে এক ইউরোপীয় ডাক্তারকে ঠাকুরের কাছে আনা হয়। তিনি পরীক্ষা করে চলে যাবার পর ঠাকুরের আদেশে বিছানায় গঙ্গাজল ছিটানো হয়।" (শ্রীরামকৃষ্ণ কিছু অজানা প্রসঙ্গ, সুনীত দে, পৃষ্ঠা ১০০)

এরকম উদাহরণ আরো আছে।

https://www.anandabazar.com/patrika/last-days-of-ramakrishna-1.1189900

১৪) "স্ত্রীজাতি শক্তিস্বরূপিণী, কিন্তু এখন ঐ শক্তি কেবল মন্দ বিষয়ে প্রযুক্ত হচ্ছে। তার কারণ, পুরুষ তার উপর অত্যাচার করছে।" (পৃষ্ঠা ১৭৩)

"যীশুখ্রীষ্ট অসম্পূর্ণ ছিলেন, কারণ তিনি যে আদর্শ প্রচার করেছিলেন, তদনুসারে সম্পূর্ণভাবে জীবনযাপন করেননি, আর সর্বোপরি তিনি নারীগণকে পুরুষের তুল্য মর্যাদা দেননি।" (পৃষ্ঠা ২২৬)

মতামত:  পুনঃপুন সেই এক দ্বিচারিতা। "নবযুগের মহাপুরুষ" গ্রন্থে বর্ণিত আছে -

"স্বামীজী আত্মানন্দ প্রমুখ সন্ন্যাসী শিষ্যদের একদিন বলেছিলেন, "ভক্তের বাড়ীতে গিয়ে স্ত্রীভক্তের হাতের রান্না খেও না। এইরূপ করলে শরীর নষ্ট ও মন নিম্নমুখী হয়।"" (পৃষ্ঠা ১৫৬)

যে সব মহিলারা এখনও ঘরে স্বামী বিবেকানন্দের ছবি টাঙিয়ে রেখে রোজ পুজো করে যাচ্ছেন, তাঁরা একবার ভেবে দেখুন! 

১৫) "রামকৃষ্ণ বর্তমান যুগের উপযোগী ধর্মশিক্ষা দিতে এসেছিলেন, তাঁর ধর্ম গঠনমূলক, এতে ধ্বংসমূলক কিছু নেই। তাঁকে নূতন করে প্রকৃতির কাছে গিয়ে সত্য জানবার চেষ্টা করতে হয়েছিল, ফলে তিনি বৈজ্ঞানিক ধর্ম লাভ করেছিলেন।" (পৃষ্ঠা ১৭৫)

মতামত: "শ্রীরামকৃষ্ণ কথামৃত" গ্রন্থ থেকে শ্রীরামকৃষ্ণদেব ও প্রখ্যাত সাহিত্যিক বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের মধ্যে কথোপকথনটা লক্ষ্য করুন -

"শ্রীরামকৃষ্ণ (বঙ্কিমের প্রতি) — কেউ কেউ মনে করে শাস্ত্র না পড়লে, বই না পড়লে ঈশ্বরকে পাওয়া যায় না। তারা মনে করে, আগে জগতের বিষয়, জীবের বিষয় জানতে হয়, আগে সায়েন্স পড়তে হয়। (সকলের হাস্য) তারা বলে ঈশ্বরের সৃষ্টি এ-সব না বুঝলে ঈশ্বরকে জানা যায় না। তুমি কি বল? আগে সায়েন্স না আগে ঈশ্বর?

বঙ্কিম — হাঁ, আগে পাঁচটা জানতে হয়, জগতের বিষয়। একটু এ দিককার জ্ঞান না হলে, ঈশ্বর জানব কেমন করে? আগে পড়াশুনা করে জানতে হয়।

শ্রীরামকৃষ্ণ — ওই তোমাদের এক। আগে ঈশ্বর, তারপর সৃষ্টি। তাঁকে লাভ করলে, দরকার হয়তো সবই জানতে পারবে।"

এই হলো শ্রীরামকৃষ্ণদেবের বৈজ্ঞানিক ধর্মের নমুনা।  

"নবযুগের মহাপুরুষ" গ্রন্থ থেকে আরেকটা উদাহরণ দেখে নেওয়া যাক -

"ঠাকুরের ঘনিষ্ঠ সংস্পর্শে আসিয়া বাবুরামের মন অন্তর্মুখী হইল। তিনি আর লেখাপড়ায় পূর্ববৎ মনোযোগ দিতে পারিলেন না। ১৮৮৩ বা ১৮৮৪ খৃষ্টাব্দে তিনি প্রবেশিকা পরীক্ষা দিলেন, কিন্তু উত্তীর্ণ হইতে পারিলেন না। এই সংবাদ পাইয়া ঠাকুর বলিলেন, 'ভালই হ'ল। তার বন্ধন ছিন্ন হ'ল। পাশ ত' নয়, পাশ (বন্ধন )।'" (পৃষ্ঠা ৬১)

এই হলো বর্তমান যুগের উপযোগী ধর্মের নমুনা।
 
https://www.ramakrishnavivekananda.info/kathamrita/unicodekathamrita/58_d_godorscience_1121_1123.html

১৬) "সর্বশক্তিমত্তা, সর্বব্যাপিতা ও অনন্ত দয়া—সেই জগজ্জননী ভগবতীর গুণ। জগতে যত শক্তি আছে, তিনিই তার সমষ্টিরূপিণী। জগতে যত শক্তির বিকাশ দেখা যায়, সবই সেই মা। তিনিই প্রাণরূপিণী, তিনিই বুদ্ধিরূপিণী, তিনিই প্রেমরূপিণী। তিনি সমগ্র জগতের ভিতর রয়েছেন, আবার জগৎ থেকে সম্পূর্ণ পৃথক্। তিনি একজন ব্যক্তি—তাঁকে জানা যেতে পারে এবং দেখা যেতে পারে (যেমন রামকৃষ্ণ তাঁকে জেনেছিলেন ও দেখেছিলেন)।" (পৃষ্ঠা ১৭৭) 

মতামত: পুনরায় দ্বিচারিতা। দ্বিতীয় খণ্ডে স্বামী বিবেকানন্দ নিজেই বলেছিলেন, "আমরা ঈশ্বরকে ইন্দ্রিয় দ্বারা অনুভব করিতে পারি না। কেহই চক্ষুর দ্বারা ঈশ্বর দর্শন করে নাই, কখনও করিবেও না।" (পৃষ্ঠা ৩০৩)

হয় শ্রীরামকৃষ্ণ ঠিক, স্বামী বিবেকানন্দ ভুল নয়তো স্বামী বিবেকানন্দ ঠিক , শ্রীরামকৃষ্ণ ভুল। 

১৭) "আমাদের অনুভূত এই জগৎ সত্য ও মিথ্যার মিশ্রণে উৎপন্ন। যেমন বল-সামান্তরিকে৩২ দুই বিভিন্নমুখী বলপ্রয়োগের ফলে একটি বস্তুতে কর্ণাভিমুখী গতির উৎপত্তি হয়, সেরূপ এই সংসারও আমাদের উপর প্রযুক্ত বিভিন্ন বিরুদ্ধ শক্তিসমূহের ফলস্বরূপ। এই জগৎ ব্রহ্মস্বরূপ ও সত্য; কিন্তু আমরা জগৎকে সেভাবে দেখছি না; যেমন শুক্তিতে রজত-ভ্রম হয়, তেমনি আমাদেরও ব্রহ্মে জগদ্‌ভ্রম হয়েছে। একেই বলে ‘অধ্যাস’। যে সত্তা একটা সত্য বস্তুর অস্তিত্বের উপর নির্ভর করে, তাকেই অধ্যস্ত সত্তা বলে।" (পৃষ্ঠা ১৮৩)

"বৃক্ষের বৃক্ষত্বটা মায়া—গাছ দেখবার সময় আমরা প্রকৃতপক্ষে ব্রহ্মস্বরূপকেই দেখছি, মায়া-আবরণে ঢাকা। কোন ঘটনা সম্বন্ধে ‘কেন’—এই প্রশ্ন জিজ্ঞাসাটাই মায়ার অন্তর্গত। সুতরাং ‘মায়া কিরূপে এল?’—এ প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করা বৃথা, কারণ মায়ার মধ্য থেকে ওর উত্তর কখনও দেওয়া যেতে পারে না; আর মায়ার পরে কে ঐ প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করবে? মন্দ বা মায়া অসদ্‌দৃষ্টিই ‘কেন’—এই প্রশ্নের সৃষ্টি করে, কিন্তু ‘কেন’ প্রশ্ন থেকে মায়া আসে না—মায়াই ঐ ‘কেন’ জিজ্ঞাসা করে। ভ্রমই ভ্রমকে নষ্ট করে দেয়। যুক্তি-বিচার নিজেই একটা বিরোধের উপর প্রতিষ্ঠিত, সুতরাং এটা একটা চক্রস্বরূপ, কাজেই যুক্তি নিজেই নিজেকে ধ্বংস করবে। ইন্দ্রিয়জ অনুভূতি একটা আনুমানিক জ্ঞান, আবার সব আনুমানিক জ্ঞানের ভিত্তি অনুভূতি।" (পৃষ্ঠা ২১৫)

"আত্মাই সকল বস্তুর মূল সত্যস্বরূপ; আমরা যা কিছু দেখছি, সবই আত্মা—কিন্তু আমরা যেভাবে এদের নামরূপাকারে দেখছি, সেভাবে নয়। ঐ নামরূপ আবরণের অন্তর্গত—মায়ার অন্তর্গত।" (পৃষ্ঠা ২২৪)

"এই সমগ্র জগৎটাই একটা ভ্রমমাত্র, এটা যেন তোমায় আর প্রতারিত করতে না পারে। জগৎটা যা নয়, তুমি তাকে তাই বলে জেনেছ, অবস্তুতে বস্তু জ্ঞান করেছ, এখন এটা বাস্তবিক যা, একে তাই বলে জান।" (পৃষ্ঠা ২৪১)

"ভাবিয়া দেখুন, জগতের কোন বস্তুকেই আমরা সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র বস্তুরূপে চিন্তা করিতে পারি না। সর্বত্রই আমরা বস্তুর সঙ্গে স্বীয় মনকে সংযুক্ত করিয়া লই। বস্তুতঃ প্রকৃত চেয়ার হইতেছে—চেয়ার ও মনের উপর চেয়ার-বস্তুটির প্রতিক্রিয়ার সংযোগ।" (পৃষ্ঠা ২৬৩)

মতামত: এইসব ভাববাদী যুক্তিগুলোকে খণ্ডন করতে গেলে আমাদের বস্তুবাদী দর্শনের সাহায্য নিতে হবে।

"ভাববাদের প্রত্যক্ষ বিপরীতটা-ই হচ্ছে বস্তুবাদ।

বস্তুর একটা চৈতন্য নিরপেক্ষ স্বতন্ত্র সত্তা আছে। এই যে সব ধারণা, - 'ব্রহ্ম সত্য', 'জগৎ মিথ্যা' বা 'জগৎ পরমাত্মার প্রকটিত রূপ মাত্র' অথবা 'পার্থিব যা কিছু তা কেবলমাত্র চৈতন্য কর্তৃকই অনুভূত উপলব্ধির সমষ্টি মাত্র', - মার্কসীয় বস্তুবাদ এগুলিকে ভাববাদী ধ্যানধারণা বলে অভিহিত করে ও তাকে বর্জন করে।

এই যে বিশ্বপ্রকৃতি তা ইন্দ্রিয়াতীত কোনও পরমাত্মার প্রকটিত রূপ নয়, নয় কোন মায়া। অপর পক্ষে তা রীতিমত ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য ও স্বভাবতই তার মর্ম একেবারেই বস্তুগত। জগৎ সংসারের যা কিছু তা কোনও পরম চৈতন্যের লীলা খেলা নয়। বরঞ্চ তা বস্তুর গতিশীলতার-ই বিচিত্র অভিব্যক্তি মাত্র।

বস্তুর সত্তা স্বতন্ত্র এবং তা চৈতন্য নিরপেক্ষ। কিন্তু বস্তুর সাথে চেতনার কোনও সম্পর্ক আছে কি? হ্যাঁ, আছে। বস্তু এবং চেতনার পারস্পরিক সম্পর্ক প্রসঙ্গে কার কি ধারণা সেই কষ্টি পাথর দিয়েই মার্কসীয় বস্তুবাদ বিচার করে থাকে, - কোন ধারণাটা বস্তুবাদী আর কোনটা ভাববাদী। যাঁরা মনে করে থাকেন, চেতনা নিরপেক্ষ বস্তুর স্বাধীন সত্তা আছে, চেতনা বস্তুরই প্রতিফলন মাত্র এবং বস্তু মুখ্য চেতনা গৌণ, তাঁরাই হলেন বস্তুবাদী। অপর পক্ষে যাঁরা মনে করেন চেতনা নিরপেক্ষ কোনও স্বাধীন সত্তা বস্তুর নাই, বস্তু চেতনার-ই নিছক একটা অনুভূতি মাত্র এবং চেতনা মুখ্য বস্তুই গৌণ, তাঁরা সকলেই হলেন কোন না কোন ধরণের ভাববাদী।

মনে করা যাক, চোখের সম্মুখে বাগানে একটা গোলাপ ফুল এবং তার রংটা লাল। ভাববাদীরা বলবেন, ওটাকে গোলাপ ফুল বলে মনে করা হচ্ছে ও তার রংটাকে লাল বলে অনুভূত হচ্ছে বলেই ওটা একটা লাল গোলাপ বলে প্রতীয়মান হচ্ছে। তাঁদের মতে ঐ লাল গোলাপের চেতনা নিরপেক্ষ কোন স্বতন্ত্র সত্তা নাই। বস্তুবাদীরা বলবেন, ওটা অন্য ফুল না হয়ে গোলাপ বলেই গোলাপ ফুল মনে হচ্ছে এবং সেটা লাল বলেই সকলের অনুভূতিতে তার রক্তিম সাড়া জাগিয়েছে। চেতনা নিরপেক্ষ ঐ লাল বলেই সকলের অনুভূতিতে তার রক্তিমা সাড়া জাগিয়েছে। চেতনা নিরপেক্ষ ঐ লাল গোলাপটির একটা স্বতন্ত্র অস্তিত্ব না থাকলে রাম, শ্যাম ও যদু - এই তিনটি সুস্থ মানুষই তাকে লাল গোলাপ বলে দেখতো না। কেউ তাকে নীল অপরাজিতা বা সাদা রজনীগন্ধা বলেও দেখতো। প্রকৃতপক্ষে বস্তুর প্রতিফলনেই অনুভূতির সঞ্চার।

মার্কসীয় বস্তুবাদের মতে, যে বস্তু চিন্তা করে তা থেকে চেতনাকে বিচ্ছিন্ন করা যায় না। কারণ বস্তুর স্বাধীন সত্তার প্রতিফলনে যেখানে চেতনার সঞ্চার ঘটে বা চিন্তার উদয় হয় সে মস্তিস্ক নিজেই মানব দেহের বস্তু সত্তা বিশিষ্ট অতীব সুসংগঠিত একটা অংশ। 

বস্তুর গতিশীলতার বিচিত্র অভিব্যক্তিতে সমৃদ্ধ এই যে বিশ্বপ্রকৃতি তা ইন্দ্রিয়গোচর এবং অবশ্যই স্বীকার্য যে, ইন্দ্রিয়ানুভূতির মাধ্যমেই তার প্রতিফলন মানব চেতনায় সঞ্চারিত হয়। কিন্তু, এই মানব ইন্দ্রিয়গুলি তো বস্তু সত্তাবিশিষ্ট এবং অবশ্যই বিশ্বাসযোগ্য। সুতরাং বস্তুজগৎ 'স্বয়ং সিদ্ধ সত্তায়' রহস্যাবৃত হয়ে মানুষের কাছে চির অজ্ঞেয় হয়ে থাকতে পারে না। কোনও একটা নির্দিষ্ট সময়ে বস্তুজগতের এই সত্তা বিষয়ে মানুষের জ্ঞান হয়তোঅসম্পূর্ণ বা সীমিত থাকতে পারে। কিন্তু ক্রমবর্ধিষ্ণু এই জ্ঞান ভাণ্ডারে আজ যা নাই, তা কালকের সংগ্রহের অপেক্ষায় আছে মাত্র। অতীতে এমন অনেক কিছু ছিল যার বস্তুসত্তা সেই সময়ে মানুষের কাছে দুর্জ্ঞেয় ছিল। কিন্তু কালক্রমে রসায়ন বিজ্ঞানের অগ্রগতির সাথে সাথে মানুষ তার গঠন প্রকৃতি শুধুমাত্র আবিষ্কার করেই ক্ষান্ত হয়নি, নিজ হাতে তাকে তৈরী করে তবে তৃপ্ত হয়েছে। সুতরাং বিশ্বপ্রকৃতির সত্তা অজ্ঞেয় বলে যে প্রচারিত ধারণা তাও এক রকমের ভাববাদ ছাড়া আর কিছু নয়। 

'অমৃতস্য পুত্রাঃ' বলেই অভিহিত করা হোক অথবা 'আশরাফুল মাখলুকাত' বলেই বর্ণনা করা হোক, এই যে মানুষ তা কোন 'পরমাত্মা'-র অংশ নয় অথবা কোনও অতি প্রাকৃত সর্বশক্তিমানের সৃষ্টি নয়। মানুষ বস্তুসত্তা সম্পন্ন এই বিশাল প্রকৃতিরই একটা অংশ মাত্র। 'সমগ্র'-র সাথে তার একটা 'অংশ'-র যে সম্পর্ক, প্রকৃতির সাথে মানুষের সম্পর্কটা সেইরকম। এই প্রকৃতির বিরুদ্ধে সংগ্রামের মধ্যে দিয়েই একটা নিছক জীব থেকে তার মানুষ হয়ে গড়ে ওঠা। বেঁচে থাকবার তাগিদে, বেড়ে উঠবার তাগিদে মানুষের সাথে অবশিষ্ট প্রকৃতির যে সংগ্রাম সেই সংগ্রামের প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়েই গড়ে উঠেছে মানুষের সমাজ। মানুষের কোন বিমূর্ত চৈতন্য তার অস্তিত্বকে নিয়ন্ত্রণ করছে না। বরঞ্চ মানুষের সামাজিক অস্তিত্ব-ই তার চেতনাকে করছে নিয়ন্ত্রিত। সেই সমাজে যখন কোন পরিবর্তনের তাগিদ দেখা দেয় তখন সেই তাগিদ মানুষকেও পরিবর্তনের সপক্ষে সক্রিয় করে তোলে।"

(আগ্রহী পাঠকেরা শ্রী অরুণ চৌধুরী মহাশয়ের লেখা "দর্শ ধর্ম নৈতিকতা" বইটা পড়ে দেখতে পারেন)।

১৮) "রামানুজ বলেন, বেদই সর্বাপেক্ষা পবিত্র পঠনীয় গ্রন্থ। ত্রৈবর্ণিক অর্থাৎ ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় ও বৈশ্য—এই তিন উচ্চ বর্ণের সন্তানদের যজ্ঞোপবীত-গ্রহণের পর অষ্টম, দশম বা একাদশ বর্ষ বয়সে বেদাধ্যয়ন আরম্ভ করা উচিত।" (পৃষ্ঠা ১৮৭)

মতামত: লক্ষণীয় যে, রামানুজের এই বক্তব্যকে স্বামী বিবেকানন্দ তাঁর বক্তব্যের মধ্যে তুলে ধরলেও, এই বক্তব্যের তিনি কোনোরূপ বিরোধিতা করেননি। প্রাচীন সমাজে শূদ্রদের বেদাধ্যয়নের কোনো অধিকার ছিল না। 

মনুসংহিতাতে লেখা আছে, "অস্পষ্টরূপে বেদ পাঠ করিবে না, শূদ্রের নিকট কখন বেদ পড়িবে না, রাত্রির শেষ প্রহরে উঠিয়া বেদপাঠে শ্রান্ত হইলে আর শয়ন করিবে না।" (৪/৯৯)
(মনুসংহিতা, সম্পাদনা ও অনুবাদ ডঃ মানবেন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় শাস্ত্রী, পৃষ্ঠা ৩৪৭)  

"যদি শূদ্র দর্প করিয়া দ্বিজাতিকে, তোমাদের এই ধর্ম্ম অনুষ্ঠেয়, এইরূপ ধর্ম্মোপদেশ দেয়, তবে রাজা উহার মুখে ও কর্ণে তপ্ত তৈল নিক্ষেপ করিবেন।" (৮/২৭২)
(মনুসংহিতা, সম্পাদনা ও অনুবাদ ডঃ মানবেন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় শাস্ত্রী, পৃষ্ঠা ৭০৫)  

স্বামীজী "ধর্মে জাতিভেদ নাই; জাতিভেদ কেবল সামাজিক ব্যবস্থা" বলে বর্বর জাতিভেদ প্রথাকে যতই তিনি আড়াল করতে চেষ্টা করুন না কেন, বাস্তবে তিনি ছিলেন জাতিভেদ প্রথার উগ্র সমর্থক। (প্রথম খণ্ড, পৃষ্ঠা ২৫) 

১৯) "কর্ম কর, কিন্তু কর্মফল ভগবানে অর্পণ কর।" (পৃষ্ঠা ১৮৮)

মতামত: শ্লোকটা গীতা থেকে নেওয়া। বাস্তবে এই সকল প্রতিষ্ঠানিক ধর্মসমূহের ঠিকাদারেরা সর্বদাই শাসকের তাঁবেদারি করে। এই উক্তিটিকে মুক্তমনে পড়লে বোঝা যায় যে এইরূপ শ্লোকের দ্বারা উচ্চবর্ণের স্বার্থে নিম্নশ্রেণীকে বেগার খাটার জন্য আহ্বান করা হচ্ছে। 

স্বামী বিবেকানন্দও ছিলেন সামন্তবাদ সমাজের সমর্থক, তাই তিনি বারংবার আত্মা, পূর্বজন্মের কর্মফল, জন্মান্তরবাদ নামক তত্ত্বগুলোকে সামনে রেখে সংখ্যাগরিষ্ঠ শূদ্র, নিপীড়িতদের ক্ষোভে জল ঢালার কাজ করে গেছেন; যেন তাঁরা কোনোভাবেই শাসকের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা না করে।

২০) "বেদের প্রমাণ এই যে, তা ব্রহ্ম হতে প্রসূত হয়েছে, আবার ব্রহ্মের প্রমাণ এই যে, বেদের মত অদ্ভুত গ্রন্থ ব্রহ্ম ব্যতীত আর কারও প্রকাশ করবার সাধ্য নেই।" (পৃষ্ঠা ১৯০)

মতামত: যুক্তিবাদের ভাষায় শঙ্কর বা স্বামীজীর এই বক্তব্য চক্রাকার কুযুক্তি বা ফ্যালাসি (Circular logic Fallacy)।

https://www.shongshoy.com/%e0%a6%95%e0%a7%81%e0%a6%af%e0%a7%81%e0%a6%95%e0%a7%8d%e0%a6%a4%e0%a6%bf-%e0%a6%ac%e0%a6%be-%e0%a6%ab%e0%a7%8d%e0%a6%af%e0%a6%be%e0%a6%b2%e0%a6%be%e0%a6%b8%e0%a6%bf/

২১) "ক্রিয়া হতে থাক, কিন্তু তার প্রতিক্রিয়া যেন না আসে; ক্রিয়া থেকে সুখই হয়ে থাকে, সমুদয় দুঃখ হচ্ছে প্রতিক্রিয়ার ফল। শিশু আগুনে হাত দেয়—তার সুখ হয় বলেই; কিন্তু যখনই তার শরীর প্রতিক্রিয়া করে, তখনই পুড়ে যাওয়ার কষ্টবোধ হয়ে থাকে। ঐ প্রতিক্রিয়াটা বন্ধ করতে পারলে আমাদের আর ভয়ের কারণ কিছু নেই। মস্তিষ্ককে নিজের বশে নিয়ে এস, যেন সে প্রতিক্রিয়াটার খবর না রাখতে পারে।" (পৃষ্ঠা ১৯৮)

মতামত: কাঁঠালের আমসত্ত্ব।

২২) "যারা উত্তম অধিকারী, তারা যোগে খুব শীঘ্র শীঘ্র উন্নতি করতে পারে—ছ-মাসে তারা যোগী হতে পারে। যারা তদপেক্ষা নিম্নাধিকারী, তাদের যোগে সিদ্ধিলাভ করতে কয়েক বৎসর লাগতে পারে, আর যে-কোন ব্যক্তি নিষ্ঠার সঙ্গে সাধন করলে, অন্য সব কাজ ছেড়ে দিয়ে কেবল সদা সর্বদা সাধনে রত থাকলে দ্বাদশ বর্ষে সিদ্ধিলাভ করতে পারে। এই-সব মানসিক ব্যায়াম না করে কেবল ভক্তি দ্বারাও ঐ অবস্থায় যেতে পারা যায়, কিন্তু তাতে কিছু বিলম্ব হয়।" (পৃষ্ঠা ২১১)

মতামত: এ কী! এতো পুরো যোগ শাস্ত্রের ওয়ারেন্টি কার্ড (warranty card)।

২৩) "আমরা যে অপরের সেবা করতে পারছি, এ আমাদের একটা বিশেষ সৌভাগ্য—কারণ ঐরূপ অনুষ্ঠানের দ্বারাই আমাদের আত্মোন্নতি হবে। লোকে যে কষ্ট পাচ্ছে, তার কারণ তার উপকার করে আমাদের কল্যাণ হবে।" (পৃষ্ঠা ২১৭)

মতামত: স্বামীজীর বারংবার বাসনামুক্ত হওয়ার কথা বলেছেন কিন্তু নিজেদের আত্মোন্নতি বা কল্যাণের কামনা করাটাও কী বাসনা নয়? 

ভবিষ্যতে বিজ্ঞান যদি বন্যার স্থায়ী সমাধান করতে পারে, তাহলে মিশনের বাবাজীরা কাকে খিচুড়ি খাওয়াবেন? 

মানুষের সমস্যা সমাধান করার জন্য বিজ্ঞান চেষ্টা চালিয়ে যাবে কিন্তু রামকৃষ্ণ মিশনের মতো আধ্যাত্মিক সংগঠনগুলো চাইবে যে বন্যা হতে থাকুক, যাতে বাবাজীরা খিচুড়ি বিলিয়ে নিজেদের কল্যাণ করতে পারেন। 

২৪) "কজন অন্ধ বলে, ‘প্রত্যেক জিনিষের ভিন্ন ভিন্ন রকমের প্রতিধ্বনি আছে, সুতরাং আমি হাততালি দিয়ে বিভিন্ন জিনিষের প্রতিধ্বনি দ্বারা আমার চতুর্দিকে কোথায় কি আছে, ঠিক ঠিক বলতে পারি।’" (পৃষ্ঠা ২১৯)

মতামত: বাস্তবে এরকম হলে অন্ধ ব্যক্তিদের White Canes ব্যবহারের প্রয়োজন হতো না। এখন অন্ধদের জন্য বিশেষভাবে প্রস্তুত এই লাঠিটি সামনের, ডানদিকের, বামদিকের বাধাগুলিকে সনাক্ত এবং এড়ানোর জন্য অন্ধব্যক্তিকে সাহায্য  করতে পারে। আধুনিক বিজ্ঞানের সাহায্যে White Canes-কে দিনে দিনে আরো উন্নত করার জন্য পরীক্ষা নিরীক্ষা চলছে। 

https://www.healthline.com/health/white-cane
https://www.ncbi.nlm.nih.gov/pmc/articles/PMC6339061/

২৫) "মানুষ নিজের মস্তিষ্ক থেকে ভগবানকে সৃষ্টি করে না; তবে তার যতদূর শক্তি, সে সেইভাবে তাঁকে দেখতে পারে, আর তার যত ভাল ভাল ধারণা তাঁতে আরোপ করে।" (পৃষ্ঠা ২৩১)

মতামত: আবার একটা দ্বিচারিতা। তৃতীয় খণ্ডে স্বামীজী নিজেই বলেছেন, "‘ঈশ্বর মানুষকে নিজ প্রতিবিম্বরূপে সৃষ্টি করিলেন’—এ কথা ভুল। মানুষ নিজ প্রতিবিম্ব অনুযায়ী ঈশ্বরকে সৃষ্টি করে—এই কথাই সত্য। সমগ্র জগতে আমরা আমাদের প্রতিবিম্ব অনুযায়ী ঈশ্বর বা দেবতা সৃষ্টি করিতেছি।" (পৃষ্ঠা ৫৩)

দুটি বক্তব্য সম্পূর্ণ পরস্পর বিরোধী। 

২৬) "যদি অদ্বৈতবাদী হও, তবে তুমি তো স্বয়ংই ব্রহ্মস্বরূপ—তোমার আবার কর্তব্য কি? তোমার স্বামী, ছেলেপুলে, বন্ধুবান্ধব—কারও প্রতি কিছু কর্তব্য নেই। যা হচ্ছে হয়ে যাক্, চুপচাপ করে পড়ে থাক।" (পৃষ্ঠা ২৪১)

মতামত: নিজের ইচ্ছেয় একটি শিশুকে পৃথিবীতে এনে তাঁর প্রতি কর্তব্য না করার বিধান কতটা ন্যায় সঙ্গত তার বিচার পাঠকদের হাতেই ছেড়ে দিলাম।

এমনকি শ্রীরামকৃষ্ণের শিষ্য ও স্বামী বিবেকানন্দের গুরুভ্রাতা, স্বামী ব্রহ্মানন্দ তাঁর স্ত্রী বিশ্বেশ্বরী দেবী ও তাঁর পুত্রসন্তানকে ত্যাগ করে সন্ন্যাসী হন, নিজ স্বামীকে হারিয়ে বিশ্বেশ্বরী দেবী আত্মহত্যার পথ গ্রহণ করতে বাধ্য হন। (ব্রহ্মানন্দ-লীলাকথা, পৃষ্ঠা ১৬, ১৭)

২৭) "নারীজাতি শত শত যুগ ধরে দুঃখকষ্ট সহ্য করেছে, তাই তাদের ভিতর অসীম ধৈর্য ও অধ্যবসায়ের বিকাশ হয়েছে। তারা একটা ভাব আঁকড়ে ধরে থাকে, সহজে ছাড়তে চায় না। এই জন্যই সকল দেশে তারা এমন-কি কুসংস্কারপূর্ণ ধর্মসমূ্হের এবং পুরোহিতদের পৃষ্ঠপোষক-স্বরূপ হয়ে থাকে, আর এইটেই পরে তাদের স্বাধীনতার কারণ হবে।" (পৃষ্ঠা ২৪৩)

"পুরুষেরা ধর্মের দার্শনিক বিচারে সমর্থ। নারী স্বভাবতঃ ভক্তিপ্রবণ; সে ভগবানকে ভালবাসে হৃদয়ের অন্তস্তল থেকে, বুদ্ধি দিয়ে নয়।" (পৃষ্ঠা ৩২২)

মতামত: নারীদের সম্বন্ধে স্বামীজীর মনুবাদী ধারণাসমূহ, কারণ ওঁর দৃষ্টিতে নারী পুরুষের কখনও সমান নয় আর এই কারণেই উনি মনুবাদী।

মনুসংহিতাতে লেখা আছে, "শয়ন, উপবেশন, ভূষণ, কাম, ক্রোধ, কৌটিল্য, পরহিংসা, ঘৃণিত ব্যবহার, এই সকল স্ত্রীলোকের স্বভাবগত, ইহা সৃষ্টিসময়ে মনু স্বয়ং কল্পনা করিয়াছেন।" (৯/১৭)

"যেহেতু স্ত্রীলোকদিগের মন্ত্র দ্বারা জাতকর্ম্মাদি সংস্কার হয় না, এজন্য উহাদিগের নির্ম্মল অন্তঃকরণ হয় না, এবং বেদস্মৃতিতে অধিকার নাই, এজন্য উহারা ধর্মজ্ঞ হইতে পারে না, এবং ইহাদিগের কোন মন্ত্রে অধিকার নাই, এজন্য পাপ হইলে মন্ত্র দ্বারা তাহা ক্ষালন করিতে পারে না; অতএব ইহারা কেবল মিথ্যা পদার্থ।" (৯/১৮)   
(মনুসংহিতা, ডঃ মানবেন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় শাস্ত্রী, পৃষ্ঠা ৭৬০)

"লোভহীন এক ব্যক্তিও সাক্ষী হইবে, অনেক স্ত্রীলোক শুচি হইলেও অস্থিরবুদ্ধি প্রযুক্ত সাক্ষী হইতে পারিবে না, এবং চৌর্য্যাদি দোষাক্রান্ত ব্যক্তি স্ত্রী বা পুরুষ হউক, সাক্ষী হইতে পারে না।" (৮/৭৭)
(মনুসংহিতা, ডঃ মানবেন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় শাস্ত্রী, পৃষ্ঠা ৬২৬)

২৮) "জগতের ইতিহাস হইল—পবিত্র, গম্ভীর, চরিত্রবান্‌ এবং শ্রদ্ধাসম্পন্ন কয়েকটি মানুষের ইতিহাস।" (পৃষ্ঠা ২৬৮)

মতামত: আজ্ঞে না, আজও পর্যন্ত আবিষ্কৃত সমস্ত সমাজের ইতিহাস হল শ্রেণীসংগ্রামের ইতিহাস।

বস্তুবাদী ব্যাখ্যায় আজ পর্যন্ত সমাজ বিকাশের পাঁচটি স্তর দেখা যায় - (১) আদিম সাম্যবাদী সমাজ (২) দাস সমাজ (৩) সামন্ততান্ত্রিক সমাজ (৪) ধনতান্ত্রিক বা পুঁজিবাদী সমাজ (৫) সমাজতান্ত্রিক সমাজ। শ্রেণী সংগ্রামের মধ্য দিয়েই মানুষ একটি স্তর থেকে পরবর্তী স্তরে পদার্পন করতে পারে।

২৯) "একদিন সন্ধ্যার সময় আমি একটি যুবককে একটি তরুণীর জন্য অপেক্ষা করিতে দেখিয়াছিলাম। ... মনে করিলাম, যুবককে পরীক্ষা করিবার ইহা একটি উপযুক্ত অবসর। সে তাহার প্রেমের গভীরতার মধ্য দিয়া অতীন্দ্রিয় দর্শন ও দূর-শ্রবণের ক্ষমতা লাভ করে। ষাট কি সত্তর বার যুবকটি একবারও ভুল করে নাই, এবং তরুণী ছিল দুইশত মাইল দূরে। (সে বলিত) ‘এইভাবে তরুণী সাজগোজ করিয়াছে।’ (কিংবা) ‘ঐ সে চলিয়া যাইতেছে।’ আমি ইহা নিজের চোখে দেখিয়াছি।" (পৃষ্ঠা ২৮৭)

"গুরু আপনার নিকট মানবরূপে আসিতে পারেন এবং আপনি তাঁহার নিকট শক্তিলাভও করিতে পারেন। কখনও কখনও তিনি স্বপ্নে দেখা দিয়া শক্তি সঞ্চার করেন। গুরুর শক্তি আমাদের নিকট নানাভাবে আসিতে পারে।" (পৃষ্ঠা ৩১২)

মতামত: এইসব অসার বক্তব্যগুলোকে গল্পের গোরুকে গাছে চড়ানো ছাড়া আর কিছু বলতে পারি না।

৩০) "আমার গুরুদেব শ্রীরামকৃষ্ণ অসুস্থ হইয়া পড়িলে জনৈক ব্রাহ্মণ রোগমুক্তির জন্য তাঁহাকে তাঁহার প্রবল মনঃশক্তি প্রয়োগ করিতে বলিয়াছিল। তাহার মতে—আচার্যদেব যদি দেহের রোগাক্রান্ত অংশটির উপর তাঁহার মন একাগ্র করেন,—তবে অসুখ সারিয়া যাইবে। শ্রীরামকৃষ্ণ বলিলেন, ‘কি! যে-মন ঈশ্বরকে দিয়াছি, সেই মন এই তুচ্ছ শরীরে নামাইয়া আনিব?’ দেহ এবং রোগের কথা তিনি ভাবিতে চাহিলেন না। তাঁহার মন সর্বদা ঈশ্বরে তন্ময় হইয়া থাকিত। সে-মন সম্পূর্ণরূপে ঈশ্বরে অর্পিত হইয়াছিল। তিনি এই মন অন্য কোন উদ্দেশ্যে ব্যবহার করিতে রাজী ছিলেন না।" (পৃষ্ঠা ৩১০)

মতামত: মুখে যতই বিজ্ঞানের সব কিছু ধর্মগ্রন্থে আছে বলে দাবী করুন না কেন, বাস্তবে বাবাজীদের শরীর খারাপ হলে সেই চিকিৎসা বিজ্ঞানেরই সাহায্য নিয়ে থাকেন। শ্রীরামকৃষ্ণের শরীর খারাপের সময় বহু ডাক্তারকে দেখানো হয়েছিল; তার মধ্যে অন্যতম কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিতীয় এমডি ডাঃ মহেন্দ্রলাল সরকার। এছাড়াও সময়ে সময়ে হোমিয়োপ্যাথিক ডাক্তার রাজেন্দ্রলাল দত্ত, কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের অধ্যক্ষ ডাক্তার জে এম কোটস শ্রীরামকৃষ্ণের চিকিৎসা করেছেন। 

৩১) "আমরা সারা জীবন পুস্তক পাঠ করিতে পারি, খুব একজন বুদ্ধিমান্ হইয়া উঠিতে পারি, কিন্তু শেষে দেখিব—আধ্যাত্মিক উন্নতি কিছুই হয় নাই। বুদ্ধিবৃত্তির উন্নতি হইলেই যে সঙ্গে সঙ্গে আধ্যাত্মিক উন্নতিও খুব হইবে, তাহার কোন অর্থ নাই। গ্রন্থপাঠ করিতে করিতে অনেক সময় ভ্রমবশতঃ ভাবি, আমাদের আধ্যাত্মিক উপকার হইতেছে। কিন্তু গ্রন্থপাঠে আমাদের কি ফল হইয়াছে, তাহা যদি ধীরভাবে বিশ্লেষণ করি, তবে দেখিব বড়জোর আমাদের বুদ্ধিবৃত্তির উন্নতি হইয়াছে, অন্তরাত্মার কিছুই হয় নাই। আমাদের মধ্যে প্রায় সকলেরই আধ্যাত্মিক বাক্যবিন্যাসে অদ্ভুত নৈপুণ্য থাকিলেও কার্যকালে—প্রকৃত ধর্মভাবে জীবন-যাপন করিবার সময়—কেন এত ভয়াবহ ত্রুটিবিচ্যুতি লক্ষিত হয়, তাহার কারণ—আধ্যাত্মিক জীবনের উন্নতির পক্ষে গ্রন্থরাশি পর্যাপ্ত নয়। জীবাত্মার শক্তি জাগ্রত করিতে হইলে অপর এক আত্মা হইতে শক্তি সঞ্চারিত হওয়া আবশ্যক।" (পৃষ্ঠা ১৭)

"বাজে পুস্তক না পড়িয়া ঈশ্বর-বিষয়ক সদ্গ্রন্থ পড়িতে হইবে।" (পৃষ্ঠা ৭৪)

"আপনারা জগতের সব গ্রন্থ পড়িতে পারেন, কিন্তু বক্তৃতাশক্তি, উচ্চতম মেধা বা নানাবিধ বিজ্ঞান অধ্যয়নের দ্বারা এই প্রেম লাভ করা যায় না। তিনি যাহাকে ইচ্ছা করেন, সেই তাঁহাকে লাভ করে। তাহার নিকটই ভগবান্ আত্মপ্রকাশ করেন।" (পৃষ্ঠা ৮৫)

"এই-সব বই, এই-সব বিজ্ঞান—আমাদিগকে কিছুই শিখাইতে পারিবে না। বই পড়িয়া আমরা তোতাপাখি হই, বই পড়িয়া কেহ পণ্ডিত হয় না। যে ব্যক্তি প্রেমের একটি অক্ষর পাঠ করিয়াছে, সে-ই প্রকৃত পণ্ডিত।" (পৃষ্ঠা ৮৫)

"বাহির হইতে যে-শক্তি আসার কথা বলা হইল, উহা গ্রন্থ হইতে পাওয়া যায় না। এক আত্মা অপর আত্মা হইতেই শক্তি লাভ করিতে পারে, অন্য কিছু হইতে নয়। আমরা সারা জীবন বই পড়িতে পারি, খুব বুদ্ধিমান্ হইয়া উঠিতে পারি, কিন্তু পরিণামে দেখিব—আমাদের আধ্যাত্মিক উন্নতি কিছুমাত্র হয় নাই। বুদ্ধি খুব উন্নত ও বিকশিত হইলেও যে সঙ্গে সঙ্গে তদনুযায়ী আধ্যাত্মিক উন্নতিও হইবে, তাহার কোন যুক্তি নাই; বরং আমরা প্রায় প্রত্যহই দেখিতে পাই, বুদ্ধির যতটা উন্নতি হইয়াছে, আত্মার সেই পরিমাণে অবনতি ঘটিয়াছে।

বুদ্ধিবৃত্তির বিকাশে গ্রন্থ হইতে অনেক সাহায্য পাওয়া যায় বটে, কিন্তু আধ্যাত্মিক উন্নতি লাভ করিতে গেলে গ্রন্থ হইতে কোন সাহায্যই পাওয়া যায় না বলিলেই হয়। গ্রন্থ পাঠ করিতে করিতে কখনও কখনও ভ্রমবশতঃ আমরা মনে করি, উহা হইতে আধ্যাত্মিক সহায়তা পাইতেছি, কিন্তু যদি অন্তর বিশ্লেষণ করিয়া দেখি, তবে বুঝিব—উহাতে আমাদের বুদ্ধিই কিছুটা সাহায্য পাইয়াছে মাত্র, আত্মার কিছুই হয় নাই। এই জন্যই আমরা প্রায় সকলেই ধর্মসম্বন্ধে সুন্দর সুন্দর বক্তৃতা দিতে পারি, অথচ ধর্মানুযায়ী জীবন-যাপনের সময় অনুভব করি—আমাদের শোচনীয় অক্ষমতা। ইহার কারণ—আধ্যাত্মিক উদ্দীপনার জন্য বাহির হইতে যে শক্তির প্রয়োজন, পুস্তক হইতে তাহা পাওয়া যায় না। আত্মাকে জাগ্রত করিতে হইলে অপর এক আত্মা হইতেই শক্তি সঞ্চারিত হওয়া একান্ত আবশ্যক।" (পৃষ্ঠা ৮৭)

"হৃৎপদ্ম একবার প্রস্ফুটিত হইলে নদী-প্রস্তর চন্দ্র-তারকা প্রভৃতি হইতে শিক্ষা গ্রহণ করা যাইতে পারে—ইহাদের সকলের নিকট হইতেই কিছু না কিছু আধ্যাত্মিক শিক্ষা পাওয়া যাইতে পারে। কিন্তু যাহার হৃৎপদ্ম এখনও প্রস্ফুটিত হয় নাই, সে শুধু নদী ও প্রস্তরই দেখিবে।" (পৃষ্ঠা ৯২)

"জ্ঞান অপেক্ষা উচ্চতর ও পবিত্রতর আর কিছু নাই; গুরুর মাধ্যমে উহা মানবাত্মায় আবির্ভূত হইয়া থাকে। সিদ্ধ যোগী হইলে ঐ জ্ঞান আপনা-আপনি আসিয়া থাকে, গ্রন্থ হইতে উহা লাভ করা যায় না!" (পৃষ্ঠা ৯৩)

"বই পড়িলেই ধর্ম হয় না, তর্কবিচার করিতে পারিলেই ধর্ম হয় না, অথবা কতকগুলি মতবাদে সম্মতি প্রকাশ করিলেই ধর্ম হয় না।" (পৃষ্ঠা ৯৮)

"আপনারা সকলেই সম্ভবতঃ বিজ্ঞানবাদ (Idealism) সম্বন্ধে অনেক গ্রন্থ পড়িয়াছেন। এই মতবাদ অনুসারে এই জগতের অস্তিত্ব নাই, আপনাদেরও অস্তিত্ব নাই। এরূপ কথা যাহারা বলে, আপনারা তাহাদের কথা বিশ্বাস করেন না, কারণ তাহারা নিজেরাই নিজেদের কথা বিশ্বাস করে না। তাহারা জানে যে, ইন্দ্রিয়গণের সাক্ষ্য এইরূপ সহস্র সহস্র বৃথা বাগাড়ম্বর অপেক্ষা বলবান্। ধার্মিক হইতে গেলে আপনাদিগকে প্রথমেই গ্রন্থ ফেলিয়া দিতে হইবে। বই যত কম পড়েন, ততই ভাল।" (পৃষ্ঠা ৯৯)

"বয়সে বড় হইতে পারি এবং জগতের সব বই পড়িয়া ফেলিতে পারি, কিন্তু ধর্মরাজ্যে আমরা শিশুমাত্র।" (পৃষ্ঠা ১০১)

"আমার মতে গ্রন্থ দ্বারা জগতে ভাল অপেক্ষা মন্দ অধিক হইয়াছে। এই যে নানা ক্ষতিকর মতবাদ দেখা যায়, সেগুলির জন্য এই-সকল গ্রন্থই দায়ী। মতামতগুলি সব গ্রন্থ হইতেই আসিয়াছে, আর গ্রন্থগুলিই জগতে যত প্রকার অত্যাচার ও গোঁড়ামির জন্য দায়ী। বর্তমানকালে গ্রন্থসমূহই সর্বত্র মিথ্যাবাদী সৃষ্টি করিতেছে। সকল দেশেই মিথ্যাবাদীর সংখ্যা বাড়িতেছে দেখিয়া আমি আশ্চর্য হই।" (পৃষ্ঠা ১০৯)

"প্রাচীন হিন্দুরা অদ্ভুত পণ্ডিত ছিলেন—যেন জীবন্ত বিশ্বকোষ। তাঁরা বলতেন, বিদ্যা যদি পুঁথিগত হয়, আর ধন যদি পরের হাতে থাকে, কার্যকাল উপস্থিত হলে সে-বিদ্যা বিদ্যা নয়, সে-ধনও ধন নয়।" (পৃষ্ঠা ১৮৯)

"শাস্ত্র বা বই পড়ে দার্শনিক জ্ঞান বা তত্ত্বজ্ঞান হয় না; বরং যত বই পড়বে, ততই মন গুলিয়ে যাবে।" (পৃষ্ঠা ১৯৭)

"নিজের ঘরে গিয়ে বস, আর নিজের অন্তরাত্মার ভিতর থেকে উপনিষদের তত্ত্বগুলি আবিষ্কার কর। তুমি সকল বিষয়ের অনন্তখনিস্বরূপ, ভূত-ভবিষ্যৎ সকল গ্রন্থের মধ্যে তুমিই শ্রেষ্ঠ গ্রন্থ।" (পৃষ্ঠা ২২০)

"গ্রন্থাদিও ধাত্রীর কাজই করিয়া থাকে, কিন্তু আমাদের চেষ্টা করিয়া সেই অবস্থায় উপনীত হইতে হইবে, যেখানে মানুষ উপলব্ধি করিবে, সে তাহার শরীরের প্রভু।" (পৃষ্ঠা ২৬৪)

"এ-সকল রহস্যপূর্ণ পবিত্র শব্দরাশি আমরা জানি এবং বুঝিতে পারি, কিন্তু কেবল গ্রন্থাদিতে পড়িলেই ঐগুলি আমাদের উপর কোন প্রভাব বিস্তার করিতে পারিবে না। শব্দগুলি ভাবপূর্ণ হইলে এবং সাধনা করিয়া যিনি স্বয়ং ভগবানের স্পর্শ লাভ করিয়াছেন এবং এখনও ভাগবত জীবন যাপন করেন, এরূপ ব্যক্তির স্পর্শ থাকিলে ঐগুলি ফলপ্রদ হয়।" (পৃষ্ঠা ২৬৫)

"মনে রাখিও—পাণ্ডিত্যের কোন মূল্য নাই। পাণ্ডিত্য সম্বন্ধে তোমাদের সকলেরই ধারণা ভুল। মনকে বলিষ্ঠ ও সুনিয়ন্ত্রিত করার মধ্যেই জ্ঞানের একমাত্র মূল্য। আমি অবাক্ হইতেছি যে অনন্ত কাল ধরিয়া এই গলাধঃকরণের দ্বারা আমাদের বদহজম হইতেছে না কেন? আমাদের এইখানেই থাকিয়া যাবতীয় পুস্তক পুড়াইয়া ফেলা প্রয়োজন এবং নিজেদের অন্তরে চিন্তা করা কর্তব্য।" (পৃষ্ঠা ২৭৩)

"জগতে অনেক লোক-শিক্ষক আছেন, কিন্তু দেখিতে পাইবে—(তাঁহাদের অধিকাংশই) একদেশী। কাহারও দৃষ্টি বুদ্ধিবৃত্তির প্রখর মধ্যাহ্নসূর্যের উপর, অন্য কিছুই তাঁহার চোখে পড়ে না। অপর কেহ বা শুনেন প্রেমের সুমধুর গীতি এবং ইহা ছাড়া আর কিছুতে কান দিতে পারেন না। আবার আর একজন আছেন কাজে (ডুবিয়া), তাঁহার অনুভূতি বা চিন্তার সময় নাই। এরূপ একজন মহামানব কেন (চাও) না—যিনি যেমন কর্মী, তেমনি জ্ঞানী, আবার সমানভাবে প্রেমিক? ইহা কি সম্ভব?—নিশ্চয়ই নয়।" (পৃষ্ঠা ২৭৮)

"(কেবলমাত্র) গ্রন্থ-অধ্যয়নে (লোকে) শুষ্ক হইয়া যায়। কে বিদ্বান্‌?—যে অন্ততঃ একবিন্দু প্রেমও অনুভব করিতে পারে।" (পৃষ্ঠা ২৮৮)

"শুধু বুদ্ধির দ্বারা জানা যায় না। ... হাজার হাজার বই পড়িয়াও তুমি জানিতে সমর্থ হইবে না ... যখন আমরা ইহা বুঝিতে আরম্ভ করি, সমুদয় জগৎ-রহস্য যেন আমাদের সম্মুখে খুলিয়া যায়। ... একটি ছোট মেয়ে তাহার পুতুল লইয়া খেলিতেছে—সব সময় সে নূতন নূতন স্বামী পাইতেছে, কিন্তু যখন তাহার সত্যকারের স্বামী আসে, তখন (চিরদিনের জন্য) সে তাহার পুতুল-স্বামীগুলি দূরে ফেলিয়া দেয়। ... জগতের সবকিছু সম্বন্ধে ঐ একই কথা।" (পৃষ্ঠা ২৯১)

"আমরা বক্তৃতা শুনি, পুস্তক পড়ি, ঈশ্বর আত্মা ধর্ম ও মুক্তি সম্বন্ধে তর্কবিতর্ক করি। এগুলি আধ্যাত্মিকতা নয়, কারণ আধ্যাত্মিকতা পুস্তকে দর্শনে বা মতবাদে নাই। ইহা বিদ্যা বা বিচারে নাই, অন্তরের প্রকৃত বিকাশে নিহিত। তোতাপাখিও বুলি মনে রাখিয়া আওড়াতেই পারে। যদি আপনি বিদ্বান্ হইয়া থাকেন, তাহাতে কি আসে যায়? গর্দভেরা সমগ্র গ্রন্থাগারটি পৃষ্ঠে বহন করিয়া লইয়া যাইতে পারে। সুতরাং যখন যথার্থ আলোক আসিবে, তখন পুঁথিগত বিদ্যার আর প্রয়োজন হইবে না। নিজের নামটি পর্যন্ত সই করতে অক্ষম ব্যক্তিও ধার্মিক হইতে পারেন, আবার পৃথিবীর যাবতীয় গ্রন্থাগারের জ্ঞানরাশি যাঁহার মস্তকে পুঞ্জীভূত আছে, তিনিও পারেন না। আধ্যাত্মিক উন্নতি পুঁথিগত বিদ্যার অপেক্ষা রাখে না। পাণ্ডিত্যের উপর আধ্যাত্মিকতা নির্ভর করে না। গুরুর স্পর্শ—শক্তি-সঞ্চার দ্বারা আপনার হৃদয় জাগ্রত হইবে।" (পৃষ্ঠা ৩১২)

মতামত: স্বামী বিবেকানন্দ তাঁর বহু বক্তব্যে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার সরাসরি বিরোধিতা করছেন কারণ, বিজ্ঞান নির্ভর, কুসংস্কার-মুক্ত শিক্ষাই আমাদের ধর্মের বেড়াজাল ভেঙে বের করে আনতে পারে; বিচার বুদ্ধি যুক্তিবোধ তৈরী করে, প্রশ্ন করতে শেখায়, যেটা কখনই তাঁর কাম্য ছিল না। বক্তব্যগুলো মুক্ত মনে পড়লেই বোঝা যায় যে, তিনি তাঁর ভক্তদের বিজ্ঞান নির্ভর শিক্ষা থেকে সরিয়ে বেদান্তভিত্তিক অনন্ত সর্বজ্ঞ আত্মাকে খুঁজে বেড়ানোর কাজে প্রভাবিত করতে চান; যাতে তাঁর সামন্ততান্ত্রিক প্রভুদের শোষণের ক্ষেত্রকে সুরক্ষিত করে রাখা যায়।

একটা প্রশ্ন থেকেই যায় - স্বামীজীর কথা অনুযায়ী বইপত্র পড়ে যখন কিছুই হয় না, তারপরেও রামকৃষ্ণ মিশন তার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে চালিয়ে যাচ্ছে কেন? আর্থিক লাভের জন্য নয় নিশ্চয়ই!

Saturday, 9 March 2024

স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা - তৃতীয় খণ্ড (সমালোচনামূলক লেখা)

১) "আধুনিক বিজ্ঞানের সমুদয় আধুনিকতম আবিষ্ক্রিয়ার সহিত উহাদের সামঞ্জস্য রহিয়াছে; আর যদি কোথাও কিছু অপূর্ণতা থাকে, তাহা আধুনিক বিজ্ঞানের দিকেই।" (পৃষ্ঠা ৮)

মতামত: "প্রায় ১৮ বৎসর পূর্বেকার কথা, আমি তখন প্রথম বিলাত হইতে ফিরিয়াছি। বৈজ্ঞানিক জগতে তখন আমার সামান্য কিছু সুনাম হইছে। ঢাকা শহরনিবাসী (অর্থাৎ আমার স্বদেশবাসী) কোনও লব্ধ প্রতিষ্ঠ উকিল আমি কি বৈজ্ঞানিক কাজ করিয়াছি জানিবার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। আমি প্রথম জীবনের উৎসাহভরে তাহাকে আমার তদানীন্তন গবেষণা সম্বন্ধে (অর্থাৎ, সূর্য ও নক্ষত্রাদির প্রাকৃতিক অবস্থা, যাহা Theory of lonisation of Elements দিয়া সুস্পষ্টরূপে বোঝা যায়) সবিশেষ বর্ণনা দেই। তিনি দুই-এক মিনিট পর পরই বলিয়া উঠিতে লাগিলেন, “এ আর নূতন কি হইল, এ সমস্তই ব্যাদে আছে।” আমি দুইএকবার মৃদু আপত্তি করিবার পর বলিলাম, “মহাশয়, এসব তত্ত্ব বেদের কোন অংশে আছে, অনুগ্রহপূর্বক দেখাইয়া দিবেন কি ? তিনি বলিলেন, “আমি ত কখনও ‘ব্যাদ’ পড়ি নাই, কিন্তু আমার বিশ্বাস, তোমরা নূতন বিজ্ঞানে যাহা করিয়াছ বলিয়া দাবী কর সমস্তই ‘ব্যাদে’ আছে।” অথচ এই ভদ্রলোক বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চতম পরীক্ষায় সসম্মানে উত্তীর্ণ হইয়াছিলেন।

বলা বাহুল্য যে, বিগত কুড়ি বৎসরে বেদ, উপনিষদ, পুরাণ ইত্যাদি সমস্ত হিন্দুশাস্ত্র গ্রন্থ এবং হিন্দু জ্যোতিষ ও অপরাপর বিজ্ঞান সম্বন্ধীয় প্রাচীন গ্রন্থাদি তন্ন তন্ন করিয়া খুঁজিয়া আমি কোথাও আবিষ্কার করিতে সক্ষম হই নাই যে, এই সমস্ত প্রাচীন গ্রন্থে বর্তমান বিজ্ঞানের মূলতত্ত্ব নিহিত আছে। সকল প্রাচীন সভ্যদেশের পণ্ডিতগণই বিশ্বজগতে পৃথিবীর স্থান, চন্দ্র, সূর্য, গ্রহাদির গতি, রসায়ন বিদ্যা, প্রাণী বিদ্যা ইত্যাদি সম্বন্ধে নানারূপ কথা বলিয়া গিয়াছেন, কিন্তু তা সত্ত্বেও বাস্তবিক পক্ষে বর্তমান বিজ্ঞান গত তিনশত বৎসরের মধ্যে ইউরোপীয় পণ্ডিতগণের সমবেত গবেষণা, বিচারশক্তি ও অধ্যবসায় প্রসূত। একটা দৃষ্টান্ত দিতেছি, এদেশে অনেকে মনে করেন, ভাস্করাচার্য একাদশ শতাব্দীতে অতি অস্পষ্টভাবে মাধ্যাকর্ষণ শক্তির উল্লেখ করিয়া গিয়াছেন সুতরাং তিনি নিউটনের সমতুল্য। অর্থাৎ, নিউটন আর নূতন কি করিয়াছে ? কিন্তু এই সমস্ত “অল্পবিদ্যা-ভয়ঙ্করী” শ্রেণীর তার্কিকগণ ভুলিয়া যান যে, ভাস্করাচাৰ্য কোথাও পৃথিবী ও অপরাপর গ্রহসূর্যের চতুর্দিকে বৃত্তাভাস ( elliptical) পথে ভ্রমণ করিতেছে একথা বলেন নাই। তিনি কোথায়ও প্রমাণ করেন নাই যে, মাধ্যাকর্ষণ শক্তি ও গতিবিদ্যার নিয়ম প্রয়োগ করিলে পৃথিবীর ও অপরাপর গ্রহের ভ্রমণ কক্ষ নিরূপণ করা যায়। সুতরাং ভাস্করাচার্য বা কোন  হিন্দু, গ্রীক বা আরবী পণ্ডিত কেপলার-গ্যালিলিও বা নিউটনের বহুপূর্বেই মাধ্যাকর্ষণতত্ত্ব আবিষ্কার করিয়াছেন, এরূপ উক্তি করা পাগলের প্রলাপ বই কিছুই নয়। দুঃখের বিষয়, দেশে এইরূপ অপবিজ্ঞানপ্রচারকের অভাব নাই, তাহারা সত্যের নামে নির্জলা মিথ্যার প্রচার করিতেছেন মাত্র।" (সবই ব্যাদে আছে - লেখক স্বনামধন্য বিজ্ঞানী মেঘনাদ সাহা) 

২) "আমরা আধুনিক জ্যোতিষ হইতে জানিতে পারি যে, আমাদের এই পৃথিবী ও সূর্যের সেই অবস্থা-পরিবর্তন চলিয়াছে, শেষে এই কঠিনাকার পৃথিবী গলিয়া গিয়া তরলাকার এবং অবশেষে বাষ্পাকার ধারণ করিবে।" (পৃষ্ঠা ১০)

মতামত: ওপরের বক্তব্য থেকে এটা পরিষ্কার যে স্বামী বিবেকানন্দ জ্যোতির্বিদ্যা আর জ্যোতিষশাস্ত্রের মধ্যে পার্থক্যটা বুঝতেন না। জ্যোতিষশাস্ত্র টলেমির বিতর্কিত ভূকেন্দ্রিক (geocentric) তত্ত্বের ওপর নির্ভরশীল এবং ইহা কখনই বিজ্ঞানসম্মত নয়।

৩) "চক্ষু যদি দেখিত, তবে মানুষের যখন মৃত্যু হয় তখন তো চক্ষু অবিকৃত থাকে, তবে তখনও তাহারা দেখিতে পাইত।" (পৃষ্ঠা ১২)

মতামত: মানুষের মৃত্যুর পর ৪ - ৬ ঘণ্টা পর্যন্ত জীবিত থাকে কর্নিয়ার এন্ডোথেলিয়াম কোষগুলি। ফলে ওই সময়ের মধ্যে তা পুনরুদ্ধার করা গেলে তা সহজেই প্রতিস্থাপন করা সম্ভব। যদিও আমাদের দেশে এই পদ্ধতি ১৯৪৮ সালে শুরু হয়েছিল (স্বামীজীর এই বক্তব্যের অনেক পরে) কিন্তু স্বামীজীর সব ইন্দ্রিয়ের পিছনে অবস্থিত নির্গুণ ব্রহ্মের বুজরুকিগুলো এবার বন্ধ হোক।

https://www.dragarwal.com/blog/general-ophthalmology/eye-donation-facts-and-myths/

৪) "কপিল-দর্শনই পৃথিবীতে যুক্তি-বিচার দ্বারা জগত্তত্ত্ব-ব্যাখ্যার সর্বপ্রথম চেষ্টা। কপিলের প্রতি উপযুক্ত সম্মান প্রদর্শন করা জগতের সকল দার্শনিকেরই উচিত। আমি আপনাদের মনে এইটি বিশেষ করিয়া মুদ্রিত করিয়া দিতে চাই যে, দর্শনশাস্ত্রের জনক বলিয়া আমরা তাঁহার উপদেশ শুনিতে বাধ্য এবং তিনি যাহা বলিয়া গিয়াছেন, তাহা শ্রদ্ধা করা আমাদের কর্তব্য। এমন কি, বেদেও এই অদ্ভুত ব্যক্তির—এই সর্বপ্রাচীন দার্শনিকের উল্লেখ পাওয়া যায়। তাঁহার অনুভূতিসমুদয় কি অপূর্ব! যদি যোগিগণের অতীন্দ্রিয় প্রত্যক্ষশক্তির কোন প্রমাণ প্রয়োগ আবশ্যক হয়, তবে বলিতে হয়, এইরূপ ব্যক্তিগণই তাঁহার প্রমাণ।" (পৃষ্ঠা ১৯)

আবার একটু পরে স্বামীজী নিজেই বলেছেন, "এ কী কুসংস্কার! আর ইহারই ফলে মানুষ তাহার দেব-স্বভাব হইতে পশু-স্বভাবে অবনত হইতেছে। যদি আমাদিগকে সবকিছু অন্ধভাবেই বিশ্বাস করিতে হয়, তবে বিচারবুদ্ধি আমরা লাভ করিয়াছি কেন? যুক্তিবিরোধী কোন কিছু বিশ্বাস করা কি মহাপাপ নয়? ঈশ্বর যে উৎকৃষ্ট সম্পদটি আমাদিগকে দান করিয়াছেন, তাহা যথাযথ-ভাবে ব্যবহার না করিবার কী অধিকার আমাদের আছে? আমার নিশ্চিত বিশ্বাস এই যে, ঈশ্বরদত্ত শক্তির ব্যবহারে অক্ষম অন্ধবিশ্বাসী অপেক্ষা যুক্তিবাদী অবিশ্বাসীকে ভগবান্ সহজে ক্ষমা করিবেন। অন্ধবিশ্বাসী শুধু নিজের প্রকৃতিকে অবনমিত করে এবং পশুস্তরে অধঃপাতিত হয়—বুদ্ধিনাশের ফলে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। যুক্তিবিচারের আশ্রয় আমরা অবশ্য গ্রহণ করিব এবং সকল দেশের প্রাচীন শাস্ত্রে বর্ণিত এই-সকল ঈশ্বরের দূত বা মহাপুরুষের কাহিনীকে যখন যুক্তিসম্মত বলিয়া প্রমাণ করিতে পারিব, তখন আমরা তাঁহাদিগকে বিশ্বাস করিব।" (পৃষ্ঠা ২০৮)

একদিকে স্বামী বিবেকানন্দ নিজেই ফতেয়া জারি করছেন আবার অন্যদিকে বলছেন যুক্তিবিরোধী কোনোকিছু গ্রহণ না করতে - কোনটাকে অভ্রান্ত হিসেবে ধরবো, সেটাই তো বোধগম্য হল না।

৫) "যে-ব্যক্তি বলে, জগৎ রহিয়াছে, কিন্তু ঈশ্বর নাই, সে নির্বোধ; কারণ যদি জগৎ থাকে, তবে জগতের একটা কারণও থাকিবে, আর সেই কারণের নামই ঈশ্বর। কার্য থাকিলেই তাহার কারণ আছে, অবশ্য জানিতে হইবে। যখন জগৎ অন্তর্হিত হইবে, তখনই ঈশ্বরও অন্তর্হিত হইবেন।" (পৃষ্ঠা ৭২)

মতামত: ধর্ম ব্যবসায়ীরা ইচ্ছাকৃতভাবে জগৎ নির্মাণের মধ্যে "কারণ"টাকে ঢোকাতে চান যাতে এর মধ্যে তাঁদের নির্গুণ ব্রহ্মের তত্ত্বটাকে জোরজবরদস্তি ঢুকিয়ে দিতে পারেন। 

https://www.shongshoy.com/%e0%a6%ac%e0%a6%bf%e0%a6%97-%e0%a6%ac%e0%a7%8d%e0%a6%af%e0%a6%be%e0%a6%82-%e0%a6%a5%e0%a7%87%e0%a6%95%e0%a7%87-%e0%a6%ae%e0%a6%b9%e0%a6%be%e0%a6%ac%e0%a6%bf%e0%a6%b6%e0%a7%8d%e0%a6%ac/

৬) "ধর্ম হইতে আমরা যে-সকল তথ্য ও তত্ত্ব শিক্ষা করিতে পারি, যে-সান্ত্বনা পাইতে পারি, তাহা ছাড়িয়া দিলেও ধর্ম অন্যতম বিজ্ঞান অথবা গবেষণার বস্তু হিসাবে মানব-মনের শ্রেষ্ঠ ও সর্বাধিক কল্যাণকর অনুশীলনের বিষয়।" (পৃষ্ঠা ৯১)

মতামত: স্বামীজীর আরেকটি ভ্রান্ত বিশ্বাস। ফিনল্যাণ্ডে প্রায় ২০%-এর ওপর মানুষ কোনো ধর্মে বিশ্বাস করেন না অথচ বিশ্বের সবচেয়ে সুখী দেশের তালিকায় টানা ছয় বছর ধরে শীর্ষে রয়েছে ফিনল্যাণ্ড। 

https://wisevoter.com/country-rankings/least-religious-countries/
https://worldpopulationreview.com/country-rankings/happiest-countries-in-the-world

৭) "মানুষের ইতিহাসে ‘যুক্তি-দেবতার উপাসনা’ ফরাসী-বিপ্লবের সময়েই প্রথম আত্মপ্রকাশ করে নাই; এই জাতীয় ঘটনা পূর্বেও ঘটিয়াছিল, ফরাসী-বিপ্লবের সময় উহার পুনরভিনয় মাত্র হইয়াছে। কিন্তু বর্তমান যুগে উহা অতিমাত্রায় বাড়িয়া উঠিয়াছে। জড়বিজ্ঞানগুলি এখন পূর্বাপেক্ষা আরও ভালভাবে প্রস্তুত হইয়াছে; আর ধর্মের প্রস্তুতি সে-তুলনায় কমিয়া গিয়াছে, ভিত্তিগুলি শিথিল হইয়া গিয়াছে। আর আধুনিক মানুষ প্রকাশ্যে যাহাই বলুক না কেন, তাহার অন্তরের গোপন প্রদেশে এ-বোধ জাগ্রত যে, সে আর ‘বিশ্বাস’ করিতে পারে না। আধুনিক যুগের মানুষ জানে যে, পুরোহিত-সম্প্রদায় তাহাকে বিশ্বাস করিতে বলিতেছে বলিয়াই, কোন শাস্ত্রে লেখা আছে বলিয়াই, কিংবা তাহার স্বজনেরা চাহিতেছে বলিয়াই কিছু বিশ্বাস করা তাহার পক্ষে অসম্ভব। অবশ্য এমন কিছু লোক আছে, যাহারা তথাকথিত জনপ্রিয় বিশ্বাসকে মানিয়া লইতে প্রস্তুত বলিয়া মনে হয়। কিন্তু এ-কথাও আমরা নিশ্চয় জানি যে, তাহারা বিষয়টি সম্বন্ধে চিন্তা করে না। তাহাদের বিশ্বাসের ভাবটিকে ‘চিন্তাহীন অনবধানতা’ আখ্যা দেওয়া চলে। এই সংগ্রাম এভাবে আর বেশীদিন চলিতে পারে না; চলিলে ধর্মের সব সৌধই ভাঙিয়া চুরমার হইয়া যাইবে।" (পৃষ্ঠা ৯৫)

"আমরা সকলেই বাল্যকাল হইতে প্রেম, শান্তি, মৈত্রী, সাম্য, সর্বজনীন ভ্রাতৃভাব প্রভৃতি অনেক কথাই শুনিয়া আসিতেছি। কিন্তু সেগুলি আমাদের কাছে কতকগুলি নিরর্থক শব্দমাত্রে পরিণত হইয়াছে। আমরা সেগুলি তোতাপাখীর মত আওড়াইয়া থাকি এবং উহাই আমাদের স্বভাব হইয়া দাঁড়াইয়াছে। আমরা ঐরূপ না করিয়া পারি না। যে-সকল মহাপুরুষ প্রথমে তাঁহাদের হৃদয়ে এই মহান্ তত্ত্বগুলি উপলব্ধি করিয়াছিলেন, তাঁহারাই এই শব্দগুলি সৃষ্টি করেন। তখন অনেকেই এগুলির অর্থ বুঝিত। পরে অজ্ঞ লোকেরা এই শব্দগুলি লইয়া ছেলেখেলা করিতে থাকে, অবশেষে ধর্ম জিনিষটাকে কেবলমাত্র কথার মারপ্যাঁচে দাঁড় করান হইয়াছে—উহা যে জীবনে পরিণত করিবার জিনিষ, তাহা তাহারা ভুলিয়া গিয়াছে। ইহা এখন ‘পৈত্রিক ধর্ম’, ‘জাতীয় ধর্ম’, ‘দেশীয় ধর্ম’ ইত্যাদিতে পরিণত হইয়াছে। শেষে কোন ধর্মাবলম্বী হওয়াটা স্বদেশপ্রেমের একটা অঙ্গ হইয়া দাঁড়াইয়াছে, আর স্বদেশপ্রেম সর্বদাই একদেশী।" (পৃষ্ঠা ১০৯)

মতামত: অনেকেই স্বামী বিবেকানন্দের মধ্যে সমাজতান্ত্রিক সত্ত্বা খুঁজে বেড়ান কিন্তু ওপরের বক্তব্যগুলি থেকে আমরা বুঝতে পারি যে উনি সংখ্যাগরিষ্ঠ শ্রমজীবী মানুষের অধিকারের প্রশ্নে পুরোনো সামন্ততান্ত্রিক শোষণভিত্তিক সমাজ কাঠামোর হয়েই তাঁবেদারি করছেন আর ধর্মের ঠিকাদারেরা বিভিন্নভাবে শ্রমজীবী মানুষদের ধর্মের বিধি, নির্দেশের দোহাই দিয়ে এই সামন্ততন্ত্রের কাঠামোকে টিকিয়ে রাখতে চিরকালই এক অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন। এর একটি প্রকৃষ্ট উদাহরণ স্বামীজী নিজে; নিচের বক্তব্যগুলো একটু দেখে নেওয়া যাক -

"বর্তমানে যন্ত্র ও অন্যান্য সরঞ্জাম-নির্মাণ দ্বারা অসাধারণ শক্তি সঞ্চিত হইতেছে এবং এমন সব অধিকার দাবী করা হইতেছে, যাহা পৃথিবীর ইতিহাসে পূর্বে কখনও করা হয় নাই। এই কারণেই বেদান্ত এই অধিকারবাদের বিরুদ্ধে প্রচার করিতে চায়, মানবাত্মার উপর এই উৎপীড়ন চূর্ণ-বিচূর্ণ করিতে চায়।" (পৃষ্ঠা ২৫২)

"বেদান্ত বলেন, আমাদিগকে অধিকারের ভাব ছাড়িয়া দিতে হইবে; ইহা ছাড়িলেই ধর্ম আসিবে। তৎপূর্বে কোন ধর্ম আসে না।" (পৃষ্ঠা ২৫৪)

এরকম আরো উদ্ধৃতি আছে।

৮) "তবু একমাত্র যুক্তিই এই মানব-প্রকৃতির সহিত সরাসরি সংযুক্ত; সেজন্য যতক্ষণ তাহা মানব-প্রকৃতির অনুগামী হয়, ততক্ষণ যুক্তিরই আশ্রয় লওয়া উচিত।" (পৃষ্ঠা ৯৭)

মতামত: স্বামীজীর বহু বক্তব্য এমনই দ্বিচারিতায় পরিপূর্ণ। একটু পরে আবার নিজেই বলেছেন, "বাগাড়ম্বর নয়, তত্ত্বালোচনা নয়, যুক্তিতর্ক নয়, চাই অনুভূতি। ইহাকেই আমি বলি—বাস্তব জীবনে পরিণত ধর্ম।" (পৃষ্ঠা ১৯৬)

বক্তব্য দুটি সম্পূর্ণ পরস্পর বিরোধী।

৯) "আমার মনে হয়, আধুনিক বিজ্ঞান বার বার যাহা প্রমাণ করিয়া চলিয়াছে, তাহা এইঃ আমরা এক; মানসিক, শারীরিক, আধ্যাত্মিক—সব দিক্ দিয়াই আমরা এক। শরীরের দিক্‌ হইতে আমরা পৃথক্‌, এ-কথাও বলা ভুল।" (পৃষ্ঠা ১০০)

স্বামীজীর বহু বক্তব্য এমনই দ্বিচারিতায় পরিপূর্ণ। একটু পরে আবার নিজেই বলেছেন, "আমাদের বুদ্ধিবৃত্তি, আমাদের শক্তি, আমাদের শরীর কি সব সমান? এক ব্যক্তি অপর ব্যক্তি অপেক্ষা বলশালী, একজনের বুদ্ধিবৃত্তি অপরের চেয়ে বেশী। যদি আমরা সকলেই সমান হই, তবে এই অসামঞ্জস্য কেন? কে ইহা করিল? আমরা নিজেরা। আমাদের পরস্পরের মধ্যে ক্ষমতার তারতম্য, বিদ্যাবুদ্ধির তারতম্য এবং শারীরিক বলের তারতম্য আছে বলিয়া আমাদের পরস্পরের মধ্যে নিশ্চয়ই পার্থক্য হইতে বাধ্য।" (পৃষ্ঠা ১১৩)

বক্তব্য দুটি সম্পূর্ণ পরস্পর বিরোধী।

১০) "যদি কলেজ হইতে পদার্থবিজ্ঞানের অধ্যাপকগণ আসেন, তাঁহারা যুক্তিবিচার পছন্দ করিবেন। তাঁহারা যত পারেন বিচার করুন। শেষে তাঁহারা এমন একস্থানে পৌঁছিবেন, যেখানে তাঁহাদের মনে হইবে যে, যুক্তিবিচারের ধারা অক্ষুণ্ণ রাখিয়া তাঁহারা আর অগ্রসর হইতে পারেন না। তাঁহারা বলিয়া বসিবেন, ‘ঈশ্বর, মুক্তি প্রভৃতি ভাবগুলি কুসংস্কার মাত্র—উহাদিগকে ছাড়িয়া দাও।’ আমি বলি, ‘হে দার্শনিক প্রবর, তোমার এই পাঞ্চভৌতিক দেহ যে আরও বড় কুসংস্কার, এটিকে পরিত্যাগ কর। আহার করিবার জন্য আর গৃহে বা অধ্যাপনার জন্য তোমার দর্শনবিজ্ঞানের ক্লাসে যাইও না। শরীর ছাড়িয়া দাও এবং যদি না পার, জীবনভিক্ষা চাহিয়া চুপ করিয়া বস।’" (পৃষ্ঠা ১১৮)

আবার স্বামীজী নিজেই বলেছেন, "আমাদের দেশে যিনি বেদপাঠ করেন, তাঁহার সম্মুখে আমরা নতজানু হই। আর যে ব্যক্তি পদার্থবিদ্যা অধ্যয়ন করিতেছে, তাহাকে আমরা গ্রাহ্যের মধ্যে আনি না। এটা কুসংস্কার—মোটেই বেদান্ত মত নয়—এও জঘন্য জড়বাদ। ঈশ্বরের নিকট সকল জ্ঞানই পবিত্র; জ্ঞানই ঈশ্বর।" (পৃষ্ঠা ২৮৭)

বক্তব্য দুটি সম্পূর্ণ পরস্পর বিরোধী।

১১) "ধর্ম অনুভূতির বস্তু—উহা মুখের কথা বা মতবাদ বা যুক্তিমূলক কল্পনা মাত্র নয়—তাহা যতই সুন্দর হউক না কেন। ধর্ম—জীবনে পরিণত করিবার বস্তু, শুনিবার বা মানিয়া লইবার জিনিষ নয়; সমস্ত মনপ্রাণ বিশ্বাসের বস্তুর সহিত এক হইয়া যাইবে। ইহাই ধর্ম।" (পৃষ্ঠা ১২৬)

মতামত: স্বামীজী বোঝাতে চেয়েছেন কোনো ব্যক্তি যেন বেদান্ত, আত্মা বা নির্গুণ ব্রহ্মের বাস্তব অস্তিত্বের উপর প্রশ্ন না করে; আর প্রশ্ন করলে সে উত্তরটা পাবে উপরের বক্তব্যের মতো - কারণ সব প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মই পুরোপুরি বিশ্বাসের ওপর স্থাপিত, এগুলোর কোনো বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই।

প্রতিটি ছত্রে ছত্রে স্বামীজী যতই এই বিজ্ঞান অমুক বলেছে, সেই বিজ্ঞান তমুক বলেছে বলে দিস্তা দিস্তা কু-যুক্তি তুলে ধরুন না কেন, "ব্রহ্ম"-এর বাস্তব অস্তিত্বের প্রমাণের দায়িত্ব উনি নিতে চান না। 

১২) "‘যোগ্যতম ব্যক্তি বা বস্তুই বাঁচিয়া থাকিবে’—আধুনিক বৈজ্ঞানিকগণের এই মত যদি সত্য হয়, তাহা হইলে এই-সকল ধর্ম যে এখনও বাঁচিয়া রহিয়াছে, ইহা হইতেই প্রমাণিত হয় যে, এখনও তাহারা কতকগুলি লোকের পক্ষে উপযোগী; তাহারা যে কেন বাঁচিয়া থাকিবে, তাহার কারণ আছে—তাহারা বহু লোকের উপকার করিতেছে।" (পৃষ্ঠা ১২৯)

মতামত: যুক্তিবাদের ভাষায় স্বামীজীর এই বক্তব্য জনপ্রিয়তার কুযুক্তি বা ফ্যালাসি (Argument from popularity/ Argumentum ad populum)।

https://www.shongshoy.com/%e0%a6%95%e0%a7%81%e0%a6%af%e0%a7%81%e0%a6%95%e0%a7%8d%e0%a6%a4%e0%a6%bf-%e0%a6%ac%e0%a6%be-%e0%a6%ab%e0%a7%8d%e0%a6%af%e0%a6%be%e0%a6%b2%e0%a6%be%e0%a6%b8%e0%a6%bf/

১৩) "আর যদি আপনার ঈশ্বরের অস্তিত্ব সম্বন্ধে সন্দেহ থাকে, তবে তাঁহাকে দেখিবার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করুন না কেন? কেন আপনি সংসার ত্যাগ করিয়া এই এক উদ্দেশ্য সিদ্ধির জন্য সমস্ত জীবন অতিবাহিত করেন না?" (পৃষ্ঠা ১৩৮)

"যেখানে ঈশ্বর আছেন, সেখানে আর কিছু নাই। যেখানে সাংসারিকতা আছে, সেখানে ঈশ্বর নাই।" (পৃষ্ঠা ১৯৪)

মতামত: স্বামীজীর বহু বক্তব্য এমনই দ্বিচারিতায় পরিপূর্ণ। প্রথম খণ্ডে উনি নিজেই বলেছিলেন, "সংসারী অপেক্ষা সংসারত্যাগী মহত্তর, এ-কথা বলা বৃথা। সংসার হইতে স্বতন্ত্র থাকিয়া স্বাধীন সহজ জীবনযাপন অপেক্ষা সংসারে থাকিয়া ঈশ্বরের উপাসনা করা অনেক কঠিন কাজ।" (পৃষ্ঠা ৪৯) 

বক্তব্য দুটি সম্পূর্ণ পরস্পর বিরোধী।

১৪) "মনে রাখিতে হইবে, মানুষ তাহার নিজ কর্মদোষে তাহার শুদ্ধ ভাব হারাইয়াছে। আমরা যে কষ্ট পাই, তাহা আমাদের নিজেদের কর্মফলে। ইহার জন্য ভগবান্ দোষী নন। এই সব ধারণার সহিত পুনর্জন্মবাদের সম্বন্ধ অচ্ছেদ্য। পাশ্চাত্যগণের হস্তে অঙ্গহানি হওয়ার পূর্বে এই মতবাদটি সর্বজনীন ছিল।" (পৃষ্ঠা ১৪৩)

"আমাদের জন্মান্তরবাদের দার্শনিক ভিত্তি এইরূপ। আমরা পূর্বজন্মের অভিজ্ঞতা লইয়া বর্তমান জীবনে প্রবেশ করিয়াছি এবং আমাদের বর্তমান জন্মের সৌভাগ্য বা দুর্ভাগ্য সেই পূর্বজন্মের কর্মের ফল; তবে উত্তরোত্তর আমাদের উন্নতিই হইতেছে এবং অবশেষে একদিন আমরা পূর্ণত্ব লাভ করিব।" (পৃষ্ঠা ১৬৫)

"উৎপীড়কদের তুলনায় উৎপীড়িতদের জীবনে বেশী আশা আছে। উৎপীড়কদের পক্ষে মুক্তিলাভ করিতে অনেক বেশী সময় লাগিবে, অন্যের পক্ষে সময় লাগিবে কম।" (পৃষ্ঠা ২৫৪)

মতামত: বেদান্তবাদী স্বামী বিবেকানন্দ "প্রকৃতপক্ষে কেহই জন্মায় না বা মরে না; স্বর্গও নাই, নরকও নাই অথবা ইহলোকও নাই" (পৃষ্ঠা ৫১) বা "মানুষ জন্মায় না বা মরে না বা স্বর্গেও যায় না এবং আত্মার পক্ষে পুনর্জন্ম একটা নিছক কাহিনী মাত্র" (পৃষ্ঠা ২৩৩) মার্কা তত্ত্ব কথা আওড়ানোর পরে পরিশেষে তিনিও সেই জন্মান্তরবাদ আর কর্মফলেরই পক্ষ নিলেন; সাধারণ মানুষের মনে এই কুসংস্কারের বীজ বপন করতে না পারলে যে ধর্ম ব্যবসা লাটে উঠবে!

১৫) "কেনই বা লক্ষ লক্ষ লোক পদদলিত হয়? দুর্ভিক্ষ-সৃষ্টির জন্য যাহারা দায়ী নয়, তাহারা কেন অনাহারে মরে? ইহার জন্য দায়ী কে? ইহাতে মানুষের কোন হাত না থাকিলে ভগবানকেই নিশ্চিতরূপে দায়ী করিতে হয়। সুতরাং ইহার উৎকৃষ্টতর ব্যাখ্যা এই যে, কাহারও ভাগ্যে যে-সকল দুঃখভোগ হয়, তাহার জন্য সে-ই দায়ী। কোন চক্রকে যদি আমি গতিশীল করি, তাহার ফলের জন্য আমিই দায়ী এবং আমি যখন আমার দুঃখ উৎপন্ন করিতে পারি, তখন তাহার নিবৃত্তিও আমিই করিতে পারি।" (পৃষ্ঠা ১৪৩)

মতামত: স্বামীজীর এই ধরণের বহু বক্তব্যই তাঁর সামন্ততান্ত্রিক প্রভুদের খুশি করবার স্বার্থে, যাতে ধর্মের দোহাই দিয়ে শোষণভিত্তিক সমাজ কাঠামোটা ধরে রাখা যায়। 

যদি ওঁর এই বক্তব্য যথার্থ হয় সেক্ষেত্রে কোনো ব্যক্তির হত্যা করা হলে, সেই ব্যক্তিই দায়ী, হত্যাকারী নয়।

১৬) "আমরা কি ঈশ্বরকে দর্শন করিতে পারি? অবশ্যই পারি না। আমরা কি ঈশ্বরকে জানিতে পারি? নিশ্চয়ই নয়। ঈশ্বর যদি জ্ঞাতই হন, তাহা হইলে তিনি আর ঈশ্বরই থাকিবেন না। জানা মানেই সীমাবদ্ধ করা। কিন্তু ‘আমি ও আমার পিতা এক।’ আত্মাতেই আমি আমার বাস্তব পরিচয় পাই।" (পৃষ্ঠা ১৪৬)

মতামত: স্বামীজীর বহু বক্তব্য এমনই দ্বিচারিতায় পরিপূর্ণ। একটু পরে আবার নিজেই বলেছেন, "আর একটি কথা আপনাদিগকে জানাইতে চাই—ধর্ম-অর্থে কোন মন-গড়া মত বা সিদ্ধান্ত নয়। আপনারা কি অধ্যয়ন করেন অথবা কি মতবাদ বিশ্বাস করেন, তাহাই প্রধান বিচার্য বিষয় নয়, বরং আপনি কি উপলব্ধি করেন, তাহাই জ্ঞাতব্য। ‘পবিত্রাত্মারাই ধন্য, কারণ তাঁহাদের ঈশ্বর-দর্শন হইবে।’—ঠিক কথা, এই জীবনেই দর্শন হইবে; আর ইহাই তো মুক্তি।" (পৃষ্ঠা ১৪৭)

১৭) "ভারতবর্ষই একমাত্র দেশ, যেখানে ধর্মের জন্য কখনই কাহারও উপর নির্যাতন হয় নাই, যেখানে কোন ব্যক্তি কখনও তাহার ধর্মবিশ্বাসের জন্য উত্যক্ত হয় নাই; সেখানে আস্তিক, নাস্তিক, অদ্বৈতবাদী, দ্বৈতবাদী এবং একেশ্বরবাদী সকলেই আছেন এবং কখনও নির্যাতিত না হইয়া বসবাস করিতেছেন।" (পৃষ্ঠা ১৫৪)

"ইহা যথার্থ গৌরবের বিষয় যে, ভারতবর্ষ এমন একটি দেশ, যেখানে কখনও ধর্মের জন্য উৎপীড়ন হয় নাই, যেখানে ধর্ম বিষয়ে মানুষকে পূর্ণ স্বাধীনতা দেওয়া হয়।" (পৃষ্ঠা ২৫১)

মতামত: সর্বৈব মিথ্যা কথা। ভারতবর্ষে সতীদাহ থেকে শুরু করে বাল্যবিবাহ, কুলিন ব্রাহ্মণদের একাধিক স্ত্রী থেকে দেবদাসী বা মহিলাদের ওপর বৈধব্যজনিত বর্বর, অমানবিক শৃঙ্খলার বেড়া হিন্দুদের মধ্যেই প্রচলিত ছিল। 

রামায়ণে মর্যাদাপুরুষোত্তম রাজা রাম বেদ অধ্যয়ন করার অপরাধে এক নিচু জাতের বালক, শম্বুককে হত্যা করেন। দক্ষিণ ভারতে শিব ও বিষ্ণু ভক্তদের মধ্যেও প্রচুর দ্বন্দ্ব বিদ্যমান ছিল। 

https://www.deccanchronicle.com/nation/in-other-news/170416/where-shiva-vishnu-bhakts-clashed.html

১৮) "ফরাসীদেশে দীর্ঘকাল ধরে জাতির মূলমন্ত্র ছিল ‘মানুষের অধিকার’, আমেরিকায় এখনও ‘নারীর অধিকার’ জনসাধারণের কানে আবেদন জানায়; ভারতবর্ষে কিন্তু আমাদের মাথাব্যথা ঈশ্বরের বিভিন্নভাবে প্রকাশের অধিকার নিয়ে।" (পৃষ্ঠা ১৭২)

মতামত: দেশ যখন পরাধীন তখন ওপরের উক্তিটি স্বামী বিবেকানন্দের সামন্ততান্ত্রিক প্রভুদের প্রতি আনুগত্যেরই সাক্ষ্য দেয়। সংখ্যাগরিষ্ঠ শ্রমজীবী মানুষের অধিকার, নারী স্বাধীনতা এইসব শব্দ মুখে আনলে তাঁর সামন্তপ্রভুরা ক্ষুব্ধ হতেন বৈকি। এরপরেও কিছু উদারপন্থী বামপন্থীদের কাছে স্বামীজী নাকি সমাজতান্ত্রিক! 

১৯) "হিন্দুদের স্বাতন্ত্র্য এই যে, ধর্মের মধ্যে তারা কোন মতবাদ বা নিয়মাদি আনেনি। তাদের ধর্মের তাই সর্বোচ্চ বিকাশ হয়েছে। এই ধর্মের ক্ষেত্রেই আমরা সবচেয়ে বাস্তবদৃষ্টিসম্পন্ন—আর তোমরা সেখানেই সবচেয়ে বাস্তবদৃষ্টিহীন।" (পৃষ্ঠা ১৭৫)

মতামত: সর্বৈব মিথ্যা কথা। সতীদাহ থেকে শুরু করে বাল্যবিবাহ, কুলিন ব্রাহ্মণদের একাধিক স্ত্রী থেকে দেবদাসী বা বিধবা মহিলাদের পুনরায় বিবাহের অন্তরায় পরিস্থিতি হিন্দুরা ধর্মকে ব্যবহার করেই সৃষ্টি করেছিল।

২০) "প্রকৃতপক্ষে ধর্ম ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য ইহলোকের বস্তু নয়; ইহা অতীন্দ্রিয় স্তরের বস্তু। ইহা যুক্তি-বিচারের অতীত, ইহা বুদ্ধিগ্রাহ্য স্তরের অন্তর্ভুক্ত নয়। ইহা এমন একটি প্রত্যক্ষ দর্শন, এমন একটি দৈব-প্রেরণা, অজ্ঞাত ও অজ্ঞেয়ের মধ্যে এমন এক আত্ম-নিমজ্জন যাহার ফলে অজ্ঞেয়কে জ্ঞাত অপেক্ষাও নিবিড়ভাবে জানা যায়; কারণ লৌকিক অর্থে ইহার জ্ঞান সম্ভব নয়।" (পৃষ্ঠা ১৭৬)

মতামত: ভক্তদের যে কোনো উপায়ে যুক্তি, বুদ্ধির পথ থেকে সরিয়ে নির্গুণ ব্রহ্মের খোঁজ নিয়ে ব্যস্ত রাখতে সর্বদা সচেষ্ট স্বয়ং স্বামী বিবেকানন্দ।

২১) "সমগ্র জগতে যে সকল অবতারপুরুষ ও সাধক জন্মগ্রহণ করিয়াছেন, তাঁহাদের কথা স্মরণ করুন; ইহা সর্বজনবিদিত যে, তাঁহাদের জীবনে এমন সব মুহূর্ত আসিয়াছে, যখন আপাতদৃষ্টিতে তাঁহাদিগকে বাহ্যজগৎ সম্পর্কে অচেতন বলিয়া মনে হয়; অতঃপর তাঁহাদের ভিতর হইতে যে জ্ঞানরাশি উৎসারিত হয়, সে সম্বন্ধে তাঁহারা বলেন, উহা তাঁহারা অতিচেতন স্তর হইতে পাইয়াছেন।" (পৃষ্ঠা ১৮৫)

মতামত: এইসব অতিচেতন স্তরের কোনো একটি সাক্ষ্য প্রমাণ আমরা তাঁদের বা তাঁদের ভক্তকুলের বাইরে থেকে পাই না।      

২২) "একটি কথা আপনাদের জানা উচিত, যে-কোন ঘটনাই সম্ভবপর হইতে পারে; এবং ইহাও সম্ভব হইতে পারে যে, লুব্ধক নক্ষত্রের সংস্পর্শে আসিয়া পৃথিবী আগামী বৎসরে বিদীর্ণ হইয়া যাইবে। আমি যদি এইরূপ সম্ভাবনা উপস্থাপিত করি, তবে আপনাদেরও অধিকার আছে যে, আপনারা আমাকে ইহা প্রমাণ করিতে বলিবেন। আইনজ্ঞেরা যাহাকে বলেন, ‘প্রমাণ করার দায়িত্ব’, সে দায়িত্ব তাহার উপরই বর্তাইবে, যে ঐ জাতীয় মতবাদ উপস্থিত করিবে।" (পৃষ্ঠা ১৮৭)

মতামত: আইন ও যুক্তিবাদের দৃষ্টিতে বাস্তব কথা; কিন্তু প্রশ্ন একটাই - স্বামী বিবেকানন্দ নিজে "ধর্ম"কে বিজ্ঞান বলে চালিয়ে দেওয়ার আগে তাঁর বক্তব্যের সপক্ষে কোনো প্রমাণ, সাক্ষ্য বা দলিলের ধার ধারলেন না কেন?

২৩) "যে বৎসরগুলি—যে শত শত বৎসর ধরিয়া আমি শুধু এই ইন্দ্রিয়ভোগে পরিতৃপ্ত মানুষ হইবার জন্য কঠোর সাধনা করিয়াছি, (ঐ দৃষ্টিতে) তাহা বৃথাই গিয়াছে!" (পৃষ্ঠা ১৯০)

মতামত: আবার সেই এক দ্বিচারিতা। দ্বিতীয় খণ্ডে স্বামীজী নিজেই বলেছেন, "এ বিষয়ে আমি নিশ্চয় করিয়া বলিতে পারি যে, আমার জীবনের ভাল-মন্দ কোন ভাবই বৃথা যায় নাই—আমি সেই অতীত শুভাশুভ উভয়বিধ কর্মেরই সমষ্টি-স্বরূপ। আমি জীবনে অনেক ভুল করিয়াছি, কিন্তু ঐগুলির একটিও যদি বাদ পড়িত, তাহা হইলে আমি আজ যাহা হইয়াছি, তাহা হইতাম না। আমার জীবনে আমি বেশ সন্তুষ্ট।" (পৃষ্ঠা ২১৯) 

দুটি বক্তব্য সম্পূর্ণ পরস্পর বিরোধী।

২৪) "তুমি দুই সহস্র আরোগ্য-নিকেতন নির্মাণ করিয়া থাকিবে, কিন্তু তাহাতে কি আসে যায়, যদি না তুমি আত্মানুভূতি লাভ করিয়া থাক? তুমি মরিবে সামান্য কুকুরেরই মত কুকুরের অনুভূতি লইয়া।" (পৃষ্ঠা ১৯৫)

মতামত: পুনঃপুন সেই এক দ্বিচারিতা। একটু পরে আবার স্বামীজী নিজেই বলেছেন, "লাভের বাসনা না রাখিয়া ঐ ধরনের কর্ম অনুষ্ঠান করিলে আত্মার মঙ্গল সাধিত হয় এবং এরূপ ব্যক্তিদেরই স্বর্গরাজ্য লাভ হয়।" (পৃষ্ঠা ১৯৬)

আত্মানুভূতি লাভ করার ইচ্ছাও তো একরকমের বাসনা। দুটি বক্তব্য সম্পূর্ণ পরস্পর বিরোধী।

২৫) "প্রকৃত ধর্ম—কোন মানুষের নিকট হইতে শিক্ষাদ্বারা প্রাপ্য নয়, পুস্তকপাঠের দ্বারাও লভ্য নয়; প্রকৃত ধর্ম হইল অন্তরাত্মার জাগরণ" (পৃষ্ঠা ২১৪)

মতামত: অথচ একটু আগে স্বামীজী নিজেই বললেন, "আধুনিক যুক্তির সম্মুখে যদি কোন ধর্মীয় মতবাদ দাঁড়াইতে পারে, তবে তাহা হইলে একমাত্র অদ্বৈতবাদ" (পৃষ্ঠা ১০২)

আবার অন্য স্থানে উনি নিজেই বলেছেন, "প্রকৃত ধর্মে—অন্ধবিশ্বাসবশতঃ কোন কিছু বিশ্বাস করা বা মানিয়া লওয়ার স্থান নাই। কোন ধর্মপ্রচারক মহাত্মা এরূপ প্রচার করেন নাই। অধঃপতনের সময়ে ইহা আসিয়া জোটে।" (পৃষ্ঠা ১৮৮)

কিন্তু ওপরের বক্তব্যে তো স্বামীজী স্বয়ং প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার সরাসরি বিরোধিতা করছেন, বিজ্ঞান-নির্ভর শিক্ষা ছাড়া তো যুক্তিবোধ গড়ে ওঠার বিকল্প রাস্তা নাই আবার অন্ধবিশ্বাস তো অশিক্ষারই নামান্তর মাত্র। বাস্তবে এটাও ওঁর আরেকটি দ্বিচারিতা মাত্র।  

আসলে প্রশ্ন করা ধর্ম জগতের সবথেকে বড় পাপ। "ব্রহ্ম সত্য" এটা মেনে নিয়ে প্রশ্ন চলতে পারে। যেমন ব্রহ্ম সাকার না নিরাকার, উনি নকুল দানায় সন্তুষ্ট নাকি কাজু বরফিতে, বেলপাতায় সন্তুষ্ট নাকি ১০ ভরি সোনার হারে। এরকম গুরুগম্ভীর প্রশ্ন চলতেই পারে কিন্তু ব্রহ্মকে মেনে নিয়েই। কিন্তু পড়াশোনা শিখলে বিচার, বুদ্ধি, যুক্তিবোধ তৈরী হলে প্রশ্ন আসবেই তাই এইসব ধর্মব্যবসায়ীদের বিধান আগে ব্রহ্ম লাভ তারপর সবকিছু। 

(আগ্রহী পাঠকেরা শ্রী সুনিত দে মহাশয়ের লেখা "শ্রীরামকৃষ্ণ কিছু অজানা প্রসঙ্গ" পড়ে দেখতে পারেন)।

২৬) "কাজেই পূর্ণসাম্যাবস্থা কখনই লাভ করা যায় না—এ-কথা বলিবার অধিকার আমাদের নাই। সাম্যাবস্থায় কোনরূপ বৈচিত্র্য থাকা অসম্ভব, উহাকে বৈচিত্র্যহীন হইতেই হইবে।" (পৃষ্ঠা ২১৫)

মতামত: পুনঃপুন সেই এক দ্বিচারিতা। একটু পরে স্বামীজী নিজেই বলেছেন, "জোরের সহিত এরূপও বলা হয় যে, জড়দেহে এবং সামাজিক শ্রেণী-বিভাগে সম্পূর্ণ সমতা স্বাভাবিক মৃত্যু আনে এবং সমাজের বিলোপ সাধন করে।" (পৃষ্ঠা ২৫৬)

দুটি বক্তব্য সম্পূর্ণ পরস্পর বিরোধী।

২৭) "এক জাতি বা এক যুগের পক্ষে যাহা পুরাণ, অন্য জাতি বা যুগের নিকট তাহাই ইতিহাস।" (পৃষ্ঠা ২২৩)

মতামত: বিভিন্ন রূপকথার গল্পগাঁথাকেও স্বামী বিবেকানন্দ ইতিহাসের অন্তর্ভুক্ত করে নিলেন, বিজেপি আরএসএস-কে দোষ দিয়ে লাভ কী?

ইতিহাসের সঙ্গে পৌরাণিক কাহিনির বেশ কিছু পার্থক্য লক্ষ করা যায়। এই পার্থক্যগুলি হল - 

চরিত্রগত পার্থক্যঃ পৌরাণিক কাহিনীতে বিভিন্ন ঈশ্বরের কর্মকাণ্ড ও তাঁদের শক্তির ওপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়। পৌরাণিক কাহিনীগুলির নায়ক - নায়িকা হলেন দেবদেবীরা। অন্যদিকে ইতিহাসে গুরুত্ব আরোপ করা হয় মানুষের কর্মকাণ্ড ও শক্তির ওপর, সেই দিক থেকে দেখলে ইতিহাসের নায়ক - নায়িকা হল মানবমানবী, ইতিহাস হল মানুষের কাহিনি। 

ভিত্তিগত পার্থক্যঃ পৌরাণিক কাহিনীগুলি ধর্মভিত্তিক হয়। পৃথিবীর সৃষ্টি, মানুষের সৃষ্টির পৌরাণিক ব্যাখ্যা দেয় কিন্তু ইতিহাসের কর্মকাণ্ড পৃথিবী ও মানুষের সৃষ্টির যুক্তিসম্মত ব্যাখ্যা তুলে ধরে। 

লক্ষণগত পার্থক্যঃ পৌরাণিক কাহিনীর প্রধান লক্ষ্য ঈশ্বরের মাহাত্ম্য প্রচার ও মানুষকে নৈতিক জ্ঞানদান করা কিন্তু ইতিহাসের প্রধান লক্ষ্য সত্যকে প্রতিষ্ঠা করা। 

বাস্তবতার পার্থক্যঃ পৌরাণিক কাহিনীর কল্পনার আধিক্য বেশি, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই কোনো বাস্তবতা নেই, নেই কোনো তথ্য বা প্রমাণ কিন্তু ইতিহাসের বাস্তবতা আছে। প্রতিটি ঘটনার তথ্য বা প্রমাণ থাকে। তথ্য বা প্রমাণ ছাড়া ইতিহাস হতে পারে না। 

সময়গতঃ পৌরাণিক কাহিনীগুলির সময়ের ভিত্তিতে কোনো ধারাবাহিকতা বা কালপঞ্জি থাকে না কিন্তু ইতিহাসের সময়ের ভিত্তিতে ধারাবাহিকতা ও সঠিক কালপঞ্জি থাকে।

২৮) "অধিকার-বিলোপ আমরা নিশ্চয়ই ঘটাইতে পারি। সমগ্র জগতের সম্মুখে ইহাই যথার্থ কাজ। প্রত্যেক জাতি ও প্রত্যেক দেশের সামাজিক জীবনে ইহাই একমাত্র সংগ্রাম। এক শ্রেণীর লোক অপর শ্রেণীর লোক অপেক্ষা স্বভাবতই বেশী বুদ্ধিমান—ইহা আমাদের সমস্যা নয়; আমাদের সমস্যা হইল এই যে, বুদ্ধির আধিক্যের সুযোগ লইয়া এই শ্রেণীর লোক অল্পবুদ্ধি লোকেদের নিকট হইতে তাহাদের দৈহিক সুখস্বাচ্ছন্দ্যও কাড়িয়া লইবে কিনা। এই বৈষম্যকে ধ্বংস করিবার জন্যই সংগ্রাম। কেহ কেহ অন্যান্য ব্যক্তি অপেক্ষা অধিকতর দৈহিক বলশালী হইবে এরূপে স্বভাবতই দুর্বল লোকদিগকে দমন বা পরাজয় করিতে সমর্থ হইবে—ইহা তো স্বতঃসিদ্ধ ব্যাপার, কিন্তু এই শারীরিক শক্তির জন্য তাহারা জীবনের যাহা কিছু সুখস্বাচ্ছন্দ্য লাভ করা যায়, তাহাই নিজেদের জন্য কাড়িয়া লইবে—এই প্রকার অধিকার-বোধ তো নীতিসম্মত নয় এবং ইহার বিরুদ্ধেই সংগ্রাম চলিয়া আসিতেছে। একদল লোক স্বভাবসিদ্ধ প্রবণতাবশতঃ অন্যের অপেক্ষা বেশী ধনসঞ্চয় করিতে পারিবে—ইহা তো স্বাভাবিক। কিন্তু ধনসঞ্চয়ের এই সামর্থ্য-হেতু তাহারা অসমর্থ ব্যক্তিদের উৎপীড়ন এবং নিষ্ঠুরভাবে পদদলিত করিবে—ইহা তো নীতিসম্মত নয়; এই অধিকারের বিরুদ্ধেই সংগ্রাম চলিয়া আসিতেছে। অন্যকে বঞ্চিত করিয়া নিজে সুবিধা ভোগ করার নামই অধিকারবাদ এবং যুগযুগান্ত ধরিয়া নীতিধর্মের লক্ষ্য এই অধিকারবাদকে ধ্বংস করা। বৈচিত্র্যকে নষ্ট না করিয়া সাম্য ও ঐক্যের দিকে অগ্রসর হওয়াই একমাত্র কাজ।

এই-সকল বৈচিত্র্য পার্থক্য অনন্তকাল বিরাজ করুক। এই বৈচিত্র্য জীবনের অপরিহার্য সারবস্তু। এভাবেই আমরা অনন্তকাল খেলা করিব। তুমি হইবে ধনী এবং আমি হইব দরিদ্র; তুমি হইবে বলবান্ এবং আমি হইব দুর্বল; তুমি হইবে বিদ্বান্ এবং আমি হইব মূর্খ; তুমি হইবে অত্যন্ত আধ্যাত্মিক-ভাবাপন্ন, আমি হইব অল্প আধ্যাত্মিক। তাহাতে কি আসে যায়? আমাদিগকে এরূপই থাকিতে দাও, কিন্তু তুমি আমা অপেক্ষা শারীরিক ও মানসিক শক্তিতে অধিকতর বলবান্ বলিয়া আমা অপেক্ষা বেশী অধিকার ভোগ করিবে, ইহা হইতে পারে না; আমা অপেক্ষা তোমার ধনৈশ্বর্য বেশী আছে বলিয়া তুমি আমা অপেক্ষা বড় বিবেচিত হইবে, ইহাও হইতে পারে না, কারণ অবস্থার পার্থক্য সত্ত্বেও আমাদের ভিতরে সেই একই সমতা বর্তমান।

বাহ্যজগতে পার্থক্যের বিনাশ এবং সমতার প্রতিষ্ঠা—কখনই নৈতিক আচরণের আদর্শ নয়, এবং কখনও হইবে না। ইহা অসম্ভব, ইহা মৃত্যু ও ধ্বংসের কারণ হইবে।" (পৃষ্ঠা ২৬০)

মতামত: সামন্ততান্ত্রিক প্রভুদের প্রতি নির্লজ্জ অনুগত্য প্রদর্শন। 

যুগ যুগ ধরে ঠিক এইভাবেই ধর্মব্যবসায়ীরা সাধারণ শ্রমজীবী মানুষের মনে পরজন্ম, কর্মফল, পাপ, পুণ্য নামক কুসংস্কারগুলোকে রোপন করে, সমাজের সামন্ততান্ত্রিক প্রভুদের শ্রমজীবী মানুষকে শোষনের ক্ষেত্রকে প্রস্তুত করেছে। স্বামী বিবেকানন্দের এই বক্তব্য সেই শোষণভিত্তিক কাঠামোকে টিকিয়ে রাখার স্বার্থেই।

২৯) "ভারতের যাবতীয় মনোবিজ্ঞান একই প্রকার, উহা প্রাচীন সাংখ্য মনস্তত্ত্বের অনুরূপ।" (পৃষ্ঠা ২৬২)

মতামত: স্বামীজীর জানা ছিল না যে বিজ্ঞান কোনোদিন কোনো দেশের, ধর্মের, বর্ণের বা জাতির হতে পারে না।

৩০) "যাঁহারা উপনিষদ্ পাঠ করিয়াছেন, তাঁহারা জানেন যে, উপনিষদই বারংবার বলিতেছে, ‘শুধু পড়িয়া শুনিয়া কেহ আত্মজ্ঞান লাভ করিতে পারে না।’" (পৃষ্ঠা ২৭৭)

মতামত: স্বামীজী তাঁর ভক্তদের আধুনিক শিক্ষা থেকে বঞ্চিত করে নির্গুণ ব্রহ্মের খোঁজ নিয়ে ব্যস্ত রাখতে বিশেষ আগ্রহী।

৩১) "আমরা সকলেই ইন্দ্রিয়ের দাস, নিজেদের চেতন ও অবচেতন মনের দাস। কোন অপরাধী যে স্বেচ্ছায় কোন অপরাধ করে—তাহা নয়, শুধু নিজের মন তাহার আয়ত্তে না থাকাতেই সে ঐরূপ করিয়া থাকে, এবং এইজন্য সে তাহার চেতন ও অবচেতন মনের, এমন কি প্রত্যেকের মনেরও দাস হয়। সে নিজ মনের প্রবলতম সংস্কারবশেই চালিত হয়। সে নিরুপায়। সে নিজ মনের ইচ্ছার বিরুদ্ধে—বিবেকের কল্যাণকর নির্দেশ এবং নিজের সৎস্বভাবের বিরুদ্ধে চলিতে থাকে। সে তাহার মনের প্রবল নির্দেশ মানিয়া চলিতে বাধ্য হয়। বেচারী মানুষ নিতান্তই অসহায়।" (পৃষ্ঠা ২৯৫)

"দাগী চোর-ডাকাতেরা, মিথ্যাবাদীরা, অন্যায়কারী নর-নারী—সকলেই নিজ নিজ অনিচ্ছা সত্ত্বেও ঐরূপ হইয়া গিয়াছে। ইহা সত্যই মনস্তত্ত্বের একটি বড় সমস্যা। মানুষের বিচার—আমাদিগকে অতি উদার সহৃদয় দৃষ্টি লইয়াই করিতে হইবে।" (পৃষ্ঠা ৩৪৭)

মতামত: ব্যাস আর কী! দেশের সব চোর, ডাকাত, খুনি, ধর্ষক, সাজাপ্রাপ্ত অপরাধীদের জেল থেকে বের করে রামকৃষ্ণ মিশনে পাঠিয়ে দেওয়া হোক।
 
৩২) "তোমাদের নিকট প্রথমে আমার নিজের অভিজ্ঞতালব্ধ কয়েকটি ঘটনারই উল্লেখ করিব। একবার এক ব্যক্তির কথা শুনিয়া-ছিলাম; মনে মনে কোন প্রশ্ন ভাবিয়া তাঁহার কাছে যাওয়া মাত্রই তিনি সেই প্রশ্নের উত্তর দিয়া দিতেন; আরও শুনিয়াছিলাম, তিনি ভবিষ্যদ্বাণীও করেন। মনে কৌতূহল জাগিল; তাই কয়েকজন বন্ধুসঙ্গে তাঁহাকে দেখিতে গেলাম। প্রত্যেকেই মনে মনে কোন-না-কোন প্রশ্ন ঠিক করিয়া রাখিলাম এবং পাছে ভুল হয়, সেজন্য প্রশ্নগুলি এক এক খণ্ড কাগজে লিখিয়া নিজ নিজ জামার পকেটে রাখিয়া দিলাম। আমাদের এক একজনের সঙ্গে তাঁহার যেমনি দেখা হইতে লাগিল, অমনি তিনি তাঁহার প্রশ্নের পুনরাবৃত্তি করিয়া উত্তর বলিয়া দিতে লাগিলেন। পরে একখণ্ড কাগজে কি লিখিয়া কাগজটি ভাঁজ করিয়া আমার হাতে দিলেন, এবং তাহার অপর পিঠে আমাকে নাম স্বাক্ষর করিতে অনুরোধ করিয়া বলিলেন, ‘এটি দেখিবেন না, পকেটে রাখিয়া দিন; যখন বলিব, তখন বাহির করিবেন।’ আমাদের সকলের সঙ্গেই এই রকম করিলেন। তারপর আমাদের ভবিষ্যৎ জীবনে ঘটিবে, এমন কয়েকটি ঘটনার কথাও বলিলেন। অবশেষে বলিলেন, ‘আপনাদের যে ভাষায় খুশী, কোন শব্দ বা বাক্য চিন্তা করুন।’ আমি সংস্কৃত ভাষায় একটি প্রকাণ্ড বাক্য মনে মনে আওড়াইলাম; সংস্কৃতের বিন্দু-বিসর্গও তিনি জানিতেন না। তিনি বলিলেন, ‘পকেট হইতে কাগজটি বাহির করুন তো!’ দেখি, তাহাতে সেই সংস্কৃত বাক্যটিই লেখা রহিয়াছে! এক ঘণ্টা আগে তিনি এটি লিখিয়াছিলেন, আর নীচে মন্তব্য দিয়াছিলেন, ‘যাহা লিখিয়া রাখিলাম, ইনি পরে সেই বাক্যটিই ভাবিবেন’—ঠিক তাহাই হইল। আমাদের অন্য একজন বন্ধুকেও অনুরূপ একখানি কাগজ দিয়াছিলেন, এবং তিনিও তাহা স্বাক্ষর করিয়া পকেটে রাখিয়াছিলেন। এখন বন্ধুটিকেও একটি বাক্য চিন্তা করিতে বলিলে তিনি কোরানের একাংশ হইতে আরবী ভাষায় একটি বাক্য ভাবিলেন। ঐ ব্যক্তির সে ভাষা জানিবার সম্ভাবনা ছিল আরও কম। বন্ধুটি দেখিলেন, সেই বাক্যটিই কাগজে লেখা আছে।

সঙ্গীদের মধ্যে আর একজন ছিলেন ডাক্তার। তিনি জার্মান ভাষায় লিখিত কোন ডাক্তারি পুস্তক হইতে একটি বাক্য ভাবিলেন। তাঁহার কাগজে তাহাই পাওয়া গেল।

সেদিন হয়তো কোনরূপ প্রতারিত হইয়াছি ভাবিয়া কিছুদিন পরে আমি আবার সেই ব্যক্তির নিকট গেলাম। সেদিন আমার সঙ্গে নূতন আর একদল বন্ধু ছিলেন। সেদিনও তিনি অদ্ভুত সাফল্যের পরিচয় দিয়াছিলেন।" (পৃষ্ঠা ২৯৯)

মতামত: সামন্তবাদী প্রভুদের স্বার্থে সাধারণ শ্রমজীবী মানুষের মধ্যে অন্ধবিশ্বাসের বীজ বপন করতে উদ্যত স্বয়ং স্বামী বিবেকানন্দ। এরকম উদাহরণ আরো আছে।

যদি স্বামীজীর কথা সত্যি হয়, সেক্ষেত্রে এমন একজন সিদ্ধ পুরুষ জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ড নিয়ে আমাদের দেশের মানুষকে আগেভাগে সতর্ক করলেন না কেন - সে প্রশ্ন থেকেই যায়! 

৩৩) "কোন হ্রদের তলদেশ হইতে একটি বুদ‍্বুদ উঠিতেছে; যখন হ্রদের উপরে উঠিয়া উহা ফাটিয়া যায়, তখনই মাত্র উহা আমাদের নজরে পড়ে, তলদেশ হইতে উপরে উঠিয়া আসিবার মধ্যে কোন সময়ই সেটিকে দেখিতে পাই না।" (পৃষ্ঠা ৩০৫)

মতামত: আধুনিক বিজ্ঞানের অগ্রগতির সাথে সাথে এখন বুদবুদের শুরু থেকে শেষ অবধি ক্যামেরা বন্দি করা যায়; আজকের দিনে দাঁড়িয়ে রামকৃষ্ণ মিশন স্বামীজীর এই অবৈজ্ঞানিক বক্তব্যটাকে অসার ও ভিত্তিহীন বলে স্বীকার করবে কী?

৩৪) "অর্থ ও অন্যান্য জাগতিক বস্তু দান করিয়া অপরকে সাহায্য করা বা দৈনন্দিন জীবনে কিভাবে নির্ঝঞ্ঝাটে চলা যায়, তাহা শিক্ষা দেওয়া—এ-সব নিতান্তই তুচ্ছ আনুষঙ্গিক কার্য মাত্র।" (পৃষ্ঠা ৩০৭)

মতামত: রামকৃষ্ণ মিশন তার ভক্তকুলের থেকে আর্থিক দান গ্রহণ করা বন্ধ করলে, ভক্তকুল এইসব তুচ্ছ আনুষঙ্গিক কাজগুলো থেকে মুক্ত হবে।

৩৫) "বৈজ্ঞানিক পরীক্ষণ অর্থে ইহাই বুঝিতে হয় যে, কতগুলি তথ্যকে এমন সাধারণ স্তরে নামাইয়া আনা হইবে যে, ঐগুলি সকল মানুষের পক্ষে সমভাবে গ্রহণীয় হইবে, ঐগুলি সকলের দ্বারা অনুভূত হইবে, তাহা হইলে কোন বিষয়ে যে এইরূপ কোন বৈজ্ঞানিক পরীক্ষণ সম্ভব—ইহা আমি সম্পূর্ণভাবে অস্বীকার করি।" (পৃষ্ঠা ৩১২)

মতামত: এক মূর্খ চাষার বাড়িতেও একটা সুইচের সাহায্যে আলো জ্বলে - বিজ্ঞান সাধারণ স্তরে গ্রহণীয় ও অনুভূত হওয়া অসম্ভব কিছু নয়!

৩৬) "নিজ মস্তিষ্ক সম্পর্কে কেহই সচেতন নয়। আমি আমার মস্তিষ্ক কখনই দেখি নাই, এবং ইহার সম্পর্কে আমি কোন সময়েই সচেতন নই। তথাপি আমি জানি, মস্তিষ্ক আছে।" (পৃষ্ঠা ৩১৪)

মতামত: বর্তমানে বিজ্ঞানের অভূতপূর্ব আবিষ্কারের ফলে ইহাও সম্ভব হয়েছে। এগুলো ধর্ম, বেদান্ত দিয়ে সম্ভবপর হয়নি, সম্ভব হয়েছে বিজ্ঞানের অগ্রগতির দ্বারা।

৩৭) "ভারতে কিন্তু এমন লোকও আছে, যে বিশ্বাস করে—মন্ত্রশক্তির দ্বারা অর্থলাভ সম্ভব। তাই সেখানে দেখা যাইবে যে, ধনাকাঙ্ক্ষী হয়তো বৃক্ষতলে বসিয়া মন্ত্রের মাধ্যমে ধন কামনা করিতেছে। (চিন্তার) শক্তিতে সব-কিছু তাহার নিকট আসিতে বাধ্য।" (পৃষ্ঠা ৩২১)

মতামত: এত মন্ত্রোচ্চারণের পরেও এই ধর্মবিশ্বাসীদের দেশে জাতীয় আয়ের ৫৭ শতাংশের মালিক জনসংখ্যার উপরের দিকের ১০ শতাংশ আর সেখানে নীচের ৫০ শতাংশের উপার্জন, জাতীয় আয়ের মাত্র ১৩.১ শতাংশ। সামন্ততন্ত্রের তাঁবেদার স্বামী বিবেকানন্দ এই বৈষম্যের মূলে আঘাত করতে অপারগ।

https://bengali.abplive.com/news/world-inequality-report-2022-india-poor-very-unequal-country-851565

৩৮) "যদি তুমি তোমার দেয় অংশ উঠাইয়া লইতে সমর্থ হও, তবে জলের উপর দিয়াও তুমি হাঁটিতে পারিবে। জল আর তোমাকে ডুবাইবে কেন?" ( পৃষ্ঠা ৩৩২)

"ধ্যানাভ্যাসই জ্ঞানলাভের বিজ্ঞানসম্মত পন্থা। ধ্যানের শক্তি ব্যতীত জ্ঞান হয় না। ধ্যানশক্তির প্রয়োগে অজ্ঞান, কুসংস্কার ইত্যাদি হইতে আমরা সাময়িকভাবে মুক্ত হইতে পারি, ইহার বেশী নয়। মনে কর, এক ব্যক্তি আমাকে বলিয়াছে যে, এই বিষ পান করিলে মৃত্যু হইবে এবং আর এক ব্যক্তি রাত্রে আসিয়া বলিল, ‘যাও, বিষ পান কর!’ এবং বিষ খাইয়াও আমার মৃত্যু হইল না (যাহা ঘটিল তাহা এই)—ধ্যানের ফলে বিষ ও আমার নিজের মধ্যে একত্ববোধ হইতে সাময়িকভাবে আমার মন বিচ্ছিন্ন হইয়াছিল। অপর পক্ষে সাধারণভাবে বিষ পান করিতে গেলে মৃত্যু অবশ্যম্ভাবী ছিল।

যদি আমি কারণ জানি এবং বৈজ্ঞানিক উপায়ে আমাকে ধ্যানের অবস্থায় উন্নীত করি, তবে যে-কোন লোককেই আমি বাঁচাইতে পারি। এই কথা (যোগ)-গ্রন্থে লিপিবদ্ধ আছে, কিন্তু ইহা কতখানি নির্ভুল, তাহার বিচার তোমরাই করিও।" (পৃষ্ঠা ৩৩৩)

"যোগীদের মধ্যে কেহ কেহ দাবী করেন যে, এই শরীর তরল বাষ্প ইত্যাদিতে পরিণত হইবে। তুমি শরীর দ্বারা যাহা খুশী করিতে পারিবে—ইহাকে ছোট করিতে পার, এমন কি বাষ্পেও পরিণত করিতে পার, এই দেওয়ালের মধ্য দিয়া যাতায়াতও সম্ভব হইতে পারে—এই রকম তাঁহারা দাবী করেন। আমার অবশ্য তাহা জানা নাই। আমি কখনও কাহাকেও এরূপ করিতে দেখি নাই। কিন্তু যোগশাস্ত্রে এই-সব কথা আছে। যোগশাস্ত্রগুলিকে অবিশ্বাস করিবার কোন হেতু নাই।" (পৃষ্ঠা ৩৩৬)

"তোমার নিজের প্রাণকে যেমন তুমি নিয়ন্ত্রিত করিতে পার, তেমনি যথেষ্ট শক্তিমান্ হইলে এখানে বসিয়াই ভারতে অবস্থিত অপর একজনের প্রাণকেও তুমি নিয়ন্ত্রিত করিতে পারিবে। সব প্রাণই এক, মাঝখানে কোন ছেদ নাই; একত্বই সর্বত্র বিদ্যমান।" (পৃষ্ঠা ৩৪৫) 

"শরীরের ভিতরে যে-সব যন্ত্রের কাজকে আমরা স্বয়ংক্রিয় বলিয়া থাকি, যেমন যকৃতের ক্রিয়া, সেগুলিকে পর্যন্ত নিজের ইচ্ছাধীন করা যায়।" (পৃষ্ঠা ৩৪৯)

মতামত: মুখে কুসংস্কার বিরোধিতার বুলি আওড়ে বাস্তবে সাধারণ জনগণের মধ্যে কুসংস্কারের প্রচার।

৩৯) "মানসিক শক্তির দ্বারা লোকের রোগ সারাইতে আমি দেখিয়াছি। উহা ‘অলৌকিক কর্মী’র কাজ। আমরা বলি, তিনি প্রার্থনা করিয়া লোককে নীরোগ করেন। (কিন্তু) কেহ বলিবেন, ‘না, মোটেই না, ইহা কেবল তাঁহার মনের শক্তির ফল। লোকটি বৈজ্ঞানিক। তিনি জানেন, তিনি কি করিতেছেন।’

ধ্যানের শক্তি আমাদিগকে সব কিছু দিতে পারে। যদি তুমি প্রকৃতির উপর আধিপত্য চাও, (ইহা ধ্যানের অনুশীলনেই সম্ভব হইবে)। আজকাল বিজ্ঞানের সকল আবিষ্ক্রিয়াও ধ্যানের দ্বারাই হইতেছে।" (পৃষ্ঠা ৩৩২)

মতামত: সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন মন্তব্য। স্বামী বিবেকানন্দের গুরু রামকৃষ্ণদেবের শরীর খারাপের সময় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিতীয় এমডি ডাঃ মহেন্দ্রলাল সরকার দেখতেন, মানসিক শক্তি দিয়ে রোগীকে কিন্তু সারানো যায়নি। এইসব এইসব ধর্মের ঠিকাদাররা ভক্তদের যা জ্ঞান দেন, সেগুলো নিজেদের জীবনে তখনও মানেননি আর এখনও মানেন না।

আজকের দিনে ভারতের যোগগুরু বলে খ্যাতনামা বাবা রামদেবকেও প্রাণে বাঁচতে সেই আধুনিক চিকিৎসা শাস্ত্রের ওপরই নির্ভর করতে হয়।

https://www.bbc.com/bengali/news/2011/06/110606_mb_ramdev_hospital   

ধ্যানের দ্বারাই যদি বাবাজীরা সব রোগ সরিয়ে দিতে পারতেন তাহলে দেশে এত আধুনিক হাসপাতালের প্রয়োজন কী? করোনা পরিস্থিতিতে সব ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের দরজা বন্ধ রাখতে হয়েছিল কেন? এই সম্বন্ধে করোনা মহামারীর সময় পড়া চারটে লাইন খুবই গুরুত্বপূর্ণ -

"যদি বেঁচে যাও এবারের মতো
যদি কেটে যায় মৃত্যুর ভয়
জেনো বিজ্ঞান লড়েছিলো একা
মন্দির মসজিদ নয়"

৪০) "মেয়েরাও পুরুষদের মত সমান সাহসী। নিজ নিজ ভাবে প্রত্যেকেই ভাল। নারী যে ধৈর্য, সহিষ্ণুতা ও স্নেহ লইয়া সন্তান পালন করে, কোন্ পুরুষ সেভাবে তাহা করিতে পারে? একজন কর্মশক্তিকে বাড়াইয়া তুলিয়াছে, অপরজন বাড়াইয়াছে সহনশক্তি। যদি বল, মেয়েরা তো শারীরিক শ্রম করিতে পারে না, তবে বলিব, পুরুষরাও তো সহ্য করিতে পারে না। সমগ্র জগৎটি একটি নিখুঁত ভারসাম্যের ব্যাপার।" (পৃষ্ঠা ৩৪১)

মতামত: মনুবাদী মতের সমর্থন। 

মনুসংহিতার ৯/২৬ শ্লোকে আমরা দেখতে পাই - সন্তানের হেতু স্ত্রীলোকেরা বহুকল্যাণভাজন, (বস্ত্রালংকারাদি দ্বারা) পুজনীয়া, গৃহশোভাকারিণী ; গৃহে স্ত্রীলোক ও শ্ৰী (লক্ষ্মী)তে কোন ভেদ নেই।

আর ৯/২৭ শ্লোকে আছে - সন্তানোৎপাদন, জাতসন্তানের প্রতিপালন ও প্রতিদিন (অতিথিসেবাদি) লোক-ব্যবহারের প্রত্যক্ষ কারণ স্ত্রী। (মনুসংহিতা – অনুবাদ : সুরেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়) 

৪১) "পতিতা নারীকে দেখিয়া আমাকে নাসিকা কুঞ্চিত করিতে হয়, কারণ সমাজ তাহাই চায়, যদিও সে আমার ত্রাণকর্ত্রী, যদিও তাহার পতিতাবৃত্তির ফলে অপর স্ত্রীলোকের সতীত্ব রক্ষা পাইতেছে। কথাটি ভাবিয়া দেখ।" (পৃষ্ঠা ৩৪৮)

মতামত: স্বামীজী দ্বিতীয় খণ্ডে নিজেই বলেছিলেন, " জনৈক সাধু বৃক্ষতলে বসিয়া লোককে ধর্মোপদেশ দিতেন। তিনি শুধু দুধ ও ফলমূল আহার করিয়া এবং প্রাণায়ামাদি অভ্যাস করিয়া নিজেকে খুব পবিত্র মনে করিতেন। সেই গ্রামে এক চরিত্রহীনা নারী বাস করিত। দুষ্কার্যের জন্য নরকে যাইতে হইবে—এই বলিয়া সাধু প্রত্যহই ঐ নারীর নিকট গিয়া তাহাকে সাবধান করিয়া দিতেন। হতভাগিনী তাহার জীবিকা উপার্জনের একমাত্র পথ পরিবর্তন করিতে অক্ষম হইয়া সাধু-কথিত ভয়াবহ পরিণামের চিন্তায় শঙ্কিত হইয়া থাকিত। নিরুপায় ঐ নারী কাঁদিয়া, ভগবানের নিকট প্রার্থনা করিয়া ক্ষমা ভিক্ষা করিত। এই সাধু ও ভ্রষ্টা নারীর মৃত্যু হইলে দেবদূতেরা আসিয়া সেই নারীটিকে স্বর্গে লইয়া গেল, আর যমদূতেরা আসিয়া সাধুর আত্মা দাবী করিল। সাধু উচ্চৈঃস্বরে জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘একি? আমি কি কঠোর সাধুজীবন যাপন করিয়া সকলের মধ্যে ধর্ম প্রচার করি নাই? আমি কেন নরকে যাইব, আর এই ভ্রষ্টা নারী স্বর্গে যাইবে?’ যমদূতগণ বলিল, ‘নারীটি দেহ দ্বারা পাপ কাজ করিতে বাধ্য হইলেও তাহার মন সর্বদা ভগবানে নিবিষ্ট ছিল এবং সে মুক্তি কামনা করিয়াছিল। সেই মুক্তি এখন সে লাভ করিয়াছে। আর তুমি বাহিরে ধর্ম-কার্য করিয়াছ, তোমার মন কিন্তু অপরের পাপের দিকেই সর্বদা নিবিষ্ট থাকিত। তুমি পাপই দেখিয়াছ, পাপই চিন্তা করিয়াছ; সুতরাং যেখানে কেবলই পাপ, তোমাকে সেই স্থানেই যাইতে হইবে।’ এই গল্পের শিক্ষণীয় বিষয়টি অতি স্পষ্টঃ বাহ্য জীবন যাপনের দ্বারা কোন ফলই হয় না। হৃদয় পবিত্র হওয়া চাই; পবিত্রহৃদয় ব্যক্তি পাপ না দেখিয়া কেবল পুণ্যই দেখে। মানবজাতির অভিভাবক অথবা পাপীতাপীর উদ্ধারকর্তা সাধুরূপে দাঁড়াইবার চেষ্টা করা আমাদের পক্ষে উচিত নয়। তাহার পরিবর্তে নিজদিগকে পবিত্র করিতে চেষ্টা করিব। ইহার ফলে আমরা অপরের ধর্মলাভেরও সহায় হইতে পারিব।" (পৃষ্ঠা ৩২২)

দুটি বক্তব্য সম্পূর্ণ পরস্পর বিরোধী।

আবার সমাজ সম্বন্ধে স্বামীজীর বক্তব্য হলো, "যে-কোন নীতিশাস্ত্র মানুষকে তাহার নিজ সমাজের গণ্ডীর মধ্যেই আবদ্ধ রাখিতে ইচ্ছা করে, তাহা সমগ্র মানবজাতির পক্ষে প্রযোজ্য নৈতিক বিধি ব্যাখ্যা করিতে অক্ষম।" (পৃষ্ঠা ৮৯)

স্বামী বিবেকানন্দ তাঁর বক্তব্যে অপরাধীদের জন্যও সমবেদনা প্রকাশ করতে পারেন (দেখুন - ৩১) কিন্তু গতর খাটিয়ে জীবনধারণ করা এক নারীর জন্য তাঁর কোনো সমবেদনা নেই।  

৪২) "ধর্ম হইতে আমরা যে-সকল তথ্য ও তত্ত্ব শিক্ষা করিতে পারি, যে-সান্ত্বনা পাইতে পারি, তাহা ছাড়িয়া দিলেও ধর্ম অন্যতম বিজ্ঞান অথবা গবেষণার বস্তু হিসাবে মানব-মনের শ্রেষ্ঠ ও সর্বাধিক কল্যাণকর অনুশীলনের বিষয়।" (পৃষ্ঠা ৯১)

"বিজ্ঞানগুলির জ্ঞান যেন আমাদের জীবনের একটুখানি অংশ জুড়িয়া আছে। কিন্তু ধর্ম আমাদের কাছে যে জ্ঞান লইয়া আসে, তাহা চিরন্তন; ধর্ম যে সত্যের কথা প্রচার করে, সে সত্যের মত এ জ্ঞানও সীমাহীন।" (পৃষ্ঠা ৯৪)

"পদার্থবিদ্যা বা রসায়নের সিদ্ধান্তগুলি যতখানি বিজ্ঞানসম্মত, ধর্ম যে অন্ততঃ ততখানি বিজ্ঞানসম্মত হইবে শুধু তাহাই নয়, বরং আরও বেশী জোরালো হইবে; কারণ জড়বিজ্ঞানের সত্যগুলির পক্ষে সাক্ষ্য দিবার মত অভ্যন্তরীণ আদেশ বা নির্দেশ কিছু নাই, কিন্তু ধর্মের তাহা আছে।" (পৃষ্ঠা ৯৫)

"উচ্চতম সামান্যীকরণ এবং বিবর্তনবাদের কথা বেদান্তে আছে বলিয়া বেদান্তের ধর্ম বৈজ্ঞানিক জগতের দাবী মিটাইতে পারে।" (পৃষ্ঠা ১০১)

"সমস্ত ধর্ম যে সত্যের সন্ধানে রত, যে সত্যের তুলনায় জড়বিজ্ঞানের সব জ্ঞানই গৌণ মাত্র, আমরা সেই সত্যের সন্ধান পাইয়াছি; ইহাই একমাত্র সত্যজ্ঞান, যাহা আমাদিগকে বিশ্বের এই বিশ্বজনীন ঈশ্বরের সঙ্গে এক করিয়া দেয়।" (পৃষ্ঠা ১০৮)

"প্রত্যেক জড়বিজ্ঞান ঐক্যের সন্ধান পাইলেই শেষ হইবে, কারণ ইহার বেশী আর আমরা যাইতে পারি না। পূর্ণ ঐক্যে পৌঁছিলে তত্ত্বের দিক্ দিয়া বিজ্ঞানের আর বেশী কিছুই বলিবার থাকে না।" (পৃষ্ঠা ২০৬)

"বিভিন্ন প্রকৃতি অনুযায়ী এই রাজযোগ-বিজ্ঞানের প্রয়োগ বিভিন্নভাবে হয়।" (পৃষ্ঠা ২২১) 

"জড়বিজ্ঞানের বিপরীত অধ্যাত্ম বিজ্ঞানের বিরুদ্ধে আজ সারা বিশ্বে এক মহা সোরগোল পড়িয়া গিয়াছে। আমাদের ঐহিক জীবন ও এই পরিদৃশ্যমান জগৎকে দৃঢ় ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত করিবার জন্য আমাদের ইন্দ্রিয়জ্ঞানের সীমার বহির্ভূত সকল ভাবের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করা অতি দ্রুত একটি ফ্যাশনে পরিণত হইতেছে, এমন কি ধর্মপ্রচারকেরাও একের পর এক এই ফ্যাশনের নিকট আত্মসমর্পণ করিতেছেন। অবশ্য চিন্তাহীন জনসাধারণ সর্বদা সুখাবহ ভাবরাশিই অনুসরণ করে, কিন্তু যাঁহাদের নিকট অধিকতর জ্ঞান আশা করা যায়, তাঁহারা যখন নিজেদের দার্শনিক বলিয়া প্রচার করেন এবংঅর্থহীন ফ্যাশন অনুসরণ করেন, তখন উহা সত্যই শোচনীয়।" (পৃষ্ঠা ২২৫)

"যদি কেহ মনে করে, মানুষের সমগ্র জ্ঞান শুধু ইন্দ্রিয়ের অনুভূতি—আর কিছু নয়, তবে আমরা ঐকথা অস্বীকার করিব। যদি প্রাকৃতিক বিজ্ঞান বলিতে ইন্দ্রিয়লব্ধ জ্ঞানই বুঝায়—তার বেশী আর কিছু নয়, তবে আমরা বলিব, এরূপ বিজ্ঞান কোন দিন ছিল না, কোন দিন হইবেও না। উপরন্তু শুধু ইন্দ্রিয়জ্ঞানের উপর প্রতিষ্ঠিত কোন জ্ঞান কখনও বিজ্ঞান বলিয়া গৃহীত হইতে পারিবে না।" (পৃষ্ঠা ২২৬)

"এখন জড়বস্তু, শক্তি, মন, নিয়ম, কারণ, দেশ, কাল প্রভৃতি ভাবগুলি অতি উচ্চ বিমূর্তনের ফল; কেহই কোনদিন এগুলি ইন্দ্রিয় দ্বারা অনুভব করে নাই; অথবা বলা যায়, এগুলি একেবারে অতিপ্রাকৃতিক বা অতীন্দ্রিয় অনুভূতি। অথচ এগুলি ছাড়া কোন প্রাকৃতিক তথ্য বোঝা যায় না।" (পৃষ্ঠা ২২৬)

"পাশ্চাত্য বৈজ্ঞানিক একমাত্র অণু বা পরমাণুর মধ্যে ঐক্যের সন্ধান করেন। যখন তিনি উহা প্রাপ্ত হন, তখন তাঁহার আর কোন কিছু আবিষ্কার করিবার থাকে না। আর আমরা যখন আত্মার বা স্ব-স্বরূপের ঐক্য দর্শন করি, তখন আর অধিক অগ্রসর হইতে পারি না। আমাদের নিকট তখন ইহা স্পষ্টই প্রতিভাত হয় যে, সেই একমাত্র সত্তাই ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য জগতের যাবতীয় বস্তুরূপে প্রতীত হইতেছে। অণুর নিজস্ব দৈর্ঘ্য বা বিস্তৃতি না থাকিলেও অণুগুলির মিশ্রণের ফলে দৈর্ঘ্য, প্রস্থ ও বিস্তৃতির উদ্ভব হয়—এইপ্রকার কথা স্বীকার করার সঙ্গে সঙ্গে বৈজ্ঞানিকদিগকে বাধ্য হইয়া অধ্যাত্মশাস্ত্রের সত্যতাও স্বীকার করিতে হয়।" (পৃষ্ঠা ২৩৯)

"এই-সকল বিভিন্ন কেন্দ্রকে নিয়ন্ত্রণ করিতে পারে, এইরূপ কোন একটি বিশেষ কেন্দ্র শারীরবিজ্ঞানে আবিষ্কৃত হয় নাই। সুতরাং ঐ-সকল বিভিন্ন কেন্দ্রের ঐক্য কোথায়, তাহা শারীরবিজ্ঞান আমাদের বলিতে পারে না। এই-সকল কেন্দ্রের ঐক্য কোথায় সংস্থাপিত? মস্তিষ্কস্থ কেন্দ্রগুলি পরস্পর-বিচ্ছিন্ন, এবং সকল কেন্দ্রকে নিয়ন্ত্রণ করিতে পারে—এরূপ কোন কেন্দ্র সেখানে নাই। সুতরাং ভারতীয় মনস্তত্ত্ব যতটুকু তথ্য আবিষ্কার করিয়াছে, তাহার বিরুদ্ধে আপত্তি করা চলে না।" (পৃষ্ঠা ২৬২)

"আমাদের এই শরীর জড়বস্তু নামে পরিচিত কতকগুলি কণিকার সমষ্টি মাত্র। ইহা অনুভূতিহীন ও অচেতন। বৈদান্তিকগণ যাহাকে সূক্ষ্মশরীর বলেন, তাহাও ঐরূপ। তাঁহাদের মতে এই সূক্ষ্মদেহটি স্বচ্ছ হইলেও জড়; ইহা অতি ক্ষুদ্র কণিকাদ্বারা গঠিত; এই কণিকাগুলি এত সূক্ষ্ম যে, অণুবীক্ষণ যন্ত্রসহায়েও সেগুলি দেখা যায় না।" (পৃষ্ঠা ২৬৩)

"নিউটনের জন্মের হাজার বছর আগে ভারতবাসীরা মাধ্যাকর্ষণের কথা জানিত।" (পৃষ্ঠা ৩০৮)

"যথাযথ নিয়ম অনুসরণ করিলে মনের অসাধ্য কিছুই নাই—এই বিষয়ে ভারতীয় মনে এতখানি দৃঢ়বিশ্বাস আসিয়াছিল যে, মনঃশক্তির গবেষণাই তাহার মহান্ লক্ষ্য হইয়া দাঁড়াইয়াছিল। তাঁহাদের নিকট সম্মোহন, যাদু ও এই জাতীয় অন্যান্য শক্তিগুলির কোনটিই অলৌকিক মনে হয় নাই। ইতঃপূর্বে ভারতীয়েরা যেভাবে যথানিয়মে জড়বিজ্ঞানের শিক্ষা দিতেন, তখন তেমনি যথা নিয়মে এই বিজ্ঞানটিও শিখাইতে লাগিলেন। এ বিষয়ে জাতির এত বেশী দৃঢ়-প্রত্যয় আসিয়াছিল যে, তাহার ফলে জড়বিজ্ঞান প্রায় লুপ্ত হইয়া গেল। তাহাদের দৃষ্টি নিবন্ধ রহিল শুধু এই একটি লক্ষ্যে।" (পৃষ্ঠা ৩০৮)

"সন্দেহাতীত সত্য বলিয়া বৈজ্ঞানিকেরা কিংবা সাধারণে বিশ্বাস করিতে পারেন—এইপ্রকার তত্ত্ব মাত্র দুই-তিনটিই আছে, অবশিষ্ট সবই শূন্যগর্ভ কল্পনা।" (পৃষ্ঠা ৩১৩)

"অনেক ক্ষেত্রেই উপস্থাপিত বিষয় সত্য নাও হইতে পারে, কিন্তু আবার অনেক ক্ষেত্রে আমরা নিজেরা সেই-সব প্রমাণ অনুধাবন করিবার উপযুক্ত কিনা এবং আমরা আমাদের দেহমনকে ঐ-সব আধ্যাত্মিক সত্য আবিষ্কারের উপযুক্ত আধাররূপে প্রস্তুত করিয়াছি কিনা, তাহা বিবেচনা করিতে ভুলিয়া যাই।" (পৃষ্ঠা ৩১৪)

"মুশকিল এই যে, অনেক ক্ষেত্রে যে-সকল অসাধারণ শক্তি তাহার আয়ত্তে আসিয়াছিল, অনুসন্ধান করিলে দেখা যায়, ঐগুলি কোন নিয়মিত বিজ্ঞানসম্মত শিক্ষাপ্রণালীর মাধ্যমে অর্জিত হয় নাই। যাহারা যাদুবলে সর্প বশীভূত করে, তাহাদের প্রাণ যায় সর্পাঘাতেই। ... কেহ যদি কোন অলৌকিক শক্তি লাভ করিয়া থাকে তো সে পরিণামে ঐ শক্তির কবলে পড়িয়াই বিনষ্ট হইবে। ভারতবর্ষে লক্ষ লক্ষ লোক নানাবিধ উপায়ে অলৌকিক শক্তি লাভ করে। তাহাদের অধিকাংশ উন্মাদরোগগ্রস্ত হইয়া মৃত্যুমুখে পতিত হয়। অনেকে আবার অপ্রকৃতিস্থ হইয়া আত্মহত্যা করে।" (পৃষ্ঠা ৩১৭)

"আমরা দার্শনিক দৃষ্টিতে দেখিয়াছি যে, আত্মা মন ভূত (জড় পদার্থ) প্রভৃতি নানা বৈচিত্র্যের (বাস্তব সত্তা কিছু নাই)। ... যাহা আছে, তাহা ‘একমেবাদ্বিতীয়ম্’। বহু কিছু থাকিতে পারে না। জ্ঞান এবং বিজ্ঞানের অর্থ ইহাই। অজ্ঞানের জন্যই বহু দেখি। জ্ঞানে একত্বের উপলব্ধি ...। বহুকে একে পরিণত করাই বিজ্ঞান ...। সমগ্র বিশ্বের একত্ব প্রমাণিত হইয়াছে। এই বিজ্ঞানের নাম বেদান্ত-বিদ্যা। সমগ্র জগৎ এক। আপাত প্রতীয়মান বৈচিত্র্যের মধ্যে সেই ‘এক’ অনুস্যূত হইয়া রহিয়াছে।" (পৃষ্ঠা ৩৩৫)

"কিন্তু একটি কথা তোমাদের স্মরণ রাখিতেই হইবে। ধর্মবিষয়ক কুসংস্কার যেমন আছে; বিজ্ঞানের ক্ষেত্রেও সেইরূপ কুসংস্কার আছে। এমন অনেক পুরোহিত আছেন, যাঁহারা ধর্মানুষ্ঠানকে নিজ জীবনের বৈশিষ্ট্যরূপে গ্রহণ করেন; তেমনি বৈজ্ঞানিক নামধেয় এমন অনেক আছেন, যাঁহারা প্রাকৃতিক নিয়মের পূজারী। ডারউইন বা হাক্সলির মত বড় বড় বৈজ্ঞানিকদের নাম করা মাত্র আমরা অন্ধভাবে তাঁহাদের অনুসরণ করি। এইটি আজকালকার চলিত প্রথা। যাহাকে আমরা বিজ্ঞানসম্মত জ্ঞান বলি, তাহার ভিতর শতকরা নিরানব্বই ভাগই হইতেছে নিছক মতবাদ। ইহাদের অনেকগুলি আবার প্রাচীনকালের বহু-মস্তক ও বহু-হস্তবিশিষ্ট ভূতে অন্ধ বিশ্বাস অপেক্ষা কোন অংশে উৎকৃষ্ট নয়; তবে পার্থক্য এইটুকু যে, কুসংস্কার হইলেও উহাতে মানুষকে গাছপাথর প্রভৃতি অচেতন পদার্থ হইতে অন্ততঃ খানিকটা আলাদা বলিয়া ভাবা হইত। যথার্থ বিজ্ঞান আমাদের সাবধানে চলিতে বলে। পুরোহিতদের সঙ্গে ব্যবহারে যেমন সতর্ক হইয়া চলিতে হয়, বিজ্ঞানীদের বেলায়ও তেমনি সতর্কতা আবশ্যক। অবিশ্বাস লইয়া শুরু কর। বিশ্লেষণ করিয়া পরীক্ষা করিয়া, সব প্রমাণ পাইয়া তবে বিশ্বাস কর। আধুনিক বিজ্ঞানের অতিপ্রচলিত বিশ্বাস এখনও প্রমাণোত্তীর্ণ হয় নাই। অঙ্কশাস্ত্রের মত বিজ্ঞানের ভিতরেও অনেকগুলি মতবাদই শুধু কাজ চালাইয়া যাইবার উপযুক্ত সাময়িক সিদ্ধান্ত হিসাবে গৃহীত হইয়াছে। উচ্চতর জ্ঞানের উন্মেষের সঙ্গে সঙ্গে সেগুলি বাতিল হইয়া যাইবে।" (পৃষ্ঠা ৩৪৩)

মতামত: প্রতিটি অবান্তর যুক্তি-বিবর্জিত মন্তব্য। যে কোনো উপায়ে, বিভিন্নরকম কু-যুক্তির উপস্থাপনা করে বিজ্ঞানের ওপর ধর্মের জয়যাত্রা সুনিশ্চিত করতে উদ্যত স্বয়ং স্বামী বিবেকানন্দ।

ধর্মবিশ্বাসীরা আমাদের আশেপাশের কতিপয় বিজ্ঞান শিক্ষক, বিজ্ঞানী বা চিকিৎসকদের স্বামী বিবেকানন্দের প্রতি অনুরাগকে সম্বল করে ওঁকে অভ্রান্ত হিসেবে তুলে ধরতে চান কিন্তু বাস্তবে এই মানুষগুলোও স্বামী বিবেকানন্দকে নিয়ে প্রচারের শিকার। 

এঁরা সামাজিক বা পারিবারিক ধর্মীয় বিশ্বাসের কারণেই স্বামীজীর প্রতি অনুরক্ত, তার বেশি কিছু নয় (এরকম মনে করার কোনো কারণ নেই যে এঁরা স্বামীজীর প্রতিটি লেখা খুব খুঁটিয়ে পড়ে তারপর তাঁর প্রতি অনুরক্ত হয়েছেন) আর স্বামীজীর এই বক্তব্যগুলো ওঁদের সামনে রাখলে ওঁরাও এইসব আজগুবি, অবান্তর, কাঁঠালের আমসত্ত্ব মার্কা কথাবার্তাগুলোকে মান্যতা দিতে পারবেন না।