Monday, 29 May 2023

নেতাজীর সিক্রেট সার্ভিস - ডাঃ পবিত্রমোহন রায়

ডস্টয়েভক্সির 'ক্রাইম অ্যান্ড পানিশমেন্ট' পড়ছিলাম। ডস্টয়েভক্সি ছিলেন বিপ্লবী দলে। রাজার বিরুদ্ধে আমাদেরই মতো যুদ্ধ চালানোর অভিযোগে জার সম্রাটের হুকুমে তার ও আরও কুড়িজনের মৃত্যুদন্ডের আদেশ দেওয়া হয়। কনকনে ঠান্ডা এক সকালে তাকে বধ্যভূমিতে নিয়ে গিয়ে লোহার খুঁটিতে বেঁধে দেওয়া হয়। ঘাতকের দল রাইফেল নিয়ে প্রস্তুত। শুধু সংকেতের অপেক্ষা। চোখের নিমেষে তারপর মাথার খুলি চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে যাবে। মাটিতে লুটিয়ে পড়বে রক্তাক্ত ছিন্নভিন্ন শরীর।   


এমন সময় দূর দিগন্তে দেখা গেল একজন ঘোড়সওয়ার জোর কদমে ছুটে আসছেন। সম্রাট মৃত্যুদন্ড মকুব করে যাবজ্জীবন কারাদন্ডের আদেশ দিয়েছেন। রাশিয়ার পালাবদলের কয়েক বছরের মধ্যেই অবশ্য তাকে মুক্তি দেওয়া হয়। 'ক্রাইম অ্যান্ড পানিশমেন্ট'-এর নায়ক হত্যার অপরাধে অপরাধী। বাঁচার অদম্য আকাঙ্খা তাকে পাগল করে তুলেছিল। কিন্তু মৃত্যু কুঠরিতে বসে আমাদের সেই অনুভূতি নেই কেন? বিশাল সমুদ্রের মধ্যে ছোট্ট একটি দ্বীপে একখন্ড পাথরের ওপর এক পা মাত্র স্পর্শ করে সে বাঁচতে চেয়েছিল। আর আমি? প্রাণ মৃত্যহীন, মরার পরেও আমি আবার নতুন করে বেঁচে উঠব - এই চিন্তা আমাকে আসন্ন মৃত্যু সম্পর্কে উদাসীন করে তুলেছিল। এখন মনে হল, যদি বাঁচতে হয় তাহলে মানুষের মধ্যে মানুষ হয়েই বাঁচব। অত্যাচার ও নিপীড়নের দেশে ঘরকুনো 'ভালো ছেলের' জীবন পরাধীন ভারতবাসীর নয়। 


আজাদ হিন্দ ফৌজের সেনাদের দিল্লীর লাল কেল্লায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে। শুনলাম - কয়েক দিনের মধ্যেই তাদের বিচার শুরু হবে। সিমলা বৈঠকের ব্যর্থতার পর এদিকে পন্ডিত জওহরলাল নেহরু এই প্রথম আজাদ হিন্দের কথা জনসাধারণের কাছে বলতে লাগলেন। দেখতে দেখতে কয়েক দিনের মধ্যেই সারা ভারতে আজাদ হিন্দ বাহিনীর বীরত্বগাঁথা ছড়িয়ে পড়ল। ইতিমধ্যে ভারত সরকার দিল্লীর লালকেল্লার শাহনওয়াজ, ধীলন ও সেগলের ঐতিহাসিক বিচার শুরু করলেন। যে আজাদ হিন্দ বাহিনীর কথা ভারতবাসী জানত না, সেই আজাদ হিন্দের লোকদেরই তারা নিজের মানুষ বলে গ্রহণ করেছে। আমরা আমাদের কথা কখনও মানুষকে মুখ ফুটে বলতে পারিনি। ফাঁসির ঘরে এসেই আমরা আমাদের কথা যথাসাধ্য জোর গলায় আশেপাশের বন্দীদের শোনাতে লাগলাম।


সারা দেশে তখন আজাদ হিন্দের নাম উত্তাল একটা ঢেউ বয়ে যাচ্ছে। সাম্রাজ্যবাদবিরোধী প্রত্যক্ষ রাজনৈতিক চেতনার ওপর ভিত্তি করে শুরু হয়েছিল অগাস্ট বিপ্লব। আজাদ হিন্দ ফৌজের আদর্শ ও নেতাজীর নেতৃত্ব সারা ভারতের মানুষের মনে একটা নতুন বৈপ্লবিক চেতনার সৃষ্টি করেছিল। জাতি, বর্ণ, ধর্মের ভেদাভেদ ভুলে সবাই ঐক্যবদ্ধ হলেন। আজাদ হিন্দ আন্দোলনের সঙ্গে দেশবাসী একাত্মবোধ করতে লাগলেন। ভারতের আবাল-বৃদ্ধ-বনিতার হৃদয় তোলপাড় করে তখন ধ্বনিত হচ্ছে একটি নাম - নেতাজী আর তার আজাদ হিন্দ ফৌজ।


সারা ভারতের এই পরিস্থিতির পটভূমিকায় অমিতা মিত্র বোম্বাই ও পুনায় গিয়ে মহাত্মা গান্ধীর সঙ্গে আমাদের বিষয়ে আলোচনা করলেন। যারা অহিংসা মন্ত্রের উপাসক নয়, যারা পরাধীন দেশের মুক্তিসাধনায় নিজের অস্ত্রে শত্রুর রক্তে মায়ের শ্বেত কমল লালে লাল করে তুলেছে, যারা সাম্রাজ্যবাদী শক্তির বিরুদ্ধে নিজের কাটামুন্ড নিয়ে মরণোৎসবে হোলি খেলেছে, আজ তাদেরই জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠলেন অহিংসা মন্ত্রের ভাবমূর্তি মহাত্মা গান্ধী স্বয়ং।


ইতিমধ্যে আরও প্রায় চার মাস কেটে গেল। তিন তিনবার আমাদের ফাঁসির সব ব্যবস্থা সম্পূর্ণ হল, তিন তিনবারই দিল্লী থেকে তা বন্ধ করা হল। এখানে খাওয়ার অসুবিধা নেই, চিন্তাভাবনার হাত থেকেও মুক্তি পেয়েছি, মেনে নিয়েছি যে, মৃত্যু আমাদের অবধারিত। তবে এ মৃত্যু মহান, এ মৃত্যু কাম্য। কারণ আজ প্রতিটি ভারতবাসী আজাদ হিন্দ আন্দোলনকে বুক দিয়ে ভালবেসেছে, আমাদের জন্য তারা প্রাণ বিসর্জন দিতে প্রস্তুত। আমাদের আদর্শ জয়লাভ করেছে। মৃত্যুর আগে একথা জেনে যাওয়ার মতো আনন্দ, সৌভাগ্য ও কৃতিত্ব আর কী থাকতে পারে।


সে এক দারুন গ্রীষ্মের দুপুরে এই রুদ্ধঘরে প্রবেশ করেছিলাম। এই ঘরে বসে চোখের সামনে নিবিড় বর্ষার ক্লান্ত সন্ধ্যার ঘনায়মান ছায়া দেখলাম, শরৎকালের অসংখ্য তারকাখচিত দিগন্তছোঁয়া নির্মল আকাশ দেখলাম। হেমন্ত শেষ হয়ে এখন শীতের আমেজ পাওয়া যাচ্ছে। ১৯৪৫-এর ৪ নভেম্বর। ঘরে ঘরে কালীপুজো ও দেওয়ালির উৎসব। আজাদ হিন্দের পক্ষ থেকে দেশজোড়া বিপুল আন্দোলনে ও মহাত্মা গান্ধীর অমোঘ প্রভাবে ব্রিটিশ 'সিংহ' মাথা নিচু করল। ভাইসরয় মহাত্মাজীর অকাট্য যুক্তির কাছে হার মেনে আমাদের চারজনের ফাঁসির হুকুম রদ করলেন। যাবজ্জীবন কারাদন্ডের আদেশ হল।


তাঁতের অন্ধকারের আড়ালে এই বদ্ধ প্রকোষ্ঠের লৌহকপাট সশব্দে উন্মুক্ত হল। আমরা ফাঁসির ঘর থেকে বেরিয়ে এলাম। পরস্পরকে আলিঙ্গন করলাম। রাজবন্দীর অভিনন্দন জানালেন।


যাবজ্জীবন কারাদন্ডের পালা শুরু হল। জয়হিন্দ!




 


















   

Sunday, 28 May 2023

জাতীয়তাবাদ - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

 আমি যথেষ্ট নিশ্চিত যে, এই দেশে এমন কিছু লোক আছেন যাঁরা তাঁদের উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত আদর্শের সঙ্গে সহমর্মিতা বোধ করেন না এবং যাদের উদ্দেশ্য হল বিকশিত হওয়ার বদলে কিছু লাভ করা। তাঁরা উচ্চৈস্বরে গর্ববোধ করেন এই ভেবে যে, তাঁরা জাপানকে আধুনিকতার স্তরে উন্নীত করেছেন। আমি তাঁদের সঙ্গে এইটুকু মাত্র সহমত পোষণ করি যে, জাতির মানসিকতা কালের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলা উচিত, কিন্তু আমি তাঁদের সাবধান করে বলতে চাই, আধুনিক হয়ে ওঠা আধুনিক মনোবৃত্তির এক ধরণের ভড়ং মাত্র, ঠিক যেভাবে কাব্যপ্রেরণার ভড়ং করার অর্থ হল কবি-কবি ভান করা। এটা অন্যের ভাবভঙ্গি নকল করা ছাড়া আর কিছু নয়। আসলের চেয়ে নকলের ভড়ং আরও বেশি উচ্চগ্রামের এবং তাও আবার আক্ষরিক। একথা মনে রাখতে হবে যে, যাঁদের মধ্যে প্রকৃত আধুনিক মানসিকতা আছে তাঁদের আধুনিক হওয়ার কোন প্রয়োজন হয় না, যেমন যাঁদের মধ্যে প্রকৃত বীরত্ব আছে তাঁদের হামবড়া লোক হওয়ার কোন প্রয়োজন নেই। ইউরোপীয়দের মতো বেশভূষা ধারণ করার মধ্যে কোন আধুনিকতা নেই। ইউরোপীয় শিশুরা যে দৃষ্টিকটু কাঠামোর মধ্যে অন্তরীণ থেকে তাদের পড়াশুনা চালায়, কিম্বা চ্যাপ্টা সোজা দেওয়ালবিশিষ্ট সারি সারি জানালা আছে এমন বর্গক্ষেত্র আকারের বাড়িতে সেখানকার মানুষ সারাজীবন বন্দি হয়ে কাটায় এর মধ্যে কোন আধুনিকতা নেই; কিম্বা সে দেশের মহিলাদের মাথায় যে অসংগতিপূর্ণ গোলাকার টুপি থাকে তার নিশ্চয়ই কোন আধুনিকতা নেই। এ সবকিছু আধুনিক নয়, এগুলি শুধু ইউরোপীয় মাত্র। যথার্থ আধুনিকতা হল মনের মুক্তি, রুচির দাসত্ব নয়। প্রকৃত অর্থে আধুনিকতা হল চিন্তার ও কর্মের স্বাধীনতা, ইউরোপীয় বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের অভিভাবকত্বে থাকা নয়। আধুনিকতা হল বিজ্ঞান, জীবনে বিজ্ঞানের ত্রুটিপূর্ণ প্রয়োগকে আধুনিকতা বলা যায় না। বিজ্ঞানের যেসব শিক্ষক বিজ্ঞানকে অন্ধ সংস্কারের পর্যায়ে নামিয়ে আনেন এবং অসম্ভব সব উদ্দেশ্যে অবাস্তবভাবে বিজ্ঞানের সাহায্য নেন তাঁদের কেবল অনুসরণ করার নাম আধুনিকতা নয়।