Thursday, 18 November 2021

ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে শ্রমিকশ্রেণীর ভূমিকা - সুকোমল সেন

আলোচ্য বৎসরগুলিতে শ্রমিকশ্রেণীকে মার্কস-লেনিনের বিপ্লবী শিক্ষায় শিক্ষিত করবার জন্য কমিউনিস্টদের নেতৃত্বে শ্রমিক-সংগঠনগুলির প্রচেষ্টা চলেছিল নিরন্তনভাবে। এটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা যে মীরাট মামলা সাজিয়ে কমিউনিস্টদের কঠোর সাজা দেওয়ার ব্যবস্থা করে সাম্রাজ্যবাদী সরকার ভারতের শ্রমিকশ্রেণীর মধ্যে কমিউনিস্ট মতাদর্শের প্রভাব সমূলে উৎপাটন করবার যে চেষ্টা করেছিল কারাগারের বাইরে অবস্থিত তরুণ কমিউনিস্টরা তাঁদের একনিষ্ঠ ও সাহসী কর্মতৎপরতার মধ্য দিয়ে ব্রিটিশ সরকারের সেই উদ্দেশ্যকে সম্পূর্ণ ব্যর্থ করে দেয়। জেলের মধ্য থেকে কমিউনিস্ট মতবাদকে শ্রমিকশ্রেণীর বিপ্লবী দর্শনকে ভারতের নিপীড়িত জনগণের সামনে বলিষ্ঠভাবে তুলে ধরেন। তেমনি কারাগারের বাইরেও বয়সের দিক থেকে অত্যন্ত তরুণ, অনভিজ্ঞ অথচ বিপ্লবী চেতনায় উদ্বুদ্ধ কমিউনিস্টরা শ্রমিকশ্রেণীকে সরাসরি জঙ্গী সংগ্রামের মধ্য দিয়ে পরিচালিত করে এবং মার্কস-লেনিনের মতাদর্শের বিপ্লবী তাৎপর্যগুলিকে বিশ্লেষণ করে শ্রমিকদের মধ্যে বিপ্লবী শ্রেণী-চেতনা বিকাশে অপরিসীম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। শ্রমিক-কৃষক আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত অনেক কমিউনিস্ট কর্মীও এই সময়ে মার্কসীয় দর্শনের প্রতি আকৃষ্ট হন। সন্ত্রাসবাদী কর্মীদের একটা বিরাট অংশ কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগদান করেন। ১৯৩৫ সালের মে দিবসে আন্দামান জেলে ভগত সিং-এর সহকর্মীগণ ৩১ জন সন্ত্রাসবাদী কর্মী কমিউনিস্ট কো-অর্ডিনেশন গঠন করেন। চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুন্ঠনের নেতৃবৃন্দ মার্কসীয় দর্শন গ্রহণ করেন। ফলে এই সময়ে মার্কসীয় দর্শনের ব্যাপক প্রসার ঘটে। ব্যাপ্তির দিক থেকে আলোচ্য সময়ে বিভিন্ন কারণে শ্রমিক আন্দোলনের যথেষ্ট ঘাটতি থাকলেও শ্রমিকশ্রেণীর শ্রেণী-চেতনার বিকাশে এই সময়ের অবদান বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ।


Monday, 15 November 2021

সহজ আলোচনায় পার্টি কর্মসূচী - দীপক নাগ

 "...আমাদের শিক্ষা কোনো আপ্তবাক্য নয়, কর্মক্ষেত্রে পথনির্দেশক।" মার্কস ও এঙ্গেলস সবসময়ই একথা বলতেন। যারা কয়েকটি "সূত্র" মুখস্থ করে বারবার আওড়াতো, তাদের তাঁরা বিদ্রুপ করতেন। এই সূত্রগুলি সম্বন্ধে এ পর্যন্ত বলা যায় যে, সেগুলি কেবল সাধারণভাবে কাজের মোটামুটি একটা রূপরেখা দিতে সক্ষম; ঐতিহাসিক প্রক্রিয়ার প্রত্যেকটি পর্যায়ের বাস্তব অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক পরিস্থিতি অনিবার্যভাবেই এই কাজের পরিবর্তন ঘটায়। ... এই প্রশ্নাতীত সত্য উপলব্ধি করা একান্ত প্রয়োজন যে, মার্কসবাদীকে বাস্তব জীবনের, প্রকৃত তথ্যের অনুশীলন করতে হবে, পুরোনো মতবাদকে আঁকড়ে থাকলে চলবে না।" - লেনিন (লেটার্স অন ট্যাকটিকস; কালেক্টেড ওয়ার্কস)

=============================================================

আজ থেকে প্রায় একশ সত্তর বছর আগে কমিউনিস্ট লিগের কর্মসূচি বা কমিউনিস্ট পার্টির ইস্তাহারে মার্কস-এঙ্গেলস স্পষ্ট কথায় বলেন : "কমিউনিস্টরা নিজেদের মতামত ও লক্ষ্য গোপন করতে ঘৃণা বোধ করে। খোলাখুলিভাবে তাঁরা বলেন যে, তাঁরা যা চান তা পাওয়া যেতে পারে কেবলমাত্র এখনকার সমস্ত সামাজিক অবস্থাকে জোর করে পাল্টে ফেলার মাধ্যমেই।" দুনিয়ায় হাজার হাজার রাজনৈতিক দল বা পার্টি থাকলেও শুধুমাত্র কমিউনিস্ট পার্টিই তার উদ্দেশ্য লিখিতভাবে ঘোষণা করে। বুর্জোয়াদলগুলোর প্রায় কোনোটারই কোনো লিখিত কর্মসূচি নেই। কারণ চলতি সমাজে যে শোষণ, অত্যাচার, অনাহার, বেকারি চলছে তা টিকিয়ে রেখে ধনীদের সেবা করাই তাদের একমাত্র কর্মসূচি।


মার্কসবাদীরা মনে করে বর্তমান সমাজ পরস্পর বিরোধী দুটো শ্রেণিতে বিভক্ত। অল্প কয়েকজন মানুষ সমাজের শতকরা নব্বুইভাগেরও বেশি সম্পত্তির মালিক। তাঁদের সবকিছু আছে। তাঁরা শোষক বা বুর্জোয়া। আর সমাজের নব্বুই ভাগেরও বেশি মানুষের হাতে কোনো সম্পদ নেই। তাঁরা শোষিত বা সর্বহারা। তাই তাঁরা নেই-রাজ্যের বাসিন্দা। মার্কসবাদীরা এই অসম ব্যবস্থার বদল চায়। তারা চায় শ্রেণিহীন সমাজ বা সাম্যবাদ। এই ব্যবস্থায় কোনো শোষক থাকবে না। তাই থাকবে না না-খেতে পাওয়ার ভয়। প্রত্যেকে তার প্রয়োজনমতো পায় বলেই অযথা সম্পদ জমিয়ে রাখার ইচ্ছে থাকে না। কারণ দরকার পড়ে না। অনেকটা মৌমাছির ফুল থেকে মধু সংগ্রহ করার মতো। কাউকে আঘাত না দিয়ে তার যতখানি প্রয়োজন ততখানিই নেবে। তার বেশি নয়। কিন্তু সাম্যবাদ বা কমিউনিজমের স্তরে আসতে গেলে সমাজকে কয়েকটা স্তর পেরিয়ে আসতে হয়। সামন্ততান্ত্রিক স্তর পেরিয়ে পুঁজিবাদী স্তর তারপর সমাজতান্ত্রিক স্তর আর অবশেষে সাম্যবাদী স্তর। এইসব স্তর পেরোনোর জন্য চাই বিপ্লবী মতবাদ এবং একটি সুসংগঠিত রাজনৈতিক দল বা কমিউনিস্ট পার্টি। যার নেতৃত্বে থাকবে শ্রমিক শ্রেণি। কারণ মার্কসবাদীদের মতে সমাজে শ্রমিকশ্রেণিই একমাত্র বিপ্লবী শ্রেণি। লেনিনের মতে, "বিপ্লবী মতবাদ না থাকলে বিপ্লবী আন্দোলন সম্ভব নয়। ... যে পার্টি সব চাইতে এগিয়ে থাকা মতবাদ দ্বারা পরিচালিত, কেবলমাত্র সেই পার্টিই পারে অগ্রণী সংগ্রামী বাহিনীর ভূমিকা পূরণ করতে।"


কমিউনিস্ট পার্টি বিপ্লবের মাধ্যমে সমাজের আমূল পরিবর্তন ঘটাতে চায়। তারা বিশ্বাস করে শুধুমাত্র ওপর ওপর পরিবর্তন বা এদিক ওদিক সামান্য সংস্কার করেই মানুষের ওপর শোষণ ও মানুষের দুঃখ দূর করা যায় না। বিপ্লব আকাশ থেকে পড়ে না। আবার স্বতঃস্ফূর্ততার দ্বারাও বিপ্লব সম্ভব নয়। এর জন্য চাই একটা পাকাপোক্ত ও সুশৃঙ্খল সংগঠন। আবার বাস্তব পরিস্থিতির ওপর ভিত্তি করে একটা সঠিক কর্মসূচি ছাড়া সমাজ পরিবর্তন সম্ভব নয়।

=============================================================

ফিনান্স পুঁজিকে লগ্নি পুঁজি বা মহাজনি পুঁজি বলা যেতে পারে। লেনিনের মতে, "উৎপাদন কেন্দ্রীয়ভাবে বা একসঙ্গে জড়ো হওয়া; তা থেকে একচেটিয়া কারবারের আবির্ভাব; ব্যাঙ্কের সঙ্গে শিল্পের মিশে যাওয়া বা মিলন ঘটা - এই হলো মহাজনি পুঁজি তৈরি হওয়ার ইতিহাস এবং কথাটার সারমর্ম।"

=============================================================

আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে দ্বন্দ্ব বেড়ে চলেছে। সাম্রাজ্যবাদী বিশ্বায়নের ফলে এখন চারটি দ্বন্দ্ব বা বিরোধ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। এই দ্বন্দ্বগুলো হলো :


(ক) সমাজতন্ত্র বনাম সাম্রাজ্যবাদের মধ্যে দ্বন্দ্ব;

(খ) সাম্রাজ্যবাদ ও তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর মধ্যে দ্বন্দ্ব;

(গ) সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলোর মধ্যে দ্বন্দ্ব;

(ঘ) পুঁজি ও শ্রমের দ্বন্দ্ব।

=============================================================

ভারতে বুর্জোয়া ও জমিদার জোটের নেতৃত্বে রয়েছে বড় বড় বুর্জোয়ারা। ধনতন্ত্রের বিকাশ ঘটানোই এদের লক্ষ্য। এই শ্রেণি জমিদারদের রাষ্ট্রক্ষমতায় রেখেই বা সামন্ততন্ত্রকে ধ্বংস না করেই ধনতান্ত্রিক পথে বিকাশ ঘটাতে চাইছে। এরা বিদেশি মহাজনি পুঁজির সাহায্য নিয়ে সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করে বা দর কষাকষি করে নিজেদের লাভের পরিমাণ বাড়িয়ে তোলে। ভারতীয় বুর্জোয়ারা এক্ষেত্রেও দুমুখো নীতি নিয়ে চলে। তাই ভারত জাতীয় বুর্জোয়াদের রাষ্ট্র নয়। কারণ সাম্রাজ্যবাদের সঙ্গে তাদের বোঝাপড়া আছে। সি পি আই ভারতকে জাতীয় বুর্জোয়াদের রাষ্ট্র বলে মনে করে। তারা মনে করে ভারতীয় বুর্জোয়ারা পুরোপুরি স্বাধীন। আবার ভারতীয় বুর্জোয়ারা মুৎসুদ্দি বা সাম্রাজ্যবাদের দালাল - নকশালপন্থীদের মতো একথাও আমরা মনে করি না। এখানেই আমাদের সঙ্গে সি পি আই বা নকশালপন্থীদের কর্মসূচির অন্যতম প্রধান ফারাক।  

=============================================================

বর্তমানে বিপ্লবের দুটি স্তরের কথা আমরা বলতে পারি। প্রথমটা বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লব এবং আর তারপর সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব। আগে বুর্জোয়ারাই নিজেদের স্বার্থে সামন্ততন্ত্রের বিরুদ্ধে লড়াই করে বুর্জোয়া গণতন্ত্র স্থাপন করতো। কিন্তু বুর্জোয়ারা এখন আর এই ভূমিকা পালন করে না। সর্বহারা শ্রেণিকেই এখন এই দায়িত্ব পালন করতে হবে। এই বিপ্লবকে জনগণতান্ত্রিক বিপ্লবের স্তর বলা যায়। আমরা এখন এই স্তরে আছি। 


আমাদের দেশের বাস্তব পরিস্থিতিতে বিপ্লবের স্তর হিসেবে যে তিনটি গুরুত্বপূর্ণ দ্বন্দ্ব বা বিরোধের কথা উল্লেখ করতেই হয়, তা হলো:

(ক) পুঁজির সাথে শ্রমের দ্বন্দ্ব;

(খ) জমিদার ও কৃষকদের মধ্যে দ্বন্দ্ব;

(গ) সাম্রাজ্যবাদের সঙ্গে ভারতীয় জনসমাজের দ্বন্দ্ব।

============================================================= 

কৃষি বিপ্লব হলো জনগণতান্ত্রিক বিপ্লবের মূল কথা। জনগণতান্ত্রিক বিপ্লবের মূল শত্রু হলো:

(ক) বড় ধরনের বুর্জোয়া গোষ্ঠী,

(খ) জমিদার বা ধনী কৃষক এবং 

(গ) সাম্রাজ্যবাদ

বড় বড় পুঁজিপতিরা বিদেশি মহাজনি পুঁজির সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধে মুনাফা করার চেষ্টা করে। কাজেই বিদেশি লগ্নিপুঁজি বা মহাজনি পুঁজি অন্যতম প্রধান শত্রু। তাই মোটামুটিভাবে জনগণতান্ত্রিক বিপ্লব হচ্ছে :

 - সামন্ততন্ত্র বিরোধী,

- সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী,

- একচেটিয়া বিরোধী ও 

- গণতান্ত্রিক। 

=============================================================  

জনগণতান্ত্রিক ফ্রন্টের নেতা হলো শ্রমিকশ্রেণি; দৃঢ় মিত্র হলো কৃষক সমাজ; মধ্যবিত্তশ্রেণি হলো সাধারণ মিত্র; আর দোদুল্যমান ও অস্থিতিশীল মিত্র হলো মাঝারি ও ছোট বুর্জোয়ারা।

============================================================= 

মার্কসবাদীরা পার্লামেন্টারি ব্যবস্থায় অংশগ্রহণের বিরুদ্ধে নয়। তারা পার্লামেন্ট-সর্বস্বতার বিরুদ্ধে। অর্থাৎ পার্লামেন্টই সব বা পার্লামেন্টের মাধ্যমেই সব সমস্যার সমাধান করা বা এই সমাজব্যবস্থার পরিবর্তন করা সম্ভব - আমরা তা বিশ্বাস করি না। লেনিনের কথায়, "শ্রমিকশ্রেণির পার্টিগুলি পার্লামেন্টারি সংগ্রামকে ব্যবহার করার, পার্লামেন্টে অংশগ্রহণ করারই পক্ষে। কিন্তু তারা 'পার্লামেন্টারি ক্রেটিনিজম'-এর অর্থাৎ পার্লামেন্টারি সংগ্রামই হচ্ছে রাজনৈতিক সংগ্রামের একমাত্র বা সবসময়ই প্রধান রূপ - এই বিশ্বাসের স্বরূপ নির্মমভাবে প্রকাশ করে দেয়।" 

=============================================================

সংসদীয় ব্যবস্থার প্রতি অতি-নির্ভরতা আমাদের মধ্যে সংশোধনবাদী বিচ্যুতি নিয়ে আসতে পারে। আবার বুর্জোয়া সংসদীয় ব্যবস্থাকে সম্পূর্ণ অস্বীকার করলে তা আমাদেরকে সংকীর্ণতাবাদী বা হঠকারী বিচ্যুতির দিকে নিয়ে যেতে পারে।

=============================================================

পার্টি গড়ার কাজে সমস্তরকম অ-মার্কসীয় চিন্তাধারা, কুসংস্কার, ধর্মীয় কূপমুন্ডুকতা, সাম্প্রদায়িকতা, জাতপাত, বুর্জোয়া সংস্কৃতি ও আচারআচরণ, বুর্জোয়া জাতীয়তাবাদ ও বিচ্ছিন্নতাবাদের বিরুদ্ধে সচেতন সংগ্রাম গড়ে তুলতে হবে।

=============================================================