Tuesday, 11 August 2020

প্রেম, বিবাহ ও অন্যান্য - প্রবীর ঘোষ

নারীরা যতই নারী স্বাধীনতা ও পুরুষের সমান অধিকার দাবি করুন না কেন, বেকার ছেলে বিয়ে করতে তো কখনওই বিজ্ঞাপন দেন না! তবে বেকার মেয়েরা কি করে প্রত্যাশা করেন রাজপুত্তুররা তাঁদের বিয়ে করবেন? আসলে মেয়েদের চেতনার অণুতে সংস্কারের মজ্জায়-মজ্জায় ঢুকে গেছে স্বামীকে আভিজাত্যের নিদর্শন একটি বস্তু হিসেবে পরিমাপ করা, স্বামীকে নিজের চেয়ে অনেক বড় মাপের হিসেবে চাওয়া, নিজের ওপর স্বামীর স্বত্বাধিকার মেনে নেওয়া।

***********************************************************

স্ত্রীর উপর স্বামীর এমন স্বত্বাধিকার প্রতিষ্ঠিত হওয়ার কারণ অনেক ক্ষেত্রেই স্বামীর উপর স্ত্রীর অর্থনৈতিক নির্ভরশীলতা। অনেক সময় সামাজিক পরিবেশগত কারণে অনেক নারী ধরেই নেন, স্বামী-পুত্র-কন্যার সেবায় জীবন উৎসর্গ করার মধ্যেই নারী জীবনের সার্থকতা। এরা অবশ্যই মধ্যবিত্ত মানসিকতার মানুষ। আপনি যখন মা হিসেবে ছেলের জামা-প্যান্ট ধোয়া, ইস্ত্রি করা, স্কুলের টিফিন তৈরি করে গুছিয়ে দেওয়া, জুতোর পালিশ ঠিক রাখা ইত্যাদি কাজগুলো করেন স্নেহময়ী জননীর মহান কর্তব্য হিসেবে, তখন একবারের জন্যেও কি ভেবেছেন আপনার এমনতর কাজ-কর্মের ফলে যৌবনে পৌঁছে আপনার ছেলে প্রত্যাশা করবে তার স্ত্রীও এমনি করে গৃহকর্ম ও শিশুপালনের কাজগুলো একা হাতেই সামলাক? সে তখন নিশ্চয়ই স্ত্রীকে গৃহকর্ম, শিশুপালন ইত্যাদি বিষয়ে পরিপূর্ণ সহযোগিতা করতে এগিয়ে আসবে না। আপনার মেয়ে যৌবনে পৌঁছে আপনার প্রভাবে এটাই ধরে নেবে এসব কাজ করার একক দায়িত্ব একজন আদর্শ স্ত্রী ও মা হিসেবে তারই। এখনও আমাদের সমাজে সাধারণভাবে প্রচলিত স্ত্রী চাকুরিরতা হলেও তার উপরই বর্তায় গৃহকর্ম ও শিশুপালনের ঝক্কি। এমন এক অবস্থা সৃষ্টির জন্য দায়ভাগ পুরুষশাসিত সমাজ ব্যবস্থায় যেমন পুরুষের ওপর বর্তায়, তেমনই কিছুটা দায়ভাগ অবশ্যই নারীদের, যাঁরা এই ধারাকে স্থায়ী রাখার মানসিকতা সন্তানদের মধ্যে তৈরি করে চলেছেন।

***********************************************************

যৌন-মুক্তির বা যৌন স্বাধীনতার দাবি যদিও ধনতান্ত্রিক সভ্যতারই দাবি, তবু এই দাবি প্রতিষ্ঠার মধ্যেই রয়েছে ধনতন্ত্রের ধ্বংসের বীজ। কারণ, যৌন স্বাধীনতার একান্ত অনিবার্য শর্ত - সাম্য, নারী-পুরুষে সাম্য, মানুষে মানুষে সাম্য, মানুষের প্রতি মানুষের ভালোবাসা। আর এই সাম্য ধনতান্ত্রিক সমাজ কাঠামোর ধ্বংস ছাড়া সম্ভব নয়। মুক্ত যৌন-প্রণয়ের আবশ্যিক শর্ত হওয়া উচিত অবদমনহীন, শোষণহীন, বন্ধুত্ব ও বিশ্বাস দ্বারা প্রতিষ্ঠিত মানবীয় সম্পর্ক।

***********************************************************

একগামী মানে অবশ্য আজীবন একজনের সঙ্গেই যৌননিষ্ঠ থাকবে - এমনটি অবশ্যই নয়। যে মানুষের জীবন বেশি গতিময়, জীবনে উত্থান-পতন বেশি, তাদের বন্ধুরাও পরিবর্তিত হতে থাকে। প্রেমিকা বা প্রেমিক একজন 'বিশেষ বন্ধু'। এই 'বিশেষ বন্ধুত্ব'ও পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে পাল্টাতে পারে। জীবনে যেমন পুরনো বন্ধুদের কেউ কেউ বিদায় নেয়, কেউ কেউ আসে -- তেমন কোনও 'বিশেষ বন্ধু' জীবনে এলে স্বাগত জানানোই উচিত।

***********************************************************

প্রেম বা দাম্পত্য জীবনের আদর্শ সম্পর্ক গড়ে ওঠার প্রাথমিক ও আবশ্যিক শর্ত যৌনতা নয়। নাহলে গণিকা ও লম্পটরাই হত সেরা প্রেমিকা ও প্রেমিকের উজ্জ্বলতম দৃষ্টান্ত। .... প্রেম বা দাম্পত্য জীবনের প্রাথমিক ও আবশ্যিক শর্তই হলো বন্ধুত্ব, বিশ্বাস, শ্রদ্ধা এবং মতাদর্শগত মিল।

***********************************************************

রাজনীতি সচেতন, আদর্শ সচেতন, মূল্যবোধ সচেতন, আত্মমর্যাদা সচেতন, স্বাধীন মানসিকতাসম্পন্ন দম্পতিদের বিচ্ছেদ তুলনামূলকভাবে অসচেতন ও স্বল্পসচেতন দম্পতিদের চেয়ে অনেক বেশি ঘটে। দু'জনেই যখন আদর্শ-সচেতন, মূল্যবোধ-সচেতন, আত্মমর্যাদা সম্পন্ন, রাজনীতি ও সমাজনীতি সম্পর্কে সচেতন তখন আদর্শগত দ্বন্দ্ব দেখা দিতেই পারে - সেটা একপক্ষের আদর্শচ্যুতির জন্যে যেমন হতে পারে, তেমনই আদর্শগত মতপার্থক্য থেকেও হতে পারে। এই দ্বন্দ্ব নিয়ে 'প্রেমিক-প্রেমিকা' অথবা 'স্বামী-স্ত্রী'র সম্পর্ক অটুট রাখা অবাঞ্ছিত মনে হওয়াটা অস্বাভাবিক কি?

***********************************************************

কোনটা সত্যি? হিন্দুদের ঈশ্বর-বিশ্বাস, নাকি মুসলিমদের আল্লা-বিশ্বাস? আমি যদি হিন্দু থেকে মুসলিম হয়ে যাই, তবে কি আমার ঈশ্বর সাকার থেকে নিরাকার হয়ে যাবেন? আমি ইসলাম ধর্ম ছেড়ে হিন্দু হলে আমার ঈশ্বর নিরাকার থেকে আবার বিশিষ্ট হতে বাধ্য হবে?

আমার ইচ্ছেতেই যদি আমার ঈশ্বরের রূপ সাকার বা নিরাকার হতে বাধ্য হন, তবে তো আমি আমার ঈশ্বরের চেয়েও বেশি শক্তিমান।

***********************************************************

কেউ কেউ মনে করেন, ঈশ্বর জগতের স্রষ্টা, যেমন কুম্ভকার মৃৎপাত্রের স্রষ্টা। ঈশ্বর সর্বব্যাপী। ঈশ্বর স্রষ্টা হলে তিনি কুম্ভকারের মত মাটি ও মৃৎপাত্র হতে পৃথক। ঈশ্বর যদি তাঁর সৃষ্টি থেকে পৃথক হন, তবে সর্বব্যাপ্ত হতে পারেন না।
ঈশ্বর যদি সর্বশক্তিমান হন, তাঁর ইচ্ছাতেই যদি মানুষের কাজ-কর্ম নির্ধারিত হয়, তবে অসৎ কাজের জন্য মানুষ কেন দায়ী হবে?
মনুষ্য জগতের বাইরের অন্যান্য প্রাণী, যাদের ভাল-মন্দ বিচার-বোধ নেই, তাদের কাজ-কর্মের জন্য ঈশ্বর কী ভাবে তাদের দায়ী করবে?
পৃথিবীতে সুখের চেয়ে দুঃখের পরিমাণ বেশি। তবে কি ঈশ্বর যতটা দয়ালু, তারচেয়ে বেশি নিষ্ঠুর?

***********************************************************

Tuesday, 4 August 2020

পরিবার, ব্যক্তিগত মালিকানা ও রাষ্ট্রের উৎপত্তি - ফ্রেডরিক এঙ্গেলস

আমাদের যুগে বুর্জোয়া বিবাহ প্রথা হচ্ছে দু-রকমের। ক্যাথলিক দেশসমূহে আগের মতোই মাতাপিতা তরুণ বুর্জোয়া সন্তানের জন্য উপযোগী পাত্রী জোগাড় করে দেন এবং এর ফলে স্বভাবতঃই একপতিপত্নী প্রথার আত্মবিরোধ পূর্ণভাবেই ফুটে ওঠে - স্বামীর দিক থেকে ঢালাও হেটায়ারিজম এবং স্ত্রীর দিক থেকে ঢালাও ব্যভিচার। ক্যাথলিক গির্জা থেকে বিবাহবিচ্ছেদ নিশ্চয়ই এইজন্য নিষিদ্ধ করা হয় যে, তাঁরা বুঝেছিলেন যে মৃত্যর মতোই ব্যভিচারের কোন চিকিৎসা নেই। অপরপক্ষে প্রটেস্টান্ট দেশগুলিতে সাধারণতঃ বুর্জোয়া ঘরের ছেলেকে স্বশ্রেণী থেকে কমবেশি স্বাধীনভাবে স্ত্রী নির্বাচন করতে দেওয়া হয়। ফলে বিবাহের ভিত্তিতে কিছুটা ভালোবাসা থাকতে পারে এবং শালীনতার জন্য প্রটেস্টান্টসুলভ ভণ্ডামিবশে সে ভালোবাসা আছে বলে ধরে নেওয়া হয়। এইক্ষেত্রে পুরুষের দিক থেকে হেটায়ারিজম অনেক কম এবং স্ত্রীলোকদের পক্ষ থেকে ব্যাভিচারও ততোটা সাধারণ নয়। কিন্তু যেহেতু প্রত্যেক ধরণের বিবাহেই স্ত্রীপুরুষ বিবাহের আগে যেমন ছিল পরে তেমনই থাকে এবং যেহেতু প্রটেস্টান্ট দেশসমূহের বুর্জোয়ারা বেশির ভাগই কূপমণ্ডুক তাই প্রটেস্টান্টদের একপতিপত্নী বিবাহের উত্তম দৃষ্টান্তগুলির গড়পড়তা ধরলেও তা পরিণত হয় এক নিরেট একঘেঁয়েমির দাম্পত্য-জীবনে, যাকেই বলা হয় দাম্পত্য সুখ। এই দুধরনের বিবাহের প্রকৃষ্ট দর্পণ হচ্ছে উপন্যাস; ফরাসী উপন্যাসে ক্যাথলিক ধরনের বিবাহের সাক্ষাৎ মেলে এবং জার্মান উপন্যাসে প্রটেস্টান্ট ধরনের। উভয়ক্ষেত্রে পুরুষই 'পায়' : জার্মান নভেলের তরুণ যুবক পায় একটি তরুণী, ফরাসী নভেলে স্বামী পায় তার প্রবঞ্চনার হেনস্থা। কার দুর্ভোগ যে বেশি সব ক্ষেত্রে বলা শক্ত, কেননা জার্মান নভেলের নীরসতা ফরাসী বুর্জোয়ার মনে যতখানি ভীতি জাগায়, ফরাসী নভেলের 'দুর্নীতি' জার্মান কূপমণ্ডুকের মনে ঠিক ততখানি ভীতি উদ্রেক করে। তবু সম্প্রতি 'বার্লিন মহানগরীতে পরিণত হওয়ায়' যে হেটায়ারিজম ও ব্যাভিচার এখানে বহুদিন থেকেই বর্তমান বলে জানা, তা নিয়ে জার্মান উপন্যাসে কিছুটা কম ভীতি দেখা দিচ্ছে।

কিন্তু উভয়ক্ষেত্রে বিবাহ নির্ভর করে পাত্রপাত্রীদের শ্রেণীর উপর এবং সেই হিসাবে এগুলি সুবিধার বিবাহই থেকে যায়। উভয়ক্ষেত্রেই এই সুবিধার বিবাহ প্রায়ই অত্যন্ত সথূল বেশ্যাবৃত্তিতে পরিণত হয় - কখনো দুপক্ষের কিন্তু বেশির ভাগ ক্ষেত্রে স্ত্রীর বেলায়; স্ত্রীর সঙ্গে সাধারণ পতিতার পার্থক্য এইটুকু যে, সে ফুরনের মজুরের মতো নিজের দেহ ভাড়া খাটায় না, পরন্তু সে দেহটা বিক্রি করে চিরকালের মতো দাসত্বে। সমস্ত সুবিধামাফিক বিবাহ সম্পর্কে ফুরিয়ের এই মন্তব্য প্রযোজ্য : 'ব্যাকরণে যেমন দুটি নেতিবাচক শব্দে একটি ইতিবাচক শব্দ হয়, তেমনই বিবাহের নীতিশাস্ত্রে দুটি বেশ্যাবৃত্তি মিলে পুণ্যকর্ম হয়ে ওঠে।' কেবলমাত্র শোষিত শ্রেণীগুলির মধ্যে অর্থাৎ বর্তমানে প্রলেতারীয়দের মধ্যে স্ত্রী সম্পর্কে যৌন প্রেম সাধারণ ব্যাপার হতে পারে ও হয়ে থাকে, সরকারীভাবে এই সম্পর্ককে স্বীকার হোক বা না হোক। কিন্তু এ ক্ষেত্রে চিরায়ত একপতিপত্নী প্রথার সমস্ত পুরনো বুনিয়াদই আর থাকছে না। যে সম্পত্তির সংরক্ষণ ও উত্তরাধিকারের জন্য একপতিপত্নী প্রথা ও পুরুষের আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, সেরকম সব সম্পত্তিই এখানে অনুপস্থিত। অতএব এখানে পুরুষের আধিপত্য খাটাবার কোন প্রেরণা নেই। উপরন্তু তার উপায়ও নেই : এই আধিপত্য রক্ষা করে যে নাগরিক আইন তার অস্তিত্ব শুধু বিত্তবান শ্রেণীগুলির জন্য এবং প্রলেতারীয়দের সঙ্গে তাদের কারবারের জন্য। এতে টাকাকড়ি লাগে এবং সেইজন্যই শ্রমিকের দারিদ্র্যের জন্য স্ত্রীর সঙ্গে তার আচরণের ব্যাপারে এর কোন কার্যকারিতা নেই। এখানে সম্পূর্ণ বিভিন্ন ধরনের ব্যক্তিগত আর সামাজিক সম্বন্ধই হচ্ছে নির্ধারক ব্যাপার। উপরন্তু, যখন থেকে বৃহৎ শিল্প স্ত্রী লোককে ঘর থেকে শ্রমবাজার ও কারখানায় পাঠাল এবং প্রায়ই তাকে পরিবার পালনে রোজগার করতে হলো তখন থেকে প্রলেতারীয় সংসারে পুরুষের আধিপত্যের যা কিছু ভিত্তি ছিল সবই লোপ পেল -- একপতিপত্নী বিবাহের প্রতিষ্ঠা থেকে স্ত্রীলোকের প্রতি যে রূঢ়তা দৃঢ়মূল হয়ে গিয়েছিল সম্ভবত তার কিছু কিছু ছাড়া। এইভাবে প্রলেতারীয় পরিবার সঠিক অর্থে আর একপতিপত্নী নয়; এমনকি যেখানে নিবিড় প্রেম ও উভয় পক্ষের পরিপূর্ণ বিশ্বস্ততা বর্তমান সেখানেও, এবং আধ্যাত্মিক ও পার্থিব সমস্ত রকমে মন্ত্রপূত হয়েও। একপতিপত্নী প্রথার দুটি চিরন্তন সঙ্গী হেটায়ারিজম ও ব্যভিচারের ভূমিকা তাই এখানে নগন্য। বস্তুতঃ স্ত্রীলোক বিবাহবিচ্ছেদের অধিকার ফিরে পেয়েছে এবং বনিবনাও না হলে স্বামী স্ত্রী ছাড়াছাড়ি হতেই পছন্দ করে। সংক্ষেপে, প্রলেতারীয় বিবাহ ব্যুৎপত্তিগত অর্থে একপতিপত্নী হলেও ঐতিহাসিক অর্থে মোটেই নয়।

আমাদের আইনজ্ঞরা অবশ্য বলে থাকেন যে, আইন প্রণয়নে প্রগতির মধ্যে দিয়ে ক্রমেই বেশি বেশি পরিমাণে স্ত্রীলোকের অভিযোগের কারণগুলি দূর হচ্ছে। আধুনিক সভ্য দেশের আইনবিধি ক্রমশঃই এই জিনিসটা মেনে নিচ্ছে যে, প্রথমত, কার্যকরী হতে গেলে বিবাহকে দুই পক্ষ থেকে স্বেচ্ছামূলক চুক্তির ভিত্তিতে হতে হবে; এবং দ্বিতীয়ত, বিবাহিত অবস্থায় অধিকার ও দায়িত্বের দিক দিয়ে উভয়পক্ষের সমতা থাকবে। যদি এই দুটি দাবি যথাযথভাবে কার্যকরী হয় তাহলে মেয়েদের চাওয়ার আর কিছু থাকে না।  

এই টিপিকাল উকিলী যুক্তি হচ্ছে ঠিক সেইরকম যা দিয়ে রেডিক্যাল বুর্জোয়া-প্রজাতন্ত্রী প্রলেতারীয়কে ফেরায়। কাজের চুক্তিকে মালিক-শ্রমিক উভয়পক্ষের স্বেচ্ছামূলক মনে করা হয়। কিন্তু কাগজে কলমে আইন উভয়পক্ষকে একই ভিত্তিতে দাঁড় করিয়ে দেয় বলে ধরা হয় চুক্তিটি স্বেচ্ছামূলক। ভিন্ন শ্রেণী অবস্থানের জন্য প্রাপ্ত একটি পক্ষের ক্ষমতা, অপরপক্ষের ওপর তার চাপ, উভয়ের বাস্তব অর্থনৈতিক অবস্থা -- এসব নিয়ে আইন মাথা ঘামায় না। এবং কাজের চুক্তি বলবৎ থাকার সময় উভয়পক্ষকেই সমান অধিকারভোগী মনে করা হয়, যতক্ষণ না কোন এক পক্ষ সুস্পষ্টভাবে এই অধিকার ছেড়ে দিচ্ছে। বিশেষ অর্থনৈতিক অবস্থার মধ্যে শ্রমিক যে তার সমান অধিকারের সামান্যতম আভাসটুকুও ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়, এই বিষয়ে আইনের কিছু করবার নেই।  

বিবাহের ব্যাপারে খুব প্রগতিশীল আইনও এইটুকুতেই সন্তুষ্ট যে, উভয়পক্ষ বিবাহে সরকারীভাবে নিজেদের সম্মতি জানিয়েছে। আইনের যবনিকার আড়ালে যেখানে বাস্তব জীবন চলে সেখানে কী ঘটছে, কীভাবে এই স্বেচ্ছামূলক চুক্তিতে পৌঁছান হচ্ছে, তা নিয়ে আইন এবং আইনজ্ঞ মাথা ঘামায় না। অথচ বিভিন্ন দেশের আইনের মামুলি তুলনা থেকেও আইনজ্ঞ বুঝতে পারবেন যে, এই স্বেচ্ছামূলক চুক্তি আসলে কী দাঁড়ায়। জার্মানিতে, ফরাসী আইনের অধীন সব দেশ ও অন্যান্য দেশগুলিতে যেখানে সন্তানসন্ততিরা বাধ্যতামূলকভাবে পিতামাতার সম্পত্তির ভাগ আইনত পায়, তাদের উত্তরাধিকারচ্যুত করা যায় না, সেখানে বিবাহের প্রশ্নে সন্তানসন্ততিদের মাতাপিতার সম্মতি নিতেই হয়। যেসব দেশে ইংরেজী আইন খাটে, যেখানে বিবাহে মাতাপিতার উইলের নিরঙ্কুশ অধিকার আছে এবং তারা যদি ইচ্ছে করে তাহলে সন্তানসন্ততিদের সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করতে পারে। অতএব এটা স্পষ্ট যে, এ সত্ত্বেও কিংবা বলা উচিত এইজন্যই যেসব শ্রেণীর মধ্যে উত্তরাধিকারের মতো সম্পত্তি আছে, ইংল্যান্ডে বা আমেরিকায় তাদের মধ্যে বিবাহের স্বাধীনতা ফ্রান্স বা জার্মানির চেয়ে একছিটে বেশি নয়। 

বিবাহে স্ত্রী পুরুষের আইনী সমাধিকারের ক্ষেত্রেও অবস্থা এর চেয়ে ভাল নয়। পূর্বতন সামাজিক অবস্থার উত্তরদায়িত্ব হিসাবে প্রাপ্ত উভয়ের আইনগত অসম অধিকার, এটি স্ত্রীলোকের ওপর অর্থনৈতিক পীড়নের কারণ নয়, ফল। পুরনো সাম্যতন্ত্রী গৃহস্থালীতে যেখানে বহু দম্পতি ও তাদের ছেলেমেয়েরা থাকত সেখানে গৃহস্থালীর ব্যবস্থা স্ত্রীলোকদের উপর ন্যস্ত ছিল, -- এই কাজটি পুরুষের খাদ্য আহরণের মতোই একটা সামাজিকভাবে প্রয়োজনীয় বৃত্তি বলে গণ্য হতো। পিতৃপ্রধান পরিবার আসার সঙ্গে অবস্থা বদলে গেল এবং আরও বেশি বদলাল একপতিপত্নী স্বতন্ত্র পরিবার আসার ফলে। গৃহস্থালীর কাজকর্মের সামাজিক বৈশিষ্ট্য চলে গেল। এটি আর সমাজের দেখবার বিষয় রইল না, এটি হয়ে দাঁড়াল ব্যক্তিগত সেবা। সামাজিক উৎপাদনের ক্ষেত্র থেকে বহিষ্কৃত হয়ে স্ত্রী-ই হলো প্রথম ঘরোয়া ঝি। কেবলমাত্র আধুনিক বৃহৎ শিল্পই আবার তাদের সামনে সামাজিক উৎপাদনে প্রবেশের দরজা খুলে দিয়েছে, অবশ্য কেবলমাত্র প্রলেতারীয় স্ত্রীলোকদের জন্যই। কিন্তু সেটা করেছে এরকমভাবে যে, যখন সে নিজের পরিবারের ব্যক্তিগত সেবার কর্তব্য পালন করে তখন সে সামাজিক উৎপাদনের বাইরে পড়ে যায় এবং কোন কিছু উপার্জন করে না; এবং যখন সে সামাজিক পরিশ্রমে অংশ নিয়ে স্বাধীনভাবে জীবিকা অর্জন করতে চায় তখন আর সে পারিবারিক কর্তব্য পালন করতে পারে না। কারখানার স্ত্রীলোকের পক্ষে যা প্রযোজ্য তা অন্য সব পেশা এমনকি চিকিৎসা ও আইনের পেশাতেও প্রযোজ্য। আধুনিক ব্যক্তিগত পরিবার স্ত্রীলোকের প্রকাশ্য অথবা গোপন গার্হস্থ্য দাসত্বের ভিত্তির উপর দাঁড়িয়ে আছে এবং বর্তমান সমাজ হচ্ছে এইসব ব্যক্তিগত পরিবারের অণুর সমষ্টি। বর্তমানে অধিকাংশ ক্ষেত্রে অন্ততপক্ষে বিত্তবান শ্রেণীগুলির মধ্যে পুরুষই হচ্ছে উপার্জনকারী, পরিবারের ভরণপোষণের কর্তা এবং এইজন্যই তার আধিপত্য দেখা দেয়, যার জন্য কোন বিশেষ আইনগত সুবিধা দরকার পড়ে না। পরিবারের মধ্যে সে হচ্ছে বুর্জোয়া; স্ত্রী হচ্ছে প্রলেতারিয়েত। কিন্তু শিল্পজগতে যে অর্থনৈতিক শোষণ প্রলেতারিয়েতকে পিষে ধরে তার বিশেষ প্রকৃতি সমগ্র তীক্ষ্ণতায় তখনই ফুটে ওঠে যখন পুঁজিপতি শ্রেণীর আইনগত সমস্ত বিশেষ সুবিধা দূর হয়েছে এবং আইনের চক্ষে উভয় শ্রেণীর সম্পূর্ণ সমান অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র উভয় শ্রেণীর বিরোধ লোপ করে না; পরন্তু সে বিরোধ লড়ে শেষ করার ক্ষেত্র যোগায়। ঠিক একইভাবে আধুনিক পরিবারের মধ্যে স্ত্রীলোকের ওপর স্বামীর আধিপত্যের বিশেষ চরিত্রে এবং উভয়ের মধ্যে সত্যিকার সামাজিক সাম্য প্রতিষ্ঠার প্রয়োজন ও পদ্ধতি তখনই পুরো ফুটে উঠবে যখন আইনের চক্ষে উভয়ের অধিকার সমান বলে স্বীকৃত হচ্ছে। তখন একথা স্পষ্ট হবে যে, সামাজিক উৎপাদনের মধ্যে গোটা স্ত্রীজাতিকে আবার নিয়ে আসাই হচ্ছে তাদের মুক্তির প্রথম শর্ত; এবং এর জন্যই আবার দরকার হচ্ছে সমাজের অর্থনীতির একক হিসাবে ব্যক্তিগত পরিবারের যে গুণটি রয়েছে তার বিলোপ।

*************************************************************************

আমরা এমন একটি সমাজ বিপ্লবের দিকে এগোচ্ছি যখন বর্তমানের একপতিপত্নী প্রথার অর্থনৈতিক ভিত্তি তেমন নিশ্চিতই লোপ পাবে, যেমন লোপ পাবে তার অনুপূরণ পতিতাবৃত্তির অর্থনৈতিক ভিত্তি। একই ব্যক্তির, মানে এক পুরুষের অধিকারে প্রচুর সম্পত্তি কেন্দ্রীভূত হওয়ার ফলে এবং অপর কাউকে নয়, কেবলমাত্র সে পুরুষের নিজের সন্তানসন্ততিকেই সম্পত্তির উত্তরাধিকার দিয়ে যাবার ইচ্ছা থেকেই এই একপতিপত্নী প্রথা আসে। এইজন্যই নারীর পক্ষেই একপতিত্বে পুরুষদের গোপন বা প্রকাশ্য বহুপত্নীত্ব বাধেনি। উত্তরাধিকারযোগ্য স্থায়ী সম্পদের অন্ততপক্ষে বেশির ভাগ অংশকে --- উৎপাদনের উপায়কে -- সামাজিক সম্পত্তিতে পরিণত করে আসন্ন সমাজ-বিপ্লব কিন্তু উত্তরাধিকারের এইসব দুশ্চিন্তাকে সর্বনিম্নে নামিয়ে আনবে। যেহেতু একপতিপত্নী প্রথা অর্থনৈতিক কারণ থেকে জন্মেছে, তাই সেসব কারণ চলে গেলে কি এটিও লোপ পাবে?

এর উত্তরে যৌক্তিকতার সঙ্গেই বলা চলে : এই প্রথা লোপ না পেয়ে পূর্ণভাবে প্রতিষ্ঠিত হবেই। কারণ উৎপাদনের উপায়গুলি সমাজের সম্পত্তি হওয়ার ফলে মজুরিশ্রম, প্রলেতারিয়েত লোপ পায় এবং সেই সঙ্গে সমাজের কিছু সংখ্যক স্ত্রীলোকের (সংখ্যাগতভাবে যা গণনাযোগ্য) পক্ষে অর্থের জন্য আত্মদানের আবশ্যকতাও লোপ পাবে। পতিতাবৃত্তি লোপ পাবে এবং একপতিপত্নী প্রথা ক্ষয় না পেয়ে শেষ পর্যন্ত বাস্তব হবে --- সেটা পুরুষদের পক্ষেও।

মোটের উপর, পুরুষদের অবস্থা এইভাবে যথেষ্ট পরিমাণে বদলে যাবে। কিন্তু নারীর ক্ষেত্রেও, সমস্ত নারীর ক্ষেত্রেও অবস্থার গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন ঘটবে। উৎপাদনের উপায় সমাজের সম্পত্তি হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ব্যক্তিগত পরিবারগুলি আর সমাজের একক (Unit) থাকবে না। ব্যক্তিগত গৃহস্থালী পরিণত হবে সামাজিক শিল্পে। শিশুর পরিচর্যা ও শিক্ষা হয়ে উঠবে সামাজিক ব্যাপার, বিবাহবন্ধনের মারফত অথবা বাইরে, শিশু যেভাবেই জন্মাক না কেন, সমাজ তাদের সকলের সমান দায়িত্ব নেবে। এইজন্যই 'ভবিষ্যৎ ফলাফলের' দুশ্চিন্তা নীতিগত ও অর্থনৈতিক উভয়দিক থেকে যেটি আজ সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক কারণ - যেজন্য একটি মেয়ে যাকে ভালোবাসে সেই পুরুষের কাছে অবাধে আত্মসমর্পণ করতে পারে না --- সে কারণ আর থাকবে না। এটা কি অধিকতর অবাধ যৌন সঙ্গমের ক্রমিক উদ্ভব ঘটাবার মতো এবং সেই সঙ্গে কৌমার্যের মর্যাদা ও স্ত্রীলোকের লজ্জাশরম সম্বন্ধে আরো শিথিল একটা জনমত উদ্ভবের মতো কারণ ঘটাবে না কি? এবং সর্বশেষে বর্তমান জগতে একপতিপত্নী প্রথা ও পতিতাবৃত্তি সম্পূর্ণ বিপরীত হলেও তারা পরস্পর অবিচ্ছেদ্য বিপরীত, একই সামাজিক অবস্থার দুটি মেরু -- এটা কি আমরা দেখিনি? তাই একপতিপত্নী প্রথাকেও বিলুপ্ত না করে কি গণিকাবৃত্তি লোপ পেতে পারে?

এখানে একটি নতুন জিনিস কার্যকরী হতে থাকবেম, এমন একটি জিনিস যা একপতিপত্নী প্রথার সূচনার সময় বড়জোর ভ্রুণ আকারে ছিল, যথা, ব্যক্তিগত যৌন প্রেম।

*************************************************************************

বিবাহের ক্ষেত্রে পূর্ণ স্বাধীনতা সাধারণভাবে তখনই কার্যকরী হতে পারে, যখন পুঁজিবাদী উৎপাদন এবং তারই সৃষ্টি করা মালিকানা সম্পর্ক বিলুপ্ত হয়ে সেইসব গৌণ অর্থনৈতিক হিসাবকে হটিয়ে দেয়, যেগুলি বিবাহের সঙ্গী নির্বাচনের উপর এত প্রভাব বিস্তার করে। তখন পরস্পর আকর্ষণ ছাড়া আর কোন উদ্দেশ্য থাকবে না।

যেহেতু যৌন প্রেম প্রকৃতিগতভাবেই একবদ্ধ --- যদিও বর্তমানে কেবল স্ত্রীলোকের বেলাতেই এই একবদ্ধতা পূর্ণমাত্রায় রূপায়িত হয় -- সেইজন্য যৌন প্রেমের ভিত্তিতে বিবাহ হচ্ছে প্রকৃতিগতভাবেই একপতিপত্নী প্রথা। আমরা আগেই দেখেছি যে, বাখোফেন যখন সমষ্টি-বিবাহ থেকে একবিবাহে অগ্রগতিকে স্ত্রী লোকদের কীর্তি বলেছিলেন তখন তিনি কত সঠিক ছিলেন; জোড়বাঁধা বিবাহ থেকে একপতিপত্নী প্রথায় অগ্রগতিকেই কেবল পুরুষের কাজ বলা যায় এবং ঐতিহাসিকভাবে এতে বস্তুতঃ স্ত্রীলোকের অবস্থার ক্রমাবনতি ঘটেছে এবং পুরুষের ক্ষেত্রে বিশ্বাসহানির সুযোগ বেড়েছে। তাই যে সমস্ত অর্থনৈতিক কারণের জন্য স্ত্রীলোকেরা পুরুষের নিত্যকার বিশ্বাসহানি সহ্য করতে বাধ্য হতো, --- নিজেদের জীবনযাত্রা নিয়ে এবং তার চেয়ে বেশি সন্তানের ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বেগ -- তার বিলোপের সঙ্গে সঙ্গেই স্ত্রীলোকের যে সমতা অর্জিত হবে তার ফলে অতীত সমস্ত অভিজ্ঞতা থেকে বলা যায়, স্ত্রীলোক বহুগামিনী না হয়ে বরং পুরুষই আরও কার্যকরীভাবে সত্যই একপত্নীব্রতই হবে।

কিন্তু একপতিপত্নী প্রথা থেকে যা নিশ্চিতই চলে যাবে তা হচ্ছে পুরানো মালিকানা প্রথা থেকে এ বিবাহ উদ্ভূত হওয়ায় তার ওপর যেসব বৈশিষ্ট্য মুদ্রিত হয়ে গিয়েছিল সেগুলি যথা, প্রথমত, পুরুষের আধিপত্য এবং দ্বিতীয়ত, বিবাহ বন্ধনের অচ্ছেদ্য বিবাহের ক্ষেত্রে পুরুষের আধিপত্য হচ্ছে তার আর্থিক আধিপত্যের প্রত্যক্ষ ফল এবং এ আর্থিক আধিপত্য লোপের সঙ্গে সঙ্গে আপনা আপনি তা লোপ পাবে। বিবাহবন্ধনের অচ্ছেদ্যতা অংশত এসেছে সেই অর্থনৈতিক অবস্থার কারণে যার মধ্যে একপতিপত্নী প্রথার উদ্ভব এবং অংশত এমন একটি যুগের রীতি থেকে যখন এইসব অর্থনৈতিক অবস্থা ও একপতিপত্নী প্রথার যোগাযোগ সঠিক হৃদয়ঙ্গম করা যায়নি এবং ধর্মে তা অতিরঞ্জিত হয়ে উঠত। বর্তমানেও বিবাহবন্ধনে হাজারো গুণ লঙ্ঘিত। যদি কেবলমাত্র প্রেমের ভিত্তিতে বিবাহই নীতিসিদ্ধ হয়, তাহলে বিবাহ তখনই নীতিসিদ্ধ যতক্ষণ প্রেম থাকে। ব্যক্তিগত যৌন প্রেমের অনুভূতির স্থায়িত্ব কিন্তু ব্যক্তিতে ব্যক্তিতে, বিশেষতঃ পুরুষদের মধ্যে খুবই বিভিন্ন হয়; তাই যখন একটি প্রেম একেবারে চলে যায় অথবা অপর একটি নতুন প্রেমাবেগ তার জায়গা নেয়, তখন স্বামী স্ত্রী উভয়ের পক্ষে এবং সমাজের পক্ষেও বিচ্ছেদ একটি আশীর্বাদ। বিবাহবিচ্ছেদ মামলার নিষ্প্রয়োজন কাদা মাড়িয়ে যাবার অভিজ্ঞতাটা শুধু আর সইতে হবে না।

*************************************************************************

আমরা বীর যুগের গ্রীকদের সংবিধানে দেখি যে, প্রাচীন গোত্র-সংগঠন তখনও পূর্ণ উদ্যমে চলছে; কিন্তু আমরা তার বিলুপ্তির সূত্রপাতও দেখতে পাই; পিতৃ অধিকার এবং সন্তানসন্ততি কর্তৃক সম্পত্তির উত্তরাধিকার, যার ফলে পরিবারের মধ্যে সম্পদ সঞ্চয়ে সাহায্য হলো এবং গোত্রের বিরুদ্ধে পরিবারকে শক্তি যোগাল; ধনের অসমতা, বংশানুক্রমিক অভিজাতকুল ও রাজতন্ত্রের প্রাথমিক ভ্রুণ সৃষ্টি করে যা সামাজিক ব্যবস্থাকে প্রভাবিত করল; দাসপ্রথা, যা প্রথমে যুদ্ধবন্দীদের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল, কিন্তু ইতিমধ্যেই উপজাতির অন্যান্য ব্যক্তি, এমনকি গোত্রের সদস্যদেরও দাসত্ববন্ধনের পথ করেছিল, আন্তঃউপজাতি যুদ্ধ থেকে গবাদি পশু, দাস ও সম্পদ লুট করে নিয়মিত জীবিকানির্বাহের উপায় হিসাবে স্থলে জলে নিয়মিত হানায় অধঃপতন; সংক্ষেপে --- ধনের প্রশস্তি শুরু হলো ও তাকেই শ্রেষ্ঠ কল্যাণ বলে সন্মান করা হলো এবং গোত্রের সাবেকী বিধি বিধানকে বিকৃত করা হলো বলপূর্বক ধন লুন্ঠন সমর্থনের জন্য। কেবলমাত্র একটি জিনিসের তখনও অভাব ছিল : একটি প্রতিষ্ঠান যা নবলব্ধ ব্যক্তিগত সম্পত্তিকে গোত্র-ব্যবস্থার সাম্যতন্ত্রী ঐতিহ্য থেকে শুধু যে বাঁচাবে তাই নয়, এতদিন যাকে হেয় জ্ঞান করা হতো সেই ব্যক্তিগত মালিকানাকে পবিত্র করবে, সেই পবিত্রকরণকে মানব সমাজের শ্রেষ্ঠ লক্ষ্য বলে ঘোষণা করবে শুধু তাই নয়, অধিকন্তু সম্পত্তি আহরণের ক্রমবিকাশমান নতুন রূপগুলির উপর এবং ধনবৃদ্ধি ত্বরান্বয়ণের উপর সাধারণ সামাজিক অনুমোদনের ছাপ দিয়ে দেবে; এমন একটি প্রতিষ্ঠান যার বলে সমাজের উদীয়মান শ্রেণী বিভাগ শুধু নয়, পরন্তু বিত্তশালী শ্রেণী কর্তৃক বিত্তহীন শ্রেণীগুলিকে শোষণ করার অধিকার, বিত্তহীনদের উপর বিত্তবানদের শাসনও চিরস্থায়ী করবে।

এবং সে প্রতিষ্ঠান এল। উদ্ভাবিত হলো রাষ্ট্র।

*************************************************************************