এই বর্তমান যুগ হচ্ছে কমিউনিজমের যুগ অর্থাৎ কিনা ক্যাপিটালিজমের ধ্বংস করে শ্রেণীভেদলুপ্ত মানব-সমাজের প্রতিষ্ঠা করবার যুগ। ক্যাপিটালিজমের ধ্বংসসাধন ও শ্রেণীভেদলুপ্ত সমাজের প্রতিষ্ঠাকরণ ব্যক্তিবিশেষের খেয়ালপ্রসূত রোমান্টিক মতবাদ নহে, এই মতবাদ হচ্ছে মানব-সমাজের ইতিহাসের বিভিন্ন অভিব্যক্তির বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ ও বিচারের ফলস্বরূপ। এই বৈজ্ঞানিক মতবাদের স্রষ্টা হচ্ছেন কার্ল মার্কস। কার্ল মার্কস ক্যাপিটালিস্ট সমাজের সমগ্র কাঠামোটিকে পুঙ্খানুপুঙ্খ রূপে বিশ্লেষণ করে দেখিয়ে দিয়েছেন যে, এই সমাজের কাঠামোটি ক্যাপিটালিস্ট সমাজের উৎপাদিকা শক্তির সঙ্গে সমাজের ক্যাপিটালিস্ট উৎপাদন প্রণালীর অবশ্যম্ভাবী মূলগত বিরোধের ফলে ভেঙে যেতে বাধ্য। অবশ্য এই ভেঙে যাওয়াটা আপনা-আপনি ঘটে উঠবে না কিম্বা ভগবানের মর্জিমতো ঘটবে না। এই ভাঙ্গনের কাজ ক্যাপিটালিস্ট সমাজের একটি শ্রেণীকে সম্পূর্ণ চেতন হয়ে আপনার ব্রত করতে হবে। সে শ্রেণী হচ্ছে শ্রমিক শ্রেণী, যাকে মার্কস 'ক্যাপিটালিজমের কবর খননকারী' বলে অভিহিত করেছেন। মার্কসের মতে যে - উপায়ে শ্রমিক শ্রেণী ক্যাপিটালিজমের ধ্বংসসাধন করবে, সেই উপায় হচ্ছে 'বিপ্লব'। নান্য পন্থা বিদ্যতে অয়নায়। মার্কসের জীবিত অবস্থায় ক্যাপিটালিজমের শেষ পরিণত অবস্থা - ইম্পিরিয়ালিজমে'র সূত্রপাত ঘটেনি। তাই এই ইম্পিরিয়ালিস্ট যুগের নির্দেশ করা ছাড়া, মার্কসের পক্ষে ইম্পিরিয়ালিস্ট যুগের প্রধান লক্ষণগুলি বিশ্লেষণ করে দেখানো সম্ভব হয়নি। এ বিষয়ে মার্কসের অসাধারণ সংযম তাঁর প্রত্যেক গ্রন্থে আমরা লক্ষ করি। তাঁর সমস্ত 'মতবাদ' ঐতিহাসিক বাস্তবতার উপর প্রতিষ্ঠিত। বিজ্ঞানের সঙ্গে খামখেয়াল মিশিয়ে তিনি মতবাদের সৃষ্টি করেননি। এই অসাধারণ সংযম, সামাজিক মতবাদকে বাস্তবতার সামাজিক জীবনের উপর প্রতিষ্ঠা করবার ও তাকে বার বার এই বাস্তবতার দ্বারা যাচাই করে দেখবার অনন্যসাধারণ শক্তি পরবর্তী যুগে আমরা একমাত্র লেনিনের মধ্যে দেখতে পাই। ঐতিহাসিক বস্তুবাদের অস্তিত্বের অভাবে মার্কস যেখানে থামতে বাধ্য হন, লেনিন ঠিক সেইখান থেকে শুরু করে পরবর্তী যুগে ইম্পিরিয়ালিজমের সমস্ত লক্ষণের বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছেন। মার্কস যখন ক্যাপিটালিস্ট সমাজের বিশ্লেষণ করে বিপ্লবের অনিবার্যতা প্রমাণ করেছিলেন, তখন বিপ্লবের থিয়োরিটিকাল যথার্থতা নিঃসন্দেহে প্রমান হলেও বিপ্লবের সমস্ত প্রণালীর বিচারের উপায় ছিল না। ক্যাপিটালিস্ট সমাজকে যে-বিপ্লব ধ্বংস করবে, সে বিপ্লব শুধু ইম্পিরিয়ালিস্ট যুগে অর্থাৎ কিনা ক্যাপিটালিজমের শেষ পরিণতির যুগে বাস্তব সমস্যা হয়ে ওঠে। সেই কারণে, তাঁর জীবিত অবস্থায় ইম্পিরিয়ালিজমের অস্তিত্বের অভাবে, মার্কসের পক্ষে সম্ভব হয়নি বিপ্লবের প্রণালী ও বিপ্লবের পরবর্তী কালে প্রলেতারিয়ান ডিকটেটরশিপ সম্বন্ধে বিস্তারিত ভাবে আলোচনা করার। প্যারিস কমিউনের অভিজ্ঞতা থেকে বিপ্লব প্রণালীর যত দূর শিক্ষালাভ করা যায় মার্কস তা দেখতে কসুর করেননি, কিন্তু সেই অভিজ্ঞতার উপর প্রতিষ্ঠিত নয় এমন কোনো মতবাদ তিনি প্রচার করেননি। এই ক্ষেত্রেও লেনিন মার্কসের আরব্ধ ব্রতকে সম্পন্ন করেছেন। লেনিনের জীবন আলোচনা করবার সময় আমাদের এটা মনে রাখতে হবে যে, রাশিয়ার প্রলেতারিয়ান বিপ্লবের ও বিশ্বব্যাপী প্রলেতারিয়ান বিপ্লবের নীতি সৃষ্টির ক্ষেত্রে ও সংগঠনের ক্ষেত্রে লেনিন সম্পূর্ণ ভাবে মার্কসের বৈজ্ঞানিক মতবাদের উপর প্রতিষ্ঠিত করেছেন।
লেনিনের জীবন আলোচনা করার মানে হচ্ছে, রাশিয়ার প্রলেতারিয়ান বিপ্লব-আন্দোলনের ইতিহাস ও বিপ্লবের পরবর্তী কালের ইতিহাসের আলোচনা করা। লেনিন ও রুশীয় বিপ্লব অভেদ্য যোগসূত্রে বদ্ধ। এদের পরস্পরকে পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন করা অসম্ভব।
=========================================================================
১৯১৮ সালে মিনস্ক শহরে রাশিয়ার সোশ্যাল ডেমোক্রাটিক দলের পত্তন করা হয়। ১৯০৩ সালে দলের দ্বিতীয় কনফারেন্সের অধিবেশন হয়। অধিবেশন শুরু হয় ব্রুসেলসে, কিন্তু নানা কারণে কনফারেন্স অসমাপ্ত অবস্থায় থাকে। পরে লন্ডনে কনফারেন্সের অধিবেশন শেষ করা হয়। এই লন্ডনের কনফারেন্সেই মতের বিভিন্নতার দরুণ রুশীয় সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক দল 'বলশেভিক' ও 'মেনশেভিক', এই দুই দলে বিভক্ত হয়ে যায়। মতের বিভিন্নতা যে-বিষয় নিয়ে ঘটে সেই বিষয়টি হচ্ছে এই - লন্ডনের কনফারেন্সে লেনিন প্রস্তাব আনেন যে, দলের প্রত্যেক সভ্যকে আইন-বিরুদ্ধ গুপ্ত আন্দোলনের কাজ করতে হবে। যারা এই আইন-বিরুদ্ধ কাজ করতে সক্ষম নয়, তারা লেনিনের মতে সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক দলের সভ্য হবার অধিকারী নয়। অ্যাক্সেলরড প্রভৃতি এক দল সোশ্যাল ডেমোক্রেট যারা পরে মেনশেভিক বলে খ্যাত হয়, তারা লেনিনের এই প্রস্তাবের ঘোরতর বিরুদ্ধতা করল। এদের মতে প্রফেসর, কলেজের ছাত্র, বিদ্যালয়ের শিক্ষক, আইন ব্যবসায়ী প্রভৃতি সকলকে সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক দলে প্রবেশ করবার সুযোগ দেওয়া উচিত। ঠিক এই মতবাদকে নাকচ করে দেবার জন্যেই লেনিন তাঁর প্রস্তাব এনেছিলেন। বিপ্লবমূলক শ্রমিক সংঘকে এই সব সুবিধাবাদী শিক্ষিতদের সংস্পর্শ থেকে রক্ষা করে ছিল লেনিনের উদ্দেশ্য। ১৯০৫ সালের বিপ্লবের আগে পর্যন্ত এই শিক্ষিত সম্প্রদায়ের অনেকেই মার্কসের বই থেকে উদ্ধৃত করে বুলি আওড়াত এবং নিজেদের সোশ্যাল ডেমোক্রেট বলে প্রচার করত। আসলে কিন্তু এরা বুর্জোয়া শ্রেণীর উদারনৈতিক (liberal) দলের লোক ছাড়া আর কিছুই ছিল না। এরা নিজেদের গা বাঁচিয়ে যতদিন কথার চাল দিয়ে চলত ততদিন নিজেদের সোশ্যাল ডেমোক্রেট বলে জাহির করতে কসুর করত না, কিন্তু যে-আইনী গুপ্ত বিপ্লবমূলক অনুষ্ঠানে যোগ দিয়ে নিজেদের বিপদাপন্ন করবার মত মুরদ এদের কারো ছিল না। এই বিপ্লবের বুলি আওড়াতে মজবুত, অথচ আসল কাজের বেলা পশ্চাৎপদ এই ধাপ্পাবাজ শিক্ষিত সম্প্রদায়ের লোকেদের অতি অনিষ্টকর বুর্জোয়া প্রভাব থেকে শ্রমিক আন্দোলনকে বাঁচাতে বদ্ধপরিকর ছিলেন লেনিন। যাঁরা লেনিনের যুক্তির যথার্থতাকে সমর্থন করে লেনিনের দলে রইলেন তাঁরা 'বলশেভিক' নামে খ্যাত হলেন, আর যারা দলের মধ্যে হরেক রকমের লোকের আমদানী করে শ্রমিক সংঘের বিপ্লবমূলক উদ্দেশ্যকে ব্যর্থ করে দেবার উদ্যোগ করল তারা 'মেনশেভিক' নামে খ্যাত হল। প্রথম দৃষ্টিতে মনে হতে পারে যে এমন একটা তুচ্ছ কারণ নিয়ে দলকে বিভক্ত করবার এমনই বা কী প্রয়োজন ছিল? পরবর্তী কালে দলের ইতিহাস লেনিনের অসামান্য দূরদর্শিতার ভূরি ভূরি প্রমাণ দিয়েছে। শুধু রুশীয় মেনশেভিক দল নয়, অন্য দেশের সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক দলগুলিও এই শিক্ষিত সম্প্রদায়ের লোকেদের মধ্যে প্রবেশের পথ সহজ করে দিয়ে দলগুলিকে ক্রমশই বুর্জোয়া ভাবাপন্ন করে তুলেছে। অবশ্য এই সব দল যে কোন বিচার না করে শিক্ষিত সম্প্রদায়ের সুবিধাবাদী লোকেদের মধ্যে প্রবেশ করতে দিয়েছে, তার কারণ অতি সুস্পষ্ট। তার কারণ হচ্ছে এই যে, দলগুলির নেতৃত্ব ছিল যাদের হাতে তারা নিজেরাই ছিল সুবিধাবাদী লোক। যতদিন বিপ্লবের সম্ভাবনা দূরে ছিল ততদিন এরা 'বিপ্লবী' ছিল - বিপ্লবের সম্ভাবনা যতই আসন্ন হয়ে এল তখন দেখা গেল পৃথিবীর সমস্ত দেশের সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক নেতার দল আসলে হচ্ছে বিপ্লবের ঘোরতর শত্রু। এই নেতারা হচ্ছে আসলে বুর্জোয়া সম্প্রদায়ভুক্ত, উদারনৈতিক দলভুক্ত লোক। এদের শ্রমিক আন্দোলনে প্রবেশের উদ্দেশ্যই হচ্ছে শ্রমিক আন্দোলনে বুর্জোয়া মতবাদের ভেজাল মিশিয়ে বিপ্লবকে প্রতিহত করা। পৃথিবীর সব দেশের সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক দল যখন ১৯১৪ সালের ইম্পিরিয়ালিস্ট যুদ্ধের সময় থেকে একেবারে পুরোপুরি ভাবে বিশ্বাসঘাতকতা করে শ্রমিকদের স্বার্থ ইম্পিরিয়ালিস্টদের পায়ে বিকিয়ে দিল, তখন একমাত্র বলশেভিক দল যে রুশীয় ও আন্তর্জাতিক শ্রমিক শ্রেণীর স্বার্থ বজায় রাখবার জন্যে সংগ্রাম করেছে - তার অন্যতম কারণ হচ্ছে যে, এই দল লেনিনের মতো নেতা পাবার সৌভাগ্যলাভ করেছিল, যে-নেতা বুর্জোয়া শিক্ষিত সম্প্রদায়ের সুবিধাবাদী লোকদের শ্রমিক সংগঠনের মধ্যে প্রবেশ করাবার পথে, বিপ্লবমূলক সংগঠনের অস্তিত্বের পক্ষে অবশ্যম্ভাবী প্রয়োজনীয় কঠোর পরীক্ষার ব্যবস্থা রেখেছিলেন।