Tuesday, 28 July 2020

লেনিন - সৌম্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর

এই বর্তমান যুগ হচ্ছে কমিউনিজমের যুগ অর্থাৎ কিনা ক্যাপিটালিজমের ধ্বংস করে শ্রেণীভেদলুপ্ত মানব-সমাজের প্রতিষ্ঠা করবার যুগ। ক্যাপিটালিজমের ধ্বংসসাধন ও শ্রেণীভেদলুপ্ত সমাজের প্রতিষ্ঠাকরণ ব্যক্তিবিশেষের খেয়ালপ্রসূত রোমান্টিক মতবাদ নহে, এই মতবাদ হচ্ছে মানব-সমাজের ইতিহাসের বিভিন্ন অভিব্যক্তির বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ ও বিচারের ফলস্বরূপ। এই বৈজ্ঞানিক মতবাদের স্রষ্টা হচ্ছেন কার্ল মার্কস। কার্ল মার্কস ক্যাপিটালিস্ট সমাজের সমগ্র কাঠামোটিকে পুঙ্খানুপুঙ্খ রূপে বিশ্লেষণ করে দেখিয়ে দিয়েছেন যে, এই সমাজের কাঠামোটি ক্যাপিটালিস্ট সমাজের উৎপাদিকা শক্তির সঙ্গে সমাজের ক্যাপিটালিস্ট উৎপাদন প্রণালীর অবশ্যম্ভাবী মূলগত বিরোধের ফলে ভেঙে যেতে বাধ্য। অবশ্য এই ভেঙে যাওয়াটা আপনা-আপনি ঘটে উঠবে না কিম্বা ভগবানের মর্জিমতো ঘটবে না। এই ভাঙ্গনের কাজ ক্যাপিটালিস্ট সমাজের একটি শ্রেণীকে সম্পূর্ণ চেতন হয়ে আপনার ব্রত করতে হবে। সে শ্রেণী হচ্ছে শ্রমিক শ্রেণী, যাকে মার্কস 'ক্যাপিটালিজমের কবর খননকারী' বলে অভিহিত করেছেন। মার্কসের মতে যে - উপায়ে শ্রমিক শ্রেণী ক্যাপিটালিজমের ধ্বংসসাধন করবে, সেই উপায় হচ্ছে 'বিপ্লব'। নান্য পন্থা বিদ্যতে অয়নায়। মার্কসের জীবিত অবস্থায় ক্যাপিটালিজমের শেষ পরিণত অবস্থা - ইম্পিরিয়ালিজমে'র সূত্রপাত ঘটেনি। তাই এই ইম্পিরিয়ালিস্ট যুগের নির্দেশ করা ছাড়া, মার্কসের পক্ষে ইম্পিরিয়ালিস্ট যুগের প্রধান লক্ষণগুলি বিশ্লেষণ করে দেখানো সম্ভব হয়নি। এ বিষয়ে মার্কসের অসাধারণ সংযম তাঁর প্রত্যেক গ্রন্থে আমরা লক্ষ করি। তাঁর সমস্ত 'মতবাদ' ঐতিহাসিক বাস্তবতার উপর প্রতিষ্ঠিত। বিজ্ঞানের সঙ্গে খামখেয়াল মিশিয়ে তিনি মতবাদের সৃষ্টি করেননি। এই অসাধারণ সংযম, সামাজিক মতবাদকে বাস্তবতার সামাজিক জীবনের উপর প্রতিষ্ঠা করবার ও তাকে বার বার এই বাস্তবতার দ্বারা যাচাই করে দেখবার অনন্যসাধারণ শক্তি পরবর্তী যুগে আমরা একমাত্র লেনিনের মধ্যে দেখতে পাই। ঐতিহাসিক বস্তুবাদের অস্তিত্বের অভাবে মার্কস যেখানে থামতে বাধ্য হন, লেনিন ঠিক সেইখান থেকে শুরু করে পরবর্তী যুগে ইম্পিরিয়ালিজমের সমস্ত লক্ষণের বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছেন। মার্কস যখন ক্যাপিটালিস্ট সমাজের বিশ্লেষণ করে বিপ্লবের অনিবার্যতা প্রমাণ করেছিলেন, তখন বিপ্লবের থিয়োরিটিকাল যথার্থতা নিঃসন্দেহে প্রমান হলেও বিপ্লবের সমস্ত প্রণালীর বিচারের উপায় ছিল না। ক্যাপিটালিস্ট সমাজকে যে-বিপ্লব ধ্বংস করবে, সে বিপ্লব শুধু ইম্পিরিয়ালিস্ট যুগে অর্থাৎ কিনা ক্যাপিটালিজমের শেষ পরিণতির যুগে বাস্তব সমস্যা হয়ে ওঠে। সেই কারণে, তাঁর জীবিত অবস্থায় ইম্পিরিয়ালিজমের অস্তিত্বের অভাবে, মার্কসের পক্ষে সম্ভব হয়নি বিপ্লবের প্রণালী ও বিপ্লবের পরবর্তী কালে প্রলেতারিয়ান ডিকটেটরশিপ সম্বন্ধে বিস্তারিত ভাবে আলোচনা করার। প্যারিস কমিউনের অভিজ্ঞতা থেকে বিপ্লব প্রণালীর যত দূর শিক্ষালাভ করা যায় মার্কস তা দেখতে কসুর করেননি, কিন্তু সেই অভিজ্ঞতার উপর প্রতিষ্ঠিত নয় এমন কোনো মতবাদ তিনি প্রচার করেননি। এই ক্ষেত্রেও লেনিন মার্কসের আরব্ধ ব্রতকে সম্পন্ন করেছেন। লেনিনের জীবন আলোচনা করবার সময় আমাদের এটা মনে রাখতে হবে যে, রাশিয়ার প্রলেতারিয়ান বিপ্লবের ও বিশ্বব্যাপী প্রলেতারিয়ান বিপ্লবের নীতি সৃষ্টির ক্ষেত্রে ও সংগঠনের ক্ষেত্রে লেনিন সম্পূর্ণ ভাবে মার্কসের বৈজ্ঞানিক মতবাদের উপর প্রতিষ্ঠিত করেছেন। 

লেনিনের জীবন আলোচনা করার মানে হচ্ছে, রাশিয়ার প্রলেতারিয়ান বিপ্লব-আন্দোলনের ইতিহাস ও বিপ্লবের পরবর্তী কালের ইতিহাসের আলোচনা করা। লেনিন ও রুশীয় বিপ্লব অভেদ্য যোগসূত্রে বদ্ধ। এদের পরস্পরকে পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন করা অসম্ভব। 

=========================================================================

১৯১৮ সালে মিনস্ক শহরে রাশিয়ার সোশ্যাল ডেমোক্রাটিক দলের পত্তন করা হয়। ১৯০৩ সালে দলের দ্বিতীয় কনফারেন্সের অধিবেশন হয়। অধিবেশন শুরু হয় ব্রুসেলসে, কিন্তু নানা কারণে কনফারেন্স অসমাপ্ত অবস্থায় থাকে। পরে লন্ডনে কনফারেন্সের অধিবেশন শেষ করা হয়। এই লন্ডনের কনফারেন্সেই মতের বিভিন্নতার দরুণ রুশীয় সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক দল 'বলশেভিক' ও 'মেনশেভিক', এই দুই দলে বিভক্ত হয়ে যায়। মতের বিভিন্নতা যে-বিষয় নিয়ে ঘটে সেই বিষয়টি হচ্ছে এই - লন্ডনের কনফারেন্সে লেনিন প্রস্তাব আনেন যে, দলের প্রত্যেক সভ্যকে আইন-বিরুদ্ধ গুপ্ত আন্দোলনের কাজ করতে হবে। যারা এই আইন-বিরুদ্ধ কাজ করতে সক্ষম নয়, তারা লেনিনের মতে সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক দলের সভ্য হবার অধিকারী নয়। অ্যাক্সেলরড প্রভৃতি এক দল সোশ্যাল ডেমোক্রেট যারা পরে মেনশেভিক বলে খ্যাত হয়, তারা লেনিনের এই প্রস্তাবের ঘোরতর বিরুদ্ধতা করল। এদের মতে প্রফেসর, কলেজের ছাত্র, বিদ্যালয়ের শিক্ষক, আইন ব্যবসায়ী প্রভৃতি সকলকে সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক দলে প্রবেশ করবার সুযোগ দেওয়া উচিত। ঠিক এই মতবাদকে নাকচ করে দেবার জন্যেই লেনিন তাঁর প্রস্তাব এনেছিলেন। বিপ্লবমূলক শ্রমিক সংঘকে এই সব সুবিধাবাদী শিক্ষিতদের সংস্পর্শ থেকে রক্ষা করে ছিল লেনিনের উদ্দেশ্য। ১৯০৫ সালের বিপ্লবের আগে পর্যন্ত এই শিক্ষিত সম্প্রদায়ের অনেকেই মার্কসের বই থেকে উদ্ধৃত করে বুলি আওড়াত এবং নিজেদের সোশ্যাল ডেমোক্রেট বলে প্রচার করত। আসলে কিন্তু এরা বুর্জোয়া শ্রেণীর উদারনৈতিক (liberal) দলের লোক ছাড়া আর কিছুই ছিল না। এরা নিজেদের গা বাঁচিয়ে যতদিন কথার চাল দিয়ে চলত ততদিন নিজেদের সোশ্যাল ডেমোক্রেট বলে জাহির করতে কসুর করত না, কিন্তু যে-আইনী গুপ্ত বিপ্লবমূলক অনুষ্ঠানে যোগ দিয়ে নিজেদের বিপদাপন্ন করবার মত মুরদ এদের কারো ছিল না। এই বিপ্লবের বুলি আওড়াতে মজবুত, অথচ আসল কাজের বেলা পশ্চাৎপদ এই ধাপ্পাবাজ শিক্ষিত সম্প্রদায়ের লোকেদের অতি অনিষ্টকর বুর্জোয়া প্রভাব থেকে শ্রমিক আন্দোলনকে বাঁচাতে বদ্ধপরিকর ছিলেন লেনিন। যাঁরা লেনিনের যুক্তির যথার্থতাকে সমর্থন করে লেনিনের দলে রইলেন তাঁরা 'বলশেভিক' নামে খ্যাত হলেন, আর যারা দলের মধ্যে হরেক রকমের লোকের আমদানী করে শ্রমিক সংঘের বিপ্লবমূলক উদ্দেশ্যকে ব্যর্থ করে দেবার উদ্যোগ করল তারা 'মেনশেভিক' নামে খ্যাত হল। প্রথম দৃষ্টিতে মনে হতে পারে যে এমন একটা তুচ্ছ কারণ নিয়ে দলকে বিভক্ত করবার এমনই বা কী প্রয়োজন ছিল? পরবর্তী কালে দলের ইতিহাস লেনিনের অসামান্য দূরদর্শিতার ভূরি ভূরি প্রমাণ দিয়েছে। শুধু রুশীয় মেনশেভিক দল নয়, অন্য দেশের সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক দলগুলিও এই শিক্ষিত সম্প্রদায়ের লোকেদের মধ্যে প্রবেশের পথ সহজ করে দিয়ে দলগুলিকে ক্রমশই বুর্জোয়া ভাবাপন্ন করে তুলেছে। অবশ্য এই সব দল যে কোন বিচার না করে শিক্ষিত সম্প্রদায়ের সুবিধাবাদী লোকেদের মধ্যে প্রবেশ করতে দিয়েছে, তার কারণ অতি সুস্পষ্ট। তার কারণ হচ্ছে এই যে, দলগুলির নেতৃত্ব ছিল যাদের হাতে তারা নিজেরাই ছিল সুবিধাবাদী লোক। যতদিন বিপ্লবের সম্ভাবনা দূরে ছিল ততদিন এরা 'বিপ্লবী' ছিল - বিপ্লবের সম্ভাবনা যতই আসন্ন হয়ে এল তখন দেখা গেল পৃথিবীর সমস্ত দেশের সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক নেতার দল আসলে হচ্ছে বিপ্লবের ঘোরতর শত্রু। এই নেতারা হচ্ছে আসলে বুর্জোয়া সম্প্রদায়ভুক্ত, উদারনৈতিক দলভুক্ত লোক। এদের শ্রমিক আন্দোলনে প্রবেশের উদ্দেশ্যই হচ্ছে শ্রমিক আন্দোলনে বুর্জোয়া মতবাদের ভেজাল মিশিয়ে বিপ্লবকে প্রতিহত করা। পৃথিবীর সব দেশের সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক দল যখন ১৯১৪ সালের ইম্পিরিয়ালিস্ট যুদ্ধের সময় থেকে একেবারে পুরোপুরি ভাবে বিশ্বাসঘাতকতা করে শ্রমিকদের স্বার্থ ইম্পিরিয়ালিস্টদের পায়ে বিকিয়ে দিল, তখন একমাত্র বলশেভিক দল যে রুশীয় ও আন্তর্জাতিক শ্রমিক শ্রেণীর স্বার্থ বজায় রাখবার জন্যে সংগ্রাম করেছে - তার অন্যতম কারণ হচ্ছে যে, এই দল লেনিনের মতো নেতা পাবার সৌভাগ্যলাভ করেছিল, যে-নেতা বুর্জোয়া শিক্ষিত সম্প্রদায়ের সুবিধাবাদী লোকদের শ্রমিক সংগঠনের মধ্যে প্রবেশ করাবার পথে, বিপ্লবমূলক সংগঠনের অস্তিত্বের পক্ষে অবশ্যম্ভাবী প্রয়োজনীয় কঠোর পরীক্ষার ব্যবস্থা রেখেছিলেন। 

Sunday, 26 July 2020

আর এস এস-বি জে পি এবং সোশ্যাল ইঞ্জিনীয়ারিং - গৌতম রায়

রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ নামক সংগঠনটির সবথেকে বড়ো বৈশিষ্ট্য হলো, তাঁরা ভারতীয়ত্বের কথা, জপমন্ত্রের মতো বললেও চিরন্তন ভারতবর্ষকে তাঁরা একদিনের জন্যেও স্বীকার করে না। সমন্বয়ী চেতনা, যা চিরন্তন ভারতবর্ষের প্রাণ ভ্রমরা, তাকেই তাঁরা স্বীকার করে না। তাই গান্ধীজী হত্যার দায়ে যখন ভারত সরকার এই সংগঠনটিকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে তখন সরকারী রোষানল থেকে বাঁচতে নানা কৌশল এঁরা অবলম্বন করলেও কোনো অবস্থাতেই সমন্বয়ী ভারতের চেতনাকে আরএসএস স্বীকার করেনি একটি মুহূর্তের জন্যে। নিষেধাজ্ঞার পর্বে ভারত সরকারের সঙ্গে আলাপ আলোচনার মাধ্যমে আপোষে সব কিছু মিটিয়ে নেওয়ার উদ্দেশে একনাথ রাণাডে আলাপ আলোচনা চালাতে শুরু করেন।

ভারত সরকার, বিশেষ করে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সর্দার বল্লভ ভাই প্যাটেলের সঙ্গে আরএসএসের উপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার এবং গোলওয়ালকরের মুক্তির বিষয়টি নিয়ে আপোষে আলাপ আলোচনার নেতৃত্ব এই একনাথ রাণাডেই দিয়েছিলেন। সর্দার প্যাটেলের সঙ্গে আরএসএস নেতা একনাথ রাণাডের প্রথম বৈঠকটি হয়েছিল মাইসোরে বিশিষ্ট শিল্পপতি ঘনশ্যামদাস বিড়লার বাড়িতে। এর আগে থেকেই নানা স্তরে আরএসএসের সঙ্গে জিডি বিড়লার একটি সম্পর্ক গড়ে উঠতে শুরু করেছিল। মূলত বৃহৎ বুর্জোয়াদের প্রতিনিধি কংগ্রেসের সঙ্গে বিড়লাদের ঘনিষ্ঠতা থাকলেও আরএসএসের সঙ্গে একটা সম্পর্ক রেখে প্রথম থেকেই চলে আসছিলেন জিডি বিড়লা।

মাইসোরে জিডি বিড়লার বাড়িতে সর্দার প্যাটেলের সঙ্গে তাঁর বৈঠকটিকে একনাথ রাণাডে 'বিশৃঙ্খলা' বলে পরবর্তী সময়ে অভিহিত করেছিলেন। প্যাটেলের পক্ষ থেকে রাণাডের উপর বার বার এই বলে চাপ সৃষ্টি করা হচ্ছিল যে, গোটা দেশের আইনশৃঙ্খলার পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে সঙ্ঘের দ্বারা - এমনটাই ছিল একনাথ রাণাডের অভিযোগ (১৯৬৯ সালের ২৯শে ডিসেম্বর কন্যাকুমারীতে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে একনাথ রাণাডে এই অভিযোগ করেছিলেন)। এই বৈঠকে সর্দার প্যাটেলের ভূমিকা সম্পর্কে সংশ্লিষ্ট সাক্ষাৎকারে বেশ ক্ষোভই রাণাডে প্রকাশ করেছিলেন। তাঁর মতে, কোন কোন ক্ষেত্রে আরএসএস আইন শৃঙ্খলার পরিবেশের অবনতি ঘটাচ্ছে - তার নাকি কোনো সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা দেশের গৃহমন্ত্রী সর্দার প্যাটেল দিতে পারেননি। সাক্ষাৎকারে রানাডে বলেন যে, আগে সঙ্ঘ সম্পর্কে যেসব অভিযোগ সর্দার প্যাটেল গোলওয়ালকরকে জানিয়েছিলেন, সেইসব অভিযোগ নিয়ে তিনি (রাণাডে) যখন প্যাটেলকে বিড়লার বাড়ির বৈঠকে চেপে ধরেন, তখন সেইসব বিষয়ে স্পষ্ট কোনো জবাব দেওয়া সর্দার প্যাটেলের পক্ষে সম্ভবপর হয়নি।

নরেন্দ্র মোদি প্রধানমন্ত্রী হয়ে সর্দার প্যাটেলের মূর্তি প্রতিষ্ঠা ইত্যাদি যেসব পদক্ষেপ নিয়েছেন, তার পিছনে সামগ্রিক ভাবে সঙ্ঘের কতোখানি সমর্থন রয়েছে, তা একনাথ রানাডের এই সাক্ষাৎকারটি প্রকাশ্যে আসার পর আলোচনার বিষয় হয়ে উঠেছে। গান্ধী হত্যার পর সঙ্ঘের উপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার এবং গোলওয়ালকরের মুক্তি প্রসঙ্গে দেশের তৎকালীন গৃহমন্ত্রী সর্দার প্যাটেলের অবশ্যই একটি সক্রিয় ভূমিকা ছিল। তবে তাঁর সেই সক্রিয়তা কতোখানি সঙ্ঘের স্বার্থে আর কতোখানি প্যাটেলের সঙ্গে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী পন্ডিত জওহরলাল নেহরুর সঙ্গে ব্যক্তি বিরোধের জেরে তা নিয়ে একটা সংশয় খোদ সঙ্ঘের ভিতরেই আছে।

সঙ্ঘের একটি অংশ মনে করেন যে, পন্ডিত নেহেরুর সঙ্গে নিজের ব্যক্তি বিরোধের জেরে প্যাটেল ব্যবহার করতে চেয়েছিলেন আরএসএসকে। কংগ্রেসের সঙ্গে সঙ্ঘের মিলনের প্রশ্নে সর্দার প্যাটেলের যে প্রস্তাব ছিল, সেই প্রস্তাব সঙ্ঘ বা কংগ্রেস দলের স্বার্থে যতো না সর্দার প্যাটেল দিয়েছিলেন, তার থেকে অনেক বেশি তিনি তাঁর নিজের স্বার্থে দিয়েছিলেন বলে সঙ্ঘ নেতৃত্বের একটি অংশ আজও মনে করেন। সঙ্ঘ নেতৃত্বের এই প্রসঙ্গে অনুমান এই ছিল যে, দক্ষিণপন্থী অবস্থানের প্রশ্নে কংগ্রেস দলের ভিতরে নেহরু লবির চাপে বেশ খানিকটা কোণঠাসা ছিলেন সর্দার প্যাটেল। তাঁর এই কোণঠাসা অবস্থাটা কাটিয়ে তুলতেই তিনি কংগ্রেসের ভিতরে সঙ্ঘকে মিশিয়ে দিতে চাইছিলেন। এই ব্যক্তিস্বার্থবাহী সর্দার প্যাটেলকে নিয়ে প্রধানমন্ত্রী হয়েই নরেন্দ্র মোদির অতি সক্রিয়তাকে সঙ্ঘ নেতৃত্বের একটা বড়ো অংশই খুব একটা ভালো চোখে নেয়নি।

মোদির এই অতি সক্রিয়তাকে সঙ্ঘের ভিতরে এখনো যাঁরা একনাথ রানাডে প্রমুখের একান্ত অনুগামী রয়েছেন, তাঁরা নিছক গুজরাটি অস্মিতাকে উসকে দেওয়া বলেই ধরেছিলেন। তাঁদের কাছে সঙ্ঘের উপর নিষেধাজ্ঞা চলাকালীন সময়ে সর্দার প্যাটেলের সঙ্গে একনাথ রানাডে বিতর্কের জেরে সর্দার প্যাটেলকে সার্বিকভাবে আরএসএসের রোল মডেল হিসেবে তুলে ধরা নিয়ে বেশ কিছুটা সংশয় আছে। এই সংশয়ের নিরিখেই হয়তো প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নেওয়ার পরই সর্দার প্যাটেলকে ঘিরে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির যে অতিসক্রিয়তা ছিল, তাতে এখন কিছুটা ভাঁটা পড়েছে।