ঋগ্বেদে নারীর বিষয়ে প্রথম উল্লেখটি হল, 'স্বয়ং সা মিত্ৰং বনুতে জনেচিৎ' নারী জনসমাজের মধ্যে নিজেই নিজের বন্ধু বা সঙ্গীকে বেছে নেয়।
====================================================
এখন সমাজে বহু প্রাচীন নিষেধকে অগ্রাহ্য করার জোয়ার এসেছে। বিগত পাঁচ ছশ' বছর সমাজে নারী পুরুষের অবাধ মেলামেশা নিয়ে কঠোর নিষেধ চাপানো ছিল; বর্তমানের ছেলেমেয়েরা সেটা অগ্রাহ্য করছে। কিন্তু এইটে কি ঐতিহ্যের বাইরে? বরং মধ্যযুগে যে নিষেধ আরোপিত হয়েছিল তাকেই এরা ভাঙছে। এবং ভাঙবার পর্বে কিছু আতিশয্য এসেই যায়; বিশেষত, রক্ষণশীল প্রতিপক্ষকে স্পর্ধার সঙ্গে তাচ্ছিল্য করার একটা মনোভাব এর মধ্যে আছে যেটা সর্বত্রই প্রতিবাদের স্বাভাবিক প্রকাশ। রক্ষণশীল অংশ সমাজে যদি একটু সহিষ্ণুতা অবলম্বন করেন তাহলে আতিশয্যটা কেটে যাবে একদিন; নারীপুরুষের যৌন এবং যে কোনো বন্ধুত্ব, ঘনিষ্ঠতা অনেক শোভন ও সহনীয় রূপে দেখা দেবে। আজ যেটাকে উচ্ছৃঙ্খলতা মনে হচ্ছে তার অনেকটাই পূর্ব প্রজন্মর প্রতি স্পর্ধিত অবজ্ঞা। ঐ প্রজন্ম এটাকে অবজ্ঞা করতে পারলে অনেক বাড়াবাড়ি ধিমিয়ে আসবে।
====================================================
বহু পূর্বে আর্যরা এ দেশে যখন আসে তখন তারা 'র' প্রধান ভাষা ব্যবহার করত। শ্রীযুক্ত অর্থে ওরা বলত 'শ্রীর' (র = যুক্ত)। কিছুদিন পরে যখন তারা দক্ষিণ দিকে এগোচ্ছিল তখন অনার্য স্থানীয় অধিবাসীদের কথ্য ভাষার প্রভাবে আর্যদের 'র' ক্রমে অনার্যদের 'ল'-য়ে পরিণত হয়। তখন শ্রীর হয় শ্রীল; আরও পরে শ্লীল, মানেটা রইল 'শ্রীযুক্ত'। এর বিপরীত অর্থ হল অশ্লীল অর্থাৎ শ্রীহীন। আমরা সচেতন নই যে আজকে যখন কিছুকে অশ্লীল বলি তখন মূল যে অর্থটি প্রকাশ করতে চাই তা হল শ্রীহীন। তাহলে মাপকাঠিটা হল সৌন্দর্য। এখন সৌন্দর্যের নিরিখ যুগে যুগে পালটেছে, থামেনি কোথাও। তবু সুপ্রাচীন গ্রীক, মিসরীয়, এশিরীয়, ব্যাবিলনীয়, মেক্সিকীয় এবং ভারতীয় স্থাপত্য ভাস্কর্যের যে নিদর্শন এখনো দেখে আমরা মুগ্ধ হই তার কারণ দীর্ঘ জগ পার করে ঐসব শিল্পকর্মে একটি শ্রী আছে যা ইতিহাস ও ভূগোলের বিপুল দূরত্বকে অতিক্রম করে মানুষের চিত্ত জয় করতে পেরেছে। প্রাচীন রাগরাগিণী, চিত্রশিল্প, সাহিত্য, অভিনয়, নৃত্যগীতের যে নিদর্শন আমাদের যুগ পর্যন্ত পৌঁছে আমাদের মুগ্ধ করে তার অন্তর্নিহিত রহস্যও ঐ শ্রী, সৌন্দর্য। এর কোনো স্থির সংজ্ঞা নেই, কিন্তু যুগে যুগে স্বীকৃত একটি সার্বজনীন গ্রাহ্যতার ভূমি আছে। যখন কোনো যুগ, বা কোনো দেশ একে লঙ্ঘন করে; তখন লঙ্ঘন করার একটা তাৎক্ষণিক উল্লাস নিশ্চয়ই থাকে। লঙ্ঘনকারীরা তাতে বেশ কিছুকাল আপ্লুত থাকতে পারে, কিন্তু একটা সম্ভাবনা থেকেই যায় যে ওরা তাৎক্ষণিক উল্লাস পেরিয়ে একদিন নিজেদের উদ্দামতার মধ্যে সৌন্দর্যের অভাব অনুভব করে অতৃপ্তি বোধ করবে। তখন ঐ শ্রীহীনতার অপূর্ণতা লক্ষ করবে এবং নিজেদের উদ্দাম আত্মপ্রকাশের মধ্যে শ্রী সঞ্চারিত করবার চেষ্টা করবে। ফলে যা দাঁড়াবে তা হয়ত আমাদের পরিচিত নয়, কিন্তু সেই অপরিচিত প্রকাশের মধ্যে আমরা হয়ত শ্রীয়ের এক নতুন প্রকাশ দেখতে পাব। এমনটা বারেবারেই ঘটেছে সভ্যতার ইতিহাসে এবং এই ধরনের বিবর্তনের মধ্যেই সভ্যতার অগ্রগতি হয়ে চলেছে। কাজেই ভবিষ্যৎকে চিরকালের মত অন্ধকার মনে করার কোনো কারণ নেই।
====================================================
পাশ্চাত্য সব কিছুকে নকল করার প্রবৃত্তি ঊনবিংশ শতকের ওপরতলার ছোট একটা সুবিধাভোগী শ্রেণীর মধ্যে খুব বেশি ছিল। কিন্তু দেশটা যেহেতু তখনও পরাধীন তাই শাসক শ্রেণীর আচার-আচরণকে পরিহার করার প্রবণতা পরিব্যাপ্ত ছিল অধিকাংশ মানুষের মধ্যে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরই ঐ বাধাটা দূর হল, ফলে, বিশেষত মধ্যবিত্তের ঘরে ঘরে ভুল উচ্চারণে, ভুল ভাষায় যত্রতত্র ইংরিজী বলার এবং ভুল উচ্চারণে ও বেসুরে বিলিতি গান গাওয়ার অভ্যাস দ্রূত বেড়ে গেল। তেমনই পাশ্চাত্য পোষাক, গান, নাচ, চলাফেরার ভঙ্গী, উৎসব নাটক সব কিছুরই বেশি প্রচলন হল। এখন বাঙালি মধ্যবিত্ত আর 'স্বামী', 'স্ত্রী' বলে না, বলে হাজব্যান্ড ওয়াইফ। টিভির বিজ্ঞাপনে পাশ্চাত্য জামাকাপড় পরা মেয়ে কৌপীন পরা পুরুষ দেখে সাহেবদের ভাষায় বিস্ময় ও আবেগ প্রকাশ করে, 'ওয়াও' বলেও মূর্ছাও যায়। প্রায় প্রত্যেকটি পণ্যদ্রব্যের বিজ্ঞাপনে বিদেশী পোশাকে তরুণতরুণী বিদেশী কেতায় নাচগান করে এবং এদের উচ্চারণে মার্কিনি প্রভাব স্পষ্টতই লক্ষণীয়, কারণ খেলো মার্কিন সিনেমাই এদের প্রেরণার উৎস। যত্রতত্র নাচ এখন প্রায় প্রত্যেকটি বিজ্ঞাপনের অপরিহার্য অঙ্গ এবং প্রায়শই সে নাচ বিদেশী। এর কারণ নকল করার মত দেশী নাচগানের কোনো নজির নেই, জীবনে, অভিনয়ে বা সিনেমায়। যা আছে তা পাশ্চাত্য নাচগানেরই নকল। অতএব পাশ্চাত্য আধুনিক সিনেমার প্রভাবে এই যে নাচগান চলছে তা শিক্ষিত মানুষের রুচিতে বাধছে, এর মধ্যে হাত পা নেড়ে উদ্দামতা প্রকাশ করা ছাড়া আর কিছু নেই। এটা অপসংস্কৃতি নয়, কিন্তু নেহাৎই রুচিগর্হিত।
====================================================
মার্ক্স বলেছিলেন স্থিতি, প্রতিস্থিতি ও সংস্থিতি এই পর্যায়ের মধ্যে দিয়ে এগোয় সমাজ। প্রথমে যা থাকে তা একদিন অপ্রয়োজনীয় অবাঞ্ছিত বলে প্রতিভাত হয়, তখন মানুষ তীব্রভাবে তার বিরুদ্ধ অবস্থানটি গ্রহণ করে, এটাই স্থিতিকে নাকচ করার জন্যে প্রবর্তিত প্রতিস্থিতি। তারপর একদিন প্রতিস্থিতির উপযোগিতা ফুরোয় তার অতিশয্যকে বর্জন করে তার সঙ্গে স্থিতির সমন্বয় ঘটায় মানুষ, সেটাই সংস্থিতি। আমাদের বেশবাস, উৎসব অনুষ্ঠান, নাচগানের বিবর্তনও এই স্থিতি-প্রতিস্থিতি-সংস্থিতির পর্যায়ে ঘটতে থাকে অনিবার্যভাবেই। কোনটা কতদিনে বদলাবে, কীভাবে, কেন ও কতটা বদলাবে তা আগে থেকে বলা যায় না ; তবে বিবর্তন এই অমোঘ নীতিতেই দীর্ঘকাল ধরে চলেছে মানবসভ্যতার সব ক্ষেত্রেই। এখানেও এই রীতিতেই বিবর্তন ঘটবে, ধৈর্য হারালে চলবে না। সব পরিবর্তন সর্বত্র সকলকে সন্তুষ্ট করতে পারে না, কিন্তু ভেতরের রুচির তাগিদই একদিন আবরণে ও আচরণে পরিবর্তন আনবে এতে কোনো সন্দেহ নেই।
====================================================
সংস্কৃত ভাষায় 'সংস্কৃতি'র তিনটি বিরুদ্ধ ধারণা আছে (ক) প্রকৃতি, (খ) বিকৃতি এবং (গ) সংস্কৃতি। প্রকৃতি মানে কোনো বস্তুর যে সাধারণ রূপ, যেমন মাটি, সোনা। বিকৃতি এর অর্থ 'বিশেষ কৃতি', বিশেষভাবে নির্মিত; বাংলার বিকার বা বিকৃত অর্থ নয়। এই বিকৃতির উদাহরণ হল যেমন মাটির কলসী, সোনার গয়না। অর্থাৎ প্রকৃতি দিয়ে মানুষের প্রয়োজনে শিল্পবোধ দিয়ে যে নির্মাণ। সংস্কৃতি হল বিকৃতির সুস্থতর ও সুন্দরতর রূপ, গান হল কণ্ঠস্বরের সুন্দর প্রকাশ, দৈনন্দিন কণ্ঠস্বরে কথাবার্তা বলা প্রকৃতির কাছাকাছি, তার সংস্কৃত অর্থাৎ শুদ্ধ ও সুন্দর মার্জিত বাগধারার প্রকাশ হল আবৃত্তি ও গান। এখন প্রকৃতিতে যেটি যেমনভাবে পাওয়া যায় তারই মনোরম রূপ বিবর্তন ঘটানোই সংস্কার বা সংস্কৃতি। আগেই বেদের উদ্ধৃতি দিয়েছি : আত্মসংস্কৃতির্বাব শিল্পানি। এ সংস্কৃতি হল শিল্পীর নিজের চেতনা ও বোধের সংস্কার, যার দ্বারা সে শিল্পবস্তু নির্মাণ করতে পারে ও করে। এ শিল্পবস্তু প্রকৃতি থেকে সরে আসা এক নির্মিত রূপ। প্রকৃতিকে শুদ্ধতর ও সুন্দরতর করার ফলই তাহলে সংস্কৃতি। মানুষের সভ্যতার ইতিহাসই হল প্রকৃতি থেকে সংস্কৃতিতে উত্তরণ।
====================================================
যুগে যুগে আগেকার জীবনধারা রক্ষা করবার জন্যে উগ্র চেষ্টা করেছে রক্ষণশীল গোষ্ঠী এবং তারই সঙ্গে যা কিছু প্রগতিশীল তার প্রভাবকে রুখতে চেষ্টা করেছে।
লক্ষ করলে দেখা যাবে বর্তমানে অপসংস্কৃতি নিয়ে যে শুচিবায়ুগ্রস্ত মনোভাব সমাজে প্রবল তার মধ্যে তিনটি দিক --- প্রধানত, পাশ্চাত্য প্রভাবের সম্বন্ধে বিরূপতা, দ্বিতীয়ত এবং এটাও পাশ্চাত্য প্রভাবের পরোক্ষ ফল মেয়েদের নতুন আচরণে আপত্তি, তৃতীয়ত যা কিছু দেশজ তার সম্বন্ধে অন্ধ আনুগত্য। পাশ্চাত্য প্রভাব দেশে আজ নতুন আসেনি; কিন্তু এখনকার সমাজে পাশ্চাত্য প্রভাবের যে উদগ্র অনুকরণ সেইটেকেই অপসংস্কৃতি বলছে রক্ষণশীল মানুষ।
====================================================
সাম্যবাদ আমাদের শিখিয়েছে, স্থিতির পরে আসে তার (প্রতিবাদী) প্রতিস্থিতি আর একদিন তার মধ্যেও স্ববিরোধ অবক্ষয় বা অন্যায়ের বীজ প্রকট হয়ে উঠলে উভয়ের সংঘর্ষ ও সমন্বয়ের ফলে আসে সংস্থিতি।
====================================================
... সংস্কৃতির সংজ্ঞার একটা দিক হল নারীর অবদমন, ব্যতিক্রম ঘটলে তার নাম অপসংস্কৃতি। নারীকে সর্বতোভাবে পুরুষের থেকে হীন প্রতিপন্ন করলে তাকে বশীভূত রাখা যায়। এর পিছনে রাষ্ট্রেরও একটা ভূমিকা আছে। নারীর অবদমন পুরুষতন্ত্র প্রতিষ্ঠার একটা আবশ্যিক শর্ত, রাষ্ট্র চায়, পুরুষসমাজকে বশংবদ রাখতে। ছলে, প্রলোভনে, প্রসাদবিতরণে। এতে পুরুষ রাষ্ট্রের স্বার্থের অনুকূল আচরণ করবে এবং নারীর স্বতন্ত্র সত্তা, স্বার্থ, অস্তিত্ব স্বীকার করার কোনো প্রয়োজন থাকবে না রাষ্ট্রের।
====================================================
অপসংস্কৃতির একটা লক্ষণ, নারীর অধীনতা না মানা। অন্য একটা প্রধান লক্ষণ হল, যা কিছু পাশ্চাত্য তাকেই অপসংস্কৃতি বলে অভিহিত করা। পাশ্চাত্য প্রভাব গত আড়াইশ' বছর ধরে কীভাবে সমস্ত সমাজ জীবনে অনুপ্রবিষ্ট হয়েছে তা লক্ষ করি না বলে আজকের এই উগ্র প্রতিবাদ। ঘড়ি, চেয়ার, টেবল, ট্রেন, মোটরকার, ফোন, ফ্রিজ, আধুনিক চিকিৎসা, জ্ঞানবিজ্ঞান, বিশেষত বিজ্ঞানের ও প্রযুক্তির চর্চা দেশে সমাজজীবনে ওতপ্রোতভাবে মিশে আছে কারণ এগুলো এমন বিষয়ে জীবনকে সহজ, গতিশীল করে, সময়সংক্ষেপ করে, নানাভাবে ব্যয়সংকোচনও করে যাতে জীবন যাপন সহজ, দ্রুত এবং আরামের হয়। কিন্তু তার বাইরে যদি জ্যাজ, বিচিত্র বেশবাস, নারীপুরুষের যৌথ বা সমবেত নৃত্য, উৎসব অনুষ্ঠানে নতুন বিদেশী আঙ্গিক দেখা দেয়, বিলিতি সুর, বিলিতি খাবার এবং নৃত্যভঙ্গীর চলন হয় তাহলে সেটা শুধু বিজাতীয় বলে পরিত্যাজ্য নয়, অপসংস্কৃতি বলেও সর্বতোভাবে পরিহরণীয়। এই হল এখনকার নতুন মনোভাব। এরা ভুলে গেছে যে, সেই ঊনবিংশ শতকে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ও রবীন্দ্রনাথ কত বিলিতি সুরে গান রচনা করেছেন। বিলিতি বিজ্ঞান, গবেষণা, চিকিৎসাশাস্ত্র কত সমাদর পেয়েছে তখন। বাঙালি মেয়েরা দেড়শ বছর আগে বিলেতে গিয়ে ডাক্তারি পাস করে এসেছেন, বাঙালি বৈজ্ঞানিক জগদীশচন্দ্র, মেঘনাথ সাহা বিলেতে গবেষণা করে এসে দেশের বিজ্ঞানচর্চাকে সমৃদ্ধ করেছেন। বিলিতি প্রভাব পরিহার করলে দেশটা মননসম্পদে দীন হয়ে থাকত। ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যের চর্চার পরোক্ষ প্রভাবে বিকশিত হয়েছিলেন মধুসূদন, বঙ্কিম, রবীন্দ্রনাথ। বিদেশী ভাবধারার প্রভাবে এদেশে সতীদাহ, বাল্যবিবাহ বন্ধ হয়, স্ত্রীশিক্ষা প্রবর্তিত হয়, নারীর কিছু কিছু অধিকার আইনে স্বীকৃত হয়। বিদেশী প্রভাবে শিক্ষার অঙ্গন বিস্তৃত হয়, ক্রমে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে মেয়েরা বাড়ির বাইরে চাকরি করতে আসে এবং তাদের মানবিক মূল্যায়নে নতুন এক মাত্রা সংযোজিত হয়। ঊনবিংশ শতকে বিদেশী জামাকাপড়ের প্রভাব, নারী পুরুষ উভয়ের ক্ষেত্রেই লক্ষ করা যায়। ক্রমে বিদেশী অর্থাৎ ফরাসী, জার্মান, স্প্যানিশ, ইটালিয়ান কাব্যনাটক উপাখ্যান পাঠে ও অনুবাদে কত না ঐশ্বর্য দেখা দেয় এবং ধীরে ধীরে একটি চর্চার ধারা গড়ে ওঠে যা প্রকারান্তরে বাংলা সাহিত্যকেই নানাভাবে সমৃদ্ধ করে। সমাজ বিজ্ঞান, নৃতত্ত্ব, পুরাতত্ত্ব যথার্থ ইতিহাসচর্চা, নানা বিভিন্ন প্রস্থানের দর্শনচর্চাও প্রবর্তিত হয়। আজকে বাঙালি যে সংস্কৃতি তার রূপ অনেকাংশেই নির্মাণ করেছে বিদেশী প্রভাব। মধ্যযুগে মোগল স্থাপত্য, ভাস্কর্য, সঙ্গীত ও চিত্রকলার প্রচুর প্রভাব এসে পড়ে ভারতীয় সংস্কৃতিতে, অবশ্যম্ভাবী রূপে বাংলার সংস্কৃতি এর দ্বারা বহুলাংশে প্রভাবিত হয়। এমনকী খাদ্য, বেশবাস, সৌজন্যমূলক আচরণ, সৌজন্যের বাকভঙ্গী ইত্যাদির ব্যাপারেও বিদেশী রীতিনীতির ছাপ লক্ষ করা যায়। এরপরে ইংরেজদের অধিপত্যকালে স্বভাবতই বিলিতি আদবকায়দা, জামাকাপড়, উৎসব-অনুষ্ঠান ও সামাজিক আচরণের প্রভাব পড়ল নারীপুরুষ উভয়েরই ওপরে। ঠান্ডা দেশের আপাদমস্তক আবৃত বেশবাসের প্রভাবে এখানকার নারীপুরুষও যথাসাধ্য ঐরকম সর্বাঙ্গ আবৃত করে রাখার রীতি মেনে নিল। যদিও ঐ মেমসাহেবরাই বল-নাচের আসরে অনেক স্বল্পাবরণ হয়েই নাচতে যায়। আমাদের দেশের শতকরা নব্বই জন আদিবাসী এবং চাষি ও মজুর নারীপুরুষ নিরপেক্ষভাবে স্বল্প বেশ ব্যবহার করে কাজের সুবিধার জন্যে এবং শরীরের স্বস্তি ও আরামের জন্যে। অবশ্য মধ্যবিত্তের হিসেবের মধ্যে ওদের চালচলন আসে না কেননা মানুষ হিসাবে তাদের গণ্য করাটা আমাদের চেতনায় বা অভ্যাসে নেই। কাজেই মূলত মধ্যবিত্তের কথাই বলছি। ঊনবিংশ শতকে সাহেবদের প্রভাবে বাঙালির বেশবাসে যে পরিবর্তন ঘটল তাতে স্বল্পবাস অসভ্যতার লক্ষণ বলে বিবেচিত হল।
====================================================
... শুধু লিঙ্গবৈষম্য বা নারী-পুরুষের স্বার্থের মধ্যেই আবদ্ধ রাখলে ব্যাপারটা যথেষ্ট মর্যাদা পায় না, তাই অনেক বড় পরিধির মধ্যে এনে ফেলা হল : সমাজের সংস্কৃতির মুলে কুঠারাঘাত করছে নারীর এই অশালীন আচরণ, তাই এর নাম দেওয়া হল অপসংস্কৃতি।
====================================================
====================================================
এ সমাজে নারী আছে স্বাধিকারে নয়, পুরুষের কাজে ও ভোগে লাগে তাই। না হলে তাদের অস্তিত্ব সমাজ মেনে নিতনা। কথাটা শুনতে বিস্ময়কর এবং অপ্রীতিকর, কিন্তু দুঃখের বিষয়, সমাজের শতকরা দুই তৃতীয়াংশের সম্বন্ধেই এটা সত্য। নারীর অবস্থান সমাজে বিপদসঙ্কুল। কী ঘরে কী বাইরে। দৈনিক সংবাদপত্রই একথা সাক্ষ্য বহন করে। নারীকে সমাজ সহ্য করে সমাজের নিজের প্রয়োজনে। তা সত্ত্বেও মানুষের মনে পুরুষ-প্রাধান্যের এমনই দৃঢ়মূল প্রভাব যে সমাজে কন্যা শিশুর জন্মই সংকুচিত হয়ে যাচ্ছে ক্রমে। আগে মনে করা হত, অ্যামনিওসেন্টেসিস পদ্ধতিতে ভ্রুণের লিঙ্গ নির্ণয় ও তারপরে কন্যাভ্রূণ নষ্ট করা বুঝি রাজস্থানের বৈশিষ্ট্য, কিন্তু এখন পশ্চিমবঙ্গে বহু ডাক্তার বা হাতুড়ে যন্ত্রে অ্যামনিওসেন্টেসিস-এর দ্বারা ভ্রুণের লিঙ্গ নিরূপণ করে কন্যাভ্রূণকে বিনষ্ট করছে এমন দৃষ্টান্ত একটুও বিরল নয়। ধীরে ধীরে কন্যাসন্তানের আনুপাতিক সংখ্যা কমবে এ রাজ্যেও। নারীকে হীন অবস্থানে রাখার চেষ্টা ও তার ফলে কন্যাভ্রূণ বিনাশ দিয়েই শুরু হয়। ভারতবর্ষের অন্যত্রও কন্যাসন্তানের সংখ্যা কমে গেছে বেশ ভয়াবহ রকমে, এই কমা স্বাভাবিক নয়, ডাক্তারের সাহায্যে কন্যাভ্রূণ নষ্ট করা হয়ে চলেছে পরিকল্পিতভাবে ও নিয়মিত, এবং এ ধারা চললে ক্রমশ ভয়াবহ অনুপাত দেখা দেবে পুত্র ও কন্যার জন্মে। রাজস্থানে বহু গ্রামে কন্যা নেই, বিয়ের জন্যে যৎসামান্য দামে অন্য কোনো গ্রাম থেকে দরিদ্র পরিবারের কন্যা কেনা হয় এবং সে যতটা স্ত্রী হয় তার চেয়েও বেশি হয় সারা পরিবারের বিনা বেতনের দাসী। পশ্চিমবঙ্গে যে হারে কন্যাভ্রূণ নষ্ট করা হচ্ছে তাতে ভয়াবহ রকম লিঙ্গ-বিপর্যয়ের সম্ভাবনা দূর ভবিষ্যতে হলেও আছে। এখনই কলকাতার অনুপাত একহাজার পুরুষের তুলনায় ৮৩৩ নারী। জেলাগুলির বড় শহরেও এ প্রবণতা ছড়াচ্ছে। এ সব বিষয়ে কেন উদাসীন এ প্রজন্ম? পুত্রকন্যার মধ্যে পার্থক্য করাটাও অপসংস্কৃতির প্রকাণ্ড একটা স্তম্ভ, সেদিকে পিছন ফিরে নারীর বহিরাবরণ ও আচরণের পরিবর্তনে আতঙ্কিত হওয়া, আর যাই হোক সুস্থ চেতনার পরিচায়ক নয়। অপসংস্কৃতি কোথায় রাষ্ট্র ও সমাজের সমর্থনে বেড়ে চলেছে তার দিকে নজর দিলে তুচ্ছ বেশবাস ও নাচগান নিয়ে বাড়াবাড়ি করার সময় ও প্রবৃত্তি হত না। এ ধরণের ক্রিয়াকলাপ যেখানে প্রচলিত, সেখানে তুচ্ছ পোষাক, নেশা, মেলামেশা ও নাচগানে স্বেচ্ছাচারিতাই চিহ্নিত হবে অপসংস্কৃতি বলে? কন্যাভ্রূণ বিনাশ এমন একটা মারাত্মক অমানবিক কাণ্ড, যে তার বিরুদ্ধে প্রবল প্রতিবাদ হলে তবেই তাতে সংস্কৃতির পরিচয় থাকত।