মনুর চোখে শূদ্র যেমন অপূর্ণ মানব, নারীও তাই । মনুসংহিতার বহু শ্লোকে নারী ও শূদ্র একই সাথে উচ্চারিত । যা শূদ্রের জন্যে নিষেধ তা নারীর জন্যেও নিষেধ । তাদের জন্যে একই বিধি-বিধান ।
মনুর ধর্মশাস্ত্রের তাত্ত্বিক ভিত্তি ছিল কর্মবাদ ও জন্মান্তরবাদ । মনুর কালের আগেই কর্মবাদ বৈধতা পেয়ে গিয়েছিল । পরে তার সাথে যুক্ত করা হয় জন্মান্তরবাদের তত্ত্বকে । মনুর ধর্মশাস্ত্র এই দুই মতবাদকে আরও দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠা করে । এই জন্মে দেবতারূপ দ্বিজ ও পতির সেবায় ত্রুটি ঘটলে পরজন্মে শুভ্রও নারীকে আরও হীনপশুযোনিতে জন্ম নিতে হবে । ব্রাহ্মণ্যধর্মের কুটিল উদ্ভাবনে কর্মবাদ ও জন্মান্তরবাদের গোলকধাঁধা থেকে শূদ্র যেমন মুক্তি পায়নি, নারীও পায়নি ।
মনুসংহিতার মূল উদ্দেশ্য ছিল ব্রাহ্মণের শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিপাদন । সেই শ্রেষ্ঠত্ব প্রায় দেবত্বের সমপর্যায়ের । কিন্তু এখানে একটা প্রশ্ন থেকে যায় । নিজেরা ভূতলস্থ দেবতার মর্যাদা গ্রহণ করেও, কেন তারা নিজেদের জননী-জায়া-ভগ্নী-কন্যা-বধূদের দেবীর মর্যাদায় ওপরে তুললেন না ? কেন তাদের নামিয়ে দিলেন দাসীর সমপর্যায়ে ? মনু ব্রাহ্মণ নারী ও শূদ্রা নারীর মধ্যে কোনও পার্থক্য রাখেননি । মনু সব বর্ণের নারীর জন্যে একই বিধান রেখে গেছেন । মনু নিজেদের পরিবারের নারীদেরও হীন অবস্থানে নামিয়ে দিয়েছিলেন অন্য বর্ণের নারীদের সাথে । এতটাই ছিল মনুর নারী বিদ্বেষ । মনু শুধু ব্রাহ্মণ্য আধিপত্য নয়, পুরুষতন্ত্রও সুপ্রতিষ্ঠিত করে গেছেন । তাঁর ধর্মশাস্ত্র সেই আধিপত্যবাদের তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা ।
==================================================================
"মানবধর্মশাস্ত্র" মনুসংহিতা
মনুসংহিতা সম্পূর্ণরূপে আচরণগত বিধি নির্দেশক শাস্ত্রগ্রন্থ । মনুসংহিতাকে বলা হয়েছে মানবধর্মশাস্ত্র । ভারতীয় সমাজ সংগঠনভুক্ত মানবসমষ্টির সব নরনারী জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত কীভাবে চলবে, কোন পরিস্থিতিতে নর-নারীর কী করণীয় আর কী বর্জনীয়, তাদের মৃত্যুর পর উত্তরাধিকারীরাই বা তাদের জন্যে কী করবেন, কোন স্খলন বা অপরাধের জন্যে কোন শাস্তি বা প্রায়শ্চিত্ত, সব ব্যাপারেই বিশদ বিধি-বিধান দিয়ে গেছেন মনু ।
==================================================================
মনুসংহিতা মানবীশাস্ত্র নয়
বর্ণবাদে বিভক্ত ভারতীয় সমাজব্যবস্থায় নারীর সামাজিক অবস্থান কখনও মর্যাদার ছিল না । সব ধর্মশাস্ত্র, স্মৃতি পুরাণেই নারীকে দেখানো হয়েছে হীনজন্মারূপে । নারীকে স্থান দেওয়া হয়েছে শূদ্র ও পশুর সাথে । মনুসংহিতার বহু শ্লোকে নারী ও শূদ্র একইসাথে উচ্চারিত ।
সুঙ্গযুগ থেকে গুপ্তযুগ-এর কালে রাষ্ট্রশক্তির সহায়তায় প্রাচীনতর বেদ ও বেদোত্তর অনুশাসনগুলির নতুনভাবে বিন্যাসের প্রয়োজন দেখা দেয় । এই উদ্দেশ্যেই আনুমানিক এই কালপর্বে মনুসংহিতা সংকলিত হয় । কল্যাণী বন্দোপাধ্যায় মনে করেন, "এই সময় বিভিন্ন বিধর্মী গোষ্ঠীর আগ্রাসন এবং বেদবিরোধী বৌদ্ধধর্মের ব্যাপক প্রসারের ফলে হিন্দুধর্মের এক সংকটকাল উপস্থিত হয় । তাই হিন্দুধর্মকে পুনরুজ্জীবিত করার উদ্দেশ্যে রচিত হয় স্মৃতিশাস্ত্র অথবা ধর্মশাস্ত্র । যার অনুশাসন ছিল অপেক্ষাকৃত কঠোর এবং অনেক সময় নিষ্ঠুর ।"
কল্যাণী বন্দোপাধ্যায় মনে করেন মানবধর্মশাস্ত্র "মনুসংহিতার যুগেই নারীকে সামগ্রিকভাবে পুরুষের পদানত করে প্রায় পশুতে পরিণত করার কাজটি সম্পূর্ণ হয় । যদিও এর প্রেক্ষাপট আগেই কিছুটা তৈরী হয়েছিল ।"
অন্য একটি গ্রন্থে তিনি দেখিয়েছেন, "প্রাচীনকাল থেকে হিন্দুশাস্ত্রের অনুশাসন অনুযায়ী ভারতীয় আর্থসামাজিক কাঠামোতে সর্বত্র সাধারণভাবে নারীকে শূদ্রের এবং পশুর সাথে একাসনে বসানো হয়েছে । বৈদিক যুগেও এর কোন ব্যতিক্রম ছিল না । শতপথ ব্রাহ্মণে নারীকে শুধু শূদ্র নয়, কুকুর এবং কালো পাখির (কাক) সঙ্গে তুলনা করে সবাইকে "অনৃত" বা "মিথ্যা" বলে ঘোষণা করা হয়েছে । স্মৃতিশাস্ত্রের প্রধান প্রবক্তা মনুও নারীকে "মিথ্যার মতই অপবিত্র" আখ্যা দিয়েছিলেন । ভগবদগীতায় শ্রীকৃষ্ণ নিজেই যে চাতুর্বর্ণ্য সৃষ্টি করেছেন এ কথা বলার সময় প্রসঙ্গত আরও বলেছেন যে বৈশ্য, শূদ্র এবং নারী প্রভৃতি "পাপযোনি"রা তাঁকে আশ্রয় করেই পরমগতি লাভ করে । অর্থাৎ বৈশ্য, শূদ্র এবং নারী সবাই এক স্থানীয় এবং পাপী । পরবর্তীকালে অনেক পুরাণেও প্রায় একই কথা শোনা যায় । উদাহরণস্বরূপ আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম শতক থেকে খ্রিস্ট পরবর্তী পঞ্চম শতকের মধ্যে রচিত বায়ু পুরাণে বলা হয়েছে যে পাপী, বৈশ্য, স্ত্রী (নারী) ও শূদ্র যদি একটি "গোপন স্তব" শোনে, তবে তারা রুদ্রলোকে (স্বর্গে) যায় । অর্থাৎ বৈশ্য, শূদ্র, নারী এবং পাপী সবাই পরস্পরের সাথে তুলনীয় এবং নিম্নস্তরের জীব (যারা সাধারণভাবে স্বর্গে যাবার অধিকারী নয়) ।
কল্যাণী বন্দোপাধ্যায় আরো দেখিয়েছেন, যে উপনিষদে শুধু দার্শনিক তত্ত্বই রয়েছে বলে মনে করা হয়, সেখানে আবার স্ত্রীর প্রতি স্বামীর সামাজিক অনুশাসন আছে যার সাথে তাত্ত্বিক দর্শনের প্রায় কোন মিল নেই । তিনি বৃহদারণ্যক উপনিষদের একটি শ্লোক তুলে ধরেছেন । "(প্রয়োজনে) স্ত্রীকে লাঠি বা হাত দিয়ে মারবে, " (৬।৪।৭) দেখা যাচ্ছে উপনিষদ শুধু দার্শনিক তত্ত্বের আকরই নয়, নারীর প্রতি অবমাননাকর বিধানও এতে আছে ।
======================
বেদ-উপনিষদে এত যে সব স্ততি নারীর, তার অবির্ভাবের, তার আত্মার, মনুসংহিতার কোথাও তার প্রভাব নেই । সেখানে নারী সম্পূর্ণরূপেই পুরুষের অধীন । তিনি পুরুষের অংশ নন । তার অবস্থান পুরুষের পদতলে । নারীকে মনুসংহিতা পাঠ করবার কিংবা শ্রবণের অধিকার পর্যন্ত দেননি মনু,
২/১৬ যার গর্ভাধান থেকে অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া পর্যন্ত বিধি মন্ত্র সহকারে উক্ত হয়েছে, এই শাস্ত্রে তার অধিকার জ্ঞাতব্য, অন্য কারও নয় ।
সুরেশচন্দ্র বন্দোপাধ্যায় 'যার' শব্দের ব্যাখ্যা দিয়েছেন 'দ্বিজ' বলে । আর 'অধিকার' বলতে তিনি অধ্যয়ন ও শ্রবণের অধিকার বলেছেন । পঞ্চানন্দ তর্করত্নের অনুবাদেও একই কথা লা হয়েছে । ব্রাহ্মণ্য সমাজসংগঠনে তারাই শুধু দ্বিজ যাদের জন্যে উপনয়নের বিধান রয়েছে । তারা শুধু পুরুষ, নারী নন । ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রিয় কন্যা হলেও নয় ।
======================
মনুর আগে বেদ অধ্যায়ন ছিল শিক্ষার প্রথম পাঠ । মনুর বিধানে মনুসংহিতায় বেদপাঠের অধিকার নিষিদ্ধ হয়ে যায় । মনু বললেন,
৯/১৮ স্ত্রীলোকদের মন্ত্রসহকারে (জাতকর্মাদি) সংস্কার নেই --- এই ধর্মবিহিত । এরা (ধর্মের প্রমান রূপ শ্রূতি স্মৃতিরহিতত্ব হেতু) ধর্মজ্ঞ নয়, (পাপনাশক মন্ত্র জপ রহিতত্ব হেতু) মন্ত্রহীন এবং মিথ্যার ন্যায় (অশুভ) --- এই শাস্ত্রীয় নিয়ম ।
মনু নারীকে মিথ্যার ন্যায় অশুভ এবং অধর্মজ্ঞ মন্ত্রহীন বলে চিহ্নিত করলেন । শুধু বেদপাঠ নয়, অন্যান্য সব ধর্মশাস্ত্র পাঠও নারীর জন্যে নিষিদ্ধ করে তার প্রথাগত সব শিক্ষার পথ বন্ধ করার বিধান দিলেন । তাতে নারীর মানবিক বিকাশের পথ চিরদিনের জন্যে বন্ধ হয়ে যায় । মনু চেয়েছিলেন নারীর ওপর পুরুষের নিরংকুশ আধিপত্য । সে জন্যে অনেক কঠোর বিধানও তাই যুক্ত করতে হয়েছে মনুসংহিতায়, এর সৃষ্টিকর্তাকে ।
যে নারী বেদের যুগে বেপারংগমা ব্রহ্মবাদিনী হতে পারতেন, হোমে যার ছিল সহজ অধিকার পুরুষের অনুরূপ, মনুসংহিতায় তা নিষিদ্ধ হয়ে যায় । হোমে নারীর অধিকার স্বীকার করতে চাননি মনু,
১১/৩৬ কন্যা, যুবতী, অল্পবিদ্যাসম্পন্ন ব্যক্তি, মূর্খ, রোগাদি পীড়িত ব্যক্তি ও অনুপনীত ব্যক্তি হোম করবে না ।
১১/৩৭ এই (উক্ত) ব্যক্তিরা হোম করলে তারা এবং যার জন্য করে সে নরকে পতিত হয় । সুতরাং, হোতা হবেন শ্রৌতকর্মে প্রবীণ ও বেদে পারদর্শী ।
কন্যা ও যুব-নারীকে এখানে পংক্তিভুক্ত করা হয়েছে অল্পবিদ্যাসম্পন্ন ও অসুস্থ পুরুষদের সাথে । এতে অবশ্য কোনও অসংগতি নেই । মনু তা করতেই পারেন । কন্যাদের শিক্ষাই তো শাস্ত্রসম্মত ছিল না মনুর কাছে । তাদের তো মূর্খ হয়ে থাকা ছাড়া কোনও বিকল্প ছিল না । কন্যাদের কুমারী হয়ে থাকারও কোন বিধান নেই মনুসংহিতায় । বিবাহ-ই কন্যার পরমাগতি ।
==================================================================
বিবাহ প্রসঙ্গে মনুসংহিতা
মানবধর্মশাস্ত্র মনুসংহিতায় কন্যা-শিশুর জন্য বিবাহ-ই ছিল প্রথম উল্লেখযোগ্য সংস্কার । পুত্রের উপনয়ন না হলে তার দ্বিজত্বে উত্তরণ হত না । কন্যার জন্যে উপনয়ন ছিল বিবাহ । মনু ২/৬৬ । মনুর ধর্মশাস্ত্রে নারীর জন্যে বিবাহ ছিল বাধ্যতামূলক ।
======================
বেদ রচনাকালের যুগে আমরা ব্রাহ্মবাদিনী বিশ্ববারা, অপালা, বাক, লোপামুদ্রাদের দেখেছি, তাঁরা অবিবাহিতই ছিলেন । পতিলোক নামে স্বর্গলাভের জন্যে বিবাহ নামক অনুষ্ঠানের সাথে জড়িত হয়ে তাঁদের পুরুষের অধীনতাকে স্বীকার করে নিতে হয়নি । সংখ্যায় অল্প হলেও বেদের যুগে চিরকুমারীদের অস্তিত্ব ছিল । কিন্তু মানবধর্মশাস্ত্র মনুসংহিতা সেই পথ রুদ্ধ করে দিয়েছিল । তাই ধর্মশাস্ত্রের যুগে আমরা অপালা-বিশ্ববারা-বাককে খুঁজে পাইনি । কোনও ধর্মশাস্ত্রের সাথেই নারীর নাম যুক্ত নয় । মনু নারীর বিবাহ অত্যাবশ্যক বলেই নির্দেশ দিয়েছিলেন । মনু নারীর বিবাহের বয়স পর্যন্ত নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন,
৯/৯৪ ত্রিশ বৎসর বয়স্ক পুরুষ মনোরমা দ্বাদশবর্ষীয়া কন্যাকে বিবাহ করবে অথবা চব্বিশ বৎসর বয়স্ক পুরুষ আট বৎসর বয়স্ক কন্যাকে বিবাহ করবে । ত্বরাবান্ ব্যক্তি (অর্থাৎ যে এই বয়স সীমার কম বয়সে বিবাহ করে সে) গার্হস্থ্যধর্মে অবসাদ প্রাপ্ত হয় ।
======================
মনুর মনোগত বাসনা ছিল কন্যা ঋতুমতী হওয়ার পূর্বেই তাকে সম্প্রদান করা । কন্যা ছিল জনকের কাছে বস্তু সমতুল । যেমন ভূমি, পশু ও বস্তু দান করা যায় । কন্যা বস্তু বলেই বিবাহ নামক অনুষ্ঠানে তাকে সম্প্রদান করা হয় । বর বস্তু নয় বলেই তাকে সম্প্রদান করা চলে না । মনু কন্যার নিম্নতম বিবাহ বয়স আট বছরের কম হলেও তাকে সম্প্রদান করার বিধান দিয়ে গেছেন,
৮/৮৮ কন্যা বিবাহযোগ্যা না হলেও তাকে উৎকৃষ্ট, সুরূপ ও সবর্ণ বরের কাছে বিধি অনুসারে সম্প্রদান করবে ।
কোন কন্যাকে বিবাহ করা যাবে মনুসংহিতায় তার বিস্তারিত বিবরণ রয়েছে,
৩/৮, ৩/৯ কপিলাবর্ণ, অধিকাঙ্গবিশিষ্টা, রোগগ্রস্তা, লোমহীনা, অধিকলোমবিশিষ্টা, বাচাল, পিঙ্গ লবর্ণা, নক্ষত্র, বৃক্ষ, নদী, পর্বত, পক্ষী, সর্প, দাস --- এইগুলির নামধারিণী এবং ভীতিজনক নামযুক্তা কন্যাকে বিবাহ করবে না ।
৩/১০ যে অঙ্গহীন নয়, যার নাম সুখে উচ্চার্য, হে হংসগতি বা গজগামিনী, যার লোম ও কেশ কোমল, দন্ত ক্ষুদ্র, অঙ্গ মৃদু , সেই স্ত্রীলোককে বিবাহ করবে ।
৩/১১ যে কন্যার ভ্রাতা নেই বা পিতা অজ্ঞাত, বিজ্ঞব্যক্তি পুত্রিকা ধর্মশঙ্কায় তাকে বিবাহ করবে না ।
======================
মনুসংহিতায় নারীর নাম কীধরণের হবে তারও নির্দেশ দেওয়া রয়েছে,
২/৩৩ স্ত্রীলোকের নাম হবে সহজে উচ্চার্য, অনিষ্ঠুরতাবাচক, অনায়াসবোধ্য, সুন্দর, শুভসূচক, অন্তে দীর্ঘবর্ণযুক্ত এবং আশীর্বাদবোধক ।
এই নির্দেশ লঙ্ঘন করলে সেই কন্যা বিবাহ করার যোগ্যা বলে বিবেচিত হবে না - এই ছিল মনুর বিধান ।
মনুসংহিতার অন্য একটি শ্লোকে "বিবাহযোগ্যা কন্যার উপযুক্ত পাত্র পাওয়া না গেলে মৃত্যপর্যন্ত পিতৃগৃহে রেখে দেওয়া উচিত" বলে বিধান দিয়েছেন মনু,
৯/৮৯ বরং কন্যা ঋতুমতী হয়েও আমরণ (পিতৃগৃহে) থাকবে, তথাপি কখনও তাকে নির্গুণ বরের হাতে দিবে না ।
======================
মনু তো কন্যার বিবাহের বয়স পর্যন্ত নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন (৯/৯৪) । এমনকি 'উৎকৃষ্ট সুরূপ ও সবর্ণ বর পেলে কন্যা বিবাহ-যোগ্যা না হলেও তাকে সম্প্রদান করতে বলেছেন (৯/৮৮) । অর্থাৎ বরের বয়স যাই হোক, 'সগুণ' হলে, আট বছরের কম হলেও কন্যাকে বিবাহ দেওয়া চলে । অন্য একটি শ্লোকে (৫/১৫৪) মনু বিধান দিয়েছেন পতি দুশ্চরিত্র, কামুক ও গুণহীন হলেও তাকে লঙ্ঘন করা যাবে না । তাকে দেবতার ন্যায় সেবা করে যেতে হবে । কোনও নারী সেই কালেও দুশ্চরিত্র কামুক গুণহীন বরকে স্বেচ্ছায় বরণ করে নিত না । তাকে তুলে দেওয়া হত তার হাতে । নির্গুণ বরের হাতে সম্প্রদান করা হলে কন্যা যাতে স্ত্রীধর্মপালনে অবাধ্য না হয়, তাই মনুর এই বিধান । নির্গুণ বরের হাতে বিবাহযোগ্যা কন্যাকে সম্প্রদান না করে তাকে আজীবন পিতৃগৃহে রেখে দেওয়ার মনু-উপদেশ তাই আমাদের বিভ্রান্ত করে ।
======================
==================================================================
নারীর ধর্ম : মনুর বিধান
মনু নারীকে কোনও রূপেই স্বাধীনতা দিতে চাননি । নারী সারাজীবন পুরুষের অধীনতা স্বীকার করে বেঁচে থাকবে জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত । কোনও রাখ-ঢাক না করেই মনু বলেছেন,
৯/২ স্ত্রীলোকদের (স্বামী প্রভৃতি) ব্যক্তিগণ তাদের দিনরাত পরাধীন রাখবেন, (অনিষিদ্ধ) রূপাদিবিষয়াসক্ত স্ত্রীলোকদেরও নিজের বশে রাখতে হবে ।
৯/৩ স্ত্রীলোককে পিতা কুমারী জীবনে, স্বামী যৌবনে ও পুত্র বার্ধক্যে রক্ষা করে; (কখনও) স্ত্রীলোক স্বাধীনতার যোগ্য নয় ।
৯/২ এরা রূপ বিচার করে না, (যৌবনাদি) বয়সে এদের আদর নেই, রূপবান বা কুরূপ পুরুষ মাত্রেই তার সঙ্গে সম্ভোগ করে ।
৯/৩ শয়ন, উপবেশন, অলংকার, কাম, ক্রোধ, কুটিলতা, পরহিংসা, মন্দ আচরণ -- এইগুলি স্ত্রীলোকের (স্বভাবগত করে) মনু সৃষ্টি করেছিলেন ।
২/২১৩ নারীদের স্বভাবই হল পুরুষদের দূষিত করা । অতএব পন্ডিতগণ স্ত্রীলোক সম্বন্ধে অনবহিত হন না ।
২/২১৪ সংসারে কাম ও ক্রোধের বশবর্তী বিদ্বান বা অবিদ্বান ব্যক্তিকে স্ত্রীলোক বিপথে নিতে পারে ।
মনু নারীদের এতটাই অবিশ্বাস করেছেন যে, জননী, ভগ্নী ও কন্যার সাথেও একাকী নির্জনগৃহে বাস করতে নিষেধ করে গেছেন ঠিক পরবর্তী শ্লোকে,
২/২১৫ মা, বোন বা মেয়ের সঙ্গে শূন্যগৃহাদিতে পুরুষ থাকবে না । শক্তিশালী ইন্দ্রিয়সমূহ বিদ্বান লোককেও বশীভূত করে ।
মনুর ধর্মশাস্ত্রের তাত্ত্বিক ভিত্তি ছিল কর্মবাদ ও জন্মান্তরবাদ । মনুর কালের আগেই কর্মবাদ বৈধতা পেয়ে গিয়েছিল । পরে তার সাথে যুক্ত করা হয় জন্মান্তরবাদের তত্ত্বকে । মনুর ধর্মশাস্ত্র এই দুই মতবাদকে আরও দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠা করে । এই জন্মে দেবতারূপ দ্বিজ ও পতির সেবায় ত্রুটি ঘটলে পরজন্মে শুভ্রও নারীকে আরও হীনপশুযোনিতে জন্ম নিতে হবে । ব্রাহ্মণ্যধর্মের কুটিল উদ্ভাবনে কর্মবাদ ও জন্মান্তরবাদের গোলকধাঁধা থেকে শূদ্র যেমন মুক্তি পায়নি, নারীও পায়নি ।
মনুসংহিতার মূল উদ্দেশ্য ছিল ব্রাহ্মণের শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিপাদন । সেই শ্রেষ্ঠত্ব প্রায় দেবত্বের সমপর্যায়ের । কিন্তু এখানে একটা প্রশ্ন থেকে যায় । নিজেরা ভূতলস্থ দেবতার মর্যাদা গ্রহণ করেও, কেন তারা নিজেদের জননী-জায়া-ভগ্নী-কন্যা-বধূদের দেবীর মর্যাদায় ওপরে তুললেন না ? কেন তাদের নামিয়ে দিলেন দাসীর সমপর্যায়ে ? মনু ব্রাহ্মণ নারী ও শূদ্রা নারীর মধ্যে কোনও পার্থক্য রাখেননি । মনু সব বর্ণের নারীর জন্যে একই বিধান রেখে গেছেন । মনু নিজেদের পরিবারের নারীদেরও হীন অবস্থানে নামিয়ে দিয়েছিলেন অন্য বর্ণের নারীদের সাথে । এতটাই ছিল মনুর নারী বিদ্বেষ । মনু শুধু ব্রাহ্মণ্য আধিপত্য নয়, পুরুষতন্ত্রও সুপ্রতিষ্ঠিত করে গেছেন । তাঁর ধর্মশাস্ত্র সেই আধিপত্যবাদের তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা ।
==================================================================
"মানবধর্মশাস্ত্র" মনুসংহিতা
মনুসংহিতা সম্পূর্ণরূপে আচরণগত বিধি নির্দেশক শাস্ত্রগ্রন্থ । মনুসংহিতাকে বলা হয়েছে মানবধর্মশাস্ত্র । ভারতীয় সমাজ সংগঠনভুক্ত মানবসমষ্টির সব নরনারী জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত কীভাবে চলবে, কোন পরিস্থিতিতে নর-নারীর কী করণীয় আর কী বর্জনীয়, তাদের মৃত্যুর পর উত্তরাধিকারীরাই বা তাদের জন্যে কী করবেন, কোন স্খলন বা অপরাধের জন্যে কোন শাস্তি বা প্রায়শ্চিত্ত, সব ব্যাপারেই বিশদ বিধি-বিধান দিয়ে গেছেন মনু ।
==================================================================
মনুসংহিতা মানবীশাস্ত্র নয়
বর্ণবাদে বিভক্ত ভারতীয় সমাজব্যবস্থায় নারীর সামাজিক অবস্থান কখনও মর্যাদার ছিল না । সব ধর্মশাস্ত্র, স্মৃতি পুরাণেই নারীকে দেখানো হয়েছে হীনজন্মারূপে । নারীকে স্থান দেওয়া হয়েছে শূদ্র ও পশুর সাথে । মনুসংহিতার বহু শ্লোকে নারী ও শূদ্র একইসাথে উচ্চারিত ।
সুঙ্গযুগ থেকে গুপ্তযুগ-এর কালে রাষ্ট্রশক্তির সহায়তায় প্রাচীনতর বেদ ও বেদোত্তর অনুশাসনগুলির নতুনভাবে বিন্যাসের প্রয়োজন দেখা দেয় । এই উদ্দেশ্যেই আনুমানিক এই কালপর্বে মনুসংহিতা সংকলিত হয় । কল্যাণী বন্দোপাধ্যায় মনে করেন, "এই সময় বিভিন্ন বিধর্মী গোষ্ঠীর আগ্রাসন এবং বেদবিরোধী বৌদ্ধধর্মের ব্যাপক প্রসারের ফলে হিন্দুধর্মের এক সংকটকাল উপস্থিত হয় । তাই হিন্দুধর্মকে পুনরুজ্জীবিত করার উদ্দেশ্যে রচিত হয় স্মৃতিশাস্ত্র অথবা ধর্মশাস্ত্র । যার অনুশাসন ছিল অপেক্ষাকৃত কঠোর এবং অনেক সময় নিষ্ঠুর ।"
কল্যাণী বন্দোপাধ্যায় মনে করেন মানবধর্মশাস্ত্র "মনুসংহিতার যুগেই নারীকে সামগ্রিকভাবে পুরুষের পদানত করে প্রায় পশুতে পরিণত করার কাজটি সম্পূর্ণ হয় । যদিও এর প্রেক্ষাপট আগেই কিছুটা তৈরী হয়েছিল ।"
অন্য একটি গ্রন্থে তিনি দেখিয়েছেন, "প্রাচীনকাল থেকে হিন্দুশাস্ত্রের অনুশাসন অনুযায়ী ভারতীয় আর্থসামাজিক কাঠামোতে সর্বত্র সাধারণভাবে নারীকে শূদ্রের এবং পশুর সাথে একাসনে বসানো হয়েছে । বৈদিক যুগেও এর কোন ব্যতিক্রম ছিল না । শতপথ ব্রাহ্মণে নারীকে শুধু শূদ্র নয়, কুকুর এবং কালো পাখির (কাক) সঙ্গে তুলনা করে সবাইকে "অনৃত" বা "মিথ্যা" বলে ঘোষণা করা হয়েছে । স্মৃতিশাস্ত্রের প্রধান প্রবক্তা মনুও নারীকে "মিথ্যার মতই অপবিত্র" আখ্যা দিয়েছিলেন । ভগবদগীতায় শ্রীকৃষ্ণ নিজেই যে চাতুর্বর্ণ্য সৃষ্টি করেছেন এ কথা বলার সময় প্রসঙ্গত আরও বলেছেন যে বৈশ্য, শূদ্র এবং নারী প্রভৃতি "পাপযোনি"রা তাঁকে আশ্রয় করেই পরমগতি লাভ করে । অর্থাৎ বৈশ্য, শূদ্র এবং নারী সবাই এক স্থানীয় এবং পাপী । পরবর্তীকালে অনেক পুরাণেও প্রায় একই কথা শোনা যায় । উদাহরণস্বরূপ আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম শতক থেকে খ্রিস্ট পরবর্তী পঞ্চম শতকের মধ্যে রচিত বায়ু পুরাণে বলা হয়েছে যে পাপী, বৈশ্য, স্ত্রী (নারী) ও শূদ্র যদি একটি "গোপন স্তব" শোনে, তবে তারা রুদ্রলোকে (স্বর্গে) যায় । অর্থাৎ বৈশ্য, শূদ্র, নারী এবং পাপী সবাই পরস্পরের সাথে তুলনীয় এবং নিম্নস্তরের জীব (যারা সাধারণভাবে স্বর্গে যাবার অধিকারী নয়) ।
কল্যাণী বন্দোপাধ্যায় আরো দেখিয়েছেন, যে উপনিষদে শুধু দার্শনিক তত্ত্বই রয়েছে বলে মনে করা হয়, সেখানে আবার স্ত্রীর প্রতি স্বামীর সামাজিক অনুশাসন আছে যার সাথে তাত্ত্বিক দর্শনের প্রায় কোন মিল নেই । তিনি বৃহদারণ্যক উপনিষদের একটি শ্লোক তুলে ধরেছেন । "(প্রয়োজনে) স্ত্রীকে লাঠি বা হাত দিয়ে মারবে, " (৬।৪।৭) দেখা যাচ্ছে উপনিষদ শুধু দার্শনিক তত্ত্বের আকরই নয়, নারীর প্রতি অবমাননাকর বিধানও এতে আছে ।
======================
বেদ-উপনিষদে এত যে সব স্ততি নারীর, তার অবির্ভাবের, তার আত্মার, মনুসংহিতার কোথাও তার প্রভাব নেই । সেখানে নারী সম্পূর্ণরূপেই পুরুষের অধীন । তিনি পুরুষের অংশ নন । তার অবস্থান পুরুষের পদতলে । নারীকে মনুসংহিতা পাঠ করবার কিংবা শ্রবণের অধিকার পর্যন্ত দেননি মনু,
২/১৬ যার গর্ভাধান থেকে অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া পর্যন্ত বিধি মন্ত্র সহকারে উক্ত হয়েছে, এই শাস্ত্রে তার অধিকার জ্ঞাতব্য, অন্য কারও নয় ।
সুরেশচন্দ্র বন্দোপাধ্যায় 'যার' শব্দের ব্যাখ্যা দিয়েছেন 'দ্বিজ' বলে । আর 'অধিকার' বলতে তিনি অধ্যয়ন ও শ্রবণের অধিকার বলেছেন । পঞ্চানন্দ তর্করত্নের অনুবাদেও একই কথা লা হয়েছে । ব্রাহ্মণ্য সমাজসংগঠনে তারাই শুধু দ্বিজ যাদের জন্যে উপনয়নের বিধান রয়েছে । তারা শুধু পুরুষ, নারী নন । ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রিয় কন্যা হলেও নয় ।
==================================================================
নারীর শিক্ষার অধিকার শাস্ত্রসম্মত নয়
মনু বেদকে অতিক্রম করেননি । মনুসংহিতায় বারংবার তা উচ্চারিত । মনু বেদমন্ত্রের রচয়িতা বেদকন্যাদের জানতেন না তা তো নয় । কিন্তু মনুসংহিতায় তিনি সেই বেদকন্যাদেরও বেদপাঠের অধিকার পর্যন্ত নেই বলে বিধান দিয়ে গেছেন ।
মনু মানবধর্মশাস্ত্রে নারীর জ্ঞানার্জন ও শিক্ষার অধিকারই তুলে দিলেন । তাদের জন্য কোনওরূপ সংস্কারের বিধান পর্যন্ত থাকল না । মনুর বিধান নারীকে সম্পূর্ণরূপে গৃহের অভ্যন্তরে ঢুকিয়ে দিল । নারীর বিবাহকে করা হল বাধ্যতামূলক ।নারীর জন্যে সব ধরনের শিক্ষা-দীক্ষা নিষিদ্ধ করে দেওয়া হল । তাকে বাধ্য করা হল স্বামী পুত্রের সেবা করে জীবনদান করতে । মনু বিধান দিলেন,
২/৬৭ স্ত্রীলোকদের বিবাহবিধি বৈদিক সংস্কার বলে কথিত, পতিসেবা গুরুগৃহে বাস এবং গৃহকর্ম তাদের (হোমরূপ) অগ্নিপরিচর্যা ।
নারীর জন্যে বিবাহ-ই হয়ে গেল সবচেয়ে বড় সংস্কার । পতিসেবা তুলনীয় হয়ে গেল গুরুগৃহ বাসের সাথে । আর গৃহকর্ম হল হোমরূপ অগ্নিপরিচর্যা । নারীর জন্যে আর কি প্রয়োজন ? মনু কিন্তু পুরুষদের জন্যে উপনয়ন ছাড়াও অন্যান্য জাতকর্মের বিধান রেখেছেন,
২/৬৫ ব্রাহ্মণের কেশান্ত সংস্কার ষোলো বৎসর বয়সে, ক্ষত্রিয়ের বাইশ বছর বৎসরে এবং বৈশ্যের চব্বিশ বৎসরে করণীয় ।
এখানে শূদ্র পুরুষের কথা নেই । মনুর কাছে শূদ্র কখনো পূর্ণমানব ছিল না । ... মনু যাদের কথা বললেন তারা সব দ্বিজপুত্র । কিন্তু দ্বিজপুত্রদের জন্যে যে সংস্কার ছিল বৈদিক উচ্চারণে ঋদ্ধ, দ্বিজকন্যাদের জন্যে তা ছিল অমন্ত্রক ।
২/৬৬ এক সকল সংস্কার স্ত্রীলোকের শরীর সংস্কারের জন্য যথাকালে ও যথাক্রমে অমন্ত্রক করণীয় ।
মনু মানবধর্মশাস্ত্রে নারীর জ্ঞানার্জন ও শিক্ষার অধিকারই তুলে দিলেন । তাদের জন্য কোনওরূপ সংস্কারের বিধান পর্যন্ত থাকল না । মনুর বিধান নারীকে সম্পূর্ণরূপে গৃহের অভ্যন্তরে ঢুকিয়ে দিল । নারীর বিবাহকে করা হল বাধ্যতামূলক ।নারীর জন্যে সব ধরনের শিক্ষা-দীক্ষা নিষিদ্ধ করে দেওয়া হল । তাকে বাধ্য করা হল স্বামী পুত্রের সেবা করে জীবনদান করতে । মনু বিধান দিলেন,
২/৬৭ স্ত্রীলোকদের বিবাহবিধি বৈদিক সংস্কার বলে কথিত, পতিসেবা গুরুগৃহে বাস এবং গৃহকর্ম তাদের (হোমরূপ) অগ্নিপরিচর্যা ।
নারীর জন্যে বিবাহ-ই হয়ে গেল সবচেয়ে বড় সংস্কার । পতিসেবা তুলনীয় হয়ে গেল গুরুগৃহ বাসের সাথে । আর গৃহকর্ম হল হোমরূপ অগ্নিপরিচর্যা । নারীর জন্যে আর কি প্রয়োজন ? মনু কিন্তু পুরুষদের জন্যে উপনয়ন ছাড়াও অন্যান্য জাতকর্মের বিধান রেখেছেন,
২/৬৫ ব্রাহ্মণের কেশান্ত সংস্কার ষোলো বৎসর বয়সে, ক্ষত্রিয়ের বাইশ বছর বৎসরে এবং বৈশ্যের চব্বিশ বৎসরে করণীয় ।
এখানে শূদ্র পুরুষের কথা নেই । মনুর কাছে শূদ্র কখনো পূর্ণমানব ছিল না । ... মনু যাদের কথা বললেন তারা সব দ্বিজপুত্র । কিন্তু দ্বিজপুত্রদের জন্যে যে সংস্কার ছিল বৈদিক উচ্চারণে ঋদ্ধ, দ্বিজকন্যাদের জন্যে তা ছিল অমন্ত্রক ।
২/৬৬ এক সকল সংস্কার স্ত্রীলোকের শরীর সংস্কারের জন্য যথাকালে ও যথাক্রমে অমন্ত্রক করণীয় ।
======================
মনুর আগে বেদ অধ্যায়ন ছিল শিক্ষার প্রথম পাঠ । মনুর বিধানে মনুসংহিতায় বেদপাঠের অধিকার নিষিদ্ধ হয়ে যায় । মনু বললেন,
৯/১৮ স্ত্রীলোকদের মন্ত্রসহকারে (জাতকর্মাদি) সংস্কার নেই --- এই ধর্মবিহিত । এরা (ধর্মের প্রমান রূপ শ্রূতি স্মৃতিরহিতত্ব হেতু) ধর্মজ্ঞ নয়, (পাপনাশক মন্ত্র জপ রহিতত্ব হেতু) মন্ত্রহীন এবং মিথ্যার ন্যায় (অশুভ) --- এই শাস্ত্রীয় নিয়ম ।
মনু নারীকে মিথ্যার ন্যায় অশুভ এবং অধর্মজ্ঞ মন্ত্রহীন বলে চিহ্নিত করলেন । শুধু বেদপাঠ নয়, অন্যান্য সব ধর্মশাস্ত্র পাঠও নারীর জন্যে নিষিদ্ধ করে তার প্রথাগত সব শিক্ষার পথ বন্ধ করার বিধান দিলেন । তাতে নারীর মানবিক বিকাশের পথ চিরদিনের জন্যে বন্ধ হয়ে যায় । মনু চেয়েছিলেন নারীর ওপর পুরুষের নিরংকুশ আধিপত্য । সে জন্যে অনেক কঠোর বিধানও তাই যুক্ত করতে হয়েছে মনুসংহিতায়, এর সৃষ্টিকর্তাকে ।
যে নারী বেদের যুগে বেপারংগমা ব্রহ্মবাদিনী হতে পারতেন, হোমে যার ছিল সহজ অধিকার পুরুষের অনুরূপ, মনুসংহিতায় তা নিষিদ্ধ হয়ে যায় । হোমে নারীর অধিকার স্বীকার করতে চাননি মনু,
১১/৩৬ কন্যা, যুবতী, অল্পবিদ্যাসম্পন্ন ব্যক্তি, মূর্খ, রোগাদি পীড়িত ব্যক্তি ও অনুপনীত ব্যক্তি হোম করবে না ।
১১/৩৭ এই (উক্ত) ব্যক্তিরা হোম করলে তারা এবং যার জন্য করে সে নরকে পতিত হয় । সুতরাং, হোতা হবেন শ্রৌতকর্মে প্রবীণ ও বেদে পারদর্শী ।
কন্যা ও যুব-নারীকে এখানে পংক্তিভুক্ত করা হয়েছে অল্পবিদ্যাসম্পন্ন ও অসুস্থ পুরুষদের সাথে । এতে অবশ্য কোনও অসংগতি নেই । মনু তা করতেই পারেন । কন্যাদের শিক্ষাই তো শাস্ত্রসম্মত ছিল না মনুর কাছে । তাদের তো মূর্খ হয়ে থাকা ছাড়া কোনও বিকল্প ছিল না । কন্যাদের কুমারী হয়ে থাকারও কোন বিধান নেই মনুসংহিতায় । বিবাহ-ই কন্যার পরমাগতি ।
==================================================================
বিবাহ প্রসঙ্গে মনুসংহিতা
মানবধর্মশাস্ত্র মনুসংহিতায় কন্যা-শিশুর জন্য বিবাহ-ই ছিল প্রথম উল্লেখযোগ্য সংস্কার । পুত্রের উপনয়ন না হলে তার দ্বিজত্বে উত্তরণ হত না । কন্যার জন্যে উপনয়ন ছিল বিবাহ । মনু ২/৬৬ । মনুর ধর্মশাস্ত্রে নারীর জন্যে বিবাহ ছিল বাধ্যতামূলক ।
======================
বেদ রচনাকালের যুগে আমরা ব্রাহ্মবাদিনী বিশ্ববারা, অপালা, বাক, লোপামুদ্রাদের দেখেছি, তাঁরা অবিবাহিতই ছিলেন । পতিলোক নামে স্বর্গলাভের জন্যে বিবাহ নামক অনুষ্ঠানের সাথে জড়িত হয়ে তাঁদের পুরুষের অধীনতাকে স্বীকার করে নিতে হয়নি । সংখ্যায় অল্প হলেও বেদের যুগে চিরকুমারীদের অস্তিত্ব ছিল । কিন্তু মানবধর্মশাস্ত্র মনুসংহিতা সেই পথ রুদ্ধ করে দিয়েছিল । তাই ধর্মশাস্ত্রের যুগে আমরা অপালা-বিশ্ববারা-বাককে খুঁজে পাইনি । কোনও ধর্মশাস্ত্রের সাথেই নারীর নাম যুক্ত নয় । মনু নারীর বিবাহ অত্যাবশ্যক বলেই নির্দেশ দিয়েছিলেন । মনু নারীর বিবাহের বয়স পর্যন্ত নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন,
৯/৯৪ ত্রিশ বৎসর বয়স্ক পুরুষ মনোরমা দ্বাদশবর্ষীয়া কন্যাকে বিবাহ করবে অথবা চব্বিশ বৎসর বয়স্ক পুরুষ আট বৎসর বয়স্ক কন্যাকে বিবাহ করবে । ত্বরাবান্ ব্যক্তি (অর্থাৎ যে এই বয়স সীমার কম বয়সে বিবাহ করে সে) গার্হস্থ্যধর্মে অবসাদ প্রাপ্ত হয় ।
======================
মনুর মনোগত বাসনা ছিল কন্যা ঋতুমতী হওয়ার পূর্বেই তাকে সম্প্রদান করা । কন্যা ছিল জনকের কাছে বস্তু সমতুল । যেমন ভূমি, পশু ও বস্তু দান করা যায় । কন্যা বস্তু বলেই বিবাহ নামক অনুষ্ঠানে তাকে সম্প্রদান করা হয় । বর বস্তু নয় বলেই তাকে সম্প্রদান করা চলে না । মনু কন্যার নিম্নতম বিবাহ বয়স আট বছরের কম হলেও তাকে সম্প্রদান করার বিধান দিয়ে গেছেন,
৮/৮৮ কন্যা বিবাহযোগ্যা না হলেও তাকে উৎকৃষ্ট, সুরূপ ও সবর্ণ বরের কাছে বিধি অনুসারে সম্প্রদান করবে ।
কোন কন্যাকে বিবাহ করা যাবে মনুসংহিতায় তার বিস্তারিত বিবরণ রয়েছে,
৩/৮, ৩/৯ কপিলাবর্ণ, অধিকাঙ্গবিশিষ্টা, রোগগ্রস্তা, লোমহীনা, অধিকলোমবিশিষ্টা, বাচাল, পিঙ্গ লবর্ণা, নক্ষত্র, বৃক্ষ, নদী, পর্বত, পক্ষী, সর্প, দাস --- এইগুলির নামধারিণী এবং ভীতিজনক নামযুক্তা কন্যাকে বিবাহ করবে না ।
৩/১০ যে অঙ্গহীন নয়, যার নাম সুখে উচ্চার্য, হে হংসগতি বা গজগামিনী, যার লোম ও কেশ কোমল, দন্ত ক্ষুদ্র, অঙ্গ মৃদু , সেই স্ত্রীলোককে বিবাহ করবে ।
৩/১১ যে কন্যার ভ্রাতা নেই বা পিতা অজ্ঞাত, বিজ্ঞব্যক্তি পুত্রিকা ধর্মশঙ্কায় তাকে বিবাহ করবে না ।
======================
মনুসংহিতায় নারীর নাম কীধরণের হবে তারও নির্দেশ দেওয়া রয়েছে,
২/৩৩ স্ত্রীলোকের নাম হবে সহজে উচ্চার্য, অনিষ্ঠুরতাবাচক, অনায়াসবোধ্য, সুন্দর, শুভসূচক, অন্তে দীর্ঘবর্ণযুক্ত এবং আশীর্বাদবোধক ।
এই নির্দেশ লঙ্ঘন করলে সেই কন্যা বিবাহ করার যোগ্যা বলে বিবেচিত হবে না - এই ছিল মনুর বিধান ।
মনুসংহিতার অন্য একটি শ্লোকে "বিবাহযোগ্যা কন্যার উপযুক্ত পাত্র পাওয়া না গেলে মৃত্যপর্যন্ত পিতৃগৃহে রেখে দেওয়া উচিত" বলে বিধান দিয়েছেন মনু,
৯/৮৯ বরং কন্যা ঋতুমতী হয়েও আমরণ (পিতৃগৃহে) থাকবে, তথাপি কখনও তাকে নির্গুণ বরের হাতে দিবে না ।
======================
মনু তো কন্যার বিবাহের বয়স পর্যন্ত নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন (৯/৯৪) । এমনকি 'উৎকৃষ্ট সুরূপ ও সবর্ণ বর পেলে কন্যা বিবাহ-যোগ্যা না হলেও তাকে সম্প্রদান করতে বলেছেন (৯/৮৮) । অর্থাৎ বরের বয়স যাই হোক, 'সগুণ' হলে, আট বছরের কম হলেও কন্যাকে বিবাহ দেওয়া চলে । অন্য একটি শ্লোকে (৫/১৫৪) মনু বিধান দিয়েছেন পতি দুশ্চরিত্র, কামুক ও গুণহীন হলেও তাকে লঙ্ঘন করা যাবে না । তাকে দেবতার ন্যায় সেবা করে যেতে হবে । কোনও নারী সেই কালেও দুশ্চরিত্র কামুক গুণহীন বরকে স্বেচ্ছায় বরণ করে নিত না । তাকে তুলে দেওয়া হত তার হাতে । নির্গুণ বরের হাতে সম্প্রদান করা হলে কন্যা যাতে স্ত্রীধর্মপালনে অবাধ্য না হয়, তাই মনুর এই বিধান । নির্গুণ বরের হাতে বিবাহযোগ্যা কন্যাকে সম্প্রদান না করে তাকে আজীবন পিতৃগৃহে রেখে দেওয়ার মনু-উপদেশ তাই আমাদের বিভ্রান্ত করে ।
মনুর অনিন্দনীয় বিবাহ পদ্ধতি হচ্ছে মূলত দানাত্মক বিবাহ । দানাত্মক বিবাহে কন্যা যেন প্রাণহীন বস্তু, সম্পত্তির সমতুল, অথবা পালিত পশু । তাই দানের বিষয় কন্যাদান হল শ্রেষ্ঠ দান, 'মহাদান' । দানের শাস্ত্রীয় পরিচয় হল দেয় বস্তুতে নিজের স্বত্বের অবসান ঘটিয়ে পরের স্বত্ব উৎপন্ন করা ... । তাই বিবাহে কন্যার পিতৃস্বত্ব বিলুপ্ত হয়ে যায় । নারীর গোত্রান্তর হয় ।
কোনও শাস্ত্রীয় বিধানেই নারীর স্বতন্ত্র সত্বা স্বীকৃত নয় । মনুর শাস্ত্রেও সেই স্বীকৃতি নেই । শুধুমাত্র বিবাহের পর সন্তান জন্মদান করার জন্যেই নারীকে সৃষ্টি করা হয়েছে । সেই তার একমাত্র কাজ ।(৯/৯৬)
==================================================================
নারীর ধর্ম : মনুর বিধান
মনু নারীকে কোনও রূপেই স্বাধীনতা দিতে চাননি । নারী সারাজীবন পুরুষের অধীনতা স্বীকার করে বেঁচে থাকবে জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত । কোনও রাখ-ঢাক না করেই মনু বলেছেন,
৯/২ স্ত্রীলোকদের (স্বামী প্রভৃতি) ব্যক্তিগণ তাদের দিনরাত পরাধীন রাখবেন, (অনিষিদ্ধ) রূপাদিবিষয়াসক্ত স্ত্রীলোকদেরও নিজের বশে রাখতে হবে ।
৯/৩ স্ত্রীলোককে পিতা কুমারী জীবনে, স্বামী যৌবনে ও পুত্র বার্ধক্যে রক্ষা করে; (কখনও) স্ত্রীলোক স্বাধীনতার যোগ্য নয় ।
৯/২ এরা রূপ বিচার করে না, (যৌবনাদি) বয়সে এদের আদর নেই, রূপবান বা কুরূপ পুরুষ মাত্রেই তার সঙ্গে সম্ভোগ করে ।
৯/৩ শয়ন, উপবেশন, অলংকার, কাম, ক্রোধ, কুটিলতা, পরহিংসা, মন্দ আচরণ -- এইগুলি স্ত্রীলোকের (স্বভাবগত করে) মনু সৃষ্টি করেছিলেন ।
২/২১৩ নারীদের স্বভাবই হল পুরুষদের দূষিত করা । অতএব পন্ডিতগণ স্ত্রীলোক সম্বন্ধে অনবহিত হন না ।
২/২১৪ সংসারে কাম ও ক্রোধের বশবর্তী বিদ্বান বা অবিদ্বান ব্যক্তিকে স্ত্রীলোক বিপথে নিতে পারে ।
মনু নারীদের এতটাই অবিশ্বাস করেছেন যে, জননী, ভগ্নী ও কন্যার সাথেও একাকী নির্জনগৃহে বাস করতে নিষেধ করে গেছেন ঠিক পরবর্তী শ্লোকে,
২/২১৫ মা, বোন বা মেয়ের সঙ্গে শূন্যগৃহাদিতে পুরুষ থাকবে না । শক্তিশালী ইন্দ্রিয়সমূহ বিদ্বান লোককেও বশীভূত করে ।
“
ReplyDeleteমনুসংহিতায় নারী প্রসঙ্গ উঠলে সবার প্রথমেই
কিছু আধুনিক নারীবাদী, বামপন্থী এবং ভিন্ন
ধর্মাবলম্বী সাম্প্রদায়িক ব্যক্তিগণ মনুসংহিতার
নবম অধ্যায়ের একটি বিখ্যাত শ্লোককে দৃষ্টান্ত
হিসেবে উপস্থাপন করে প্রমাণ করার চেষ্টা করেন।যে, ঋষি মনু অত্যন্ত নারী বিরােধী ছিলেন।গবেষণার নামে তারা মনুসংহিতায় বর্ণিত শ্লোকগুলার পৌর্বাপর্য বা সময়কাল বিবেচনায় না নিয়েই তাদের নিজস্ব মতামত এবং সিদ্ধান্ত স্থাপন করেন। কিন্তু ভাল করে একটু তলিয়ে দেখলে দেখা যায় তাদের সিদ্ধান্তটি সম্পূর্ণভাবে নিজস্ব চিন্তা এবং নিজস্ব বাস্তবতা নিরিখে একপাক্ষিক চাপিয়ে দেয়া সিদ্ধান্ত। উক্ত শ্লোকটিতে ভাল করে দৃষ্টি দিলে দেখা যায়, শ্লোকে রক্ষতি' শব্দের সুস্পষ্ট ব্যবহার করা হয়েছে। অর্থাৎ নারীকে পরাধীনতার নাগপাশে বদ্ধ নয় তাকে সকল অবস্থাতেই রক্ষা করতে হবে। গৃহের লক্ষ্মী স্বরূপা নারী যেন কোন অবস্থাতেই দুর্দশাগ্রস্ত না হয়।সনাতন ধর্ম নারীর সম্ভ্রম রক্ষার শিক্ষা দেয়। দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণের সময় ভগবান শ্রীকৃষ্ণ তার সম্ভ্রম রক্ষা করেছিলেন। ভিন্ন ধর্মাবলম্বী সাম্প্রদায়িক ব্যক্তিবর্গের সাথে সাথে স্বধর্মদ্বেষী কিছু আত্মঘাতী বুদ্ধিজীবীগণ মহর্ষী মনুর লিখিত
মনুস্মৃতিকে নারী বিদ্বেষী গ্রন্থ হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করতে প্রচেষ্টা করে। বিষয়টি অত্যন্ত দুঃখজনক এবং দুর্ভাগ্যজনক।'মনু' শব্দ থেকেই মানব, মানবতা, মানুষ, মনুষ্যত্ব ইত্যাদি শব্দের উৎপত্তি। তাই মহর্ষী মনুর নির্দেশনায় শুধু নারী-পুরুষ নয়; বৈশ্বিক মানবতার কথা বলা হয়েছে। শ্লোকগুলাকে স্থান, কাল, পাত্র বিবেচনা না করে নিজস্ব চশমা দিয়ে দেখতে গিয়ে আমরা মনুসংহিতা নিয়ে বিভ্রান্ত হচ্ছি। মানবসমাজের প্রাণ হচ্ছে নারী। তাদের মাধ্যমেই মানব প্রজাতির বংশধারা, প্রজন্ম রক্ষিত হয়। তাই তারা অত্যন্ত সম্মান প্রাপ্য। এ বিষয়গুলাে অত্যন্ত সুন্দর এবং সুস্পষ্টভাবে মহর্ষি মনু মনুসংহিতায় বলেছেন।
১.সর্বাবস্থায় নারীকে রক্ষা করতে হবে:
পিতা রক্ষতি কৌমারে ভর্তা রক্ষতি যৌবনে।
রক্ষত্তি স্থবিরে পুত্রা ন স্ত্রী স্বাতন্ত্রমহতি৷৷
(মনুসংহিতা:৯.৩)
“বিবাহের আগে কুমারী অবস্থায় স্ত্রীলােককে
পিতা রক্ষা করবে, যৌবনকালে বিবাহিতা স্ত্রীকে
স্বামী রক্ষা করবে, আর বৃদ্ধাবস্থায় পুত্রেরা রক্ষা
করবে; পতি-পুত্রবিহীনা স্ত্রীকেও সন্নিহিত পিতা প্রভৃতিরা রক্ষা করবে।কোনও অবস্থাতেই স্ত্রীলােককে অরক্ষিত স্বাতন্ত্র অবস্থায় রাখবে না
২. গৃহে গর্ভবতী নারীকে আগে খাবার দিতে হবে: ভারতবর্ষের সংস্কৃতিতে অতিথিকে দেবতা বলে সম্বােধন করা হয়। বেদের মধ্যেই আছে, অতিথি দেবাে ভবঃ। তাই কোন গৃহে আগমন করা অতিথি স্বরূপ দেবতাদের গৃহের গৃহকর্তাদের ভােজনের পূর্বেই ভােজন করানাে হয়। যেহেতু গৃহে অতিথিকে আগে খাইয়ে পরে গৃহস্থদের খাবার গ্রহণের রীতি। কিন্তু সেই গৃহে যদি কোন নববিবাহিতা বধূ, কন্যা এবং গর্ভবতী নারী থাকে তবে অতিথি ভােজনের পূর্বেই তাদের ভােজন প্রদান করতে হবে। নববিবাহিতা বধূ যেহেতু পিতার গৃহ থেকে এসে শশুরের গৃহে এক নতুন পরিবেশে আগমন করে। তাই সে নতুন পরিবেশ পরিস্থিতি বুঝে উঠতেও কিছু সময়ের প্রয়ােজন। সে অধিকাংশ সময়েই নিজের কথা মুখ ফুটে বলতে লজ্জা পায়।তাই পরিবারের সকলের খাবার পূর্বে তাকে খাবার কোনরকম বিচার না করেই ভােজন করাতে হবে।গৃহের বালক বালিকাদেরও স্বাস্থ্যের প্রয়ােজনে দেহে যেন পুষ্টির ব্যাঘাত ঘটতে না পারে তাই সকলে পূর্বেই ভােজন করাতে হবে।
সুবাসিনীঃ কুমারাংশ্চ রােগিণাে গর্ভিণীস্তথা।
অতিথিভ্যোহগ্র এবৈতা ভােজয়েদবিচারয়ন।।
(মনুসংহিতা: ৩.১১৪)
“সুবাসিনী অর্থাৎ নববিবাহিতা বধূ, পুত্রবধূ ও
কন্যা, বালক, রােগী এবং গর্ভবতী নারী এদের
অতিথি ভােজনের আগেই কোনরকম বিচার না করেই ভােজন করাবে। কারণ, স্বাস্থ্যের
প্রয়ােজনে এদের আহারাদির ব্যবস্থায় বিলম্ব
হওয়া উচিত নয়। বিলম্ব হলে তাদের পুষ্টির
ব্যাঘাত ঘটতে পারে। তাই অতিথিভােজনের
আগেই এদের ভােজন করালে কোনও দোষ হয় না।
৩.নারী অপহরণকারীদের মৃত্যুদণ্ড:
নারী অপহরণকারীদের মৃত্যুদণ্ডের মত সর্বোচ্চ দণ্ডে দণ্ডিত করতে হবে।
৩.নারী অপহরণকারীদের মৃত্যুদণ্ড:
ReplyDeleteনারী অপহরণকারীদের মৃত্যুদণ্ডের মত সর্বোচ্চ দণ্ডে দণ্ডিত করতে হবে।
পুরুষাণাং কুলীনানাং নারীণাঞ্চ বিশেষতঃ ।
মুখ্যানাঞ্চৈব রত্নানাং হরণে বধমৰ্হতি।।
(মনুসংহিতা:৮.৩২৩)
“পুরুষ কিংবা রূপ, গুণ ও সৌভাগ্যসম্পন্না নারী
এবং হীরা, বৈদূর্য প্রভৃতি উৎকৃষ্টজাতীয় রত্ন
অপহরণ করলে বধদণ্ড হবে।”
৪.পরিবারে পুত্র এবং কন্যার অধিকার সমান:
কন্যা পুত্রের সমান অধিকার ভােগ করবে।
কন্যার উপস্থিতিতে কেউ অন্যায়ভাবে তার
অধিকার হরণ করতে পারবে না।
যথৈবাত্মা তথা পুত্রঃ পুত্রেণ দুহিতা সমা।
তস্যামাত্মনি তিষ্ঠ্যাং কথমন্যো ধনং হরে।।
(মনুসংহিতা:৯.১৩০)
“কোন ব্যক্তি নিজেও যেমন পুত্রও সেইরকম,
অর্থাৎ আত্মা ও পুত্রতে কোন প্রভেদ নেই।
আবার দুহিতা বা কন্যার পুত্রেরই সমান
অধিকার। কন্যার পুত্র স্বয়ং বিদ্যমান থাকতে
অন্য কোনও ব্যক্তি কিভাবে তার পিতার ধন গ্রহণ
করবে? অর্থাৎ কন্যাকে তার পিতামাতার ধন
থেকে বঞ্চিত করা যাবে না।”
৫. পতি-পত্নীর সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্য এবং আমৃত্যু: পতি ও পত্নী অন্যকোন জীবনসঙ্গী গ্রহণ না করে আমৃত্যু একসাথে থাকবে এবং তারা কেউ ব্যাভিচারে লিপ্ত হতে পারবে না। স্ত্রী স্বামীর সাথে যুক্ত হয়ে সর্বদা ধর্মাচরণ করবেন।তাই স্ত্রীকে শাস্ত্রে সহধর্মিণী বলা হয়। সনাতন শাস্ত্রে স্বামী স্ত্রীর পারস্পরিক বিচ্ছেদকে নিন্দনীয় কর্ম বলা হয়েছে। কারণ
এতে বংশের সাথে সাথে সন্তানদের মনােজগতে প্রভূত ক্ষতি হয়
অন্যোন্যস্যাব্যভিচারাে ভবেদামরান্তিকঃ |
এষ ধর্মঃ সমাসেন জ্ঞেয়ঃ স্ত্রীপুংসয়ােঃ পরঃ।।
তথা নিত্যং যতেয়াতাং স্ত্রীপুংসৌ তু কৃতক্রিয়ৌ।
যথা নাতিচরেতাং তৌ বিযুক্তাবিতরেতর৷৷
(মনুসংহিতা:৯, ১০১-২)
“স্ত্রী এবং পুরুষের শ্রেষ্ঠ কর্তব্য সম্বন্ধে এই কথাই
সংক্ষেপে বলা যায় যে, মরণকাল পর্যন্ত পতি-পত্নী
পরস্পর পরস্পরের প্রতি ব্যভিচার অর্থাৎ
ব্যতিক্রম করবে না।
স্ত্রী এবং পুরুষ বিবাহ-সংস্কারে আবদ্ধ হয়ে সকল
সময় এমন কাজ করতে থাকবে, যাতে তারা
পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ে ধর্মাদি কাজ পৃথকভাবে না
করে।”
৬. ধর্ষণের শাস্তি মৃত্যুদণ্ড :
ReplyDeleteজোরপূর্বক নারীদের সাথে অবৈধ যৌন মিলনকে ব্যভিচার বলা হয়। যারা নারীদের ধর্ষণ করে বা উত্ত্যক্ত করে বা তাদের ব্যাভিচারে প্ররােচিত করে তাদের এমন শাস্তি দিতে হবে যাতে তা অন্যদের মধ্যে ভীতি সঞ্চার করে এবং কেউ তা করতে আর সাহস না পায়।ধর্ষণ বা নারীদের জোরপূর্বক
যৌন মিলনের প্রচেষ্টারূপ ব্যভিচার উৎপন্ন হলে সেক্ষেত্রে করণীয় প্রসঙ্গে মনুস্মৃতিতে সুস্পষ্টভাবে নির্দেশনা দেয়া আছে।যারা নারীদের ধর্ষণ করে বা উত্ত্যক্ত করে বা তাদের ব্যাভিচারে প্ররােচিত করে, তাদের এমন শাস্তি দিতে হবে যাতে তা অন্যদের মধ্যে ভীতি সঞ্চার করে এবং কেউ তা করতে আর সাহস না পায়।
পরদারাভিমর্ষেষু প্রবৃত্তান্ নৃন্ মহীপতিঃ।
উদ্বেজনকরৈর্দণ্ডশ্চিহ্নয়িা প্রবাসয়েৎ।।
(মনুসংহিতা:৮.৩৫২)
“যারা পরস্ত্রী নারীদের জোরপূর্বক যৌন মিলনের
প্রচেষ্টা করে ব্যভিচারে রত হয়, রাজা তাদের
নাক-কান ছেদন করে এমন শাস্তি দিবেন; যা
দেখে সকলে ভীত হয়। সে অবস্থায় তাদের দেশ
হতে বিতারিত করতে হবে।”
যােহকামাং দূষয়েৎ কন্যাং স সদ্যো বধমৰ্হতি।
সকামাং দূষয়ংস্তুল্যো ন বধং প্রাপুয়ান্নরঃ II
(মনুসংহিতা:৮.৩৬৪)
“যে পাপিষ্ঠ পুরুষ কোন কন্যাকে তার ইচ্ছার
বিরুদ্ধে জোরপূর্বক ধর্ষণ করে, তার কন্যাত্ব ভ্রষ্ট করবে; প্রমাণ পাওয়ার সাথেসাথেই রাজা তাকে সে দিনই বধদণ্ড প্রদান করবেন।তবে কন্যাটির যদি সেই কাজে ইচ্ছা এবং সম্মতি থাকে, তাহলে সম্ভোগকারীর শারীরিক দণ্ড হবে না।”
৭.নারী পূজ্যা, সমাদরনীয়া, ভূষনীয়া, সম্মাণীয়া ও বংশের শ্রীবৃদ্ধির কারণ:
যে বংশে স্ত্রীলােকেরা সন্তুষ্ট থাকে, সেই বংশ
নিশ্চিতভাবেই শ্রীবৃদ্ধি লাভ করে এবং দেবতারাও সেই বংশের প্রতি প্রসন্ন হয়। কিন্তু ভগিনী, পত্নী, পুত্রবধূ প্রভৃতি স্ত্রীলােকেরা যে বংশে অনাদৃত, অপমানিত সেই বংশ বিষপান করা ব্যক্তির ন্যায় ধন-পশু প্রভৃতিসহ সর্বতােভাবে বিনাশপ্রাপ্ত হয়। দেবতারাও সেই বংশের প্রতি রুষ্ট হন।
পিতৃভিড্রাতৃভিশ্চৈতাঃ পতিভির্দেবরৈস্তথা।
পূজ্যা ভূষয়িতব্যাশ্চ বহুকল্যাণমীক্ষ্ণভিঃ।।
যত্র নার্যস্তু পূজ্যন্তে রমন্তে তত্র দেবতাঃ।
যত্রৈতাস্তু ন পূজ্যন্তে সর্বাস্তত্ৰাফলাঃ ক্রিয়াঃ ।।
শােচন্তি জাময়াে যত্র বিনশ্যন্ত্যাশু তৎ কুল।
ন শােচন্তি তু যত্রৈতা বর্ধতে তদ্ধি সর্বদা।।
জাময়াে যানি গেহানি শপৰ্য্যপ্রতিপূজিতাঃ।।
তানি কৃত্যাহতানীব বিনশ্যন্তি সমন্ততঃ।।
তম্মদেতাঃ সদা পূজ্যা ভূষণাচ্ছাদনাশনৈঃ।
ভূতিকামৈনরৈর্নিত্যং সত্ত্বারেমূৎসবেষু চ৷৷
(মনুসংহিতা:৩.৫৫-৫৯)
“বিবাহসময়ে পতিই কেবল কন্যাকে ধনাদি
দিবেন এমন নয়, বিবাহােত্তর কালেও পিতা,
ভ্রাতা, পতি, দেবর ইহারা সকলেই যদি
বহুকল্যাণরাশির অভিলাষী হয়, তবে ঐ
কন্যাদিগকে ভােজনাদির দ্বারা পূজা করবে ও
বস্ত্র অলঙ্কারাদির দ্বারা ভূষিত করবে।
যে বংশে নারীরা বস্ত্রালঙ্করাদি দ্বারা পূজা বা
সমাদর প্রাপ্ত হন, সেখানে দেবগণ প্রসন্ন হয়ে
থাকেন এবং দেবতারা প্রসন্ন হলে পরিবারের
সবাই অভীষ্ট ফল প্রাপ্ত হয়। অন্যথা যে বংশে
নারীরা সমাদরনীয় নয়, সে গৃহে যাগ,হােম, দেব আরাধনাদি সমস্ত ক্রিয়াই নিষ্ফল হয়ে যায়।
যে বংশে ভগিনী ও গৃহস্থের সপিণ্ড স্ত্রী, কন্যা,
পুত্রবধূ প্রভৃতি নারীর ভূষণ-আচ্ছাদন-
অন্নাদির অভাবে দুঃখিনী হয়, সেই বংশ অতিশীঘ্র ধ্বংস প্রাপ্ত হয় অর্থাৎ দৈব ও রাজাদের দ্বারা পীড়িত হয়।পক্ষান্তরে যে বংশে নারীরা ভােজন-আচ্ছাদনাদিতে দুঃখী না থেকে সন্তুষ্ট থাকে সেই বংশের নিশ্চিতভাবে শ্রীবৃদ্ধি হয়। ভগিনী, পত্নী, পুত্রবধু প্রভৃতি স্ত্রীরা অনাদৃত হয়ে যে বংশকে উদ্দেশ্য করে অভিশাপ দেন, সেই বংশ অভিচার হতের মত ধনপশু প্রভৃতির সহিত সর্বতােভাবে বিনাশ প্রাপ্ত হয়। অতএব যারা ভূতি অর্থাৎ ঐশ্বৰ্য্য সম্পদাদি কামনা করেন, এইরকম পতিসম্বন্ধীয় লােকেরা উপনয়ন, অন্নপ্রাশন প্রভৃতি বিভিন্ন সৎকাৰ্য্যানুষ্ঠানে এবং নানা উৎসবে অলঙ্কার, বস্ত্র ও ভােজনাদির দ্বারা নিত্য নারীদের পূজা করব অর্থাৎ সম্মানিত করবে।”
৮.স্বামী-স্ত্রীর কেউ ব্যভিচার করতে পারবে না:
ReplyDeleteস্ত্রিয়ান্তু রােচমানায়াং সর্বং তদ্ৰোচতে কুলম্।
তস্যাল্বরাচমানায়াং সর্বমেব ন রােচতে৷৷
(মনুসংহিতা:৩.৬২)
ভূষণাদির দ্বারা স্ত্রী সুসজ্জিত থাকলে সম্পূর্ণ
বংশ শােভামণ্ডিত থাকে। আর স্ত্রীর প্রতি স্বামীর যদি রুচি না থাকে তাহলে সমস্ত পরিবার শােভাহীন হয়ে পড়ে।” স্বামীর যেমন স্ত্রীর প্রতি সম্পূর্ণ রূচি এবং ভালােবাসা থাকতে হবে। তেমনি বিপরীতক্রমে
স্ত্রীর স্বামীর প্রতি সম্পূর্ণ সমর্পণ এবং ভালােবাসা থাকতে হবে। স্ত্রীকে কায়মনােবাক্যে সংযত থাকতে হবে। পতির এবং তার বংশের কোনও অনিষ্ট চিন্তা করতে পারবে না। তবেই সেই স্ত্রী স্বামীর অর্জিত পুণ্যে লাভ করে এবং সমাজ তাকে ‘সাধ্বী' বলে প্রশংসা করেন।কিন্তু যে স্ত্রী
স্বামীর প্রতি ব্যভিচারিণী হয়ে অন্য পুরুষের সাথে সম্পর্ক করে। বিষয়টি জানাজানি হলে জগতে সে যেমন নিন্দনীয় হয় এবং ভয়ংকর রােগের দ্বারা আক্রান্ত হয়।মৃত্যুর পরে মুক্তিলাভ না করে জন্মান্তরে শৃগাল সহ বিবিধ পশুযােনিতে জন্মগ্রহণ করে।
পতিং যা নাতিচরতি মনােবাগদেহসংযতা।
সা ভর্তৃলােকানাগ্লোতি সম্ভিঃ সাধ্বীতি চোচ্যতে।।
ব্যভিচারাত্ত্ব ভর্তুঃ স্ত্রী লােকে প্রাপ্লেতি নিন্দ্যতাম্।
শৃগালযােনিঞ্চাপ্নোতি পাপরােগৈশ্চ পীড্যতে।।
(মনুসংহিতা:৯.২৯-৩০)
“যে কায়মনােবাক্যে সংযত থেকে পতির কোনও
অনিষ্ট চিন্তা করে না, সেই স্ত্রী স্বামীর পুণ্যে
অর্জিত যে উৎকৃষ্ট লােক, সেখানে গমন করে
এবং সাধুগণও তাকে ‘সাধ্বী বলে প্রশংসা
করেন। কিন্তু যে স্ত্রী স্বামীর প্রতি ব্যভিচারিণী হয় অর্থাৎ অন্য পুরুষের সাথে সম্ভোগ করে, ইহলােকে সে নিন্দনীয় হয় এবং জন্মান্তরে শৃগাল-যােনিতে জন্মগ্রহণ করে ও নানারকম ক্ষতিকারক রােগের দ্বারা আক্রান্ত হয়।”
৯. জন্মদায়িনী মাতা, স্ত্রী এবং কন্যার নামে মিথ্যা দোষারােপ করলে, তাকে দণ্ডিত করতে হবে: যদি কেউ মা, স্ত্রী বা কন্যার নামে মিথ্যে
দোষারােপ করে তাদের নামে কুৎসা রটনা করে সামাজিকভাবে হেয় প্রতিপন্ন করার প্রচেষ্টা করে তবে সেই ব্যক্তিকে শাস্তি প্রদান করতে হবে। যাতে পরবর্তীতে কেউ এমন ঘৃণ্য কাজ না করে।
মাতরং পিতরং জায়াং ভ্রাতরং তনয়ং গুরু।
আক্ষারয় শতং দাপ্যঃ পন্থানং চাদদ গুরােঃll
(মনুসংহিতা:৮.২৭৫)
“মাতা, পিতা, স্ত্রী, ভ্রাতা, পুত্র এবং গুরু এঁদের
সম্বন্ধে মিথ্যা দোষারােপ বা নিন্দা করলে এবং
শিক্ষাদাতা গুরুকে অহংকারী হয়ে পথ ছেড়ে না দিলে একশ পণ দণ্ডে দণ্ডিত হবে।”
১০.মা-বাবা, স্ত্রী-সন্তানকে পরিত্যাগ দণ্ডনীয়।
অপরাধ:
ন্যায়সঙ্গত কারণ ছাড়া যে ব্যক্তি মা-বাবা, স্ত্রী-
সন্তান পরিত্যাগ করে তাকে কঠিন দণ্ড প্রদান
করতে হবে।
ন মাতান পিতা ন স্ত্রী ন পুত্রস্ত্যাগমতি।
ত্যজন্নপতিতানেতা রাজ্ঞা দণ্ড্যঃ শতানি ষট্।।
(মনুসংহিতা: ৮.৩৮৯)
“মা, বাবা, স্ত্রী এবং পুত্র - এদের অকারণে
পরিত্যাগ করা চলবে না। এদের কাউকে ত্যাগ
করা হয়েছে, এমন হলে ত্যাগকারী ব্যক্তিকে রাজা ছয়শত পণ অর্থদণ্ডে দণ্ডিত করবেন।
১১. রাস্তায় চলাচলের ক্ষেত্রে নারীকে আগে পথ ছেড়ে দিতে হবে।
ReplyDeleteবর্তমানে আমরা দেখি নারীদের জন্যে বাস ট্রেন সহ বিবিধ যানবাহনে সংরক্ষিত আসন থাকে।
আমরা কোন সিট হলে পার্শ্ববর্তী কোন নারী
দাড়িয়ে থাকলে তাকে আগে বসতে দেই। এই
অত্যন্ত জনপ্রিয় মানবিক বিধানটি নিরাপদে
নারীদের রাস্তায় চলাচল করার ক্ষেত্রে
মনুসংহিতায় সুস্পষ্টভাবে দেখি। সেখানে বলা
হয়েছে, কোন যানবাহনে বৃদ্ধ মানুষ, অসুস্থ
ব্যাক্তি, বােঝা বহনকারী, বিবাহের বর, রাজা,
ছাত্র এবং নারীকে আগে পথ ছেড়ে দিতে হবে।
চক্রিণাে দশমীস্থস্য রােগিণাে ভারিণঃ স্ত্রিয়াঃ ।
স্নাতকস্য চ রাজুশ্চ পন্থা দেয়াে বরস্য চ।
(মনুসংহিতা:২.১৩৮)
চাকাযুক্তরথাদি প্রভৃতি যানে আরূঢ় ব্যক্তি, বয়স্ক
ব্যক্তি, রােগাৰ্ত, ভারবহনে ক্লান্ত ব্যক্তি, স্ত্রীলােক,
স্নাতক অর্থাৎ গুরুগৃহ থেকে শিক্ষা সমাপন করা
ছাত্র, রাজা এবং বিবাহের উদ্দেশ্যে প্রস্থিত বর
এদের আগে যেতে পথ ছেড়ে দেয়া কর্তব্য।”
১২. নারীরা সৌভাগ্যবর্তী, বহুসম্মানের অধিকারী এবং তারাই গৃহের দীপ্তি :
মাতৃরূপে, কন্যারূপে, স্ত্রীরূপে, ভগ্নীরূপে কিংবা ধর্মকর্মে অংশীদাররূপে নারীই সকল কল্যাণের অন্যতম উৎস। তারা নতুন প্রজন্ম বা উত্তরসূরির জন্ম দেয় ও পালন করে। তারা সৌভাগ্য ও আশীর্বাদ বয়ে আনে; তাই তারা প্রতিটি গৃহের লক্ষ্মী স্বরূপা শ্রী। সনাতন ধর্ম নারীর ক্ষমতায়নে কঠোরভাবে বিশ্বাসী। বেদ, রামায়ণ, মহাভারত,অষ্টাদশ পুরাণ সহ শাস্ত্রে বিভিন্ন স্থানেই নারীদের উজ্জ্বলভাবে গুরুত্বপূর্ণ পদে পাওয়া যায়।
সেখালে নারীদের রথ বা যানবাহন চালানাের
আধকারও ছিল।এ কারণে, নারীদের সর্বদা
সম্মান সহকারে রাখা উচিত। বাড়ীতে স্ত্রী এবং শ্রী এ দুইয়ের মধ্যে কোনও ভেদ নেই, অভেদ।
সন্তানাদি প্রসব ও পালন করে বলে, শাস্ত্রে
নারীদের অত্যন্ত সৌভাগ্যবতী বলা হয়েছে। তারা গৃহের দীপ্তি বা প্রকাশস্বরূপ। ভূতি অর্থাৎ ঐশ্বর্য কামনা করে, বিভিন্ন সৎকার্যের অনুষ্ঠানে এবং নানা উৎসবে উত্তম অলঙ্কার, বস্ত্র ও ভােজনাদি দ্বারা নারীদের সম্মান প্রদর্শন করে প্রীত রাখতে হবে। পরিবারের সুখ-শান্তি-সমৃদ্ধির জন্য নারীকে সর্বদা সুখী রাখতে হবে।
প্রজনার্থং মহাভাগাঃ পূজাহা গৃহদীপ্তয়ঃ ।
স্ক্রিয়ঃ শ্রিয়শ্চ গেহেষু ন বিশেষােহস্তি কশ্চন।।
উৎপাদনমপত্যস্য জাতস্য পরিপালন।
প্রত্যহং লােকযাত্রায়াঃ প্রত্যক্ষং স্ত্রীনিবন্ধনম্।।
অপত্যং ধর্মকার্যাণি শুশ্রুষা রতিরুক্তমা।
দারাধীনস্তথা স্বর্গঃ পিতৃণামাত্মনশ্চ হ৷৷
(মনুসংহিতা:৯.২৬-২৮)
“স্ত্রীলােকরা সন্তান প্রসব ও পালন করে বলে
তারা অত্যন্ত সৌভাগ্যবর্তী। এ কারণে তারা
বহুসম্মানের যােগ্য। নারীরা গৃহের দীপ্তি অর্থাৎ
প্রকাশস্বরূপ। পুরুষের ধনৈশ্বর্য থাকলেও যদি
ভার্যা না থাকে, তা হলে বাড়ীতে বন্ধু-বান্ধব,
আত্নীয়-স্বজনেরা উপস্থিত হলে গৃহস্বামী নিজে
তাদের প্রত্যেককে ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও পান-
ভােজনাদির দ্বারা আপ্যায়িত করতে পারে না।
সন্তান উৎপাদন ও জাত সন্তানের পরিপালন
এবং প্রতিদিন লােকযাত্রা নির্বাহরূপ
অতিথিসেবা, ভিক্ষাদান প্রভৃতি গৃহস্থের যে সব কাজ, স্ত্রীলােকেরাই এই সব কাজ অন্তরঙ্গভাবে সম্পাদন করে।
সন্তানের উৎপাদন, অগ্নিহােত্রাদি পঞ্চমহাযজ্ঞ সহ সকল প্রকারের ধর্মকর্ম সম্পাদন, সকলের
পরিচর্যা, রতি-সুখ, সন্তানের মাধ্যমে পিতৃগণের পরিতৃপ্তি এ সকল কাজ পত্নীর দ্বারাই নিম্পন্ন হয়।
১৩, নারী-শিশু হত্যাকারীদের
মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করতে হবে: নারী, শিশু ও জ্ঞানীদের যারা হত্যা করে, তাদের
মত পাপী আর নেই। তাই তাদের মৃত্যুদণ্ডের মত কঠিনতম শাস্তি প্রদান করতে হবে।
কূটশাসনকর্তৃংশ্চ প্রকৃতীনাঞ্চ দূষকা।
স্ত্রীবালব্রাহ্মণগ্নাংশ্চ হন্যাটিসেবিনস্তথা৷৷
(মনুসংহিতা:৯,২৩২)
“যারা মিথ্যা রাজাজ্ঞা লেখে বা প্রচার করে, যারা
অমাত্যাদি রাজ প্রকৃতিদের মধ্যে ভেদ ঘটায়,
যারা স্ত্রীলােক, বালক ও ব্রাহ্মণকে বধ করে এবং যারা রাজার শত্রুপক্ষের সাহায্য করে তাদের বধ করা কর্তব্য।”
মনু দর্শন কার্লমার্কসের দর্শন কে একেবারে ঘেটে ঘ করেছেন। আগে সংস্কৃত শিখুন তারপর লিখতে বসবেন। কপি পেষ্ট করে আর চলছে না।
ReplyDeleteহা হা হা😃😃😃
Delete