গীতা পড়লে আপাতদৃষ্টিতে মনে হয় যে, যুদ্ধে বিমুখ অর্জুনকে যুদ্ধে পাঠাবার জন্যই গীতা লেখা হয়েছিল ।
আসুন যুক্তির আলোকে বিচার করি । কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে এমন সময় অর্জুন বেঁকে বসলেন । যুদ্ধে যাবেন না । দীর্ঘ সময় ধরে কৃষ্ণ শুরু করলেন জ্ঞান দেওয়া যুদ্ধের field-এ থেকেই ।
ভগবদগীতার এগারো পরিচ্ছেদে বিশ্বরূপ দর্শনের পরে কৃষ্ণকে অর্জুন 'my father' বলে মেনে নিলেন । এবং আঠারো পরিচ্ছেদে কৃষ্ণের দাসত্ব মেনে নিয়ে যুদ্ধে প্রবৃত্ত হলেন । কিন্তু ভগবদগীতায় কৃষ্ণের বাণী শেষ হয়ে যাওয়ার পরে যুদ্ধের নবম দিনে অর্জুন আবার বেঁকে বসলেন, যুদ্ধে যাবেন না ।
এটা কেমন হল ! যে অর্জুন আগেই কৃষ্ণের মুখে বিশ্বরূপ দর্শন করে মোহভঙ্গ হয়ে যুদ্ধ করার জন্য চাঙ্গা হয়ে উঠলেন, সেই আবার পরে বলছেন যুদ্ধ করার কী প্রয়োজন ! দ্রষ্টব্য যে কৃষ্ণ একবারও তখন গীতার কথা না বলে অর্জুনের প্রতিজ্ঞা ও ক্ষত্রিয়ধর্মের কথাই বললেন । অর্জুনও পূর্বপ্রতিজ্ঞা ও ক্ষত্রিয়ধর্মের কারণেই আবার যুদ্ধে গেলেন ।
সুতরাং বোঝাই যাচ্ছে গীতা মহাভারতে বিশেষ কারণে সংযোজিত হয়েছিল । গীতার মধ্য দিয়ে ব্রাহ্মণ্যধর্মের মূলনীতিকে ঈশ্বরের মুখ দিয়ে প্রচার করাই ছিল মুখ্য উদ্দেশ্য । ব্রাহ্মণ্যধর্মকে প্রতিষ্ঠা করার জন্য রাজশক্তি প্রভূত সাহায্য করেছিল ।
প্রাক আর্যরা এবং বৌদ্ধ ও জৈনরা আত্মা, জন্মান্তরবাদ, যজ্ঞকর্ম ইত্যাদিতে বিশ্বাস করত না । তাই সে'সময়কার জনগোষ্ঠীর মধ্যে মধ্যে আত্মা চিরন্তন এই ভাবনাকে গেঁথে দিতে গীতার রচনা । কারণ আত্মার অস্তিত্ব না থাকলে ব্রাহ্মণ্যধর্মের অস্তিত্বই ধ্বংস হয়ে যায় । আত্মা নশ্বর হলে পুনর্জন্ম থাকে না । এই এতগুলো না থাকার কারণ ঈশ্বর পুজো এবং দ্বিজ ভক্তিই তো বাতিল হয়ে যায় । তাই দ্বিজ অর্থাৎ ব্রাহ্মণরা নিজেদের অস্তিত্ব সংকট থেকে বাঁচতে গীতার পক্ষে ধুন ধরেছিল ।
======================================================
আঠারো পরিচ্ছেদে মোক্ষযোগে (ভগবদ্ গীতা, ১৮/৬৬) বলা হয়েছে --
"সর্বধর্মান্ পরিত্যাজ্য মামেকং শরণং ব্রজ ।
অহং ত্বাং সর্বপাপেভ্যো মোক্ষয়িষ্যামি মা শুচঃ ।।"
সব ধর্ম ছেড়ে আমাকেই গ্রহণ করো । শোক কোরো না, আমি তোমাকে সব পাপ থেকে মুক্ত করব ।
এই শ্লোকের মাধ্যমে সব ধর্ম ছেড়ে আর্যদের ঈশ্বরকে বা তাদের ধর্মমতকে গ্রহণ করার জন্য ডাক দেওয়া হয়েছে । পাপ থেকে মুক্ত করার লোভও দেখানো হয়েছে । কৃষ্ণের তত্ত্বকে প্রচার করা হয়েছে অন্যান্য ধর্মকে সরাসরি আক্রমণ করে ।
আর্যদের ধর্মকে গ্রহণ না করলে প্রাক আর্যদের চরম ক্ষতি হবে সেই হুমকিও দেওয়া হয়েছে । যেসব লোক ব্রাহ্মণ্যধর্ম গ্রহণ করে না, তাদেরকে কৃষ্ণ অর্থাৎ গীতা রচয়িতারা 'দুষ্কর্মকারী, মূঢ়, নরাধম ও অসুর' বলে চিহ্নিত করেছে (ভগবদ্ গীতা, ৭/১৫)।
গীতায় (ভগবদ্ গীতা ৯/১১) বলা হয়েছে, যে শ্রী ভগবান অর্থাৎ ব্রাহ্মণ্যধর্মকে অস্বীকার করে, তারা অসুর ও রাক্ষসযোনি প্রাপ্ত হয় ।
অসুর বা রাক্ষস বলতে প্রাক আর্য বা ভূমিপুত্রদেরই বলা হয় । এবং আরও অশ্লীলভাবে ষোলো পরিচ্ছেদে (ভগবদ্ গীতা ১৬/১৮-২০) বলা হয়েছে, যারা শ্রীভগবানকে মানে না তাদের অশুভ অসুর যোনিতে আবার ঢুকিয়ে দেওয়া হবে । অর্থাৎ প্রাক আর্যরা যে যোনি থেকে জন্মেছে সেখানে ঢুকিয়ে দেওয়া হবে । এ তো দেখছি পাড়ার কাঁচা খিস্তিবান মস্তানদের কথা ।
এমন জঘন্য ভাষা গীতিকারেরা গীতার অনেক জায়গাতেই লিখেছেন ।
গীতায় জ্ঞানযোগের চতুর্থ অধ্যায়ে (ভগবদ্ গীতা ৪/৭-৮) বলা হয়েছে -
"যদা যদা হি ধর্মস্য গ্লানির্ভবতি ভারত।
অভ্যুত্থানম অধর্মস্য তদাত্মানং সৃজাম্যহম্॥
পরিত্রাণায় হি সাধুনাং বিনাশয় চ দুষ্কৃতাম।
ধর্মসংস্থাপনার্থায় সম্ভবামি যুগে যুগে॥"
ধর্মের যখন অস্তিত্বের সংকট আসে এবং অধর্ম প্রতিষ্ঠিত হয়, তখন আমি নিজেকে সৃষ্টি করি । দুষ্কৃতীদের মেরে সাধুদের বাঁচিয়ে আবার ধর্ম প্রতিষ্ঠিত করার উদ্দেশ্যে আমি যুগে যুগে সৃষ্টি হই ।
এই শ্লোকটি প্রচুর জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে । সাধারণভাবে এই শ্লোকটি পড়লে মনে হয় যেন কৃষ্ণ ভালো লোকদের বাঁচাতে যুগে যুগে আবির্ভূত হন এবং ধর্ম প্রতিষ্ঠিত করেন । আবার অনেকে মহাভারতের সঙ্গে একে মিলিয়ে মনে করেন - মহাভারতে অধার্মিক কৌরবদের মেরে ধার্মিক পাণ্ডবদের বাঁচানোর উদ্দেশ্যে ঈশ্বরের অবতার কৃষ্ণের আবির্ভাব ।
এবার বিশ্লেষণে আসা যাক । কুরুক্ষেত্র যুদ্ধে কৌরবপক্ষকে ধরা হয় অধার্মিক এবং পাণ্ডবদের ধার্মিক । কিন্তু মহাভারতে দেখা যায় অধার্মিক কৌরবপক্ষের অনেকেই বেঁচে গেছেন যথা ধৃতরাষ্ট্র, যুযুৎসু, বিদুর ও সঞ্জয় । এবং পাণ্ডবদের সকলেই যে বেঁচে ছিলেন তা নয় । পঞ্চপান্ডব এবং যাদব যোদ্ধারা ছাড়া আর সবাই মারা গিয়েছিলেন । এমনকী, কৃষ্ণের বংশের অনেকেই মদ্যপান জিরে মাতাল হয়ে মারামারি করে মারা গেলেন । শেষপর্যন্ত অধার্মিক কৌরবপক্ষের সবাই মারা গিয়ে স্বর্গে পর্যন্ত গেল । কৌরবরা যদি অধার্মিক হয় তাহলে অধার্মিকদের বিনাশ হল কোথায় ? জতুগৃহে নিম্নবর্ণের (নিষাদ) পাঁচজন পুরুষ ও একজন রমণীকে আশ্রয় দিয়ে পুড়িয়ে মেরেছিলেন এই পঞ্চপান্ডব । তাহলে পঞ্চপান্ডবরাও কি ঘোর অধার্মিক নন ? স্বয়ং কৃষ্ণ ও পঞ্চপান্ডবরা ছলচাতুরি, অন্যায়ের আশ্রয় নিয়ে যুদ্ধে জিতেছিলেন । এ হল যে আইন রক্ষাকারী, সেই চোর ।
সুতরাং অধার্মিক-ধার্মিক তত্ত্ব বিশ্লেষণ করে বোঝা যাচ্ছে যে, গীতার এই শ্লোকটি মোটেও মহাভারতের সাথে খাপ খায় না ।
সুতরাং আর্যসভ্যতা ও ব্রাহ্মণ্যধর্ম বিরোধী সবাইকে হত্যা করে ব্রাহ্মণ্যধর্মের পুনঃপ্রতিষ্ঠাই ছিল গীতার ধর্মসংস্থাপনের মূল কথা । উল্লেখ্য, নবম শতাব্দীতে প্রথম গীতা ভাষ্যকার শংকরাচার্য রাজশক্তির সাহায্যে প্রচুর বৌদ্ধ হত্যা করেছিলেন । রাষ্ট্রশক্তির পৃষ্ঠপোষকতায় ব্রাহ্মণ্যধর্ম রাজধর্ম রূপে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ।
======================================================
বৈদিক যুগ থেকেই প্রচলিত ছিল চতুর্বর্ণ প্রথা অর্থাৎ জাতপাতের ভেদাভেদ । বলা হলো ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়দের সমাজের সব থেকে উঁচুতে অবস্থান এবং তারপর বৈশ্যদের অবস্থান । সমাজের সব থেকে নিচে শূদ্ররা অবস্থিত । উচ্চ তিন বর্ণের সেবা করাই হল শূদ্রদের একমাত্র কাজ । প্রাক আর্য এবং নিরীশ্বরবাদীরা সংখ্যায় বৃদ্ধি পাওয়ার ফলে এই চতুর্বর্ণ প্রথা লুপ্ত হতে থাকে । এইজন্য গীতার মাধ্যমে কৃষ্ণের মুখ দিয়ে চতুর্বর্ণ প্রতিষ্ঠা করা হল ।
চতুর্থ অধ্যায়ের জ্ঞানযোগে (ভগবদগীতা, ৪/১৩) বলা হল -
"“চাতুর্বর্ণ্যং ময়া সৃষ্টং গুণকর্মবিভাগশঃ।
তস্য কর্তারমপি মাং বিদ্ধ্যকর্তারমব্যয়ম।"
আমি গুন্ অনুযায়ী কর্মের বিভাগ অনুসারে চতুর্বর্ণ সৃষ্টি করেছি । আমাকে এর কর্তা এবং অব্যয় অকর্তা রূপে জানবে ।
ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় = কায়স্থ, বৈশ্য = ব্যবসায়ী, শূদ্র = বাদবাকি যারা আছে । গীতায় বলা হয়েছে এই চারবর্ণের সৃষ্টিকর্তা স্বয়ং কৃষ্ণ । আবার মনুসংহিতায় এই চারবর্ণের সৃষ্টিকর্তা মনুকেই বলা হয়েছে । এবার আপনারাই বিচার করুন কার সৃষ্টি তত্ত্ব গ্রহণ করবেন । কারণ দু'জনের মধ্যে একজন অসত্য ভাষণ করেছেন ।
======================================================
চোদ্দ অধ্যায়ে (ভগবদগীতা, ১৪/১৮) কৃষ্ণ বলেছেন -
"ঊর্ধ্বং গচ্ছন্তি সত্ত্বস্থা মধ্যে তিষ্ঠন্তি রাজসাঃ।
জঘন্যগুণবৃত্তিস্থা অধো গচ্ছন্তি তামসাঃ ।।"
সত্ত্বগুণের অধিকারীরা ঊর্ধ্বে যায়, রজ বা রাজকীয় গুণসম্পন্নরা মধ্যে অবস্থান করে, আর তম বা অন্ধকার গুণসম্পন্ন লোকেরা জঘন্য বৃত্তিতে নিযুক্ত হয়ে অধোগামী হয় ।
গীতায় (ভগবদগীতা, ১৮/৪০), সত্ত্ব, রজ এবং তম গুনকে স্বভাবজাত বলা হয়েছে ।
গীতায় আঠারো অধ্যায়ে বলা হয়েছে (ভগবদগীতা, ১৮/৪১-৪৮) - "ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য এবং শূদ্রদের সহজাত গুণাবলি দ্বারাই তাদের কর্ম ভাগ করা হয়েছে ।"
এখানে বলে রাখি সহজাত গুণাবলি বলে কিছুই হয় না । যা হয় তা হল সহজাত প্রবৃত্তি । মানুষ যে জলপান করে সেটা দেখেই শিখেছে । মানুষ যে কথা বলে, হাঁটে সেটাও দেখেই শেখা । একটু একটু করে উত্তরণ হয়েছে ।
======================================================
গীতায় বর্ণিত চতুর্বর্ণ বিভাজন কোনওরকম ভাবেই সহজাত প্রবৃত্তি নয় ।
গীতায় (ভগবদগীতা, ২/৪৭-৪৮) বলা হল - শুধু কাজেই তোমার অধিকার আছে, ফলে নয় । ফললাভের আশা না করে শুধু কাজ করে যাও ।
মুখ বুজে সব অত্যাচার সহ্য করে শুধু উচ্চবর্ণের সেবার মধ্যেই শূদ্রদের কাজের সীমা বেঁধে দেওয়া হল । শূদ্রেরা যাতে উচ্চ তিন বর্ণের সেবার মধ্যেই নিযুক্ত থাকে, উচ্চ পেশায় আগ্রহ প্রকাশ না করে । সাবধান করে গীতার তৃতীয় অধ্যায়ে কর্মযোগে বলা হল - পরধর্মের চেয়ে গুণহীন নিজের ধর্মই শ্রেষ্ঠ । স্বধর্মে মৃত্যুও ভালো, কিন্তু পরধর্ম ভয়াবহ ।
এই একই শ্লোক আবার মনুসংহিতাতেও (১০:৯৭) পাওয়া যায় । অর্থাৎ শূদ্ররা যেন এই দাসবৃত্তি, সেবার মধ্যে নিজেকে জড়িয়ে রাখে । অত্যাচারের ফলে যদি তার মৃত্যুও হয় তাহলেও তা ভালো । কারণ সে সেবা করতে করতেই মারা গেছে । শূদ্রদের ছিন্ন ও মলিন বস্ত্র দেওয়া হত পোশাক হিসেবে । তাদের খাদ্য ছিল উচ্চবর্ণের উচ্ছিষ্ট খাদ্যবশেষ ।
ভগবদগীতা নিয়ে যাঁরা গদগদ, তাঁরা উপনিষদ ও গীতা পড়লে দ্বিধাহীনভাবে বুঝতে পারবেন, কৃষ্ণ অর্জুনের জন্য উপনিষদরূপী গাভী থেকে গীতামৃত দোহন করেছিলেন ।
বৈদিক যুগে বেদ পাঠ করা তো দূরের কথা, শোনাও ছিল শূদ্রদের পক্ষে ভয়ংকর রকমের অপরাধ । পরবর্তীকালে বেদ ও উপনিষদের কিছু কথা উচ্চবর্ণের স্বার্থে শূদ্রদের মাথায় ঢোকাবার প্রয়োজনেই তৈরি করা হল 'গীতা' । এই গীতা পাঠ করা বা পাঠ শোনা শূদ্রদের পক্ষে পুণ্যকর্মের পরিবর্তে অপরাধ বলে ঘোষিত হল ।
======================================================
গীতায় যোগের শ্রেষ্ঠত্বের কথা বলা হয়েছে । এখানে বলে রাখা দরকার যোগ এবং যোগব্যায়াম (free hand exercise) আলাদা । পতঞ্জলির যোগশাস্ত্রে রয়েছে হটযোগবলে উড়ে যাওয়ার কথা । রয়েছে রাজযোগের দ্বারা ইচ্ছেমতো আকাশে উড়ে যাওয়ার কথা, অদৃশ্য হওয়ার কথা, এমনকী অলৌকিক শক্তি লাভ করার কথা । খেচরীমুদ্রার সাহায্যে মৃত্যুকে জয় করা যায় অর্থাৎ অমর হওয়া যায় । এগুলো প্রত্যেকটাই অসম্ভব ।
======================================================
'ব্রাহ্মণ' শব্দটির উৎপত্তি ব্রহ্মতত্ত্ব থেকে । যে ব্যক্তি ব্রহ্মজ্ঞান লাভ করেছেন, তিনি-ই 'ব্রাহ্মণ' । 'ব্রাহ্মণ্যবাদ' শব্দটি নবীন । চতুর্বর্ণ প্রথা ও ব্রাহ্মণদের তৈরি নানা শাস্ত্র অর্থাৎ অনুশাসন বা বিধি বিষয়ক মতবাদ-ই হল 'ব্রাহ্মণ্যবাদ'।
======================================================
বৈদিক-ধর্মের প্রধান বৈশিষ্ট্য যজ্ঞ । ব্রাহ্মণগ্রন্থগুলো যজ্ঞকেই সর্বশক্তির আধার বলে বর্ণনা করেছে । সমস্ত সৃষ্টিকে যজ্ঞক্রিয়ার ফল বলা হয়েছে ।
বেদগুলোকে দুটি ভাগে ভাগ করতে পারি আমরা । (১) মন্ত্র (২) ব্রাহ্মণ । 'মন্ত্র' হল দেবতার গুনকীর্তন ও প্রার্থনা ।
'ব্রাহ্মণ' হল যাগ-যজ্ঞের প্রণালী । ব্রাহ্মণের বক্তব্য অনুসারে ঋকবেদের দেবতারা যজ্ঞের ক্রিয়াকলাপের দ্বারা পরিচালিত হতে বাধ্য । অর্থাৎ যে জন্য যজ্ঞ করা, সে ফল পাওয়া যাবেই । ফলদানের বা ফল আটকে দেবার ক্ষমতা দেবতাদের নেই ।
এরপর যে প্রশ্ন উঠে আসা স্বাভাবিক - তাহলে মন্ত্র বা প্রার্থনার মূল্য কি রইল ? বেদেরই অংশ 'ব্রাহ্মণ' বলছে - বেদভক্তি, মন্ত্র ও প্রার্থনার কোনও মূল্য নেই । তবে যজ্ঞে ফল লাভ অনিবার্য ।
এটা আপাতভাবে বেদের স্ববিরোধ মনে হতেই পারে । কিন্তু এই স্ববিরোধ তৈরি করা । বেদ লেখক জাদু-পুরোহিতদেরই তৈরি করা । স্বার্থবুদ্ধি থেকেই তারা এমনটা করেছে । তারা চেয়েছে সুনিশ্চিত ফল পেতে যজমানরা দেবতার চেয়ে তাদের উপর নির্ভর করুক বেশি ।
======================================================
বৃহদারণ্যক উপনিষদেও বলা হয়েছে - নারীর নিম্নদেশ যজ্ঞবেদি, যৌনকেশ যজ্ঞতৃণ, ত্বক সোমরস-পোষণের ভূমি এবং অন্ডকোষ দুটি অগ্নি । এই বিশ্বাস নিয়ে যে সঙ্গমে প্রবৃত্ত হয়, সে বাজপেয় যজ্ঞের ফললাভ করে ।
এখানে দেখছি যজ্ঞ না করেই শুধু মৈথুনেই যজ্ঞের ফল লাভের ঘোষণা করা হয়েছে । এখানে আরও বলা হয়েছে, কোনও নারী যৌনমিলন প্রত্যাখ্যান করলে তাকে জোর করে বাধ্য করা উচিত (বৃহদারণ্যক, ৬, ৪, ৬, ৭)। হিন্দুত্ববাদীরা কি হিন্দুধর্মের এই ধর্ষণ সমর্থনের কথা জানেন ?
======================================================
বৈদিক যুগ থেকে সমাজে নারীর অবস্থান ছিল সবথেকে নীচে । বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থে নারীকে দুশ্চরিত্রা, অপবিত্রা আখ্যা দেওয়া হয়েছে । গীতাতেও গীতাকারের দ্বারা কৃষ্ণের মুখ দিয়ে নারীজাতির হীনত্ব প্রকাশিত হয়েছে ।
নারীদের 'পাপযোনি' সম্বোধন করে বলা হয়েছে (ভগবদগীতা, ৯/৩২-৩৩) -
'মাং হি পার্থ ব্যাপাশ্রিত্য য়েঽপি স্যুঃ পাপয়োনয়ঃ ।
স্ত্রিয়ো বৈশ্যাস্তথাশূদ্রাস্তেঽপি য়ান্তি পরাং গতিম্ ॥
কিং পুনর্ব্রাহ্মণাঃ পুণ্যা ভক্তা রাজর্ষয়স্তথা ।
অনিত্যমসুখং লোকমিমং প্রাপ্য ভজস্য মাম্ ॥'
অর্থাৎ আমাকে আশ্রয় করে স্ত্রী, বৈশ্য, শূদ্র এসব পাপযোনিরা পরমগতি লাভ করে থাকে । ব্রাহ্মণ ও রাজর্ষিদের মতো পুণ্যবান ভক্তদের আর কথা কি ? অনিত্য এবং সুখহীন ইহলোকে জন্মেছো, আমাকে ভজনা করো ।
এবং গীতায় (ভগবদগীতা, ১/৪১) অর্জুনের মুখ দিয়ে বলানো হল -
"অধর্মাভিভবাৎ কৃষ্ণ প্রদুষ্যন্তি কুলস্ত্রিয়ঃ ।
স্ত্রীষু দুষ্টাসু বার্ষ্ণেয় জায়তে বর্ণসঙ্কর ।।"
কৃষ্ণ অধর্মের আবির্ভব হলে কুলস্ত্রীরা দূষিত হয় । এবং স্ত্রীরা দুষ্টা হলে বর্ণসংকরের সৃষ্টি হয় ।
বর্ণসংকরের পরিনাম সম্বন্ধে বলে হয়েছে (ভগবদগীতা, ১/৪২-৪৪) - বর্ণসংকর হলে পিতৃপুরুষদের পিন্ড এবং জল দেওয়ার কেউ থাকে না । তাই তারা চিরকাল নরকে বাস করে ।
পিতৃপুরুষ মানে বাবা, ঠাকুরদা, তাঁর বাবা, তাঁর বাবা, তাঁর বাবা, এরকম করে অনন্ত বাবাদেরকে বোঝায় । তারা নরক বাস করবে এ কথা বলেছে গীতা । কিন্তু কি মুশকিল ! আত্মাকে তো কাটা যায় না, পোড়ানো যায় না । তাহলে আত্মাকে আবার কি করে নরকযন্ত্রণা দেবে ! একথা যাঁরা লিখেছেন তাঁদের জ্ঞান-গম্যির বড়ই অভাব দেখছি ।
এবং ওই শ্লোকেই আরও লেখা আছে যে কুলধর্ম বর্ণসংকরের ফলে নষ্ট হয়ে যায় । ...
... এ সবই আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে বুঝিয়ে দেয় বৈদিক সমাজের দুটি বৈশিষ্ট্যকে । এক : যৌন-শক্তিধর হওয়াটা প্রধান একটি গুণ হিসেবে গণ্য হত । বিশিষ্ট প্রত্নতত্ত্ববিদ ও নৃতত্ত্ববিধ ডঃ অতুল সুরের কথায়, 'মৈথুন ধর্মটাই সেকালের সনাতন ধর্ম ছিল" । (দেবলোকের যৌনজীবন, ডঃ অতুল সুর, প্রথম সংস্করণ পৃষ্ঠা ৬২) দুই : বৈদিক যাদুপুরোহিতরা প্রাকবৈদিক যুগের মাতৃপ্রাধান্যের শিকড় সমাজ থেকে উপড়ে ফেলতে চেয়েছিলেন । চেয়েছিলেন পুরুষতান্ত্রিক সমাজ প্রতিষ্ঠা করতে । মেয়েদের মৈথুন-যন্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতে চেয়েছিলেন । তাই ব্রহ্মার বাণী বলে প্রচার করা হয়েছে - নারীরা পুরুষদের মৈথুনের জন্যই সৃষ্ট । তোমরা মৈথুন কর্ম চালিয়ে যাও । প্রজা উৎপাদন কর । তাতেই আমি তুষ্ট ।
======================================================
হিন্দু ধর্মীয় বিধানে নারী জন্ম পরাধীন, চির-পরাধীন । মনুর বিধানে (৯:৩) আছে ।
'পিতা রক্ষতি কৌমারে ভর্ত্তা রক্ষতি যৌবনে
রক্ষতি স্থবিরে পুত্রা ন স্ত্রী স্বাতন্ত্র্যমর্হতি॥'
অর্থাৎ নারীকে :
পিতা রক্ষা করবে কুমারীকালে, স্বামী রক্ষা করবে যৌবনে ।
বার্ধক্যে রক্ষা করবে পুত্ররা, স্ত্রী স্বাধীনতার যোগ্য নয় ।
মনুর বিধানে মানুষ বিভক্ত হয়েছিল সরাসরি দুটি ভাগে - 'পুরুষ' ও 'নারী' । পুরুষকে প্রভুর ভূমিকায় এবং নারীকে ক্রীতদাসীর চেয়েও অধম, ধর্ষিতার চেয়েও অত্যাচারিতা এবং গৃহপালিত পশুর চেয়েও হীন ভূমিকায় নামিয়ে এনেছিল মনুর আইন অর্থাৎ হিন্দু ধর্মীয় আইন ।
মনুর পদাঙ্ক অনুসরণ করে হিন্দু ধর্মগ্রন্থগুলো একইভাবে নারীকে চূড়ান্তভাবে শোষণ করতে নানা উপদেশ প্রয়োগ করেছে । নানা নীতিকথার নামে দুর্নীতি ছড়াতে চেয়েছে ।
মনুসংহিতার সময়কালে মেয়েদেরকে শুধুমাত্র সন্তান উৎপাদনের যন্ত্র হিসেবেই দেখা হত । মনুও সেই একই মত পোষণ করেছেন । বিয়েই হল নারীর প্রকৃত সার্থকতা এবং মাতৃত্বেই তার চরিতার্থতা । গর্ভধরণের জন্য স্ত্রীলোক এবং গর্ভধানের জন্যই পুরুষের সৃষ্টি (৯:৯৬) ।
মনুসংহিতায় (২:২১৩) লেখা আছে -
'স্বভাব এষ নারীণাং নরাণামিহ দূষণম ।'
এই সংসারে নারীরা স্বভাবতই পুরুষের মনকে কামকলুষিত করে । অর্থাৎ নারী মাত্রেই লম্পট ।
তাই মনু (২:২১৫) বলেছেন 'মাত্রা স্বস্রা দুহিত্রা বা না বিবিক্তাসনো ভবেৎ ।'
অর্থাৎ, মা, বোন বা কন্যার সঙ্গে নির্জন গৃহে কোনও পুরুষের বাস করা উচিত নয় ।
শিক্ষা আনে চেতনার মুক্তি, যা দাসত্ব থেকে মুক্ত হতে উদ্বুদ্ধ করতে পারে বিবেচনায় মনুষ্যত্বের ও মানুষের চরম শত্রু মনুর বিধান দিলেন তার বিখ্যাত মনুসংহিতায় (২:৬৭) :
'বৈবাহিকো বিধিঃ স্ত্রীণাং সংস্কারো বৈদিকঃ স্মৃতঃ ।
পতিসেবা গুরৌবাসো গৃহার্থোহগ্নি পরিক্রিয়া ।।'
অর্থাৎ 'বিয়েই নারীর বৈদিক উপনয়ন । পতিসেবাই গুরুগৃহবাস, গৃহকর্মই হোমস্বরূপ অগ্নিপরিচর্যা ।'
এখানেই শেষ নয় । মনু আরও বলেছেন (৫:১৫৪), পতি সদাচারহীন, পরস্ত্রীর সঙ্গে যৌন সম্পর্কযুক্ত বা গুণহীন হলেও সতী স্ত্রী সেই পতিকে দেবতার মতোই পুজো করবে ।
তাহলে হিন্দু নারীর বিনোদন কি শুধুই নানা ব্রতপালন ও উপবাস ঘিরেই আবর্তিত হবে?
না । ব্রতপালন, উপবাসের স্বাধীনতা নারীকে দেননি মনু । তাঁর বিধানে আছে (৫:১৫৫) : স্ত্রী'র স্বামী ছাড়া পৃথক যজ্ঞ নেই, পতির অনুমতি ছাড়া ব্রত বা উপবাস নেই । নারী স্বর্গে যেতে পারে কেবলমাত্র স্বামীসেবার সাহায্যেই ।
মনু (৫:১৫৮) আরও বলেছেন, স্ত্রীলোক তার মৃত্যু পর্যন্ত কষ্ট সহ্য করবে, নিয়মচারিণী হবে এবং স্বামীর সেবা করবে, এটাই তার পরম ধর্ম ।
হিন্দু সমাজে পুরুষরা এভাবে নিজেদের লাম্পট্য, অসদাচরণ ও অত্যাচারকে নারীদের কাছে শুধুমাত্র প্রতিবাদহীনভাবে গ্রহণীয় করেনি, নিজেদের দেবতার আসনে বসিয়েছে ধর্মের বিধান খাড়া করে ।
ব্যভিচারী নারীদের জন্য শাস্তির ব্যবস্থা ছিল মনু সংহিতায় । যে নারী নিজেদের পতিকে পরিত্যাগ করে পরপুরুষের সঙ্গে মিলিত হবে, তাকে জনাকীর্ণ স্থানে কুকুর দিয়ে খাওয়ানোর কথা বলা হয়েছে (৮:৩৭১) ।
কিন্তু যে পুরুষ ধর্ষণ করে, ঘরে স্ত্রী থাকা সত্ত্বেও পরস্ত্রীর সঙ্গে সহবাস করে, তার বিরুদ্ধে কোনও শাস্তির ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি । বরং বেদপাঠ, যজ্ঞ ইত্যাদি বিভিন্ন প্রায়শ্চিত্তের মাধ্যমে এই ধরণের ঘৃণ্য কাজের শাস্তি থেকে মুক্তি পাওয়ার বিধানও রয়েছে ।
স্ত্রীজাতিদের স্মৃতি ও বেদ শোনা বা পড়ার অধিকার ছিল না । মনু (৯:১৮) এদেরকে এইজন্য হীন ও অপদার্থ বলেছেন ।
মনুসংহিতায় (৯:৯৪) আরও লেখা আছে - ত্রিশবছরের পুরুষ বারো বছরের মেয়েকে এবং চব্বিশ বছরের পুরুষ আট বছরের মেয়েকে বিয়ে করবে । কিন্তু যদি ধর্মহানির আশঙ্কা থাকে তাহলে পুরুষ কম বয়সেও বিয়ে করতে পারে ।
কম বয়স বলতে কত বোঝায় ? চলুন হিসেব করে দেখি । ত্রিশ বছরে বারো বছরের কন্যা এবং চব্বিশ বছরে আট বছরের কন্যাকে বিয়ে করতে হবে বলে বলা হয়েছে । অর্থাৎ পুরুষের বয়সের অনুপাত ছয় বছর কমলে মেয়ের বয়স চার বছর করে কমবে । সোজা হিসেব ।
আবার বলা হয়েছে পুরুষ কম বয়সেও বিয়ে করতে পারে । তাহলে কোনও আঠারো বছরের ছেলে চার বছরের মেয়েকে বিয়ে করতে পারবে । এবার বুঝতে পারছেন কাম প্রবৃত্তির জন্য পুরুষেরা কী ভয়ঙ্কর কাজ করত । হিসেবমতো নাবালিকা ধর্ষণ করা হত সেইসময় । এবং মনুসংহিতা এই ধর্ষণকে সমর্থন করেছিল ।
হিন্দুধর্মের বিভিন্ন বিধানে পদে পদে পুরুষের লাম্পট্যের অধিকারকে স্বীকার করে নেওয়া হয়েছে । তৈত্তিরীয় সংহিতায় (৬/৬/৮৫) বলা হয়েছে, 'যজমান, দীক্ষার দিনে গণিকাসাহচর্য বর্জন করবেন, তার পরদিন পরস্ত্রীর সাহচর্য এবং তৃতীয় দিন নিজস্ত্রীর সাহচর্য বর্জন করবেন ।'
অর্থাৎ, দীক্ষার দিনেও পরস্ত্রীর সাহচর্য বৈধ ছিল । দীক্ষার দিন ছাড়া অন্যান্য দিন গণিকা গমনও বৈধতার ছাড়পত্র পেয়েছিল এবং গণিকাগমন পুরুষের কাছে কখনই দোষাবহ বা লজ্জার বলে চিহ্নিত হয়নি । বরং চিহ্নিত হয়েছিল পৌরুষের প্রতীক হিসেবেই ।
মনুর বিধানে (৯:৪) বলা হয়েছে, নিঃসন্তান স্ত্রীকে বিয়ের দশ বছর পর ত্যাগ করা যায়, যে স্ত্রী শুধুমাত্র কন্যা সন্তানের জন্ম দেয় তাকে ত্যাগ করা যায় বারো বছর পরে, মৃত সন্তানের জন্মদানকারী স্ত্রীকে ত্যাগ করা যায় পনেরো বছর পরে ।
সন্তানের জন্ম দেওয়ার অক্ষমতার কারণে স্বামীকে কিন্তু ত্যাগ করার কোনও বিধান নেই । অথচ এই যুগের বিজ্ঞান বলছে ছেলে জন্মাবে কী মেয়ে জন্মাবে, এক্ষেত্রে পুরুষের ভূমিকাই মুখ্য ।
মনু (৯:৪) ঝগড়ুটে স্ত্রীকে তক্ষুনি ত্যাগ করার অধিকার দিয়েছেন স্বামীকে । কিন্তু ঝগড়ুটে শুধু নয়, অত্যাচারী স্বামীকেও দেবতা জ্ঞানে পুজো করতে বলেছেন এই মনু নামক অমানুষ এক পুরুষ । মানুষের শত্রু, মনুষ্যত্বের শত্রু এই মনুকে দেবত্ব আরোপ করেছে হিন্দু পুরুষ সমাজ । মনুকে ব্রহ্মার অংশ হিসেবে চিত্রিত করে মনুর বিধানকেই আইনের বিধান বলে মেনে নেবার কথা বলেছেন হিন্দু শাস্ত্রকার, যাঁরা মানুষ ছিলেন না অবশ্যই, যাঁরা ছিলেন পুরুষ শ্রেণির প্রতিনিধি, যাঁদের হাতে ধর্মের আর এক নাম কখনওই মনুষ্যত্ব হয়ে ওঠেনি, বরং যাঁদের হাতে মনুষ্যত্ব হয়েছে খণ্ডিত, লাঞ্ছিত, ধর্ষিত ।
======================================================
মনু বিধান দিয়েছিলেন যে, কলিযুগে কন্যার বিয়ে যেন গোটা পুরুষদের সঙ্গে যৌথভাবে দেওয়া হয় । ঋকবেদে এবং অথর্ববেদে এমন কয়েকটি শ্লোক রয়েছে যা থেকে স্পষ্ট বোঝা যায় । যদি জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা কোনও কন্যাকে বিয়ে করে বধূ করত, তাহলে তার কনিষ্ঠ সহোদরদের প্রত্যেকেরই ওই কন্যার সঙ্গে রমণের অধিকার থাকত । এ-থেকেই 'দেবর' শব্দের উৎপত্তি ।
জ্যেষ্ঠ ভ্রাতার মৃত্যু হলে স্ত্রী দেওরকেই বিয়ে করত । কিন্তু তারপরও অন্যান্য দেওররা তাকে রমণ করত । স্ত্রীরা বহুজনের সঙ্গে রমণের আনন্দ উপভোগ করত ।
======================================================
'দশরথজাতক' গ্রন্থে আছে কোশল বংশের রাজা দশরথ কোশল বংশের রাজকন্যা কৌশল্যকেই বিয়ে করেছিলেন, যাদের সম্পর্ক ছিল ভাই-বোনের । উত্তর-ভারত, পূর্ব-ভারত ও মধ্য-ভারতে একসময় ভাই-বোনের বিয়ে প্রচলিত ছিল । এসবের সামাজিক স্বীকৃতিও ছিল । দশরথ জাতকে আছে - রামও তাঁর ভগ্নী সীতাকে বিয়ে করেছিলেন ।
======================================================
সীতাকে উদ্ধারের পর রাম রাজসভাতে মন্ত্রী-সভাসদ ও প্রজাদের সামনেই সীতাকে বললেন, আমি যুদ্ধ করে তোমাকে উদ্ধার করে এনেছি নিজের বংশকলঙ্ক মোচন করার জন্য । তোমার চরিত্র সন্দেহজনক । তুমি রাবণের কোলে বসে ওর ঘনিষ্ঠ আদর পেয়েছ । তোমাকে গ্রহণ করে কেমন করে আমার বংশের মর্যাদাহানি করব ? বুদ্ধিমান তুমি, আমি তোমাকে বলছি, লক্ষণ, ভরত, শত্রুঘ্ন, সুগ্রীব ও বিভীষণের মধ্যে যাকে ইচ্ছে মনোনীত করে নাও এবং তার সঙ্গেই মনোরম রমণ জীবন-যাপন করো । তুমি হলে কুকুরের চাটা ঘি । আমি তোমাকে গ্রহণ করতে পারি না ।
আহা ! রামের কী পত্নীপ্রেম !
======================================================
অধ্যাপক রাবণ তামিলনাড়ুর একজন স্বনামধন্য লেখক এবং গবেষক । দীর্ঘদিন তিনি রামায়ণের ওপর গবেষণা করেছেন । তিনি চাইছেন যে দক্ষিণ ভারতীয় মূলনিবাসীদের সঙ্গে উত্তর ভারতীয় আর্যদের মধ্যে যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে আদিকবি বাল্মীকি যে রামায়ণ রচনা করেছিলেন, জনস্বার্থের কারণেই তা সকলের সামনে আনা হোক । মূল রামায়ণের আলোকে ভারত তথা বিশ্বের জনগণ বিচার করে দেখুক বাল্মীকির নাম করে তুলসীদাস বা কীর্তিবাস প্রভৃতি কবিরা যে রামায়ণ রচনা করেছিলেন তা কতটা খাঁটি বা কতটা ভেজাল । তিনি মূল বাল্মীকি রামায়ণের মা স্বরুপনখার (সুর্পণখা নয়) কাহিনী প্রকাশ করে বললেন যে, আদিকবি বাল্মীকির রামায়ণের বহু কাহিনিকেই পরবর্তীকালে ব্রাহ্মণেরা নিজেদের মতো করে পরিবেশন করেছে যাতে আদি কাহিনিটি লুপ্ত হয়ে গিয়েছে । মা স্বরুপনখার কাহিনিটি হল :
স্বরুপনখা রাবণের বোন । অসুর রাজ বিদ্যুৎজ্জিতবাহুর সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয় । তাঁদের একটি ছেলে । তার নাম সাম্ব । অসুররাজ বিদ্যুৎজ্জিতবাহুর মৃত্যুর পর রাবণ স্বরুপনখাকে দণ্ডকারণ্যের শাসিকা হিসেবে নিয়োগ করেন এবং বীর খরকে সেনাপতি হিসেবে নিয়োগ করেন । রাম বনবাসের নামে ব্রাহ্মণ্য যজ্ঞ সংস্কৃতি ও শাসন ব্যবস্থা কায়েম করার জন্য দক্ষিণ প্রদেশগুলি আক্রমণ করে । বালক সাম্ব রামের সম্মুখীন হলে রাম তাকে নির্মমভাবে হত্যা করে । মা স্বরুপনখা নিজের পুত্রের এমন নির্মম হত্যার কথা শুনে হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে একাকী রামের সঙ্গে যুদ্ধ করার জন্য হাজির হন । রাম তার পত্নী সীতার সামনেই স্বরুপনখাকে ধর্ষণ করে ।
তার শুধু নাক, কান নয় নিজের হাতেই রাম স্বরুপনখার স্তনও কেটে দেয় ।
কিন্তু তুলসীদাস বা কীর্তিবাস এই কাহিনিকে চেপে দিয়ে সম্পূর্ণভাবে তাঁদের মনগড়া কাহিনি আকারে পরিবেশন করেন ।
======================================================
উপনিষদগুলো বাগাড়ম্বর, হাস্যকর ও বিজ্ঞান-বিরোধী নানা তথ্যের জঞ্জাল । জগৎ ও জীবন সৃষ্টির এক আজগুবি তথ্য (বৃহদারণ্যক, ২/১/১০) দিয়ে বলা হয়েছে, 'আমি থেকে যেমন স্ফুলিঙ্গের উদ্ভব, তেমনই এই আত্মা থেকে উদ্ভব হয় প্রাণ, লোক দেব এবং বস্তুসমূহের । এই 'আমি' কে ? আত্মা ।'
আর এক জায়গায় (বৃহদারণ্যক, ১/৪/১-৪) সৃষ্টির বর্ণনা করতে গিয়ে বলা হয়েছে, 'আত্মাই প্রথম পুরুষ । চতুর্দিকে দৃষ্টিপাত করে তিনি নিজেকে ব্যতীত দ্বিতীয় কাউকে দেখতে পেলেন না । তিনি উচ্চারণ করলেন 'সোহং' (আমিই একমাত্র) । অতঃপর তাঁর নাম হল 'অহং', যা আমরা নিজেদের নামোচ্চরণের আগে বোধ করি ।... তিনি আতঙ্কিত হলেন, আজও তাই নিঃসঙ্গ ব্যক্তিকে আতঙ্ক গ্রাস করে ।... তিনি দ্বিতীয় সত্তাকে কামনা করলেন ।... নিজ আত্মা ও শরীরকে দ্বিধাবিভক্ত করলেন, সৃষ্টি হল পতি ও পত্নী ...।'
আবার ছান্দোগ্যতে (ছান্দোগ্য উপনিষদ ৬/২/১-৪) সৃষ্টি বর্ণনায় আমরা পাচ্ছি, 'সৃষ্টি প্রথমে এক অদ্বিতীয় ভাবরূপেই ছিল, তিনি নিজেকে প্রকাশ করতে চাইলেন। তাই অগ্নি তথা তেজ উৎপন্ন করলেন । তেজ ইচ্ছা করলেন এবং জল সৃষ্টি হল...জল থেকে সৃষ্টি করলেন...অন্ন ।'
ছান্দোগ্যতে আমরা পরলোক তত্ত্বে 'পিতৃযান' ও 'দেবযান'-এর পরিচয় পেয়েছি । পিতৃযান তত্ত্বে দেওয়া আছে মৃতের আত্মা বা চেতনা মৃত্যুর পর কোথায় কোথায় কত দিন ধরে অবস্থান করে । তারপর চন্দ্রলোকে যায় । সেখান থেকে মেয়াদ শেষে আবার আত্মা ফিরে আসে । ফেরাটা এইরকম - চন্দ্রলোক, আকাশ, পিতৃলোক, দক্ষিণায়ন মাস, কৃষ্ণপক্ষ, রাত্রি, তারপর কায়াহীন এবং সবশেষে স্ত্রী-যোনিতে ।
দেবযান-এ যেতে পারলে আত্মাকে আর ফিরতে হয় না । দেবযানের যাত্রী আত্মাকে প্রথম যেতে হয় আলোর দেবতার কাছে । সেখান থেকে পর্যায়ক্রমে যেতে হয় দিনের দেবতা, শুল্কপক্ষের দেবতা, বর্ষার দেবতা, আদিত্য, চন্দ্র, বিদ্যুতের দেবতার কাছে । এখন থেকে আত্মাকে নিয়ে যাওয়া হয় ব্রহ্মার কাছে । এ-বার যাত্রা শেষ ।
পৃথিবীর বাইরে যেমন আকাশ আছে, শরীরের ভিতর তেমনই নাকি আকাশ আছে । আছে অগ্নি, বায়ু, চন্দ্র, সূর্য, পৃথিবী এবং জোতির্মন্ডল । এ সবই আছে শরীরের মধ্যে একটি ছোট কমলা রঙের ঘরে বা হৃদয়ে ।
হৃদয়াকাশে একত্রিত এই দ্যুলোক-ভূলোককে স্মরণের মধ্যেই তাই ব্রহ্ম উপাসনা করা যায় । হৃদয়কে বা মনকে ব্রহ্ম জেনেই উপাসনা করার উপদেশ রয়েছে ছান্দোগ্যতে ।
ঐতেরেয় উপনিষদ-এ আবার এসেছে সৃষ্টিতত্ত্ব । বলা হয়েছে, 'প্রথমে একমাত্র এই আত্মাই জীবিত ছিল । আত্মা মনে মনে ইচ্ছা করলেন লোকপাল সৃষ্টি করব । জল থেকে এক পুরুষকে তুলে তিনি তার দেহে কম্পন সৃষ্টি করে তাকে তপ্ত করলেন । তপ্ত করার পর তার মুখ বিকশিত হল । মুখ থেকে নির্গত হল বাণী, তা থেকে অগ্নি সৃষ্টি হল । নাসারন্ধ্র থেকে নির্গত হল নিঃশ্বাস, নিঃশ্বাস থেকে প্রাণ, প্রাণ থেকে বায়ু । চক্ষু থেকে সৃষ্টি হল দৃষ্টিশক্তি, তা থেকে সূর্য । কর্ণযুগল থেকে হল শ্রবণক্ষমতা, শ্রুতি থেকে দিশা । ত্বক থেকে রোম, রোম থেকে ওষধি বনস্পতি । হৃদপিন্ড স্ফুরিত হল, তা থেকে সৃষ্টি হল মন । মন থেকে চন্দ্র ।' (ঐতেরেয় উপনিষদ, ১/১-৩) ।
আমরা উপনিষদ পড়ে জানলাম, প্রাণ সৃষ্টি রহস্য, যা বিবর্তনবাদের উল্টো দিকে চলেছে । আমরা জানলাম প্রাণ থেকেই সূর্য, চন্দ্র-র সৃষ্টি রহস্য । মন থাকে হৃদয়ে যা বিজ্ঞানের উল্টোপথের পথিক ।
আমরা জানলাম, বায়ু, অগ্নির সৃষ্টি রহস্য । তারপরও হিন্দু দার্শনিকরা কেন যে আজও নিজেদের যুক্তি বিচারকে নির্ভুল প্রমাণ করতে ভুলে ভরা উপনিষদের দোহাই পাড়েন, সেটাই রহস্য । আর একটা মজার কথা হল, উপনিষদ আবার নিজেদের জাহির করতে বেদের দোহাই পাড়ে ।
উপনিষদের প্রতিটি বিভাগই এই ধরণের বিজ্ঞান বিরোধী, অদ্ভুতুড়ে, অর্থহীন ভাষায় ঠাসা । একই সঙ্গে ঠাসা কুসংস্কারে ।
======================================================
বেদের যুগ ছিল উচ্চবর্ণদের সুবর্ণ সুযোগ । 'খাও-পিও-মৌজ করো' । কাজ করবে শূদ্র দাসেরা । উচ্চবর্ণের লোকেদের কাজ ছিল লাম্পট্য - মনুসংহিতা ও আর্য-সাহিত্যই তার প্রমান ।
বেদ ও মনুর অনুশাসনের প্রতি শূদ্রদের অনাগ্রহ, সন্দেহ, ক্ষোভ দেখে আর্য শাসক ও পুরোহিত গোষ্ঠী বিপদের গন্ধ পেলেন । ধোঁয়া থেকে আগুন সৃষ্টি হওয়ার আগেই ধোঁয়ায় উৎপত্তিতে জল ঢেলে দেওয়ার প্রয়োজন অনুভব করলেন ।
এমনই এক প্রয়োজনীয় মুহূর্তে উচ্চবর্ণদের এই সংকটে উদ্ধারকর্তার ভূমিকায় হাজির হলেন পাঞ্চালের রাজা জৈবলি ও ব্রাহ্মণ উদ্দালক আরুণি (গৌতম) । তাঁরা তৈরি করলেন ছান্দোগ্য উপনিষদ (৭০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে) । 'উপনিষদ' শব্দের অর্থ হল - 'গুরু কর্তৃক শিষ্যের নিকট বর্ণিত রহস্য' । ছান্দোগ্য উপনিষদে জৈবলি ও আরুণি নিয়ে এলেন এক নতুন মতবাদ, 'জন্মান্তরবাদ' । পৃথিবীর একমাত্র ধর্ম হিসেবে সনাতন হিন্দু উপাসনা ধর্মে যুক্ত হল 'জন্মান্তর' বিশ্বাস । উপনিষদের এই 'জন্মান্তরবাদ' ও কর্মফল ভারতবর্ষের দাস শ্রমিকদের মাথায় 'সার্থকভাবে' ঢোকানো গিয়েছিল । এই দেশের জনসমষ্টির বেশিরভাগই ছিলেন দাস । সংখ্যাধিক্যের এই সুবিধে থাকা সত্ত্বেও দাসেরা বিদ্রোহ করেননি । কারণ, আগামী জন্মে আবার দাস হতে চাননি । পৃথিবীর অন্যান্য দেশে দাস-বিদ্রোহের আগুন জ্বলতে দেখেছি । কিন্তু আমাদের দেশে জ্বলতে দেখিনি । এই 'মহান' দেশে দাস-বিদ্রোহের আগুন জ্বলতে দেয়নি জন্মান্তরবাদের জলকামান ।
শুধু কি তাই ? উপনিষদ মৃত্যুর পর মানুষকে স্বর্গসুখের ভয়ংকর মিথ্যে প্রলোভন দেখিয়ে অত্যাচারিত, শোষিত মানুষদের প্রতারিত করেছে ।
বেদ তৈরি করেছিল স্থূল কুসংস্কার । উপনিষদ তৈরি করেছিল সূক্ষ্ম কুসংস্কার, যা বেদের কুসংস্কারের চেয়েও বহুগুন
শক্তিশালী । এই আপাত নিরীহ সূক্ষ্ম কুসংস্কারই আজও দুঃখপীড়িত মানুষদের ক্ষোভে জল ঢেলে চলেছে ।
======================================================
বেদে কিন্তু ব্রহ্মাকে পরম ব্রহ্ম বলা হয়েছে । কিন্তু বেদান্ততে শ্রীকৃষ্ণকে পরম ব্রহ্ম বলা হচ্ছে । অর্থাৎ পরম ব্রহ্মের পদ পরিবর্তন হয়েছে । এই পরিবর্তন কেন ? কারণ বেদান্তের রচয়িতা ছিলেন বৈষ্ণব । বৈষ্ণবদের আরাধ্য দেবতা ছিলেন শ্ৰীকৃষ্ণ । তাই ব্রহ্মাকে হঠিয়ে শ্রীকৃষ্ণকে প্রতিষ্ঠা করে ছিল তাঁদের মুখ্য উদ্দেশ্য ।
======================================================
বেদান্ততে রয়েছে অধার্মিকগণ মৃত্যুর পর নরকে গিয়ে দুঃখ, যন্ত্রনা ভোগ করে ফিরে আসে । বেদান্তে বলা হয়েছে রৌরবাদি সাতটি নরকের কথা । আবার পৌরাণিক অভিধান অনুযায়ী নরক আঠাশটি । ...
... আবার অপরদিকে গীতায় এটাও বলা হয়েছে আত্মাকে কাটা যায় না, পোড়ানো যায় না, আত্মা যন্ত্রনা ভোগ করে না । এর মধ্যে কোনটা ঠিক আপনারাই বলুন ।
======================================================
মানব সভ্যতা সত্য, ত্রেতা, দ্বাপর এই তিন যুগে মোট ৩৮ লক্ষ ৮৮ হাজার বছর অতিক্রম করে এসেছে এমনটা যাঁরা ভাবেন,তাঁদের 'বোকা' বললে বোকাদের-ই অসম্মান করা হবে ।
======================================================
সত্যযুগে হিরণ্যাক্ষ দানব সমুদ্রের নীচে পৃথিবীকে নিয়ে গেলে বিষ্ণু পৃথিবীকে উদ্ধারের জন্য বরাহ বা শূকর রূপ ধারণ করেন । বরাহ রূপ ধারণ করে দীর্ঘ একহাজার বছর ধরে যুদ্ধ করেন ওই দানবের সঙ্গে । এবং অবশেষে হত্যা করেন । এরপর পৃথিবীকে আবার ওপরে উঠিয়ে নিয়ে আসেন ।
তাহলে বরাহপুরাণ থেকে জানা গেল পৃথিবীকে তার মধ্যেই অবস্থিত সমুদ্রের মধ্যে নিয়ে যাওয়া যায় । অথবা এটাও হতে পারে মহাকাশের বাইরে পৃথিবীর নীচে সমুদ্রে ভাসমান অবস্থায় রয়েছে । RSS-এর কোনও ধর্মবেত্তা কিন্তু মহাকাশ বিজ্ঞানীদের এই তথ্যটি দিতে পারেন । তবে মহাকাশ গবেষণার ক্ষেত্রে একটি বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটে যেতে পারে । হাজার হোক বিষ্ণুর কীর্তি বলে কথা । স্বয়ং প্রণম্য কৃষ্ণ বেদব্যাস হয়ে নিজের এই অবতারত্বের কথা রচনা করেছেন । বিষ্ণুর এই কাহিনি কি মিথ্যে হতে পারে ! তিনি অবতার হয়ে কি এই আষাঢ়ে গল্প ফাঁদতে পারেন !
======================================================
বিষ্ণুর নবম অবতার হিসেবে বুদ্ধ অবতার রূপে জন্মগ্রহণ করেছিলেন । বুদ্ধ ছিলেন নিরীশ্বরবাদী । যে বুদ্ধ নিরীশ্বরবাদী, কার্যকারণ সম্পর্কে বিশ্বাসী - সেই বুদ্ধকে দেবতা বানানোর জন্য বুদ্ধ অবতার কাহিনি লেখা হয়েছিল । বুদ্ধকে ঘিরে কাহিনি ও তথাকথিত ইতিহাসে অলৌকিক ঘটনার ছড়াছড়ি । পালি ভাষায় বৌদ্ধ ধর্ম নিয়ে প্রথম লেখা হয় তাও বুদ্ধের মৃত্যুর কয়েকশো বছর পরে । তখন আদি বৌদ্ধ ধর্মের রূপান্তর ও বিভাজন চলছে । পালি বৌদ্ধশাস্ত্রে আমরা পেলাম পল্লবিত, অলৌকিকে ভরা বৌদ্ধকে ।
বুদ্ধের উপদেশাবলি বুঝতে হলে বুদ্ধের মূল চার সিদ্ধান্ত জানাটা খুবই জরুরি । সিদ্ধান্তগুলো হল (এক) ঈশ্বরের অস্তিত্ব স্বীকার না করা, (দুই) আত্মাকে 'নিত্য' স্বীকার না করা, (তিন) কোনও গ্রন্থকে স্বতঃপ্রমাণ হিসেবে স্বীকার না করা ।
এবার বলুন এই নিরীশ্বরবাদী বুদ্ধ কীভাবে বিষ্ণুর অবতার হন ?
======================================================
পুরাণ অনুযায়ী সত্যযুগে কোনও পাপকাজ বলে কিছু ছিল না । সবাই পুণ্যবান ছিলেন । অর্থাৎ মানুষের ওপর কোনও অত্যাচার হত না ।
কিন্তু এ-যুগেই বিষ্ণু কূর্ম ও নৃসিংহ অবতার রূপে অত্যাচারী হিরণাক্ষ দানব ও হিরণ্যকশিপুর অত্যাচার থেকে পৃথিবীকে বাঁচাতে আবির্ভূত হয়েছিলেন । এ তো চরম স্ববিরোধিতা । সত্যযুগে যদি সবাই পুণ্যবান হন, তাহলে পাপী হিরণাক্ষ দানব এবং হিরণ্যকশিপু কীভাবে জন্মগ্রহণ করেন ? পুরাণের কাহিনি অনুযায়ী তো এই পাপীদের সত্যযুগের পরের যুগগুলোতে জন্মগ্রহণ করার কথা, যেখানে পাপ ধীরে ধীরে বিস্তার লাভ করছিল ।
আসলে এই স্ববিরোধিতা থাকাটা স্বাভাবিক । কারণ মানুষ মাত্রেই ভুল হয় । পুরাণ রচয়িতারাও ভুল করেছিলেন ।
======================================================