Sunday, 2 August 2015

ভারত ও পরমাণু বোমা - অমর্ত্য সেন

ভারতের ক্ষেপনাস্ত্র নির্মান কার্যক্রমের প্রধান স্থপতি এবং পরমাণু অস্ত্রের বিকাশ সাধনের ক্ষেত্রে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি ড. আবদুল কালাম । তাঁর জন্ম মুসলিম পরিবারে । তিনি এক অতি বিশিষ্ট বিজ্ঞানী এবং ভারতীয় জাতীয়তাবাদের প্রতি তাঁর আনুগত্য প্রবল । ব্যক্তি হিসাবেও তিনি অতিশয় অমায়িক, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৯৯০ সালে এক সান্মানিক উপাধি প্রদান অনুষ্ঠানে তাঁর সান্নিধ্যে আসতে পারার সুবাদে এটা আমি আবিষ্কার করি । কালামের জনহিতৈষণাও  অতি প্রবল এবং ভারতে মানসিক প্রতিবন্ধী শিশুদের জন্য তিনি যে সেবামূলক কাজ করেছেন তারও নজির আছে ।

রাজস্থানের থর মরুভূমির প্রান্তদেশ পোখরানে ১৯৯৮-এর মে মাসে ভারতের পারমানবিক বিস্ফোরণ দেখে কালাম যে গর্ব অনুভব করেছিলেন তিনি তার কথা লিখছেন: 'আমাদের পায়ের তলায় মাটি কেমন বজ্রনিনাদ করে উঠল, আমাদের সামনে মৃত্তিকা কেমন করে উর্ধ্বে  উৎক্ষিপ্ত হল, আতঙ্কিত হয়ে তা আমরা দেখলাম । এ এক অপরূপ দৃশ্য ।' এমন একজন সদয় মানুষ কিরকমভাবে নিছক শক্তির গুণগ্রাহী হয়ে উঠতে পারেন সেটা একটা লক্ষ করবার মতো  বিষয় । তবে সম্ভবত তাঁর প্রতিক্রিয়ার মধ্যে জাতীয়তাবাদের শক্তিরও একটা ভূমিকা ছিল  এবং তার সঙ্গে ছিল একটি মহাশক্তিশালী অস্ত্র সম্পর্কে মোহমুগ্ধতা । কালামের আচরণের কোমলতা তাঁর জাতীয়তাবাদের তীব্রতাকে চোখের আড়াল করে রাখে, কিন্তু বিস্ফোরণের পরে তিনি যেসব কথা বলেছেন তা থেকেই সেটা স্পষ্ট বোঝা গেছে ('২৫০০ বছর ধরে ভারত কারও ওপর আক্রমণ চালায়নি')। যেমন বোঝা যায় ভারতের ওই সাফল্যে তাঁর আনন্দ ('ভারতীয় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির এক বিরাট জয়')।

.... প্রফুল বিদওয়াই এবং অচিন বনায়ক তাঁদের প্রচুর গবেষণাপ্রসূত এবং যুক্তিপূর্ণ গ্রন্থে সঠিক ভাবেই বলেছেন,'পরমাণু অস্ত্রের যাঁরা সর্বাপেক্ষা জোরালো পক্ষপাতী তাঁরা নিরন্তন তাকে এক ধর্মীয় গুরুত্ব এবং ক্ষমতায় ভূষিত করতে চেয়েছেন - তার প্রতি যে ভয়-মিশ্রিত সম্ভ্রম, তাকে আশ্চর্য ব্যাপার বলে মনে করার উপরই বেশি জোর দিয়েছেন; তার যে বিভৎসতা, ভয়ঙ্করতা তার ওপর নয় । আমাদের যুগে জনমানসে, লোকসংস্কৃতিতে সেসব অস্ত্রের স্বীকৃত সন্মানিত স্থান যাতে সুনিশ্চিত হয় সেটাই তাঁরা চেয়েছেন ।'

.... ঔপন্যাসিক অমিতাভ ঘোষ The New Yorker-এ পরমাণু বোমা বিষয়ে ভারতীয় জনগণের প্রতিক্রিয়ার ব্যাপক আলোচনার সূত্রে যথার্থই বলেছেন, 'এই সব পরীক্ষা ভারতের জনগণকে এমন ভাবে বিভক্ত করেছে, যা অন্য কোনও কিছু এর আগে করেনি ।'

...হিন্দু পত্রিকার বিশিষ্ট সাংবাদিক সি. রামমনোহর রেড্ডি হিসেব করেছেন যে, পারমানবিক অস্ত্রে সজ্জিত হওয়ার ব্যয় বছরে মোট জাতীয় উৎপাদনের অর্ধ শতাংশের মতো । শুনে মনে হয় এটা এমন কিছু নয় । কিন্তু অন্য কী কী খাতে এই অর্থ ব্যয় করা যেতে পারত সেটা ভেবে দেখলে এই অঙ্কটা যে কত বড় তা বোঝা যায় । যেমন, হিসেব করে দেখা গেছে, প্রত্যেক অঞ্চলে নিকটবর্তী বিদ্যালয়ে প্রত্যেক শিশুকে প্রাথমিক শিক্ষা দেওয়ার জন্য অতিরিক্ত ব্যয় মোটামুটি ওই একায়পরিমান অর্থ । ভারতের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৪০ শতাংশ এখনও নিরক্ষর, পাকিস্তানে আরও বেশি - প্রায় ৫৫ শতাংশ । তা ছাড়া পরমাণবিকীকরণের মূল্য অন্যভাবেও দিতে হয় , যথা, ভারতীয় বৈজ্ঞানিক প্রতিভাকে অধিকতর উৎপাদনশীল গবেষণা-ধারা এবং যথার্থ অর্থনৈতিক উৎপাদন থেকে সরিয়ে আনা । সামরিক তৎপরতা সম্পর্কে যেহেতু গোপনীয়তা রক্ষা করা হয়, তাই সংসদে সে-বিষয়ে খোলাখুলি আলোচনা হতে পারে না এবং গণতন্ত্রের ও বাকস্বাধীনতার রীতিও এতে ক্ষুন্ন হয় ।

তবে পরমাণবিকীকরণের সম্পর্কে সবচেয়ে বড় যে আপত্তি সেটা প্রধানত অর্থনৈতিক নয় । এই উপমহাদেশে পারমাণবিক দুঃসাহসিকতার জন্যে আসল যে শাস্তি -মানবজীবনের অধিকতর নিরাপত্তাহীনতা - সেইটাই বিরোধিতার আসল কারণ । ---  Amartya Sen​

No comments:

Post a Comment