Wednesday, 15 May 2024

অরিজিন অফ স্পিসিস - চার্লস ডারউইন

প্রত্যেক জীব স্বাভাবিকভাবে এত দ্রুতহারে বৃদ্ধি পায় যে যদি না তারা ধ্বংপ্রাপ্ত হয়, তাহলে পৃথিবী এক জোড়া বংশধর দ্বারা শীঘ্রই পূর্ণ হবে। এমনকি মন্থরভাবে প্রজননক্ষম মানুষ পঁচিশ বছরে দ্বিগুণ হয়েছে, এবং এক হাজার বছরের কম সময়ের মধ্যে আক্ষরিক অর্থে এই হারে এদের বংশধরদের দাঁড়াবার কোন জায়গা থাকবে না। লিনিয়াস গণনা করেছেন যে একটি একবর্ষজীবী উদ্ভিদ যদি কেবলমাত্র দুটি বীজ উৎপাদন করে - এভাবে এত অনুর্বর উদ্ভিদ যদি না থাকে - এবং যদি এদের চারাগাছগুলি পরের বছর দুটি উৎপাদন করে এবং যদি এইভাবে চলে, তবে কুড়ি বছরে দশ লক্ষ উদ্ভিদ জন্মাবে। সমস্ত প্রাণীদের মধ্যে হাতি হচ্ছে সবচেয়ে কম প্রজননক্ষম, এবং এদের স্বাভাবিক বৃদ্ধির সম্ভবপর সর্বনিম্ন হার আমি কষ্ট করে হিসেব করেছি। মোটামুটিভাবে ধরে নেওয়া যেতে পারে যে হাতিরা ত্রিশ বছরের হলে সন্তান উৎপাদনক্ষম হয় এবং নব্বই বছর পর্যন্ত বেঁচে থাকে। যদি এভাবে চলতে থাকে তাহলে ৭৪০ থেকে ৭৫০ বছর পরে প্রায় এক শত নব্বই লক্ষ হাতি বেঁচে থাকবে, যারা প্রথম জোড়ার বংশধর।***********************************************************


Friday, 10 May 2024

প্রাগিতিহাস - মধুশ্রী বন্দ্যোপাধ্যায়

 ১৯৭৪ সালে কেনিয়ার উত্তরে ইথিওপিয়ায় পাওয়া গিয়েছিল একটি জীবাশ্ম যার নাম দেওয়া হয়েছিল লুসি। আমেরিকান নৃতত্ত্ববিদ ডোনাল্ড জোহানসন তখন উত্তর-পূর্ব ইথিওপিয়ার আওয়াস উপত্যকায় হাদার প্রত্নস্থলে কাজ করছিলেন। তিনি সেই সময়ে একটি বাহুর হাড়ের টুকরো পেয়েছিলেন। জোহানসন পরে বলেছিলেন, তখন তার নাড়ির স্পন্দন দ্রুত হয়ে গিয়েছিল, তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে এটি বানর নয়, একটি হোমানিন-এর হাড়। ওই প্রজাতির নামকরণ করা হয় 'অস্ট্রালোপিথেকাস আফারেন্সিস'। এরা হল প্রারম্ভিক হোমিনিন প্রজাতিগুলির মধ্যে একটি। 

সে সময়ে বীটলস-এর বিখ্যাত গান 'লুসি ইন টু দ্য স্কাই উইথ ডায়ামন্ডস'-এর অনুসরণে ওই জীবাশ্মের নাম দেওয়া হয় লুসি। লুসির কঙ্কাল প্রায় ৪০% সম্পূর্ণ অবস্থায় পাওয়া গেছে।

আজ থেকে প্রায় বত্রিশ লক্ষ বছর আগে লুসি মারা গেছে; তখন তার বয়স ছিল মাত্র ১২ বছর। ও ছিল ছোট্টখাট্ট পূর্ণ নারী। শিম্পাঞ্জির মত মুখ ও দেহকাণ্ড, কিন্তু মানবের মত কোমর থেকে নিচের অংশ। ওদের মধ্যে এপ এবং মানব, উভয় বৈশিষ্ট্যই বর্তমান ছিল। ওরা দুটি পায়ে দাঁড়াতে এবং হাঁটতে পারত। আটত্রিশ থেকে ঊনত্রিশ লক্ষ বছর আগে পর্যন্ত ওরা পৃথিবীতে ছিল। পূর্ব আফ্রিকার ইথিওপিয়া, কেনিয়া, তানজানিয়াতে ওদের জীবাশ্ম পাওয়া গেছে। এই প্রজাতির সদস্যদের নাক ছিল চ্যাপ্টা, নিম্ন চোয়াল দৃঢ়ভাবে বেরিয়ে আসা এবং মস্তিস্ক ছিল ক্ষুদ্র। ওদের মস্তিষ্কের আয়তন ছিল ৫০০ কিউবিক সেন্টিমিটারের (সিসি) কম। ওরা খেত নরম খাবার যেমন পাতা, উদ্ভিদ, ফল।

কীভাবে লুসি মারা গেছে? ওর দেহের কিছু আঘাত দেখে অনুমান করা হয়, হয়তো বেচারি গাছ থেকে পড়ে গিয়েছিল। অথবা হয়তো ওকে দ'লে মাড়িয়ে চলে গিয়েছিল শত শত পশু।
***************************************************************
মানব প্রজাতিগুলি তখন উঠে দাঁড়িয়ে হাঁটতে পারছে, হাত দিয়ে ছোট ছোট পাথরের অস্ত্র বানাচ্ছে। তৈরি করতে শিখেছে পাথরের কুঠার। দাঁত হয়েছে ক্ষুদ্রতর। তার মগজের আয়তন বৃদ্ধি পাচ্ছে। ধীরে ধীরে তাদের একটি প্রজাতির দেহের গঠন হল অনেকটা আধুনিক মানুষের মত। এমনই এক মানব প্রজাতি হল 'হোমো ইরেক্টাস'। ওদের হাত ও পা ছিল আগের প্রজাতিগুলির তুলনায় আনুমানিকভাবে দীর্ঘ, অনেকটা আজকের মানুষের মত।

ওরা সেই সময়ে রীতিমত শিকার করতে শুরু করে ও খাদ্যতালিকায় আসে মাংস। নৃতত্ত্ববিদরা মনে করেন যে, মানব প্রজাতিসমূহের খাদ্যাভ্যাসে মাংস আসার ফল ছিল সুদূরপ্রসারী। মানব দেহের একটি অত্যন্ত মহার্ঘ অঙ্গ হল মস্তিক। এটি মানুষের দেহের ওজনের মাত্র ২% দখল করে কিন্তু একে পোষণের জন্য মোট প্রয়োজনীয় ক্যালোরির ২৫% পর্যন্ত আবশ্যক হয়। মস্তিষ্কের পর্যাপ্ত পুষ্টি পেতে মাংসের প্রয়োজনীয়তা ছিল।
***************************************************************
আফ্রিকান জন্মদাত্রী 

আফ্রিকার বাইরে পৃথিবীর বিভিন্ন গোষ্ঠীর 'মাইটোকন্ড্রিয়াল ডিএনএ' হ্যাপ্লোগ্রুপ অনুসন্ধান করে দেখা যাচ্ছে সমস্ত মানুষের শিকড় আছে L3 হ্যাপ্লোগ্রুপে। L3 হ্যাপ্লোগ্রুপের উৎস আফ্রিকা। এই হ্যাপ্লোগ্রুপ থেকে পরিব্যক্তি অনুযায়ী বিভিন্ন শাখাপ্রশাখা বেরিয়েছে। আফ্রিকা থেকে যে মহাপরিযানের দলটি বেরিয়েছিল তাদের ছিল L3 'মাইটোকন্ড্রিয়াল ডিএনএ' হ্যাপ্লোগ্রুপ। তাই পৃথিবীতে যে কোন মানুষের 'মাইটোকন্ড্রিয়াল ডিএনএ' হ্যাপ্লোগ্রুপের পরিব্যক্তি ধরে বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, সেই হ্যাপ্লোগ্রুপ একসময়ে উদ্ভূত হয়েছে L3 হ্যাপ্লোগ্রুপ থেকে। আফ্রিকায় অনেক পুরনো, যেমন L1, L2 ইত্যাদি হ্যাপ্লোগ্রুপ রয়েছে। এদের পৃথিবীর অন্য স্থানে দেখা যায় না। L3 হ্যাপ্লোগ্রুপ-এর কিছু নারী আফ্রিকা থেকে ছড়িয়ে পড়েছিল বাকি বিশ্বে, আর কিছু L3 নারী আফ্রিকাতেই থেকে গিয়েছিল। শেষ দলের নারীরা গোটা বিশ্বে শেষ মহাপরিযানের অংশীদার ছিল না।

আদি হ্যাপ্লোগ্রুপ L3 থেকে প্রায় সমান্তরালভাবে M এবং N উদ্ভূত ও বিকশিত হয়েছে। আর N থেকে সরকারি উদ্ভূত হয়েছে R হ্যাপ্লোগ্রুপ। আফ্রিকার বাইরে সমস্ত আধুনিক মানুষের বংশগতির শুরু ওই M, N ও R হ্যাপ্লোগ্রুপ থেকে। দক্ষিণ এশিয়াতে ওই তিনটি হ্যাপ্লোগ্রুপই পাওয়া যায়। ইউরোপে আছে শুধু N ও R।

পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলের পুরুষের ওয়াই-ক্রোমোজোম ডিএনএ-র পরিব্যক্তির শৃঙ্খল ধরে মূলে যেতে গিয়ে দেখা গেছে যে, আফ্রিকার বাইরের সমস্ত পুরুষের উদ্ভব হয়েছে C, D ও F এই তিনটি হ্যাপ্লোগ্রুপ থেকে। এই তিনটি হ্যাপ্লোগ্রুপ আবার উদ্ভূত হয়েছে আফ্রিকার CT হ্যাপ্লোগ্রুপ থেকে।

বিবর্তনীয় জীববিজ্ঞানীরা মনে করেন যে কজন L3 হ্যাপ্লোগ্রুপযুক্ত নারী সেই সময়ে আফ্রিকা ছেড়েছিল, আফ্রিকার বাইরের সমগ্র মনুষ্য সমাজের আদি মাতা তারাই। আধুনিক গণনা অনুযায়ী L3 হ্যাপ্লোগ্রুপ উদ্ভূত হয়েছে সত্তর হাজার বছর বা তার কিছু আগে। আর M ও N হ্যাপ্লোগ্রুপ দুটি তার পরবর্তী দশ হাজার বছরের মধ্যে উদ্ভূত হয়েছে। বিজ্ঞানের যত অগ্রগতি হচ্ছে এই সময় গণনা ক্রমাগত নিখুঁত করার চেষ্টা চলছে। যেহেতু আফ্রিকার বাইরের সমস্ত মাতৃক্রমের উদ্ভব একটিমাত্র 'মাইটোকন্ড্রিয়াল ডিএনএ' হ্যাপ্লোগ্রুপ থেকে, সেহেতু এই সফল মহাপরিযান হয়েছে মাত্র একবার। অর্থাৎ আফ্রিকার বাইরে সেই মহাপরিযানের বংশধরেরা আজ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে, বিভিন্ন জাতিতে ভাগ হয়ে টিকে আছে। আগে যে সব পরিযান হয়েছে, সেগুলির আর কোন উত্তরসূরী নেই। কারণ আলাদা আলাদা সফল পরিযান হলে, আমরা আজকের মাতৃক্রম ধরে পিছন দিকে গেলে একাধিক হ্যাপ্লোগ্রুপের সন্ধান পেতাম। সেটা কিন্তু পাওয়া যায়নি। আবার পিতৃক্রম ধরে পিছনে গিয়েও সেই রকম একটা হ্যাপ্লোগ্রুপেরই সন্ধান পাই।
***************************************************************
আদি ভারতীয়দের জিনগত পরিচয় 

ভারত ছিল আফ্রিকা থেকে প্রাচীন মানুষের পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ার পথের এক গুরুত্বপূর্ণ ধাপ। পঁয়তাল্লিশ থেকে কুড়ি হাজার বছর আগে প্রাগৈতিহাসিক দক্ষিণ এশিয়াতে বিশ্ব জনসংখ্যার অর্ধেক বাস করত। মানুষের সেই অতি গুরুত্বপূর্ণ পরিযান সম্পর্কে জরুরি তথ্য পাওয়া সম্ভব ভারতের বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর ডিএনএ সিকোয়েন্স থেকে।

এই শতকের প্রথম থেকেই ভারত ও পৃথিবীর বহু জিনবিদ উপমহাদেশের বিস্তীর্ণ অঞ্চল থেকে বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর মানুষের ডিএনএ সংগ্রহ ও বিশ্লেষণ করে তার ফলাফল প্রকাশ করছেন।

এই সমস্ত গবেষণাপত্রে দেখা যায় যে, সমগ্র ভারতীয়দের মূল 'মাইটোকন্ড্রিয়াল ডিএনএ' হ্যাপ্লোগ্রুপ হল M ও N। N থেকে বিভিন্ন সময়ে উদ্ভূত হয়েছে R ও U হ্যাপ্লোগ্রুপ। ভারতীয়দের মধ্যে এই দুই হ্যাপ্লোগ্রুপও দেখা যায়। মাতৃক্রমের বিচারে অন্ততপক্ষে ৬০% ভারতীয় M 'মাইটোকন্ড্রিয়াল ডিএনএ' হ্যাপ্লোগ্রুপের বিভিন্ন শাখা হ্যাপ্লোগ্রুপগুলি বহন করছে। শতাংশে কিছু বিভিন্নতা লক্ষ্য করা যায় দেশের অঞ্চল, জাতি, বর্ণ ইত্যাদির ওপরে। ভারতবর্ষে পরবর্তীকালে যে পরিযানগুলি হয়েছে, বাদবাকিদের মাতৃক্রমের উৎস আছে তাদের মধ্যে।

হায়দ্রাবাদের সেলুলার এবং মলিক্যুলার বায়লোজি কেন্দ্রের বিশিষ্ট জিনবিদ কুমারস্বামী থঙ্গরাজ দীর্ঘদিন ধরে আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের উপজাতিদের জিনোম বিশ্লেষণের কাজে রত। থঙ্গরাজ ও তাঁর সহযোগীরা গ্রেটার আন্দামানিজ ও ওঙ্গেদের 'মাইটোকন্ড্রিয়াল ডিএনএ', 'ওয়াই-ক্রোমোজোম ডিএনএ' ও সার্বিক 'অটোজোমাল ডিএনএ' বিশ্লেষণ করেন। তারা ওদের মধ্যে দুই অভিনব 'মাইটোকন্ড্রিয়াল ডিএনএ' হ্যাপ্লোগ্রুপ M31 ও M32-কে চিহ্নিত করেছেন। এই হ্যাপ্লোগ্রুপের উৎস দক্ষিণ এশিয়াতে, সম্ভবত ভারতে বলে অনুমান করা হয়েছে। প্রাচীন ওই দুই হ্যাপ্লোগ্রুপ থেকে ভারতে মহাপরিযানের সময়কালের একটা আভাস পাওয়া যায়।

আজ থেকে কমবেশি সত্তর হাজার বছর আগে একটি মাত্র তরঙ্গে, অল্প সময়ের মধ্যে, অতি দ্রুত আধুনিক মানুষ উপকূল বরাবর দক্ষিণ এশিয়াতে ছড়িয়ে পড়ে। দীর্ঘদিন ধরে শ্লথ পরিযান হলে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে পৃথক নতুন হ্যাপ্লোগ্রুপ দেখা যেত। তা কিন্তু হয়নি।

২০০৭ সালে ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক সোসাইটির জেনোগ্রাফিক প্রজেক্ট দ্বারা পরিচালিত একটি গবেষণায় দেখা গেছে যে, দক্ষিণ ভারতে মাদুরাইয়ের কাছাকাছি জোথিমনিকাম গ্রামে বসবাসকারী কিছু পুরুষ C হ্যাপ্লোগ্রুপের এক বিরল জেনেটিক মার্কার M130 বহন করে। জেনেটিক মার্কার হল বিপুল ডিএনএ সিকোয়েন্সের মধ্যে একটি ঠিকানা। উল্লেখ করার মতো বিষয় হল, অস্ট্রেলিয়ান আদিবাসীদের মধ্যেও M130 মার্কার পাওয়া গেছে। পুরুষের 'ওয়াই-ক্রোমোজোম ডিএনএ' হ্যাপ্লোগ্রুপের নির্দিষ্ট মার্কার থেকে তিনটি মহাদেশের মধ্যে একটি অতি প্রাচীন যোগাযোগের ইঙ্গিত পাওয়া যায়। এই তথ্য একইসঙ্গে ভারতীয়দের প্রাচীনতা ও ওই মহাপরিযানের সম্ভাব্য পথেরও ইঙ্গিত দেয়। সম্ভবত মাদুরাই অঞ্চল থেকে কিছু মানুষ অস্ট্রেলিয়ায় পরিযান করেছিল। তারা আদিতে এসেছিল আফ্রিকা থেকে। সম্ভবত তারা ছিল মহাপরিযান দলের সদস্য বা তার নিকট বংশধর।

পুরুষদের 'ওয়াই-ক্রোমোজোম ডিএনএ' হ্যাপ্লোগ্রুপ ধরে বিশ্লেষণ করে দেখা যায় যে, ভারতে পিতৃক্রম অনুযায়ী সরাসরি আফ্রিকা থেকে আগত হ্যাপ্লোগ্রুপের প্রভাব তুলনায় কম, ৪০ থেকে ১০ শতাংশের বেশি নয়। এই তথ্য প্রাথমিকভাবে বিভ্রান্তিকর ঠেকে। মাতৃক্রমের দিক দিয়ে অধিকাংশ মানুষ আফ্রিকা থেকে সরাসরি আগত নারীর বংশধর, কিন্তু পিতৃক্রমের দিক দিয়ে পুরুষরা নয় কেন?

আসলে আফ্রিকা থেকে প্রথম যে মানুষ এদেশে এসেছিল ভারতে ইতিহাস সেখানেই থেমে নেই। পরে আরও পরিযান হয়েছে, হয়েছে মানুষের মিশ্রণ। সেই পরিযানগুলি হয়েছে তুলনামূলকভাবে সাম্প্রতিক অতীতে পৃথিবীর অন্যান্য অঞ্চল থেকে। এরাও আদিতে সেই মহাপরিযান গোষ্ঠীর বংশধর। তবে এরা চলে গিয়েছিল পৃথিবীর অন্য প্রান্তে, সেখানে পরিব্যক্তির জন্য তাদের হ্যাপ্লোগ্রুপ হয়ে গেছে ভিন্ন। আবহাওয়া ও খাদ্যের জন্য দেহের আকার, বর্ণ হয়েছে আলাদা। তারা পরবর্তী পরিযানে ভারতবর্ষে আসে। ভারতবর্ষে আগমনকারী সেই পরিযানগুলিতে পুরুষ ছিল নারীদের তুলনায় অনেক বেশি। তারা ভারতে এসে এখানকার নারীদের সঙ্গে মিশ্রিত হয়ে নিজেদের 'ওয়াই-ক্রোমোজোম ডিএনএ' রেখে গেছে পুরুষানুক্রমে ভারতীয় পুরুষের মধ্যে। যে কোনও কারণেই হোক সরাসরি আফ্রিকা থেকে আগত আদি ভারতীয় পুরুষেরা নবাগতদের তুলনায় কম বংশধর রাখতে সক্ষম হয়েছে - হয়তো তাদের নারীদের কোনোভাবে দখল করেছে নবাগত পুরুষদের দল। ...

সত্তর হাজার বছর আগে আধুনিক মানুষের ছোট এক দল সুদূর আফ্রিকা থেকে আরব দেশ ছাড়িয়ে সিন্ধুনদের তীরে ভারতবর্ষে প্রথম পা রেখেছিল। তারাই হল প্রাচীন ভারতের আদি অধিবাসী। জিনবিদরা সেই প্রাচীন জনগোষ্ঠীর নাম দেন 'আদি প্রাচীন দক্ষিণ ভারতের অধিবাসী শিকারী-সংগ্রাহক' বা 'Ancient Ancestral South Indian Population'। এই গ্রন্থে ওদের বলা হয়েছে 'আন্দামানি শিকারী-সংগ্রাহক', কারণ আজকের আন্দামান দ্বীপপুঞ্জের আদি অধিবাসী ওঙ্গে, সেন্টিনেলিজ, জারোয়ারা ওই প্রাচীন জনগোষ্ঠীর নিকটতম জেনেটিক প্রতিনিধি।
***************************************************************
জিনবিদ্যা ও আমাদের সংস্কার 

আধুনিক মানুষের উৎস আফ্রিকা। এক সময়ে শ্বেত-আধিপত্যবাদীদের এই সত্য গলাধঃকরণ করতে কষ্ট হয়েছে। তখন প্রচার করা হয়েছিল 'নিয়ান্ডারথাল'দের থেকে ইউরোপীয়দের উৎপত্তি। অর্থাৎ ওরা অন্যদের থেকে ভিন্ন। জিনবিদ্যার গবেষণায় এ দাবি ধোপে টেঁকেনি। কেননা শুধু ইউরোপে নয়, আফ্রিকার বাইরে সকল মানুষের মধ্যেই সামান্য 'নিয়েন্ডারথাল' জিন উপস্থিত আছে।

এমনকি ইংল্যাণ্ডে মিথ্যা জীবাশ্ম তৈরি করে প্রমাণের চেষ্টা হয়েছে ইংল্যাণ্ডেই ওদের উৎস। এ প্রসঙ্গে পিল্টডাউন ম্যানের কথা স্মর্তব্য। ১৯১২ সালে শখের নৃতত্ত্ববিদ চার্লস ডসন দাবি করেছিলেন তিনি এপ ও মানুষের মধ্যেকার 'মিসিং লিংক' আবিষ্কার করেছেন। জিওলজিক্যাল সোসাইটির সভাতেও ঘোষণা করা হয়েছিল যে, ওই করোটি জীবাশ্ম পাঁচ লক্ষ বছর আগের। ওই ঘোষণার মূল প্রতিপাদ্য হল - ইংরেজরা আফ্রিকা থেকে উদ্ভূত নয়, ওরা পৃথিবীর অন্য মানুষদের থেকে পৃথকভাবে ওদের দেশেই উদ্ভূত হয়েছে। তবে ১৯৫৩ সালে ধরা পড়ে যায় তার এই জালিয়াতি।

বিজ্ঞানভিত্তিক নতুন চিন্তা অনেকে সহজভাবে নিতে পারে না, তারা সত্যকে দেখতে পায় না। অথবা হয়তো দেখতে চায় না। ১৮৫৯-এ চার্লস ডারউইনের 'অন দ্য অরিজন অফ স্পিসিস' প্রকাশিত হবার পরে মিশ্র প্রতিক্রিয়া এসেছিল। এই সম্পর্কিত একটা বিখ্যাত ঘটনার উল্লেখ করছি, আজকে হয়তো তা অকল্পনীয় মনে হবে।

১৯২৫ সালে আমেরিকা হিলসবরোতে এক তরুণ জীববিদ্যার শিক্ষক স্কুলে ডারউইনের বিবর্তনবাদ পড়ান। সেই অপরাধে যুবকটির বিরুদ্ধে মামলা হয়েছিল। আবার সেই ঘটনা নিয়ে ১৯৫৫ সালে আমেরিকাতে বিখ্যাত নাটক 'ইনহেরিট দ্য উইণ্ড' মঞ্চস্থ হয়।

স্কুলশিক্ষক ডারউইনের বিবর্তনবাদ পড়ালে কি দেশের আইন ভঙ্গ হয়? পৃথিবীর সৃষ্টি কি মাত্র ৬,০০০ বছর আগে? বিবর্তনবাদ কি নাস্তিক্য ধর্ম? ইউরোপ, আমেরিকায় কিছুদিন আগেও এই সব প্রশ্ন ছিল। পরবর্তীকালে 'ডারউইনিজম' এক আন্দোলনের জন্ম দেয়। সৃষ্টির ধারণা বিকাশের ক্ষেত্রে তা নেয় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। দেহবর্ণ ও জাতিগত বৈষম্যের বিরুদ্ধে মানুষের চিন্তাধারাকে করে তোলে আধুনিক। 

যা কিছুতে আমরা অভ্যস্ত, তা ব্যত্যয় আমরা সহজে গ্রহণ করতে পারি না। আফ্রিকার মানুষের সঙ্গে আমরা সম্পর্কিত, এই কথা অনেক সাধারণ মানুষও মানতে চান না। তাদের প্রশ্ন আসে, আমার দেহের রঙ তো অত গাঢ় নয়? আমি কেন আফ্রিকার মানুষের উত্তরপুরুষ হব?

দেহের ও চুলের রঙ নিয়ে এক সংস্কার দীর্ঘদিন ধরেই আমাদের মধ্যে আছে।

মনে পড়ে হার্পার লির যুগান্তকারী গ্রন্থ 'টু কিল এ মকিং বার্ড' বইটির কথা! আফ্রিকার কালো মানুষদের জন্য এই সেদিনও আমেরিকাতে আলাদা গির্জা রাখা হত। আমাদের পরিচ্ছন্ন আদিবাসীদের সম্পর্কে স্তেপভূমি থেকে আগত শ্বেতকায়দের দৃষ্টিভঙ্গী সুকুমারী ভট্টাচার্যের 'বেদে সংশয় ও নাস্তিক্য' গ্রন্থে আলোচিত হয়েছে। এই দৃষ্টিভঙ্গী স্বাক্ষরিত আছে আমাদের বর্ণভেদ প্রথায়।

অথচ জিনবিদ্যার সাহায্যে বোঝা যায়, হাজার দশেক বছর আগেও আমরা সবাই কালো ছিলাম। জিনোম বিজ্ঞানের গবেষণায় দশ হাজার বছর আগের এক ব্রিটিশের মুখের প্রতিচ্ছবি নির্মাণ করা হয়েছে। তার ছিল ঘন কালো দেহবর্ণ, চুল কৃষ্ণবর্ণ, চোখ সবুজ। ওই প্রাচীন ব্রিটিশের নাম দেওয়া হয়েছে 'ছেডার ম্যান'।

ডিএনএ বিশ্লেষণ করে একটা মানুষের লিঙ্গ, চুলের রঙ, ত্বকের রঙ, বয়স, সে কোন রোগে আক্রান্ত ছিল কিনা কিংবা কোন অঞ্চল থেকে সে উদ্ভূত এবং আরও অনেক তথ্য জানা যায়। আজ থেকে মাত্র ৫,৭০০ বছর আগের ডেনমার্কের একটি মেয়ের মুখের ছবি তৈরি করা হয়েছে। মেয়েটির দেহবর্ণ ছিল কালো, চুল খয়েরি। চোখ নীল। তখনও ইউরোপের কিছু অংশের মানুষের দেহবর্ণ ছিল কালো। বেশ কয়েক হাজার বছর ধরে ধীরে ধীরে ওদের দেহবর্ণের অভিযোজন হয়ে ফ্যাকাসে হয়ে গেছে।

ও থাকত বাল্টিক সাগরের তীরে এক গাঁয়ে। সেই মেয়ে ছিল ইউরোপীয় শিকারী-সংগ্রাহক গোষ্ঠীর সদস্য। মাছ ধরার কাজে সেই সময়ে ওরা বার্চ গাছের আঠা ব্যবহার করত। এই মেয়ে সেই বার্চ গাছের আঠা চিবিয়েছিল। যেখানে মেয়েটি আঠার টুকরো ফেলেছিল সেখানে বালির স্তরের নিচে সেটি আটকে সিল হয়ে গিয়েছিল। সেই আঠাতে রয়ে গেছে ওর দাঁতের দাগ আর তার সঙ্গে রয়ে গেছে ওর ডিএনএ।

সে সময়ে ওরা আঠা ব্যবহার করত জলের মধ্যে ছোট বেড়া তৈরি করতে। সেই বেড়াতে আটকে পড়া মাছ শিকার করত। আশ্চর্যজনকভাবে ওখানে কোন মানুষের দেহাবশেষ পাওয়া না গেলেও আঠাতে লেগে থাকা দাঁতের দাগ থেকে বিজ্ঞানীরা সেই নারীর সম্পূর্ণ জিনোম সিকোয়েন্সিং করতে পেরেছেন। আর সেই জিনোম সিকোয়েন্সিং থেকে ওই নারীর চেহারা সম্পর্কে আজকে একটা আন্দাজ করা সম্ভব হচ্ছে।

পৃথিবীতে সামগ্রিকভাবে বিজ্ঞানের, বিশেষ করে জিনবিদ্যার বিপ্লব ঘটে যাচ্ছে। প্রতিদিন যুগান্তকারী আবিষ্কারের কথা প্রকাশিত হচ্ছে, যা আমাদের পুরনো ধ্যানধারণাকে পাল্টে দিতে সাহায্য করে।

শীতের দেশের মানুষের রঙ হালকা হওয়ার মূল কারণ ত্বকের এক ধরনের অভিযোজন। এক সময়ে সকলের রঙ ছিল গাঢ়। তবে শীতের দেশে সূর্যের আলো কম। মানুষের ত্বক ভিটামিন-ডি সংশ্লেষ করে সূর্যালোকের সাহায্যে। কালো ত্বক সূর্যালোককে চামড়ার গভীরে ঢুকে ভিটামিন-ডি তৈরি করার পথে বাধা দেয়। যেখানে সূর্যের তেজ যথেষ্ট, সেখানে ত্বকের কালো রঙ সূর্যালোকের ক্ষতিকর ও অনাবশ্যক প্রবেশ আটকায়। কিন্তু শীতের দেশে কালো রঙ হলে মুশকিল, বিশেষ করে যদি খাদ্যে ভিটামিন-ডি কম থাকে। মনে করা হয়, যখন সবাই শিকারী-সংগ্রাহক ছিল তখন খাদ্যে ভিটামিন-ডি পরিমাণে ছিল অনেক বেশি। ওরা বিভিন্ন ধরনের মাছ, ডিম খেত। সেই সময়ে কালো চামড়া জৈবিকভাবে অসুবিধাজনক হয়নি। কিন্তু কৃষি খানিকটা প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাবার পরে খাদ্যাভাস পাল্টে যায় আর তখন শীতের দেশের মানুষের চামড়ার রঙ ফ্যাকাশে হওয়া বেঁচে থাকার পূর্বশর্ত হয়ে দাঁড়ায়।

অল্প কিছুদিন আগেও, ইউরোপ ছিল কালো মানুষের দেশ। শুধু ব্রিটেন বা ডেনমার্ক নয়, অন্য দেশেও মানুষ কালো ছিল। স্পেনে সাত হাজার বছর আগের মানুষের পুনর্নির্মিত মুখ কালো রঙ ফুটিয়ে তুলেছে। গ্রিসেও তাই। সারা ইউরোপের মানুষের ফর্সা হতে কয়েক হাজার বছর লেগেছে। বর্ণের পরিবর্তন এক প্রকার অভিযোজন।
***************************************************************
আধুনিক মানুষের অনুমিত উদ্ভবকাল হল তিন লক্ষ পঁয়ত্রিশ হাজার বছর আগে। আর কৃষিকাজ শুরু হয়েছে এগারো-বারো হাজার বছর আগে। ভাবতে অবাক লাগে, মানুষের মেয়াদকালের ৯৭% সময় সে কৃষিকাজ না করে কাটিয়েছে। দীর্ঘকাল তাদের দৈনন্দিন খাদ্যতালিকায় শস্যজাত খাদ্য ছিল না।
***************************************************************
ভারতবর্ষে মানুষের মিশ্রণের প্রাথমিক ইতিহাস 

হলোসিন যুগের শুরু থেকে পূর্ব ইরানের অভিবাসীরা সিন্ধুনদের অববাহিকার দিকে চলে আসতে থাকে। তখন সারা ভারতে ছিল অবিমিশ্র 'আন্দামানি শিকারী-সংগ্রাহক'রা। ওই অঞ্চলের আদি 'আন্দামানি শিকারী-সংগ্রাহক'দের সঙ্গে মিশ্রিত হয়ে ইরানের অভিবাসীরা বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে বসতি স্থাপন করে। এই মিশ্রণে 'প্রাচীন ইরান-সম্পর্কিত শিকারী-সংগ্রাহক 'দের পরিমাণ ছিল অনেকটা বেশি। হয়তো ওরা দেশের আদি 'আন্দামানি শিকারী-সংগ্রাহক'দের ঠেলে দিয়েছিল প্রত্যন্তে। যাহোক, সেই 'সিন্ধু নদের মিশ্র মানুষ' গড়ে তোলে তৎকালীন ভারত উপমহাদেশের প্রথম নগরকেন্দ্রিক সভ্যতা - হরপ্পীয় সভ্যতা।

পরবর্তীকালে হরপ্পীয় সভ্যতা বিস্তৃত হতে লাগল উত্তর ও পশ্চিম ভারতে। সিন্ধু অঞ্চলের মিশ্র মানুষ হরপ্পীয় সভ্যতার ক্ষয়ের সময় থেকে, অথবা হয়তো আরও আগে, ছড়িয়ে পড়ে সারা ভারতে, দেশের পূর্ব ও দক্ষিণ প্রান্তে। দক্ষিণ ভারতে এসে ওরা সেখানকার 'আন্দামানি শিকারী-সংগ্রাহক'দের সঙ্গে আরও একবার মিশ্রিত হয়। দক্ষিণাঞ্চলে তৈরি হয় 'প্রাচীন দক্ষিণ ভারতের মিশ্র জাতি'। আজও দক্ষিণ ভারতের প্রত্যন্ত অঞ্চলের বিভিন্ন আদিবাসী জনগোষ্ঠীর মধ্যেও 'সিন্ধু নদের মিশ্র মানুষ'র প্রোফাইল পাওয়া যায়।

ডেভিড রাইখ ও তার সহকর্মীদের মডেল অনুযায়ী প্রায় ২,০০০ - ১,০০০ সাধারণ পূর্বাব্দের মধ্যে রাশিয়া/মধ্য-এশিয়ার স্তেপ অঞ্চল থেকে পশুপালকরা আসে উত্তর ভারতে। সেই দলে নারীর সংখ্যা ছিল কম। 'সিন্ধু নদের মিশ্র মানুষ' এর সঙ্গে এই নতুন অভিবাসীদের মিশ্রণে সমগ্র উত্তর ভারত জুড়ে তৈরি হয় 'প্রাচীন উত্তর ভারতের মিশ্র' জাতি। ওই মিশ্রণ ছিল মূলতঃ 'সিন্ধু নদের মিশ্র মানুষ' ও ইন্দো-ইউরোপীয় পশুপালকের মিশ্রণ।

তবে এখন আর 'বিশুদ্ধ' এই দুই পৃথক গোষ্ঠীর মানুষ পাওয়া সম্ভব নয়। কারণ পরবর্তী সময়ে এদের নিজেদের মধ্যে আবার মিশ্রণ হয়েছে। এই দুই প্রাচীন জনগোষ্ঠীর মিশ্রণে আজকের বিভিন্ন ভারতীয় জাতিগোষ্ঠীর সৃষ্টি। এছাড়াও অঞ্চল বিশেষে সংমিশ্রণ হয়েছে পরবর্তীকালে আগত বিভিন্ন আগন্তুকদের সঙ্গেও। এই মিশ্রণের অনুপাত দেশের বিভিন্ন অঞ্চল, জাতি ও বর্ণের ক্ষেত্রে ভিন্ন।

ভারতীয়দের ডিএনএ বিশ্লেষণের মূল কথা এরকম। আগের অধ্যায়ে আলোচিত হয়েছে যে, আমাদের 'মাইটোকন্ড্রিয়াল ডিএনএ' আসে মায়ের দিক থেকে। সেগুলো অধিকাংশই আফ্রিকা থেকে পঁয়ষট্টি হাজার বছর আগে ভারতে আদি আগমনকারী মানুষের 'মাইটোকন্ড্রিয়াল ডিএনএ'-এর সঙ্গে ঘনিষ্টভাবে সম্পর্কিত। সেই আগমনকারীদের দলে নারী ছিল, এবং তাদের উত্তরসূরী এখনও ভারতে যথেষ্ট পরিমাণে আছে। অন্যদিকে, 'ওয়াই-ক্রোমোজোম ডিএনএ' আসে কেবল বাবার দিক থেকে। এই ডিএনএ কেবল পুরুষদের থাকে। তাদের মধ্যে আদি আগমনকারীদের 'ওয়াই-ক্রোমোজোম ডিএনএ' পাওয়া যায় তুলনায় অনেক কম। তার মানে পরে-আসা জনগোষ্ঠীগুলির পুরুষরা পূর্বতনদের চাইতে বেশি বংশধর রেখে গেছে। কেমন করে এটা সম্ভব হল? পরে-আসা গোষ্ঠীগুলিতে পুরুষের সংখ্যা ছিল বেশি, নারী ছিল কম। পুরুষরা মাইগ্রেট করেছে আর নারীরা থেকে গেছে একই অঞ্চলে। নতুন আসা পুরুষরা কোনভাবে ভারতবর্ষের আগে-আসা গোষ্ঠীর নারীদের ওপর নিজেদের অধিকার স্থাপন করতে পেরেছে। হয়তো পুরনো গোষ্ঠীর পুরুষরা লড়াইতে হেরে পালিয়ে গেছে, বা খাদ্যাভাব হওয়ায় তাদের নারীরা নতুন 'ক্ষমতাশালী' গোষ্ঠীর পুরুষদের কাছে এসেছে।

ভারতবর্ষে পিতৃধারায় 'ওয়াই-ক্রোমোজোম ডিএনএ'-র মূল হ্যাপ্লোগ্ৰুপগুলি হল R, H, L ও J। প্রায় ৭৭% ভারতীয় পুরুষ এই চারটি হ্যাপ্লোগ্ৰুপের অন্তর্গত। এর মধ্যে R-এর উৎস স্তেপ অঞ্চলে। আর H ও L হ্যাপ্লোগ্ৰুপের উৎস মধ্য এশিয়ার দিকে, J-এর উৎস ফার্টাইল ক্রিসেন্ট। শাহর-ই-শোকতা ও ব্যাকট্রিয়া-মার্জিয়ানা আর্কিওলজিক্যাল কমপ্লেক্সে প্রাপ্ত ২টি দেহাবশেষের 'ওয়াই-ক্রোমোজোম ডিএনএ' বিশ্লেষণ করে পাওয়া গেছে H1 হ্যাপ্লোগ্ৰুপ।    

এককথায়, ইরান বা পরে স্তেপ থেকে আসা দলে পুরুষ ছিল বেশি, নারী তুলনায় কম। সেই পুরুষেরা ভারতে এসে এখানকার আদি নারীদের সঙ্গে মিশ্রিত হয়ে পুরুষানুক্রমে নিজেদের ওয়াই-ক্রোমোজোম ডিএনএ রেখে গেছে এই দেশের পুরুষদের মধ্যে।
***************************************************************
প্রায় পৌনে চার হাজার বছর আগে ওই সভ্যতা বিনষ্ট হয়েছে, কিন্তু তাদের সভ্যতা, সংস্কৃতি, অর্জিত জ্ঞান সবই কি নষ্ট হয়ে গেছে? 

একথা সত্য, কিছু প্রযুক্তিগত বিদ্যার ধারাবাহিকতা আর ছিল না। নগরের সেই নির্মাণ শৈলী, পশ্চিম এশিয়ার সঙ্গে বাণিজ্য, বন্দরনগরী, অথবা লিখিত সিল হারিয়ে গিয়েছে। এমনকি পরিকল্পিত শহর, সমকোণে মিলিত হওয়া শহুরে রাস্তাঘাট, জনস্বাস্থ্য সচেতনতা কয়েক হাজার বছরে ফিরে আসেনি। তবে গ্রামীণ যে সভ্যতা ওখানে ছিল - চাষের কাজে বলদের ব্যবহার, বিভিন্ন ধরনের গহনা, দাবা ও পাশা খেলা, মূর্তিপূজা, জীবনে গাছ ও পশুর গুরুত্ব, বলদে টানা যানবাহন, মৃৎশিল্প ও চাকার ব্যবহার, ধাতুশিল্প, নাচের মুদ্রা, সঙ্গীতের সঙ্গে বিভিন্ন ধরনের বাজনা ইত্যাদির ধারাবাহিকতা সম্ভবত চলেছে আজও। হরপ্পীয় সভ্যতার নাগরিক নিদর্শন আমরা উদ্ধার করেছি বটে, কিন্তু যুক্তিসঙ্গতভাবে মনে হয় নগরকে উদ্বৃত্ত খাদ্য জোগাত বিরাট গ্রামাঞ্চল। তার প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন নষ্ট হয়ে গেছে, কিন্তু সাংস্কৃতিক ধারাবাহিকতা হয়তো বজায় থেকেছে বহুকাল। 

আজকে ডিএনএ তথ্য বলছে ওরা পরবর্তীকালে প্রায় সমগ্র ভারতে ছড়িয়ে পড়েছিল।

সাড়ে তিন হাজার বছর আগে নাগাদ ইউরেশিয়দের আগমনের ফলে এদেশে আসে বৈদিক সভ্যতা। এই বৈদিক সভ্যতা দিয়েছে নতুন ভাষা, তৈরি হয়েছে গ্রামভিত্তিক অর্থনীতি। কিছু ধর্মীয় জীবনচর্যা যেমন শবদাহ ও অন্যান্য অগ্নিসংস্কার এদের থেকেই এসেছে। ইতিহাসে বৈদিক সভ্যতার অবদান যতটা চর্চা করা হয়, সিন্ধু সভ্যতার কথা সেভাবে আলোচিত হয় না। যে দেশে একসময়ে এত লিখিত সিলের ব্যবহার হত, সেখানেই পরবর্তীকালে কয়েক হাজার বছর ধরে জোর দেওয়া হয় শ্রুতিতে, শোনা কথায়।
***************************************************************
ইউরোপীয় দেহাবশেষ থেকে প্রাচীন ডিএনএ বিশ্লেষণ করে গবেষকরা কতগুলি ফলাফল লিপিবদ্ধ করেন:

* রাশিয়ার নব্যপ্রস্তর যুগ ও ব্রোঞ্জ যুগের পুরুষদের দেহাবশেষে R1a বা R1b হ্যাপ্লোগ্রুপকে ১০০% জিনে চিহ্নিত করা গেছে। এদের মধ্যে য়াম্নায়া পুরুষরা R1b হ্যাপ্লোগ্রুপ বহন করেছে। এই সময়কাল হল আজ থেকে সাড়ে ন'হাজার থেকে চার হাজার সাতশো বছর আগে পর্যন্ত।

* তবে রাশিয়ার বাইরে নব্যপ্রস্তর যুগে R1b ডিএনএ-বিশিষ্ট প্রাচীন দেহাবশেষ পাওয়া যায়নি। অর্থাৎ য়াম্নায়ারা আসার আগে ইউরোপে ওই বিশেষ হ্যাপ্লোগ্রুপের কোন অস্তিত্ব ছিল না। এই হ্যাপ্লোগ্রুপ রাশিয়ান স্তেপ অঞ্চলের, আর তা বাকি ইউরোপে বহন করে এনেছে য়াম্নায়ারা।

* R1a ও R1b হ্যাপ্লোগ্রুপ রাশিয়া থেকে ইউরোপে ছড়িয়ে পড়ে পাঁচ হাজার থেকে সাড়ে চার হাজার বছর আগে। এই দুটি হ্যাপ্লোগ্রুপ আজকের রাশিয়া সহ সারা ইউরোপের পুরুষদের মধ্যে সবচাইতে বেশি পরিমাণে পাওয়া যায়।

সহজ কথায় বললে, হ্যাপ্লোগ্রুপ R ও তার উপশাখাগুলি নব্যপ্রস্তর যুগের প্রাচীন ইউরোপে পাওয়া যায়নি। এই হ্যাপ্লোগ্রুপ ও তার শাখা য়াম্নায়াদের ইউরোপ অভিযানের পরে ওই অঞ্চলে প্রাচীন দেহাবশেষে পাওয়া যায়। অপরদিকে য়াম্নায়াদের সবাই এই জিন বহন করেছে; এর কোনও ব্যতিক্রম পাওয়া যায়নি। ওরা আসার আগে ইউরোপে এক স্থিতিশীল কৃষিভিত্তিক সমাজ ছিল। য়াম্নায়ারা ইউরোপের সেই স্থিতিশীল সমাজকে ভেঙে দিয়ে, কৃষকদের প্রতিস্থাপিত করে নিজেদের সম্প্রসারিত করেছিল। ...

... ইউরোপে বর্তমান অধিবাসীদের জিনপুলের মধ্যে অন্তত ১২% থেকে ৮৫% মানুষ প্রাচীন সেই যাযাবর পশুপালকের R1b1b2 মার্কার বহন করছে। শতাংশের বিভিন্নতা নির্ভর করছে অঞ্চলের ওপরে। তুরস্কের পূর্ব দিকে এই জিন সমাহার সবচাইতে কম, আর পশ্চিমে আয়ারল্যাণ্ডে সবচাইতে বেশী। এই নতি তৈরি হয়েছে পূর্ব থেকে পশ্চিম দিকে।
***************************************************************
আজকের উত্তর ইউরোপীয়দের মত অতটা না হলেও য়াম্নায়াদের দেহবর্ণ ছিল বেশ হাল্কা। এটি একটি জেনেটিক রূপান্তরের (SLC24A5) ফলে হয়েছে। মজার কথা হল, নির্দিষ্ট জিনের এই রূপান্তর ইউরোপীয় ও দক্ষিণ এশীয়দের একটা অংশের মধ্যে দেখা যায়। এই রূপান্তর পাওয়া যায় উত্তর ভারত, পাকিস্তান ও মধ্য এশিয়াতে। তবে দক্ষিণ ভারতীয়দের মধ্যে কিন্তু রূপান্তরটি পাওয়া যায় না। পূর্ব এশীয়, অর্থাৎ চীন জাপান ইত্যাদি দেশের মানুষের বর্ণও হালকা। তবে তাদের হালকা বর্ণ কিন্তু অন্য একটি জেনেটিক রূপান্তরের ফল।
***************************************************************
ওয়াই-ক্রোমোজোমে R1a1a-Z93 ডিএনএ ভারতের উচ্চবর্ণের মধ্যে দেখা যায়। বিশেষ করে উত্তর ভারতের ব্রাহ্মণদের মধ্যে এই ডিএনএ বা তার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ডিএনএ-র প্রাধান্য অবিসংবাদিত। মধ্য এশিয়াতেও এই ডিএনএ যথেষ্ট পাওয়া যায়। বিভিন্ন আনুষঙ্গিক তথ্যের ওপরে ভিত্তি করে বলা যায় যে, সম্ভবত আজ থেকে চার হাজার থেকে তিন হাজার আটশ বছর আগের মধ্যে ভারতীয় উপমহাদেশে R1a1a-Z93 প্রবেশ করেছে। আজ থেকে প্রায় চার হাজার বছর আগে মধ্য এশিয়ার ব্রোঞ্জ যুগের জনগোষ্ঠী ইউরেশিয়ার পূর্ব ও দক্ষিণ দিকে সম্প্রসারিত হয়েছিল।   
***************************************************************
ইন্দো-ইউরোপীয়রা ভারতে একবারে আসেনি। দলে দলে এসেছে। তাদের মধ্যে একটি দল হয়তো বেদের একটা অংশ বহন করে এনেছে। অধ্যাপিকা সুকুমারী ভট্টাচার্য মনে করেন, তারাই শেষ বৃহৎ দল।

অধ্যাপক রামশরণ শর্মা মনে করেন, ঋগ্বেদে উল্লিখিত দাস ও দস্যু হয়তো এক গোষ্ঠী নয়। দস্যুরা হরপ্পীয় সভ্যতার উত্তরসূরী। দাস হয়তো অগ্রগামী ইন্দো-ইউরোপীয় গোষ্ঠীর অধস্তন পুরুষ। ঋগ্বেদের প্রথম দিকে দাস হত্যার কথা বিশেষ নেই, ওদের সঙ্গে আগন্তুকদের আচরণ ছিল কিছুটা সংযত। কিন্তু দস্যুদের ক্ষেত্রে তা নয়। ইন্দ্রও দাসেদের থেকে দস্যুদেরই বেশি আক্রমণ ও হত্যা করেছে। যারা যাগযজ্ঞ করে না তাদের মেরে ফেলে সেই ধনসম্পদ সকলকে বিলিয়ে দেওয়া হবে, এইরকমই আশা সকলে পোষণ করত। অনেক সময়ে তাদের পরাজিত করা হয়েছে ও গৃহকর্মে নিযুক্ত করা হয়েছে। এদের অপমানজনক অভিধায় ভূষিত করা হয়েছে, যেমন অনাস, বৃষশিপ্র, রাক্ষস, দাস, দস্যু। বৃষের মতো মোটা ঠোঁট বলে তাদের ওরা বলেছে বৃষশিপ্র।
***************************************************************
ভারতের মুসলমান সমাজ 

ভারতীয় মুসলমানরা এদেশীয় নাকি তারা দেশের বাইরে থেকে এসেছেন - এ নিয়ে বিতর্ক চলেছে বহুদিন।

২০০৭ সালে মারিয়া সি টেরেরোস ও তার সহকর্মীরা জিনবিদ্যার প্রাথমিক গবেষণায় দাবি করেন যে, ভারতীয় শিয়া ও সুন্নি সম্প্রদায়ের মধ্যে পশ্চিম-এশিয়ার 'মাইটোকন্ড্রিয়াল ডিএনএ'-র সুস্পষ্ট অনুপস্থিতি প্রমাণ করে তারা দেশের বাইরে থেকে আসেনি। ডিএনএ নমুনা নেওয়া হয়েছিল মূলতঃ উত্তরপ্রদেশের শিয়া ও সুন্নি গোষ্ঠীগুলি থেকে। সেই ডিএনএ বিশ্লেষণ করে মধ্য এশিয়া ও উত্তর আফ্রিকার হ্যাপ্লোগ্রুপের সঙ্গে তুলনা করা হয়। এরপরে তারা সিদ্ধান্তে আসেন যে, ভারতীয় মুসলিমরা মাতৃক্রমের দিক দিয়ে দেশের বাইরের লোকেদের সঙ্গে নয় বরং অন্যান্য ভারতীয় গোষ্ঠীর সঙ্গে তুলনীয়। তারা মাতৃক্রমে ভারতীয় বংশোদ্ভূত।

পুরুষদের ক্ষেত্রে পূর্ববর্তী বিভিন্ন ওয়াই-ক্রোমোজোম ডিএনএ ডেটা থেকে উনি সিদ্ধান্তে এসেছেন যে, ভারতীয় মুসলমানরা আঞ্চলিক প্রতিবেশী হিন্দুদের থেকে ধর্মান্তরিত। তবে ভারতীয় শিয়াদের মধ্যে আফ্রিকান ও মধ্য প্রাচ্যের 'ওয়াই-ক্রোমোজোম ডিএনএ'-র YAP মিউটেশনের উল্লেখযোগ্য উপস্থিতি আছে। শিয়াদের এই মার্কার প্রমাণ করে, সম্ভবত একটা জিন প্রবাহ হয়েছিল মধ্য এশিয়া থেকে ভারতবর্ষে। এটি কিন্তু সুন্নিদের মধ্যে অনুপস্থিত।

২০১০ সালে মুথুকৃষ্ণ ঈশ্বরকণ্ঠ, জ্ঞানেশ্বর চৌবে, ক্রিস টাইলার স্মিথ, কুমারস্বামী থঙ্গরাজনদের গবেষণাতে দেখা যায় যে, মুসলিমদের জিনোমিক প্রোফাইল ভৌগোলিকভাবে পার্শ্ববর্তী অমুসলিমদের সঙ্গেই মেলে। তবে সামান্য পরিমাণে আফ্রিকা, আরব ও পশ্চিম এশিয়া থেকেও জিন এসেছে। এইগুলি হল L0a2a2 'মাইটোকন্ড্রিয়াল ডিএনএ' এবং E1b1b1a ও J 'ওয়াই-ক্রোমোজোম ডিএনএ'। শেষ পর্যন্ত ওরাও মারিয়া সি টোরোসাস-এর মত একই সিদ্ধান্তে এসেছেন। ভারতবর্ষে ইসলাম কোন ব্যাপক বহিরাগত জিন প্রবাহ নিয়ে প্রবেশ করেনি।

প্রায় একই ধরনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে জোনমিং ঝাও ও তার সহকর্মীদের গবেষণায়। ওরা দেশীয় শিয়াদের মধ্যে সনাক্ত করেন এক বিশেষ হ্যাপ্লোগ্রুপ E1b1b1। এটি সুন্নিদের মধ্যে পাওয়া যায় না। শিয়াদের মধ্যে এই হ্যাপ্লোগ্রুপের উপস্থিতি প্রমাণ করে যে, মুসলিমদের দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে জিনগত পার্থক্য আছে।

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ভারতীয় মুসলমানরা যদিও হিন্দু বর্ণপ্রথা অনুসরণ করে না তবে তারাও নিজস্ব সম্প্রদায়ের মধ্যেই বিবাহ সীমাবদ্ধ রাখে। অর্থাৎ সুন্নি এবং শিয়ারা নিজেদের গোষ্ঠীর মধ্যেই বিবাহ করতে পছন্দ করে। দেশজুড়ে মুসলমানদের নিয়ে একাধিক গবেষণায় জিনোম সিকোয়েন্সিং করে এই সিদ্ধান্তে আসা যায় যে, ভারতে ইসলামের বিস্তার মূলতঃ একটি সাংস্কৃতিক সংশ্লেষ, মুসলিম বিশ্ব থেকে জিন প্রবাহের প্রমাণ তেমন পাওয়া যায় না। ভারতীয় মুসলমানরা ক্ষত্রী, কুর্মী, ব্রাহ্মণ এবং ঠাকুরদের মতোই ভারতীয়।
***************************************************************
ডেভিড মহল প্রমুখ ২০১৮ সালে কিছু মূল জনগোষ্ঠীর ওয়াই-ক্রোমোজোম ডিএনএ হ্যাপ্লোগ্রুপগুলি বিশ্লেষণ করে জেনেটিক মার্কারের সাহায্যে তাদের ভৌগোলিক উৎসকে সনাক্ত করার চেষ্টা করেছেন। ভারতীয় উপমহাদেশের ৫০টি বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর থেকে মোট ২৫০৪টি নমুনা সংগ্রহ করে 'ওয়াই-ক্রোমোজোম ডিএনএ' ও 'অটোমোজাল ডিএনএ' বিশ্লেষণ করা হয়েছে। ফলাফলগুলি থেকে সামগ্রিকভাবে ভারতে পিতৃক্রমের দিক দিয়ে মোট ১৪টি বিভিন্ন হ্যাপ্লোগ্রুপকে সনাক্ত করা সম্ভব হয়েছে। এই হ্যাপ্লোগ্রুপগুলি আবার পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে মিউটেট করেছে। এইসব তথ্য বিশ্লেষণ করে ওরা কতগুলি সিদ্ধান্তে আসেন।

ভারতবর্ষে ওদের পরীক্ষিত প্রতিটি জাতিগোষ্ঠীর একাধিক হ্যাপ্লোগ্রুপের প্রতিনিধিত্ব আছে। এর থেকে বোঝা যায় যে, একটি সম্প্রদায়ের মধ্যেও একাধিক ভৌগোলিক উৎস থেকে আগত মানুষ আছে। যদিও মোট তথ্যভাণ্ডারে ১৪টি হ্যাপ্লোগ্রুপের অস্তিত্বের প্রমাণ পাওয়া গেছে, তবে দেশের প্রায় ৯০% মানুষই পিতৃক্রমের দিক দিয়ে মাত্র ৭টি হ্যাপ্লোগ্রুপের অন্তর্ভুক্ত। এই গ্রুপগুলি হল: F, G, H, J, L, O এবং R। এদের মধ্যে আবার প্রায় ৭৭% মানুষ ৪টি বৃহত্তম হ্যাপ্লোগ্রুপের অন্তর্ভুক্ত: R, H, L এবং J।

হ্যাপ্লোগ্রুপ R - এটি ভারত ও পাকিস্তানের অন্যতম প্রধান হ্যাপ্লোগ্রুপ। ৩৮.৫% মানুষ এই হ্যাপ্লোগ্রুপ বহন করে। এটি উদ্ভূত হয়েছে প্রায় ২৭ হাজার বছর আগে উত্তর এশিয়ায়। ইউরোপেরও অন্যতম প্রধান এই হ্যাপ্লোগ্রুপ। এই হ্যাপ্লোগ্রুপের উত্তরসূরীদের অধিকাংশ বিভিন্ন ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষায় কথা বলেন। ভারতে হ্যাপ্লোগ্রুপ R আসে য়াম্নায়াদের সঙ্গে সম্পর্কিত বৈদিক সংস্কৃতভাষী ইন্দো-ইউরোপীয় জনগোষ্ঠীর স্তেপভূমি থেকে আগমনের সঙ্গে।

হ্যাপ্লোগ্রুপ H - প্রায় ১৬.১% মানুষ এই হ্যাপ্লোগ্রুপের অধিকারী। এটি ভারতীয় উপমহাদেশের একটি প্রাচীন হ্যাপ্লোগ্রুপ। একে ভারতীয় হ্যাপ্লোগ্রুপ হিসাবে উল্লেখ করা যেতে পারে। মূলতঃ মধ্য প্রাচ্য বা দক্ষিণ মধ্য এশিয়া থেকে প্রায় তিরিশ হাজার বছর আগে এর উৎপত্তি। এরা সম্ভবত আফ্রিকা থেকে আগত জনগোষ্ঠী, তবে ভারতে পরে প্রবেশ করে। উল্লেখ্য, প্রায় সাড়ে চার হাজার বছর আগের শাহর-ই-শোকতা  ব্যাকট্রিয়া-মার্জিয়ানা আর্কিওলজিক্যাল কমপ্লেক্সে প্রাপ্ত ১১টি দেহাবশেষের মধ্যে ২টি ওয়াই-ক্রোমোজোম ডিএনএ বিশ্লেষণ করে পাওয়া গিয়েছিল H1a1d2 হ্যাপ্লোগ্রুপ।

হ্যাপ্লোগ্রুপ L - প্রায় ১১.২% মানুষ এই হ্যাপ্লোগ্রুপের অধিকারী। এরাই হল হরপ্পীয় সভ্যতা তৈরির অন্যতম কারিগর।

হ্যাপ্লোগ্রুপ J - ১১.১% মানুষ এই হ্যাপ্লোগ্রুপের অধিকারী। প্রায় পনের হাজার বছর আগে ফার্টাইল ক্রিসেন্টে এই হ্যাপ্লোগ্রুপের সৃষ্টি।

হ্যাপ্লোগ্রুপ O - এই হ্যাপ্লোগ্রুপ মূলতঃ দেশের পূর্ব দিকে প্রবেশ করা অস্ট্রো-এশিয়াটিক ও তিব্বতি-বর্মীভাষীদের মধ্যে দেখা যায়।
***************************************************************
বাংলা ও ঝাড়খণ্ডের রাজমহল পাহাড়ে মালতো বা 'মালপাহাড়ি' ভাষা দ্রাবিড় ভাষাপরিবারের। ওরাওঁ, মালপাহাড়ি ইত্যাদিরা দ্ৰাবিড় ভাষায় কথা বলেন। এর থেকে ইঙ্গিত পাওয়া যায় যে, পূর্ব ভারতেও একসময় দ্রাবিড় ভাষা প্রচলিত ছিল।
***************************************************************
আধুনিক মানুষের মস্তিস্ক দশকের পর দশকের তথ্য সঞ্চয় করে রাখতে পারে, প্রয়োজন মত সেই তথ্য গোপন গহ্বর থেকে নিয়ে এসে মুহূর্তে প্রক্রিয়াকরণ করতে পারে, সেই প্রক্রিয়াজাত তথ্য বর্তমান সময়ে প্রাপ্ত কোন তথ্যের সাথে তুলনা করে সিদ্ধান্ত নিতে পারে। সেই তথ্যের ভিত্তিতে প্রক্রিয়াকরণ করতে পারে মূর্ত বা বিমূর্ত ভাবনা, হাইপোথিসিস, চিত্র, উপন্যাস, বিজ্ঞানের গুরুত্বপূর্ণ নিগূঢ় নিয়ম।

তবে এই বিশাল মস্তিষ্কের জন্য (যার ওজন দেহ ওজনের মাত্র ২%) আমাদের মোট অক্সিজেনের ২০% দিতে হয়। আর দেহের ২০% রক্ত সঞ্চালন হয় ওই মস্তিষ্কে। দ্বিপদী প্রাণী হবার ফলে (সেই সময়ে মানবের পেলভিস ও জননপথ ছোট হয়ে গেছে), শরীর দীর্ঘ হবার ফলে এবং মস্তিষ্কের আয়তন বৃদ্ধি পাবার ফলে সবচাইতে যন্ত্রণা পায় মানুষ মা। বাচ্চা জন্ম দিতে গিয়ে সে মারাও যেতে পারে। কারণ সরু জননপথ দিয়ে বড় মাথাওয়ালা হোমো স্যাপিয়েন্স শিশু জন্মায়। সন্দেহ নেই এই অসুবিধে সত্ত্বেও টিকে থাকার লড়াইতে বৃহৎ মস্তিস্ক মানুষকে সব অসুবিধা ছাপিয়ে অতিরিক্ত সুবিধা দিতে পেরেছিল।
***************************************************************
ইন্দো-ইউরোপীয়দের উদ্ভব ও তাদের দীর্ঘ পরিযানের পথ নিয়ে কিছু গবেষণা ইতিমধ্যেই হয়েছে। প্রাচীন ডিএনএ থেকে বিশ্লেষিত তথ্য এই গবেষণায় সাহায্য করেছে। স্তেপভূমির পোল্ট্যাভকাতে ২৭১০ সাধারণ পূর্বাব্দের এই পুরুষের জীবাশ্ম পাওয়া গেছে। ওই পুরুষটি ওয়াই-ক্রোমোজোম হ্যাপ্লোগ্রুপ R1a-এর এক উপশাখা R1a-Z93 বহন করেছে। এই বিশেষ হ্যাপ্লোগ্রুপটি মিউটেট করবার সামান্য পরেই পুরুষটি তা বহন করেছে। আবার R1a-Z93 হ্যাপ্লোগ্রুপ আজকে উত্তর ভারতের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে পাওয়া যায়। দক্ষিণ এশিয়ার ব্রোঞ্জ যুগের ফসিলে কিন্তু R1a হ্যাপ্লোগ্রুপ অনুপস্থিত ছিল। এই সব তথ্য একত্রিত করলে বোঝা যায় স্তেপভূমি থেকে R1a হ্যাপ্লোগ্রুপ বহনকারী এক গোষ্ঠীর পরিযান হয়েছে দক্ষিণ এশিয়ার দিকে।

আবার বিগত কয়েক বছর ধরে পূর্ব ইউরোপে ব্রোঞ্জ যুগের যে সব জীবাশ্ম পাওয়া গেছে সেখানেও ওয়াই-ক্রোমোজোম হ্যাপ্লোগ্রুপ R1a-এর উপস্থিতির প্রমাণ পাওয়া যায়। খেয়াল রাখতে হবে, রাশিয়ার স্তেপভূমি বা পূর্ব ইউরোপের মানুষের মধ্যে দক্ষিণ এশিয়ায় ব্যাপ্ত 'আন্দামানি শিকারী-সংগ্রাহক' অথবা 'প্রাচীন ইরান-সম্পর্কিত শিকারী-সংগ্রাহক'-এর জিনোমিক প্রোফাইল পাওয়া যায় না। তাই ভারতবর্ষ থেকে পূর্ব ইউরোপে ইন্দো-ইউরোপীয়দের পরিযান হয়েছে এমন কথা বলার কোন বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই।

স্তেপভূমি থেকে একদিকে পূর্ব ইউরোপ অভিমুখে, অন্যদিকে এশিয়ার দক্ষিণ দিকে ইন্দো-ইউরোপীয়রা পরিযান করেছে, আর এই দক্ষিণমুখী পরিযান তাদের নিয়ে এসেছে ভারতবর্ষে। যুক্তির তীর ভারতে ইন্দো-ইউরোপীয়দের পরিযানের একটাই পথ দেখাচ্ছে। আজ থেকে চার থেকে সাড়ে তিন হাজার বছর আগে রাশিয়া থেকে ওরা এসেছে উত্তর ভারতে।

আর খেয়াল রাখতে হবে এই বৈজ্ঞানিক তথ্যের সঙ্গে বৈদিক সাহিত্য সাযুজ্যপূর্ণ। বিভিন্ন ভাষাতত্ত্ববিদ ও শব্দতাত্ত্বিক যে কথা দীর্ঘদিন ধরে বলে আসছেন, সেই কথাই দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত হয় আজকের জিনবিদ্যার আলোকে।     
***************************************************************
১৩৩ কোটি মানুষের এই দেশ। এই দেশের বিভিন্নতার সঙ্গে অন্য কোন দেশের তুলনা হয় না। ভারত সরকারের 'এনথ্রোপোলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়া'-র 'পিপল অফ ইন্ডিয়া' প্রজেক্ট দেশের ৮৬৩৫ জনগোষ্ঠীর মধ্যে গবেষণা করে বিভিন্ন ধর্ম, সম্প্রদায়, গোত্র, বংশনাম নিয়ে এক তালিকা প্রস্তুত করে। ভারতে হিন্দু ধর্মে ৩৫৩৯টি সম্প্রদায় আছে, মুসলিমদের মধ্যে আছে ৫৮৪টি সম্প্রদায়, খৃস্টানদের মধ্যে ৩৩৯টি, শিখদের মধ্যে ১৩০, জৈন ১০০, বৌদ্ধ ৯৩। পার্সি, ইহুদি এবং আরও ৪১১টি ট্রাইবাল সম্প্রদায় আছে যারা ওপরের কোন ধর্মের সঙ্গে নিজেদের সনাক্ত করতে পারেনি। এই প্রসঙ্গে বলি,ভারতবর্ষে আছে ২২টি মূল ভাষা, আর ছোট বড় মিলিয়ে ১৯৫০০টি ভাষায় মানুষ কথা বলে।
***************************************************************