Thursday, 7 September 2023

চিঠিপত্র - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর - শান্তিনিকেতনের প্রাক্তন ছাত্র শ্রীঅরবিন্দমোহন বসুকে লিখিত

ধর্ম্মকে দেশে প্রতিষ্ঠা না করে দেশকেই ঈশ্বরের এবং ধর্ম্মের আসনে প্রতিষ্ঠিত করবার যে চেষ্টা তাকে য়ুরোপীয় নজিরের খাতিরে আমরা কখনই শ্রদ্ধা করতে পারবনা। Manlinessএর দোহাই দিয়ে ধর্ম্মকে দুর্ব্বল Sentimentalism বলে উড়িয়ে দেবার একটা প্রথা য়ুরোপে আছে আমরাও তার নকল করতে সুরু করেছি - কিন্তু আমাদের দেশে যাকে মনুষ্যত্ব বলে তা Manlinessএর চেয়ে অনেক বড় - আমরা যেন ঐ য়ুরোপীয় Manlinessএর ধিক্কারে লজ্জিত হয়ে তাড়াতাড়ি ঐ মনুষ্যত্বকে বিসর্জন দিতে প্রস্তুত না হই। আমাদের দেশে বলেচেন, "ভূমাত্বেব বিজিজ্ঞাসিতব্যঃ" ভূমা অর্থাৎ যিনি সকলের চেয়ে বড় তাঁকেই জানতে তাঁকেই লাভ করতে চাইবে - তাঁকে আর কিছুরই কাছে ছোট করতে চাইবেনা - যদি তাঁকে খর্ব্ব করে প্যাট্রিয়টিজ্ম্কেই একটা ঘোরতর অন্ধতা; আমাদের দেশের হাঁচি টিকটিকি, ওলাবিবি ঘেঁটুপুজার মতই অন্ধতা; প্রভেদ এই যে, এই অন্ধতার উপর সভ্যদেশের ছাপ মারা আছে - এই অন্ধতা বড় নাম ধরে আমাদের বড় রকম করে ভোলাতে পারে। একথা নিশ্চয় মনে রাখতে হবে দেশ আমাদের দেবতা নয় - অর্থাৎ ঈশ্বরের পরিবর্তে আমরা দেশকে বরণ করতে পারিনে। ... সংসারের সমস্ত দ্বিধাদ্বন্দ্বের মধ্যে প্রবৃত্তির সমস্ত উত্তেজনার মধ্যে, প্রয়োজনের সমস্ত প্রলোভনের মধ্যে এই একটি হাল অটলভাবে চেপে ধরে থাকতেই হবে যে, লাভই হোক আর ক্ষতিই হোক, বাঁচিই আর মরিই, ধর্ম্মকে, ভূমাকে, অর্থাৎ শ্রেষ্ঠতম সত্যকে মহত্তম মঙ্গলকে সর্ব্বান্তঃকরণে স্বীকার করবই - দুর্ব্বলতাবশত তার থেকে ভ্রষ্ট হতে পারি কিন্তু স্পর্দ্ধা করে কোনোদিন যেন একথা মনে চিন্তাও না করি যে ধর্ম্ম চুলোয় যাক দেশকে আমি বড় করে তুলব দেশের জন্য চুরি করব, ডাকাতি করব, অন্যায় করব। দৈশিকতা (প্যাট্রিয়টিজ্ম্) আমাদের আত্মাকে চরম আশ্রয় দিতে পারবেনা, আমি মনুষ্যত্বকে বরণ করে নিয়েছি - আমি হীরের মূল্যে কাচ কিনব না - দৈশিকতা যে মনুষ্যত্বকে লঙ্ঘন করবে এত আমি আমার জীবনে ঘটতে দিতে পারবনা - সেই পথে দু পা বাড়িয়েই দেখলুম পারলুম না - দেশকে ছাড়িয়ে যদি ধর্ম্মকে যদি বিশ্ব মানবকে না দেখতে পাই, যদি দেশের সংস্কারে আমার ঈশ্বরকে আচ্ছন্ন করে তাহলে আমি আমার আত্মার খাদ্য হতে বঞ্চিত হই।