সিকার শহরের পঁচিশটি বাড়ির প্রতিটি পরিবার থেকে পতাসিবাঈ একটা করে রুটি পায় প্রতিদিন। কেউ কেউ আবার সামান্য কটা পয়সাও দেয়। যদিও সে নিজে পয়সা চায় না, কারোর দয়া ভিক্ষাও করে না পতাসি। যারা তাকে প্রতিদিন রুটি দেয়, পতাসির সঙ্গে একসাথে বসে খাওয়ার কথা কল্পনাও করতে পারে না তারা। যদিও পতাসি কাজ না করলে প্রতিটি বাড়ি আর পরিবারই নরককুণ্ড হয়ে যাবে। পতাসির প্রতিদিনের কাজটা তাদের সুস্থ নাগরিক জীবনের পক্ষে চূড়ান্তভাবে অপরিহার্য, অথচ তারা ভীষণ সতর্ক থাকে যাতে পতাসির ছোঁয়া না লাগে।
পতাসি নিজের হাতে সব ভদ্রজনদের বিষ্ঠা পরিষ্কার করে প্রত্যেকের খাটা পায়খানা থেকে। --"হ্যাঁ, আমি মাথায় করে মানুষের গু-মুত বয়ে নিয়ে যাই। তার বদলে মজুরি হিসাবে প্রতিদিন একটা রুটি কিংবা মাসে দশটা টাকা পাই প্রতি বাড়ি থাকে। আমি দিনে প্রায় পঁচিশটা বাড়ির ময়লা পরিষ্কার করি।" একটা ঝুড়িতে ময়লা তুলে মাথায় করে দূরের আবর্জনা ফেলার জায়গায় তা ফেলতে হয়। পায়খানা থেকে ময়লা ফেলার দূরত্ব প্রায় এক কিলোমিটার।
এই সিকার টাউনে পতাসির মতো কয়েকশো মহিলা আছে, যারা বেঁচে থাকার জন্য একই কাজ করতে বাধ্য হয়। মানুষ হয়ে নিজের হাতে মানুষেরই বর্জ্য, মলমূত্র, ক্লেদ ঘেঁটে নাগরিক জীবনকে পরিচ্ছন্ন রাখে। শহরের ভদ্র মহোদয়গণ চমৎকার ভদ্রজনোচিত একটা নামও দিয়েছেন এই পূতিগন্ধময়, নিজেদের শরীরের বর্জ্য আবর্জনার : 'নাইট সয়েল'। মাথায় করে পতাসিরা তাই বহন করে নিয়ে যায়।
এরা টিনের পাত দিয়ে চেঁছে আর এক হাতে ছোট একটা ঝাঁটা দিয়ে কাঁচিয়ে এই ময়লা ঝুড়িতে তোলে। সরকারি বাবুরা পতাসিদের গায়ে একটা লেবেল সেঁটে দিয়েছেন। তাই সরকারি ভাষ্যে তাদের বলা হয় 'ভাঙ্গি'। ময়লা কুড়োনিদের জাতিগোষ্ঠীর লোক। তো, সে যে নামেই ডাকুক না, পতাসি নিজেকে 'মেথর'ই বলে। এদের মধ্যে কোনো কোনো গোষ্ঠী নিজেদের পরিচয় দিতে শুরু করেছে 'বাল্মীকি' বলে।
এই কাজ করে মাসে আড়াইশো টাকার বেশি আয় হয় না পতাসির। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে কমই হয়। কোনো কোনো পরিবার আবার পয়সা দেয় না। মজুরি হিসাবে এদের কাছ থেকে পাওয়া যায় একটা করে রুটি।
আবার যোধপুরে পতাসিদের মতো এই কাজটা যারা করে, তারা আরও কম পায়। মেথর বস্তির গিরজাবাঈ-এর কাছ থেকে জানলাম - প্রতি পরিবার থেকে দিনে একটা রুটি আর মাসে পাঁচ টাকা।
এই বস্তির প্রতি পাঁচজনে একজন মলমূত্র পরিষ্কার করার এই কাজ করে।
ভারতবর্ষে মানুষের মলমূত্র সাফাই করার কাজটা নিজের হাতে করে, সেই মানুষদের সংখ্যা কত?
১৯৭১ সালে সেনসাস পর্যন্ত মানুষের মাথায় মানুষেরই বিষ্ঠা বহন করার কাজটা জীবিকা বা বৃত্তি হিসাবে তালিকাভুক্তই করা হয়নি। কিছু রাজ্য সরকার তাদের রাজ্যে মলমূত্র বহন করার মতো একটা বৃত্তির অস্তিত্ব আছে এটা পর্যন্ত স্বীকার করেন না। তবু ভুলে ভরা, অনুমান-নির্ভর যে তথ্য আছে, তাতে দেখা যাচ্ছে প্রায় দশ লক্ষ দলিত নিজেদের হাতে মানুষের মলমূত্র সাফাই-এর কাজ করে। প্রকৃত সংখ্যাটা সম্ভবত অনেক বেশি। তারা শহুরে ভদ্রলোকদের পায়খানা সাফাই করে, খালি হাতে পচাগলা মৃত জন্তুদের দেহ তুলে নিয়ে যায়।
এই কাজটাই আবার জাতপাতে বিভাজিত ভারতীয় সমাজে আচার-বিচার, সংস্কারের শোচনীয় দূষণকে ডেকে আনে। অস্পৃশ্যতা একটা বৈধ সামাজিক মূল্যবোধের মতোই পতাসিদের অস্তিত্বকে প্রতিটি মুহূর্তে তাড়া করে ফেরে। এমনকী দলিতদের অন্যান্য অংশের কাছেও বাল্মীকিরা অস্পৃশ্য! আচারে-বিচারে-সংস্কারে দলিতরা নিজেরাও এই অভিশাপকে লালন করে নিজেদের মধ্যে। আর বাল্মীকিদের বহন করতে হয় মনুষ্যেতর জীবনের অসহনীয় লাঞ্ছনা। তাদের বস্তিতে এই বিভাজন আরও তীব্র। আর এই নরকের মধ্যে আরও ভয়ঙ্কর মনুষ্যেতর জীবনযাপনের বিচ্ছিন্নতায় বাস করে বাল্মীকিরা।
সিকার বস্তির বংশীলাল গভীর হতাশার সঙ্গে বলল - অবর্ণনীয় দারিদ্রের নিকষ অন্ধকারে ঢাকা পড়ে থাকে বাল্মীকিদের বস্তিগুলি। - "আমাদের চারিদিকে অবদমনের শব্দ, চারিদিকে সর্বগ্রাসী দারিদ্র্যের ক্ষয়।"
জাতপাতের এই নৃশঃস বিভাজন শুধু গ্রামাঞ্চলেই সীমাবদ্ধ নেই। শহরের প্রান্তিক জনজীবনেও আছে। নিজের হাতে এই ক্লেদ পরিষ্কার করার বৃত্তিটা কিছু জাতের জন্যই নির্দিষ্ট। বেশ কিছু পরিবার আবার বংশানুক্রমে এই কাজই করে আসছে। আবার মফঃস্বল টাউনে কিংবা শহরে বাল্মীকিরাই এই কাজ করে থাকে। যেন এটা তাদেরই জাতগত পেশা।
গ্রামাঞ্চলে মানুষ মাঠেই মলমূত্র ত্যাগ করে। সিকার রাজস্থানের প্রায় দু লক্ষ মানুষের এক শহর। তেমনই যোধপুর রাজস্থানের আর এক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ শহর। জনসংখ্যা পনেরো লক্ষের মতো।
-"আমি যে বাড়িগুলিতে কাজ করি তার পঁচিশটা বাড়ির মধ্যে বারোটায় পাকা পায়খানা আছে।" সিকারের গোমতি তার কাজের কথা জানাল। কিন্তু বড় পরিবারের পক্ষে তাদের পায়খানাগুলি খুবই ছোট। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই বড়রা পাকা পায়খানা ব্যবহার করে, ছোটরা কাঁচা পায়খানা। আমাকে কাঁচা পায়খানাগুলি পরিষ্কার করতে হয়।
গোমতি মাসে নির্দিষ্ট কোনো মজুরি পায় না। শুধু দৈনিক একটা করে রুটি পায়। আর যখন মলমূত্র মাখানো বাচ্চাদের জামাকাপড় পরিষ্কার করায় বাবুরা - তখন মাত্র পাঁচ টাকা পায়। আর কিছু না।
অন্য বহু রাজ্যের মধ্যে রাজস্থান একটা রাজ্য, যেখানে স্বাধীনতা-উত্তর পঞ্চাশ বছরে এদের জন্য প্রায় কিছুই করা হয়নি।
১৯৯৩ সালে কেন্দ্রীয় সরকার দ্য এমপ্লয়মেন্ট অফ ম্যানুয়াল স্ক্যাভেনজারস অ্যান্ড কন্সট্রাকশন অফ ড্ৰাই ল্যাট্রিনস (প্রোহিবিশন) অ্যাক্ট চালু করে। এটা রাজ্য তালিকাভুক্ত বিষয়। কেন্দ্রীয় সরকার তাই পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা, কর্ণাটক, মহারাষ্ট্র এবং গোয়া - এই রাজ্যগুলির সমর্থন চায় এবং রাজ্যগুলিও এই আইন প্রণয়নে অকুন্ঠ সমর্থন জানায়। (কেরালায় গণসচেতনতা রাজনৈতিক আন্দোলনের মধ্য দিয়ে এই বৃত্তির অবসান হয়েছে অনেক আগেই)। কিছু পরে মধ্যপ্রদেশ এবং অন্ধ্রপ্রদেশ তাদের সমর্থন জানায়। কিন্তু রাজস্থানে এই আইন এখনও চালু করা যায়নি।
মানুষের বর্জ্য, মলমূত্র, ক্লেদ মানুষের হাত দিয়ে পরিষ্কার করার এই বৃত্তির সংজ্ঞা নির্ধারণ করাটাও এক সমস্যার ব্যাপার। বেশিরভাগই স্যানিটেশন বা নিকাশির কাজে নিযুক্ত, তারাই এই বৃত্তিতে আসে। এদের পরিবারের অনেক সদস্যই আবার নগর পরিষদে ঝাড়ুদারের কাজ করে। এই সাফাই কর্মচারীরা বহু ধরনের স্যানিটেশন কাজের সঙ্গে যুক্ত।
এই পরিবারের অনেককে পাওয়া যায় যারা নিজেরাই ময়লা পরিষ্কারের কাজ করে। আবার কিছু মহিলা সাফাই কর্মচারী হিসাবে কাজ করেও এই কাজ করে। আবার কিছু মিউনিসিপ্যালিটি বেআইনিভাবে মলমূত্র পরিষ্কার করার জন্য এদের ভাড়া করে গোপনে।
এমনকী মহানগরগুলির ম্যানহোলগুলিতে এদের নামিয়ে ময়লা পরিষ্কার করায়। মাটির তলায় নোংরা কাদায় প্রায় বুজে যাওয়া পয়ঃপ্রণালীর ময়লা তোলার কাজেও তাদের ব্যবহার করা হয়।
সিকারে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই কম বয়সি মেয়েরাই বিষ্ঠা পরিষ্কার করার কাজটা করে। এমন অনেক মেয়ের মধ্যে তিনজনের কথা বলি। শকুন্তলা, বয়স ১৬। লাচ্ছি আর রিনা, দু-জনেই ১৪।
-"কয়েকমাস আগে আমরা কাজ বন্ধ করেছিলাম। দু'মাস আমরা এই কাজ করিনি। কিন্তু কোনো কিছুই হয়নি। কাজ বন্ধের দু'মাসে আমরা কারো কাছ থেকে কোনো সাহায্য পাইনি। আমাদের অন্য কোনো উপায়ও ছিল না। তাই বাধ্য হয়ে এই কাজই আবার শুরু করলাম। যদিও নিজেদের ওপরে খুব ঘেন্না হল।"
ভাঙ্গিদের এই মনুষ্যেতর বৃত্তির বিরুদ্ধে সামাজিক প্রতিরোধটা তাদের নিজেদের জাতের মধ্যে থেকেই প্রবলভাবে শুরু হয়েছিল।
মেথর বস্তির ছোট্টুরাম আমাদের জানিয়েছিল যে, "যখন মেয়েরা আর এই কাজ করবে না বলে রুখে দাঁড়াল প্রবল চাপ দেওয়া হয়েছিল তাদের ওপর। অনেককে মারধোরও করা হয়েছিল।"
-"আমাদের ঘরের মরদরাই এ কাজ করতে বাধ্য করত আমাদের। তুমি তাদের সঙ্গে কথা বলে দেখতে পারো।" কমলা এই পরামর্শটা দিয়েছিল আমাকে।
আর আমরা যাদের সঙ্গে কথা বললাম তারা সবাই এই জন্তু-জানোয়ারের মতো নোংরা তোলার বিরুদ্ধে ক্রুদ্ধ জেহাদ ঘোষণা করল। তাদের মধ্যে বিজেপি আর কংগ্রেস(আই)-এর নেতারাও ছিল। এরা সব সাফাই কর্মচারী ইউনিয়নের মাথা।
অথচ কার্যকর এবং প্রামাণ্য কোনো বিরোধিতা তাদের কোনো কর্মসূচির মধ্যে দেখতে পাইনি। এমনকী তাদের ইউনিয়নের দাবিসনদের কোথাও মানুষ মানুষের মলমূত্র মাথায় করে বহন করবে - এর বিরুদ্ধে একটা শব্দও নেই।
পতাসিরাই তাদের কাজের সুবিধার কথা প্রসঙ্গে বলল, "যদি ট্রলি কিংবা চাকা লাগানো ঠেলা গাড়ি পাই তাহলে ময়লা বইতে কিছুটা সুবিধা হয় আমাদের। আমরা যখনই নগরপালিকার কাছে এই গাড়ির কথা বলি, তারা হ্যাঁ বলে।অথচ কখনও কোনো ধরনের গাড়িই দেয় না।"
ইউনিয়নের নেতারাও তাদের অভিযোগের সত্যতা স্বীকার করে জানাল যে, গাড়ি দিলেই কাজটা নগর পরিষদের পুরুষ-কর্মীদের কাছে চলে যাবে। আর সামান্য যে-কটা ঠেলা গাড়ি দেওয়া হয়েছিল, সেগুলিও চুরি হয়ে গেছে। বাজারে, ভাঙা লোহালক্কড়ের দোকানে বিক্রি হয়েছে স্ক্র্যাপ হিসেবে।
মেয়েরা চেয়েছিল আর একটু লম্বা ঝাঁটা। যাতে বিষ্ঠাটা তাদের হাতে মাখামাখি না হয়।
সিপিআই(এম)-এর গণেশ বেড়ওয়াল ধরিয়ে দিলেন - অন্য জায়গার চাইতে অনেক ছোট ঝাড়ু দেওয়া হয় এদের। তার ফলে অনেকটা ঝুঁকে, বিষ্ঠায় প্রায় নাক ঠেকিয়ে ময়লা তুলতে হয় এদের। ফলে নানা রোগ সংক্রমণের ঝুঁকি তো থেকেই যায়।
এদের সমস্যা নিয়ে গবেষণা করছেন সুসান ই. চ্যাপলিন। তাঁর গবেষণাপত্রে তিনি উল্লেখ করেছেন যে, মানুষ মানুষের বিষ্ঠা, মূত্র, ক্লেদ হাতে করে কাঁচিয়ে মাথায় বহন করে নিয়ে যাবে, এই মধ্যযুগীয় বর্বর ব্যবস্থা নিষিদ্ধ করার আইনে যে রাজ্যগুলি প্রথমে সমর্থন জানিয়েছিল সেই রাজ্যগুলিতেই শুধু এই আইন কার্যকর হয়েছে। তার মানে, এই মনুষ্যত্বের কাজটা ভারতবর্ষের নানা প্রদেশের কম করে ২৫০০ ছোট আর বড় শহরগুলিতে এখনও এভাবেই চলছে।
চ্যাপলিন দেখিয়েছেন যে ১৯৫৬-৫৭ সালে এসসি/এসটি কমিশনার এই বর্বর প্রথাটা বন্ধ করতে চেয়েছিলেন। মাথায় করে মানুষের মলমূত্র বহন করার বৃত্তিটার মধ্যেই অস্পৃশ্যতার অভিশাপ দ্রুত ছড়িয়ে পড়ার কারণটা সুপ্ত আছে। আর ময়লানিকাশির এই পদ্ধতিটা চূড়ান্ত অমানবিক, অস্বাস্থ্যকরও বটে।
রাজস্থানের মুখ্যমন্ত্রী অশোক গেহলোট এই সমস্যার সমাধান চাইছেন। জয়পুরে তিনি কথা প্রসঙ্গে আমাদের বলেছিলেন যে, "সরকার খুব তাড়াতাড়ি এই নিষিদ্ধকরণের আইন প্রয়োগ করবে। অন্য রাজ্যগুলি যেভাবে এই সমস্যা মিটিয়েছে, আইনি পথে সেই কাজটাই আমরা শুরু করতে চলেছি।"
এইসব প্রতিশ্রুতির প্রতি মেথররা কিন্তু কঠোর দৃষ্টি রাখবে। বিশেষভাবে যোধপুরে। কেননা যোধপুর গেহলোটের নিজের জায়গা।
যোধপুর বস্তিতে হিসেব মতো শহরের প্রতি চতুর্থ পায়খানাটি কাঁচা। মানে হাত দিয়ে পরিষ্কার করার মতো পায়খানা! এই কাজ তাদের মর্যাদা, সন্মান সব কিছু ধ্বংস করে দিচ্ছে। ফলে এই অসহনীয় বৃত্তির হাত থেকে মুক্তি চাইছে তারা।
সিকারেও মেয়েরা এই 'গান্ধাগি' থেকে রেহাই পেতে উন্মুখ ছিল। মানুষের বিষ্ঠা তাদের তিক্ত ঘৃণার ভাষায় গান্ধাগি ছাড়া আর কী? ভেতরে ভেতরে এই পূতিগন্ধময় জীবিকার বিরুদ্ধে তীব্র অন্তর্মুখী একটা ঐক্য গড়ে উঠছে তাদের মধ্যে।
কিন্তু আর একটা বিষয়েও তারা ঐক্যবদ্ধ ছিল। যদি এই কাজটা সত্যি সত্যি নিষিদ্ধ করা হয়, তাহলে এর থেকে আয় যত সামান্যই হোক না কেন, তার ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থাও করতে হবে।
-"আমাদের আর কী উপায় আছে!" এই তীব্র প্রশ্নটা করল গোমতি। "আমরা মরদ নগর-পরিষদে কাজ করে। আমাদের তিনটে মেয়ে, দুটো ছেলে, তাদের তো মানুষ করতে হবে। আমাদের আয়ও তো খুবই সামান্য।"
পতাসিবাঈ-এর সাতটা ছেলে-মেয়ে। কিশোরী শকুন্তলা আর তার বন্ধুরা জানে যে, এই কাজ করার ফলে তাদের মর্যাদা বলে কিছু থাকছে না। আবার এটাও তারা জানে যে, এই কাজ না করলে তারা ধ্বংস হবে অন্যভাবে। তারা সরকারের কাছে খয়রাতি নয়, পুনর্বাসন চায় - যদিও সেটা পাওয়ার ব্যাপারে বিন্দুমাত্র বিশ্বাস নেই তাদের।
সরকার প্রায়ই খাটা পায়খানাগুলি জলের তোড়ে পরিষ্কার করার পায়খানায় পালটে ফেলার ক্ষেত্রে তহবিলের অপ্রতুলতার কথা বলে। কিন্তু এক বাল্মীকি ধরিয়ে দিল সরকারি এই যুক্তির ফাঁকিটা। - "অন্যান্য ফালতু, অপ্রয়োজনীয় নানা স্কিমের জন্য তো টাকার অভাব হয় না!"
অষ্টম পরিকল্পনায় সাফাই কর্মচারীদের পুনর্বাসনের জন্য ৪৬৪ কোটি টাকার বাজেট বরাদ্দ ছিল, অথচ তাদের ভাগ্যে ছিটেফোঁটাও জুটল না। একটা ফুটো পয়সাও তারা চোখে দেখতে পেল না। কার্যত এই সব বড় বড় কথার ভণ্ডামি আর প্রতিশ্রুতিভঙ্গের ঘটনা দেখে দেখে তারা এতটাই বীতশ্রদ্ধ যে কোনো কিছুতেই আর তারা বিশ্বাস করে না।
-"এই দেশটা অদ্ভুত মজার।" পরিহাসছলে খুবই গভীর একটা প্রসঙ্গের অবতারণা করল যোধপুর মেথর বস্তির বামপন্থী কর্মী শ্যামজি কাল্লা।
একজন অবসরপ্রাপ্ত নাবিক। ১৯৭১ সালে আইএনএস বিক্রান্তের সঙ্গে লড়াইটা নিজে প্রত্যক্ষ করেছে।
-"যখন রাজন্যভাতা বিলোপ হল তখন যারা শত্রুদের স্বার্থরক্ষা করেছে, তাদেরই পুরস্কৃত করা হয়েছে। অথচ যখন মাথায় করে মানুষের মলমূত্র বহন করার জঘন্য প্রথাটা নিষিদ্ধ করা হল আইন করে, তখন এতদিন যারা একেবারে পূতিগন্ধময় ক্লেদের মধ্যে নেমে এই নাগরিক সমাজটাকে পরিচ্ছন্ন রেখেছে, শুধুমাত্র অস্তিত্ব রক্ষার প্রয়োজনে তাদের জন্য কিছুই করা হল না। বরঞ্চ যতই নোংরা হোক, নিষিদ্ধ করার আইন যদি জারি করা হয়, একদিক থেকে শাস্তিই দেওয়া হবে তাদের। শ্রেণী শাসনটা এরকমই নির্দয়।"
তার অনুমান আর অবিশ্বাসটা ভুল প্রমাণিত হোক, মনেপ্রাণে সেই নাবিক সেটা চায়। কিন্তু তার কথায় - এটাতো শুধু টাকার প্রশ্ন নয়, এটা ন্যায়েরও প্রশ্ন। এমনকী যেখানে বাল্মীকিরাও নিজেদের আর্থিক অবস্থার কিছু উন্নতি করতে পেরেছে, সেখানে নিজেদের মধ্যে সামাজিক ভারসাম্য বজায় থাকেনি। বহু ছোট শহরে ঝাড়ুদারের কাজে তাদেরই নিরঙ্কুশ আধিপত্য, ফলে স্থায়ী বেতনের কর্মচারী হয়েছে তারা। বেতন তাদের কম হলেও বেশ কয়েক বছর আগে আর্থিক অবস্থা যা ছিল, তার থেকে এখন যথেষ্ট ভালো অবস্থা তাদের।
কিন্তু এমনই একটা কাজে তাদের একাধিপত্য প্রতিষ্ঠিত, যে কাজটা কেউ করতে চায় না। তাই এখনও পর্যন্ত সমাজের পাতালকুঠির সবচেয়ে অন্ধকারে তাদের অবস্থান। যদিও পরিবর্তন হচ্ছে, কিন্তু অতি ধীর বিলম্বিত গতিতে। আর কখনও কখনও তা তীব্র বিড়ম্বনার কারণও ঘটায়। কারণটা, স্বচ্ছ দৃষ্টিভঙ্গির যুবক কাল্লা জানাল, "এভাবেই তো জাতপাতের ওপর নির্ভরশীল ব্যবস্থাটা টিকে যাক।"