Saturday, 17 December 2022

অবরোধ প্রতিরোধে প্যালেস্তাইন

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মদত ছাড়া ইজরায়েল এই আগ্রাসী মনোভাব নিয়ে চলতে পারত না। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকেই আরব দুনিয়ায় মার্কিন শিখণ্ডী হিসাবে ইজরায়েল ভূমিকা পালন করেছে।


১৯৪৯ থেকে ২০০০ পর্যন্ত আমেরিকা প্রতিরক্ষা বাদ দিয়েই ৯১০০ কোটি ডলার সাহায্য করেছে ইজরায়েলকে। এর প্রায় তিন চতুর্থাংশ পরিমাণ দেওয়া হয়েছে গত ১৪ বছরে। ইজরায়েলকে প্রতিরক্ষা বহির্ভূত খাতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যে অর্থ বা ঋণ দেয় তার একটি বিস্ময়কর নিয়মও চালু আছে ১৯৮৪ থেকে। প্রতি বছর আমেরিকাকে যে টাকা ফেরত দেবার কথা তার থেকে বেশি টাকা ইজরায়েলকে দিয়ে দেওয়া হয় বছরের শুরুতেই। ইজরায়েলকে আমেরিকা সবচেয়ে বেশি অর্থ দেয়। আমেরিকার মোট বিদেশের জন্য বরাদ্দ অর্থের এক-তৃতীয়াংশই পায় ইজরায়েল। যদিও ইজরায়েলের জনসংখ্যা হলো পৃথিবীর ০.০০১ শতাংশ। ইজরায়েল মাথাপিছু আয়ের দিক থেকে বিশ্বের ষোড়শ স্থানে, ইউরোপের অনেক দেশের চেয়েই ওপরে। এতদসত্ত্বেও ইজরায়েলকে এভাবে অর্থসাহায্য করার কারণ নিশ্চয়ই অর্থনৈতিক নয়। ইজরায়েলকে শক্তিশালী করা মার্কিন রণনীতিরই অঙ্গ।


আরব দুনিয়ায় জাতীয়তাবাদী এবং প্রগতিশীল আন্দোলনের ঢেউ উঠেছিল গত শতাব্দীর ছয় ও সাতের দশকে। আরব দুনিয়ার অভ্যন্তরে শাসকরা যেমন সেই প্রবণতা রুখতে চেষ্টা করেছে, ইজরায়েলকে কাজে লাগানো হয়েছে আরব দুনিয়াকে শাসনে রাখতে। ১৯৬৭ সালে আরব-ইজরায়েল যুদ্ধের পর থেকে ইজরায়েল আমেরিকার 'দৃঢ় রাজনৈতিক ও সামরিক মিত্র' হিসেবে ওয়াশিংটনের নীতিপ্রণেতাদের কাছে বিবেচিত হয়েছে।


ইজরায়েল আমেরিকার অস্ত্র পেয়েছে, ইজরায়েলের সেনাবাহিনী প্রায় পুরোপুরিই আমেরিকার অস্ত্রে সজ্জিত শুধু তা-ই নয়, তৃতীয় দেশকে মার্কিন অস্ত্র সরবরাহ করা হয়েছে ইজরায়েলের মাধ্যমে। যেমন দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবিদ্বেষী শাসকদের, লাতিন আমেরিকায়। ইজরায়েলের মধ্যেও আমেরিকার এই ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। ইজরায়েলী সংবাদপত্র ইয়েদিয়ত আহারোনোতের ভাষায়, 'ইজরায়েল হলো এক গডফাদারের বার্তাবাহক, তার নোংরা কাজগুলি করে দেবার লোক'। এই 'নোংরা কাজের' মধ্যে পড়ে প্যালেস্তাইনের আধিপত্য বজায় রাখা, সিরিয়া থেকে ইরান মধ্য প্রাচ্যকে সামরিক হুমকির মধ্যে রাখা, দুনিয়ার দেশে দেশে মার্কিনী অস্ত্রনির্মাতাদের অস্ত্র নাম-বেনামে চালান করা এবং আন্তর্জাতিক মঞ্চে আমেরিকার যাবতীয় কুকীর্তির পাশে দাঁড়ানো।


প্যালেস্তাইন সমস্যার সমাধানে আমেরিকার তথাকথিত উদ্যোগগুলি আসলে ইজরায়েলের অবস্থান শক্তিশালী করার জন্যই। কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের অধ্যাপক রশিদ খালিদির একটি বইয়ের নামই হলো 'প্রতারণার দালালি'। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কীভাবে শান্তি প্রক্রিয়ার নামে প্যালেস্তাইনের সমস্যাকে জীইয়ে রাখছে, তার বিবরণ রয়েছে এই বইয়ে। এর একটি বড় কারণ আমেরিকার রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক মহলে জায়নবাদীদের বিপুল প্রভাব। তারা মার্কিন নীতিকে ইজরায়েলমুখী করে তোলে। আমেরিকার মধ্যে নয়া রক্ষণশীল বা 'নিও কন' বলে পরিচিত যে কট্টর গোষ্ঠী রয়েছে, যারা বিশ্বজুড়ে সামরিক আগ্রাসনের পক্ষে সওয়াল চালিয়েছে, তাদের অনেকেই জায়নবাদী বা তাদের ঘনিষ্ঠ।


******************************************************************


গাজায় ইজরায়েলী আগ্রাসন নিয়ে ভারত সরকারের অবস্থান দেশের মধ্যে ও আন্তর্জাতিক স্তরে গুরুতর প্রশ্ন তুলেছে। বিজেপি সরকার এমনকি সংসদে গাজার ঘটনা নিয়ে পূর্ণাঙ্গ আলোচনা করতে দিতেও রাজি হয়নি। সরকারের নিজের স্পষ্ট অবস্থান তো দূরের কথা। বিদেশমন্ত্রী-সহ মন্ত্রীরা যুক্তি দিচ্ছেন, ইজরায়েল ও প্যালেস্তাইন উভয়েই ভারতের 'বন্ধু', গাজার ঘটনা 'স্পর্শকাতর'। রাষ্ট্রসঙ্ঘের মানবাধিকার সংস্থার প্রস্তাবে ইজরায়েল-বিরোধী অবস্থানে সম্মত হলেও এর বাইরে এক ইঞ্চিও নড়েনি নরেন্দ্র মোদীর সরকার। ইজরায়েলী হামলার কোনো নিন্দা করেনি ভারত সরকার।


এই ঘটনা ভারতের বিদেশনীতিতে বড় রকমের পরিবর্তন। ভারত বরাবর প্যালেস্তাইনের পাশে থেকেছে। গান্ধীজীও প্যালেস্তাইনের মানুষের পূর্ণ স্বাধীন রাষ্ট্র ও ভূখণ্ডের পক্ষে সওয়াল করেছিলেন। ১৯৪৬-র মে মাসে গান্ধীজী বলেছিলেন, আমেরিকা ও ব্রিটেনের সাহায্য নিয়ে এবং এখন খোলাখুলি সন্ত্রাসবাদের সাহায্য নিয়ে প্যালেস্তাইনের ওপরে চেপে বসা অত্যন্ত খারাপ কাজ হচ্ছে। নেহরু থেকে ইন্দিরা গান্ধীর সরকার আন্তর্জাতিক মঞ্চে প্যালেস্তাইনের পক্ষে দাঁড়িয়েছে বরাবর। কিছুদিন আগেও প্যালেস্তাইনের অধিকারের সপক্ষে আন্তর্জাতিক মঞ্চে ভারত সওয়াল করেছে। এমনকি ভারতের ডাকটিকিটে প্যালেস্তাইনের অধিকারের স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। অন্যদিকে, ১৯৪৮ থেকে ১৯৯১ ইজরায়েলের সঙ্গে ভারতের পূর্ণ কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিল না। ১৯৫০-এ ভারত ইজরায়েলকে স্বীকৃতি দিলেও ১৯৯২-এ এসে ভারতে ইজরায়েলী রাষ্ট্রদূত পূর্ণ দূতাবাস তৈরি করতে পারেন। এই সময় থেকেই ইজরায়েলের সঙ্গে ভারতের সম্পর্কেও পরিবর্তন আসতে থাকে। তার একটি কারণ ভারত সরকার নয়া উদারনীতির রাস্তা নেয়, যে পথে পশ্চিমী পুঁজির দাপটই মুখ্য উপাদান হয়ে যেতে থাকে। আন্তর্জাতিক ভারসাম্যের পরিবর্তনে ভারতের বিদেশনীতিতেও মার্কিনমুখী প্রবণতা বাড়তে থাকে। আমেরিকার দৌত্যেই ইজরায়েলের সঙ্গেও ভারতের সম্পর্ক তৈরি হতে থাকে। তবে, ভারতের সঙ্গে ইজরায়েলের সম্পর্ক নতুন দিকে মোড় নেয় অটলবিহারী সরকারের আমলে। ২০০২-এ ইজরায়েলের বিদেশমন্ত্রী সাইমন পেরেজ নয়াদিল্লি সফরে আসেন। এই সফরকে উভয় দেশই অত্যন্ত গুরুত্ব দেয়। ভারতের তদানীন্তন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা ব্রজেশ মিশ্র তত্ত্ব হাজির করেন: সন্ত্রাসবাদের হাতে অভিন্ন ভাবে আক্রান্ত আমেরিকা, ইজরায়েল ও ভারত, সুতরাং এই তিন দেশের একসঙ্গে লড়াই করা উচিত। এই সূত্রায়ণ থেকেই ইজরায়েল-ভারত সম্পর্কের বিন্যাস বদলে যেতে থাকে। প্যালেস্তাইন প্রশ্নকে সন্ত্রাসবাদের সঙ্গে এক করে ফেলে ইজরায়েলের যাবতীয় অমানবিক কুকীর্তিকে প্রশ্রয় দেবার একটি প্রবণতা ভারতের সরকারী নীতিনির্ধারণের জগতেও জায়গা পেতে থাকে।


এই ভারসাম্য বদলের পিছনে একটি উপাদান সামরিক। ইজরায়েলের অর্থনীতির একটি বড় অংশই অস্ত্র ও সামরিক সরঞ্জাম উৎপাদন ও রপ্তানির। ভারত ক্রমশ ইজরায়েলের সামরিক সরঞ্জামের বড় ক্রেতা হয়ে ওঠে। ইজরায়েলের বৃহত্তম তিন অস্ত্র উৎপাদক - ইজরায়েলী আর্মস ইন্ডাস্ট্রি, ইজরায়েল মিলিটারি ইন্ডাস্ট্রিজ এবং রাফায়েল - ভারতে বড় বরাত পেয়েছে। গত দশ বছরে ভারত ইজরায়েল থেকেই সবচেয়ে বেশি সামরিক সরঞ্জাম কিনেছে। এই সংস্থাগুলি বরাত পেতে উৎকোচ দেওয়ায় কালো তালিকাভুক্তও হয়েছে। প্রতিরক্ষা সংক্রান্ত এই সম্পর্ক ইজরায়েলের সঙ্গে ভারত সরকারের সম্পর্ক পরিবর্তনের অন্যতম বড় উপাদান।


মতাদর্শ উপাদানকে মোটেই অবহেলা করা চলে না। হিন্দুত্ববাদী মতাদর্শের সঙ্গে উগ্র জায়নবাদী মতাদর্শের নৈকট্য চোখে না পড়ে পারে না। আরএসএস-র মতবাদিক গুরু গোলওয়ালকার লিখেছিলেন ইহুদীরা তাদের জাতি, ধর্ম, সংস্কৃতি, ভাষা সবই রক্ষা করতে সমর্থ হয়েছে; তাদের জাতীয়তা সম্পূর্ণ করতে শুধু দরকার একটি স্বাভাবিক ভূখণ্ড। প্যালেস্তাইনের জমি দখল করে এই তথাকথিত 'ভূখণ্ড'-ই ইজরায়েল। গোলওয়ালকার যেমন হিটলার অনুরাগী ছিলেন তেমনই জায়নবাদী মতাদর্শকেও সম্ভ্রম করতেন। অভিন্ন সূত্রটি হলো মুসলিম-বিদ্বেষ। গোলওয়ালকার ভারতে 'হিন্দু রাষ্ট্র' প্রতিষ্ঠা করে মুসলিমদের যেভাবে দেখতে চাইতেন, ঠিক সেভাবেই আরব ও প্যালেস্তিনীয়দের দেখে থাকে ইজরায়েল। এই মতাদর্শকে ভারতের সরকারী নীতি নির্ধারণের জগতে নিয়ে আসা হচ্ছে।


গাজায় সাম্প্রতিক আক্রমণের সময়ে নজিরবিহীন ভাবে ভারতের সংবাদমাধ্যমে, সোস্যাল মিডিয়ায় ইজরায়েলের হয়ে সাফাই গাওয়া হচ্ছে। স্তম্ভলেখকদের কেউ কেউ এমনও লিখছেন, পশ্চিম এশিয়ায় ইজরায়েল একমাত্র 'গণতান্ত্রিক' দেশ, নিরাপত্তার প্রশ্নে তাদের সঙ্গে সম্পর্ক রাখাই ভারতের পক্ষে উচিত হবে। ইতিহাসের পুরো কাহিনী, ঘটনাপরম্পরা, ইজরায়েলের অভ্যন্তরীণ বাস্তবতা, ইজরায়েলের সন্ত্রাসবাদী নেটওয়ার্কের সমস্ত বিষয়কে আড়ালে রেখে জায়নবাদের পক্ষে ভারতের জনমতকে টেনে আনার চেষ্টা চলছে। প্যালেস্তাইনের প্রশ্নকে 'মুসলিম প্রশ্ন' হিসেবে দেখানোর চেষ্টাও চলছে। তবে, প্যালেস্তাইন প্রশ্নে ভারতের এই অবস্থান বদলের পিছনে সাম্রাজ্যবাদের সঙ্গে ভারতের সম্পর্কের প্রশ্নটিও গুরুত্বপূর্ণ। সাম্রাজ্যবাদের রণনীতিগত পরিকল্পনার অংশ হিসাবেই ইজরায়েল কাজ করছে। এই একই রণনীতিতে ভারতকে টেনে নেবার উদ্যোগ চলছে। ভারত সরকারও ক্রমে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে 'স্ট্র্যাটেজিক সম্পর্ক' গড়ে তুলে নিজের স্বাধীন অবস্থানকে দুর্বল করছে।


প্যালেস্তাইনের জনগণের অধিকারের সপক্ষে ভারতে সবচেয়ে সোচ্চার বামপন্থীরা। বরাবর প্যালেস্তাইনের প্রতি সংহতি আন্দোলনের সামনের সারিতে ছিলো ভারতের বামপন্থীরা। এবারেও সংসদে ভারত সরকারকে কাঠগড়ায় তুলেছেন বামপন্থী সাংসদরা। দেশজুড়ে অসংখ্য মিছিল, বিক্ষোভ, সভায় জনগণকে সমবেত করেছেন বামপন্থীরা।


বিপদের বার্তাই স্পষ্টই। প্যালেস্তাইনের পাশে দাঁড়াতে গেলে এখন ভারতেও কঠিন লড়াই হবে। তা-ই যদি হয়, তাহলে ইতিহাসের ডাক, মানবতার আহবান হলো সেই কঠিন সংগ্রামেই পা মেলাতে হবে।

Friday, 16 December 2022

ছাত্র-যুব-মহিলা ফ্রন্ট সম্পর্কে সিপিআই(এম)

ভারতে, স্বাধীনতা সংগ্রামে ছাত্রসমাজ এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। ১৯৩৬ সালের ১২ই আগস্ট লক্ষ্ণৌতে, সারা ভারত ছাত্র-ফেডারেশনের প্রথম সম্মেলনের প্রারম্ভে সভাপতির আসন গ্রহণ করেন মহম্মদ আলি জিন্নাহ্ এবং জওহরলাল নেহরু সম্মেলন উদ্বোধন করেন।