বাবরি মসজিদ ধ্বংসের পরে যে তথ্যচিত্রটি তোলা হয় তাতে মসজিদ ধ্বংসের পরে তথ্যচিত্রী ক্যামেরা নিয়ে এক বুড়ি হিন্দু মহিলাকে জিজ্ঞেস করেন, 'মাতাজি, আজ এই এতক্ষণ ধরে যা ঘটল তাতে আপনার কি মনে হল? বৃদ্ধা সাশ্রুনেত্রে বক্ষে করাঘাত করে বললেন, 'হায় রাম, তোমার শেষে এই দশা হল যে, অন্যের বাড়ি ভেঙে তোমায় বাস করতে হয়?' ওই বৃদ্ধা বিশ্বাসী হিন্দু, তাঁর কাছে তাঁর ইষ্টদেবতা রামের মান গেল ওই সাম্প্রদায়িক বর্বরতায়।
*************************************
যে ধর্ম অসাম্প্রদায়িক, যে ধর্ম মূলত মানবিক তা সত্যকার মানব-অকল্যাণের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করবে, যেন করত লিবারেশন থিওলজিস্টরা, প্রধানত দক্ষিণ আমেরিকায়, তবে অন্য বহু দেশেও এঁরা সক্রিয়। এঁরা বামপন্থী খ্রিস্টান, সামাজিক অত্যাচার ও শোষণের বিরুদ্ধে এঁরা নিয়ত সংগ্রাম করেন।
*************************************
আপনজনকে দূরে ঠেলে দিয়ে পর করে দেওয়া আমরা কম করিনি। এখন বোধ হয় সময় এসেছে যারা নিজেদের মার্কসবাদী বলে এবং কাজে, সাম্যবাদী সংগঠনে, আন্দোলনে সক্রিয় অংশ গ্রহণ করে; তাদের শুধুমাত্র ধর্মে বিশ্বাসী বলেই ঠেলে দূরে না সরাবার। মার্কসের পরে মার্কসবাদ অপরিবর্তিত থাকেনি। ওইসব মত অবলম্বন করে দেশে দেশে বিপ্লবও সংঘটিত হয়েছে, কাজেই মার্কসবাদের মূল তত্ত্বটিকে অবিকৃত রেখে ধর্মের সঙ্গে যুক্ত হয়ে তা যদি আন্দোলনের দ্বারা বিপ্লবের পথে এগোয়, তাহলে বোধহয় ওই পর্যন্ত ধর্মকে সহ্য করে তেমন মানুষদের সহযোদ্ধা বলে স্বীকার করলে সংগঠনের লাভ ছাড়া ক্ষতি হয় না।
ধর্ম যখন শ্রেণিসংগ্রামকে বাধা দেয়, মানুষে মানুষে বিভেদ সৃষ্টি করে তখনই তাকে সহ্য করা অন্যায়। কিন্তু আজকের ভারতবর্ষে ধর্মবিশ্বাসী মাত্রেই শ্রেণিশত্রু বা সংগ্রামের শত্রু নয়। বহু লোকের কাছে ধর্ম একান্ত ব্যক্তিগত কিছু বিশ্বাস ও আচরণ, যার দ্বারা তারা কারও কোনো ক্ষতি করার কথা কল্পনাও করে না। এদের পর করে কী লাভ? এরা নিজেদের ধর্মবিশ্বাসকে যুক্তিবিচারের আওতার বাইরে রাখে ঠিকই, রাখুক না? যদি সে বিশ্বাস অন্য কোনো সম্প্রদায়ের মানুষকে আঘাত না করে, গণসংগ্রামকে ব্যাহত না করে, বরং সংগ্রামীর সঙ্গে হাত মিলিয়ে এগোয়, তাহলে নাস্তিক মার্কসবাদীর কি সেই সহিষ্ণুতাটুকু থাকবে না তার ওই গোপন ঠাকুরঘরটুকুকে আঘাত না করার? যুক্তিবিচার দিয়ে ধর্মবিশ্বাসকে যাচাই করে না বলেই অনেকসময় নিজের অভিজ্ঞতাই তাদের বিশ্বাসে আঘাত হানে। আর নাও যদি হানে তো, সাম্যবাদী চেতনায় সে আর যাই হোক সাম্প্রদায়িক হয়ে উঠবে না কখনও এবং এই কারণেই আমাদের সহযোদ্ধা থাকবে।
*************************************
সব ধর্মের আদিপর্বে দেখি কোনো সম্প্রদায় ছিল না; কিছু পরে দলীয় স্বার্থ ও প্রাধান্যের লোভে কোনো কোনো ব্যক্তি পৃথক সম্প্রদায় গঠন করে ক্ষমতার জগতে উন্নতি করে নেয়, নিজের ও দলের ... । ইসলাম বাইরের জগতে সৃষ্ট হয়ে ভারতবর্ষে প্রবেশ করে ভিন্নমতাবলম্বী একটি দল হিসাবে। তার আগের ভারতবর্ষ মুখ্যত হিন্দু, বৌদ্ধ, জৈন, আজীবক --- এদের বিভিন্ন শাখা এবং অগণ্য আদিবাসীর দেশ ছিল। ইসলাম এখানে তেমনই একটি সম্প্রদায় হয়ে পাশাপাশি শান্তিতে থাকতে পারত। ছিলও। সিন্ধুপ্রদেশে আসার পর থেকে পাঠান রাজত্বকাল পর্যন্ত। মোগল রাজত্বকালে বিধর্মী হিন্দুকে ধর্মান্তরিত করার চেষ্টার সঙ্গে সঙ্গে হিন্দু-মুসলমানের স্বতন্ত্র সম্প্রদায়চেতনা কতকটা উগ্র হয়ে ওঠে। তখন অন্য সব পরিচয় ছাপিয়ে শুধু সাম্প্রদায়িক পরিচয়ই মুখ্য হয়ে ওঠে।
*************************************
*************************************