'দেখ, বিয়ের পর আশীর্বাদ করবার সময়ে বলি, 'সাবিত্রীসমানা ভব' অর্থাৎ স্বামীকে যমের হাত থেকে ছিনিয়ে এনো। বেমালুম ভুলে যাই, যে ঐ সাবিত্রীই কিন্তু বিয়ের আগে প্রকাশ্যে রাজসভায় নারদের সামনে বাবার সঙ্গে প্রবল তর্ক করেছিল, তার পছন্দের মানুষকে সে বিয়ে করবেই। একবছর পর বিধবা হবে জেনেও তর্ক করেছিল। এবং জিতেছিল। আশীর্বাদ করবার সময়ে সেই সাবিত্রীই সমান হতে বলি কি? নিজের পছন্দের মানুষকে পেয়ে তার প্রাণ ভরে গিয়েছিল, সেই জোরেই না সে যমের সঙ্গে অতক্ষণ লড়াই করেছিল। এবং জিতেছিল। এরা দুই সাবিত্রী নয়রে, একটিই মেয়ে, আশীর্বাদ করতে হলে এই মেয়ের দুটো দিক ভেবেই আশীর্বাদ করতে হবে।'
========================================================================
... আমরা শাস্ত্রের দোহাই পাড়ি তখনই, যখন সে শাস্ত্র আমাদের অভীষ্টের অনুকূল। প্রতিকূল হলে বেমালুম চেপে যাই সে শাস্ত্র।
========================================================================
প্রাচীন শাস্ত্রে বৈধ বিবাহ আটরকমের ছিল (আশ্বলায়ন গৃহ্যসূত্র ১/৬ অংশে এগুলির বিবরণ আছে, অন্যান্য গৃহ্যসূত্রেও আছে): ব্রাহ্ম, দৈব, আর্য, প্রজাপত্য, গান্ধর্ব, রাক্ষস, আসুর ও পৈশাচ। 'ব্রাহ্ম' বিবাহে সবস্ত্রা সালংকারা কন্যাকে পিতা উপযুক্ত পাত্রে দান করতেন। 'দৈব' বিবাহে যজ্ঞ কর্মে রত পুরোহিতকে যজ্ঞকালেই কন্যাদান করতেন কন্যার পিতা। 'আর্য' বিবাহে একটি বলদ ও একটি গাভী কন্যার পিতা দান করতেন বরকে। 'প্রজাপত্য' বিবাহে কন্যার পিতা বর ও কন্যাকে 'উভয়ে একত্রে ধর্মাচরণ কর' এই বলে আশীর্বাদ করে কন্যা দান করতেন। 'আসুর' বিবাহে কন্যার পিতাকে অর্থদানে তুষ্ট করে বর কন্যাকে বিবাহ করতে পারত। 'রাক্ষস' বিবাহে আত্মীয়স্বজনের মধ্যে থেকে রোরুদ্যমানা কন্যাকে বলপূর্বক হরণ করত বর ও তার বন্ধুরা। 'পৈশাচ' বিবাহে ঘুমন্ত অথবা মদমত্ত কন্যাপক্ষীয়দের মধ্যে থেকে ঘুমন্ত কন্যাকে ধর্ষণ করে নিয়ে যেত বর।
লক্ষ করলে দেখি, আসুর বিবাহে কন্যাপণ চলিত ছিল। মনে হয়, অনেক আগে কন্যাপণই প্রচলিত ছিল। বিবাহের এ নামকরণগুলি পরবর্তী কালে খ্রীষ্ট্রীয় পঞ্চম-ষষ্ঠ শতকের। ততদিনে সমাজে কন্যাপণ উঠে গেছে, বরপণ চলিত হয়েছে। 'আর্য' বিবাহে কন্যার পিতা নিঃসম্বল জামাতাকে তখনকার কালে সংসার পাততে যা অত্যাবশ্যক সেই গাভী-বলদ দিতেন বরকে; পণ হিসাবে ততটা নয়, যতটা সংসারযাত্রায় রওনা করিয়ে দেবার জন্য। 'আসুর' বিবাহে কন্যাপণ স্পষ্টভাবেই অনুষ্ঠিত হত। অনুমান করা যেতে পারে, এটি অন্যান্য বিবাহের সঙ্গেও যুক্ত ছিল। সেই কন্যাপণেরই স্মৃতি আর্য বিবাহে, যেখানে গাভী ও বলদ কন্যার পিতা বরকে দিতেন। (কন্যাপণের কথা পাই ঋগ্বেদে ১/১০৯/২; অথর্ববেদ ১৪/১৩২/৩৩ এবং পরবর্তীকালে কাত্যায়ন গৃহ্যসূত্রে ২/৪/২ এবং আরও অন্য বহু শাস্ত্রাংশে। গোভিল গৃহ্যসূত্রে পড়ি, বরপক্ষ ও কন্যাপক্ষ উভয়ই উভয়কে স্বর্ণদান করত, তবে বরপক্ষ অনেক বেশী সোনা দিত। ২/৩/৪; কাত্যায়ন গৃহ্যসূত্র ২/৪/২ - এতেও কন্যাপণের কথা আছে। এছাড়া পরবর্তী সাহিত্যে বেশ কিছু দৃষ্টান্ত আছে কন্যাপণের) রোমানদের মধ্যেও অর্থ দিয়ে কন্যা বিয়ে করার পদ্ধতি চালু ছিল। পরবর্তীকালে যখন ধীরে ধীরে নারীর সামাজিক অবনমন ঘটে, তখন কন্যাপণও ক্রমে অচলিত হয়ে যায় এবং প্রচুর অর্থের বিনিময়ে বধু লাভ করাটা অসম্মানজনক হয়ে ওঠে বরের পক্ষে। তাই সেদিনের কন্যাপণবিশিষ্ট বিবাহের সংজ্ঞা হল 'আসুর' অর্থাৎ আর্যরীতি-বহির্ভূত। এর সমর্থনে বলা যায়, পরবর্তী কালের বহু পুরানে অনুমাত্র কন্যাপণ গ্রহণ করে যে পিতা, তাঁকে ধিক্কার দিয়ে বলা হয়েছে সে 'কন্যাবিক্রয়ী'। মনে হয় 'কন্যাবিক্রয়ী' সমাজে অপাঙ্ক্তেয় হয়ে উঠেছিল। ততদিন বরপণ সমাজে চালু, কিন্তু কোনো শাস্ত্রেই পুত্রের বিবাহে পণ গ্রহণ করেন যে - পিতা, তাঁকে পুত্রবিক্রয়ী বলা হয়নি। যদিও ছেলের বিয়েতে পণ নেওয়া মানেই বাপ ছেলেকে বিক্ৰী করছে, কারণ 'পণ' কথাটির একটাই মানে - দাম। তাই পণ নিয়ে ছেলের বিয়ে দেওয়ার অর্থই হল মেয়ের বাপের কাছে ছেলেটিকে বেচে দিচ্ছে তার বাবা। কিন্তু ততদিনে পুরুষতন্ত্র এত প্রবলভাবে সমাজে প্রতিষ্ঠিত যে, এ অর্থ এবং এর অন্তর্নিহিত অপমান কোনো ছেলের বাপ ভেবেই দেখেনা, কারণ পুরুষমাত্রই ততদিনে স্বমহিমায় প্রতিষ্ঠিত; নারী ঊনমানব।
========================================================================
পণ ছাড়াও নানারকমভাবে টাকা ও ধনরত্ন জড়িত ছিল বিয়ের সঙ্গে। মেয়েটিকে তার বাপের বাড়ির আত্মীয়বন্ধুরা ভালবেসে যা উপহার দিত তা 'স্ত্রীধন'। বরবধূ একসঙ্গে বসে (তাদের তখনকার সংজ্ঞা হল 'যুতক') দুবাড়ির কাছে যা পেত তা হল 'যৌতক' বা 'যৌতুক'। মেয়ের বাবা যে দামে জামাই কেনে তা হল 'পণ'। শ্বশুরবাড়িতে ভালবেসে লোকে বরবধূকে যা দেয় তা হল 'সৌদায়িক'। এর মধ্যে শাস্ত্রমতে স্ত্রীধন হল বধূর একান্ত ব্যক্তিগত সম্পত্তি, যার ওপরে শ্বশুরবাড়ির কোনো অধিকার ছিল না; মেয়েটি তার ইচ্ছামত স্ত্রীধন খরচ ও দান করতে পারত।
========================================================================
খ্রীস্টপূর্ব সপ্তম খ্রীষ্টাব্দ থেকে প্রায় দেড় বছর পরে পর্যন্ত যেসব শাস্ত্র রচিত হয়েছিল, তাতে নারীকে নিজের দেহের বা সম্পত্তির ওপরে অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে। (বারবার বলা হয়েছে, শৈশবে পিতা, যৌবনে স্বামী, বার্ধক্যে পুত্ররা নারী রক্ষাকর্তা, নারী স্বাধীনতার যোগ্য নয়; 'ন স্ত্রী স্বাতন্ত্র্যমর্হতি'।
========================================================================
বৃহদারণ্যক উপনিষৎ, খ্রীষ্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকের কাছাকাছি রচনা বলে অনুমান করা হয়। সেখানে ঋষি যাজ্ঞবল্ক্য দাম্পত্য ব্যাপারে স্বামীকে পরামর্শ দিচ্ছেন: 'স্ত্রী যদি স্বামীর কামনা পূরণ করতে অস্বীকার করে তাহলে প্রথমে তাকে মধুর বাক্যে বশীভূত করবার চেষ্টা করবে। সেটা নিষ্ফল হলে তাকে 'কিনে নেবে'। (অবক্রীণীয়াৎ - অর্থাৎ আভরণ ইত্যাদি দেবার লোভ দেখাবে বা দেবে।) তাতেও যদি সে না রাজি হয় তাহলে লাঠি দিয়ে বা হাত দিয়ে মেরে স্ববশে আনবে।' (আক্ষরিক অনুবাদ। বৃহদারণ্যক উপনিষৎ ৬/৪/৭) এ হল ঋষিবাক্য, এর ভিত্তি আরও দু'শ বছর আগেকার প্রাচীন সংহিতা ও ব্রাহ্মণ সাহিত্যের বচন: ধন বা নিজ দেহের ওপরে নারীর কোনো অধিকার নেই (মৈত্রায়ণী সংহিতা ৩/৬/১; ৪/৬/৭; ৪/৭/৪; ১০/১০/১১। তৈত্তিরীয় সংহিতা ৬/৫/৮/২ ও শতপথ ব্রাহ্মণ ৪/৪/২/১৩ ইত্যাদি_ এ ধরণের শাস্ত্রবাক্যের উদ্দেশ্য বধূর যৌনজীবনের সব স্বাধীনতা হরণ করা; স্বামীই তার যৌনজীবনের নিয়ন্তা হয়ে থাকবে। ... যাজ্ঞবল্ক্য থেকে আজ পর্যন্ত এই অত্যাচার অব্যাহত আছে। নারীর এই অসহায়তার একটা হেতু তার অর্থনৈতিক পরতন্ত্রতা। আর্থিকভাবে ভরণপোষণের জন্যে স্বামী ও শ্বশুরবাড়ির ওপরে নির্ভরশীল হওয়ার ফলে নিজের শরীরের ওপরেও নারীর কর্তৃত্ব থাকে না। যেসব বিধি বিধান যৌনতার প্রকাশ, বিবাহ ও বিবাহবিচ্ছেদ নিয়ন্ত্রণ করে সেগুলির সাফল্য নারীটির আর্থিক অবস্থারই প্রতিবিম্বন। সংবিধান, তত্ত্ব ও প্রয়োগের মধ্যে বিস্তর অসামঞ্জস্য থাকে; নারীর অধিকার খণ্ডিত হতে পারে সংবিধানবহির্ভূত পক্ষপাতিত্বে। অর্থনৈতিক পরাধীনতা থেকে সার্বিক অধীনতা তাকে মেনে নিতে হয়। আর ঐ পরাধীনতার অন্তরাল থেকে বিবাহকে নিয়ন্ত্রণ করে রাষ্ট্রশক্তি, প্রাচীনকালে শাস্ত্রের মাধ্যমে, পরে আইনের দ্বারা।
========================================================================
বিবাহ নারীর জীবনের একটা অবস্থামাত্রই নয়। পুরুষের কাছে তা-ই, কিন্তু নারীর কাছে যৌবনোত্তর জীবনের লক্ষ্যই হল বিবাহ। জীবনের পথ নয়, গন্তব্যস্থল।
========================================================================
স্থিতি-প্রতিস্থিতি-সমন্বয়ের (thesis, antithesis, synthesis) যে নিয়মে সংসার আবর্তিত ও বিবর্তিত হচ্ছে ...
========================================================================
রাধা ও সরস্বতী বাদে দেবীমূর্তিগুলি সবই মাতৃমূর্তি, এ-যেন মাতৃত্ব সম্বন্ধে এই আতিশয্যেরই এক প্রকাশ। দৈনন্দিন জীবনে নারীর ঊনমানব অবস্থানের প্রায়শ্চিত্ত করবার জন্যই যেমন পূজার কদিন মাটির প্রতিমাকে মাতৃসম্বোধন করে রক্তমাংসের নারীর প্রতি সারাবছরের আচরণের পাপক্ষালন ও ক্ষতিপূরণ করা হয়, এ-ও তারই এক প্রকাশ। শুধু তাই নয়, শাস্ত্রে, পরিবারে সমাজে বরাবর শুনি, নারীর জীবন মাতৃত্বে পূর্ণতা প্রাপ্ত হয়; কখনো কেউ বলে না পুরুষ পিতৃত্বে পূর্ণ হয়। মাতৃত্বের বহু দায় আছে, পিতৃত্ব শুধুই আনন্দের; তাই এই অসম দৃষ্টি। মাতৃত্বে নারী অবশ্যই গৌরবান্বিত হয়, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে পিতৃত্বকেও সন্মান করে' দুটি অবস্থারই দায়িত্ব এবং অধিকার সমানভাবে ভাগ করে নেবার একটা লক্ষ্য থাকা উচিত। কোনো দেবতাই পিতৃত্বের জন্যে মহীয়ান নয়, কিন্তু সর্বদেশে মাতৃদেবী মহীয়সী। ঐ মহিমা বর্তায় মর্তনারীতে, এবং নারীকে কেবলমাত্র মাতৃত্বে আবদ্ধ করে রাখলে তার যৌনতা সম্পর্কে আতঙ্ক থেকে অব্যাহতি পায় পুরুষ সমাজ। তাই বেদ থেকে পুরানে বারবার নারী সম্বন্ধে কামনা ও আশীর্বাদ উচ্চারিত হয়েছে সে যেন 'অশূন্যপস্থা হয়, অর্থাৎ তার কোল যেন কখনো খালি না থাকে, ক্রমান্বয়ে সন্তানজন্ম দিয়ে যেন সে তার নারীজন্ম সার্থক করে। ...
... পুরুষতান্ত্রিক সমাজে উৎপাদন -- সে শস্যই হোক, শিল্পই হোক, সন্তানই হোক -- ঘটবে পুরুষের ইচ্ছায়। এর পিছনে রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ ও প্রবর্তন প্রচ্ছন্ন থাকে। সন্তান উৎপাদনের সফলতার ওপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখার জন্য এবং সমকালীন অর্থনীতির বিধানের কাছে এই উৎপাদনব্যবস্থা সমর্পন করবার জন্য নারীর নিজদেহের ওপরে তার (রাষ্ট্রের) নিয়ন্ত্রণ প্রসারিত করতে রাষ্ট্র বাধ্য হয়েছে। কাজেই নারী নিজদেহের ওপরে নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছে। নারীকে 'মহাভাগা পূজার্হা গৃহদীপ্তি' বলেছেন মনু কিন্তু তার ঠিক আগে এসব বিশেষণের হেতুটিও উল্লেখ করেছেন: 'প্রজনার্থা'; সন্তানের জন্ম দেয় বলেই সে মহনীয়া পূজনীয়া এবং গৃহের দীপ্তিস্বরূপিণী। (মনু ৯/২৬)
========================================================================
বিয়ের অনুষ্ঠানের মধ্যে একটা অদ্ভুত জগাখিচুড়ি আছে। কিছু কিছু বৈদিক অনুষ্ঠান -- বৈদিক যুগের শেষাংশের -- রয়ে গেছে, সঙ্গে কিছু বৈদিক মন্ত্রও। কিন্তু তার সঙ্গে এসে জুড়েছে বিস্তর লৌকিক অনুষ্ঠান, শুধু স্ত্রী-আচারে নয়, বিয়ের অপরিহার্য অঙ্গ হিসাবেও এগুলি যথেষ্ট গুরুত্ব পায়! যুগে যুগে বিকশিত হয়ে পরিবর্ধিত আকারে এখন যা দাঁড়িয়েছে তার মধ্যে আছে বরকে আসনে বসিয়ে সবস্ত্রা সালংকারা কন্যা দান করা হয়। হোম হয়, আবার বহু পরবর্তী যুগের সংযোজন শালগ্রাম শিলা বিষ্ণুর প্রতীক হয়ে সাক্ষী থাকে, অগ্নির মত। বৈদিক যুগের মত পাণিগ্রহণ ও সপ্তপদী গমন হয়। যোক্তবন্ধন অর্থাৎ বরকনের কাপড়ের শেষ প্রান্তে গিঁট বাঁধা হয়। মালাবদল অর্বাচীন কালের সংযোজন। পুরানো কতকগুলো গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠান সংক্ষিপ্ত আকারে রয়ে গেছে, যেমন অশ্বারোহন। এটি বৈদিক; বর একখণ্ড পাথর বধূর সামনে রাখলে সে তার ওপরে দাঁড়ায়, তখন বর বলে, ঐ পাথরের মত স্থির হয়ো (এহি অশ্মানমতিষ্ঠ অশ্বেব ত্বং স্থিরা ভব -- কৌশিকসূত্র ১০/৭৭)। তেমনই বহু প্রাচীনকালের রীতি অনুসারে ধ্রুবনক্ষত্র ও অরুন্ধতী দর্শনের স্মৃতিমাত্রই অবশিষ্ঠ আছে, সত্যিকার নক্ষত্রদুটিকে এখন বেশি কেউ চেনেও না। দেখেও না। কিন্তু মন্ত্রটি জরুরি, সেটি বর বলে: আকাশ ধ্রুব, পৃথিবী ধ্রুবা, এই জগৎ ধ্রুব, ধ্রুব এই পর্বতরা, এই স্ত্রী পতিকূলে ধ্রুবা (আশ্বলায়ন গৃহ্যসূত্র ১/৭/২২)। লক্ষণীয়, ধ্রুবত্ব, স্থিরত্ব শুধু বধূটির কাছেই অপেক্ষিত। সে-ই প্রতিজ্ঞা করবে আমি পতিকূলে ধ্রুবা হব, অরুন্ধতীর দ্বারা আমি অবরুদ্ধ। অর্থাৎ প্রাচীন পতিব্রতা ঋষিপত্নী আমাকে পতিকূলে স্থির থাকবার জন্যে অবরুদ্ধ করেছেন। পাণিগ্রহণের পরে বধূর শুদ্ধির জন্যে বর কিছু মন্ত্র পড়ত -- ছটি আহুতি দিত বিনা মন্ত্রে এবং বলে যেত, 'এই নারীর চোখের পাতার চুল, মাথার চুল, চরিত্র, কথা, হাসি, দেহ ও বস্ত্রের রন্ধ্র থেকে নিঃসৃত রশ্মিকণা (আরোক), দন্ত, হস্ত, পদ, ঊরু, উপস্থ, জঙ্ঘাসন্ধিতে, যা কিছু ঘোর ও অশুচি আছে তার সর্বাঙ্গে, তা শুদ্ধ হোক, আপনিই মনে আসে, পুরুষ কি স্বতই শুচি, আর যত অশুচিতা তা শুধু নারীর দেহে মনে আচরণে? তা শোধন করার দায় বা অধিকার কোথা থেকে পায় পুরুষ? আসলে তার চাই একটা শুচি কুমারী কন্যা এবং সম্ভাব্য অশুচিতার প্রতিকার করার স্পর্ধা শাস্ত্র জুগিয়েছে পুরুষকে। পুরুষের অশুচিতার সম্ভাবনা পর্যন্ত শাস্ত্রে স্বীকৃত নয়। এই বৈষম্যের ভিত্তিতেই শাস্ত্রে নিষ্পন্ন হয় বিবাহ এবং অনুষ্ঠানের পদে পদে এই বৈষম্য প্রকট হয়ে ওঠে। কন্যার পিতা ভাবী জামাতাকে আসন দিয়ে অভ্যর্থনা করে বলেন 'আপনাকে অর্চনা করছি' [অর্চয়িষ্যামো ভবন্তম্] এবং জামাতা অনুমতি দেয় 'হ্যাঁ, অর্চনা করুন' [ওম্ অৰ্চয়]। সম্প্রদানের মধ্যেও কন্যা ব্যক্তি থেকে বস্তু হয়ে ওঠে: যে বস্তুর তৎকালীন মালিক পিতা ভাবী জামাতার কাছে কন্যারূপ বস্তুটিকে দান করেন। সবস্ত্রা, সালংকারা এবং পণযৌতুক সহ। এর মধ্যেও প্রচ্ছন্ন থাকে বধূটির সামাজিক সত্তার অবমাননা, তাকে বস্তু রূপে হস্তান্তরিত হয়। বিয়ের প্রায় প্রতি পর্বে এই ধরনের অবমাননা অন্তর্নিহিত ছিল। একটিমাত্র মন্ত্রে কন্যার দীর্ঘ আয়ু কামনা করে বলা হয়েছে, তুমি সম্পদ্ ধারণ কোরো। বলাবাহুল্য, এ সম্পদ তার পতিকূলেরই, কোনো সম্পত্তিতে কন্যার তো স্বতন্ত্র কোনো অধিকার ছিল না। একটি অনুষ্ঠানে কন্যা মাদুরে পা রাখবে, তখন উচ্চারিত হবে 'পতি দেবতা' এবং 'পতিযান কামনীয়' অর্থাৎ কন্যা কামনা করছে যেন সে পতিলোকে যেতে পারে। যেটা লক্ষণীয়, তা হল শাস্ত্রে অন্য দুটি যান আছে 'দেবযান' ও 'পিতৃযাণ' অর্থাৎ দেবলোক থেকে মোক্ষ ও পিতৃলোক থেকে পুনর্জন্মের পথ। দেবতা ও পিতৃগণের মত উচ্চ আসন সৃষ্টি হল পতির এবং পত্নীর কামনা হল: যেন সে পতিলোকে ঠাঁই পায়। লাজহোম (আগুনে খই দিয়ে হোম) অনুষ্ঠানে পতির দীর্ঘায়ু, শতবর্ষ পরমায়ু কামনা করে বধূ, আর বলে, তার শ্বশুরবাড়ির সকলের যেন শ্রীবৃদ্ধি হয়। [দীর্ঘায়ুরস্তু মে পতিঃ শতং বর্ষাণি জীবত্বেধন্তাং জ্ঞাতয়ো মম] সপ্তপদীগমনের মন্ত্রগুলিতে উভয়ের মিলিত জীবনের শ্রীবৃদ্ধির কামনা আছে। পাণিগ্রহণের মন্ত্রে বর বধূকে বলে: 'আমার ব্রতে তুমি তোমার হৃদয় ধারণ কর, তোমার চিত্ত আমার চিত্তের অনুগামী হোক। বৃহস্পতি তোমাকে আমার জন্য নিযুক্ত করুন।' [... - মানব গৃহ্যসূত্র ১/১০/১৩] লক্ষণীয়, বধূটিরও যে চিত্ত আছে, আগামী বিবাহিত জীবন সম্বন্ধে যে তারও কিছু স্বপ্ন, কিছু কামনা থাকতে পারে সে বিষয়ে শাস্ত্র ও সমাজ সম্পূর্ণ উদাসীন। এক সময়ে বর বধূ সম্বন্ধে প্রার্থনা করে, এর যে পতিঘাতিকা তনু তাকে ধ্বংস কর, এর যে পুত্রহীনা তনু, পশুহীনা তনু তা দূর হোক।' [...]
এই অনুষ্ঠান ও মন্ত্রগুলির মধ্যে নারীর, বিশেষত বধূর সম্বন্ধে যে মনোভাব বিবৃত আছে তা হল: প্রথমত প্রকৃতির সৃষ্টি যে নারী যে স্বভাবত অশুচি, অকল্যানী, পুরুষপরতন্ত্র, হীন এবং কতকটা যেন ঊনমানব। বিয়ের অনুষ্ঠানের ও মন্ত্রের মধ্যে দিয়ে তার শুচিতা সম্পাদন করে' বর তাকে নিজের, পরিবারের ও সমাজের জীবনে গ্রহনযোগ্য করে তোলে। নইলে সে সংসার ও সমাজে অকল্যাণ আনবে; স্বামীকে হত্যা করবে, পুত্রদের হারাবে ও পশুর বিনাশের কারণ হবে। দ্বিতীয়ত, তার স্বতন্ত্র চিত্ত বলে কিছুই নেই বা থাকলেও না থাকাই বাঞ্চনীয়, তার সে স্বতন্ত্র চিত্তের অবনমন ঘটিয়ে সম্পূর্ণ স্বামীর চিত্তের অনুগামী, স্বামীর ব্রতের অনুব্রতা হওয়াই তার চূড়ান্ত কর্তব্য। তৃতীয়ত, স্বামী এবং শ্বশুরবাড়ির কল্যাণসাধনে সে আত্মনিয়োগ করবে। এতে দোষের কিছু থাকত না যদি তার আপন বাপের বাড়ির প্রতি কোনো কর্তব্য করবার কোনো সুযোগ বা অধিকার তাকে দেওয়া হত, অথবা তার স্বামীও তার শ্বশুরবাড়ি, অর্থাৎ বধূটির বাপের বাড়ির সম্বন্ধে কোনো কর্তব্য সাধনের কোনো দায়িত্ব বোধ করত। বিবাহ অনুষ্ঠানে বধূর গোত্রান্তর এমনই আমূল এবং সর্বাত্মক, এমনই আত্যন্তিক যে তার পূর্বসত্তার প্রায় পূর্ণ বিলোপ ঘটিয়ে তাকে -- শুধু তাকেই -- তার শ্বশুরবাড়ির সঙ্গে একাত্ম হতে হত। চতুর্থত, স্বামীর জীবনে সে ধ্রুবা হবে। যেমন ধ্রুবা অরুন্ধতী, পাথরের ওপরে দাঁড়িয়ে, বধূ প্রতিজ্ঞা করবে স্বামীর জীবনে এবং শ্বশুরকুলে সে থাকবে পাথরের মত স্থির অটল। লক্ষণীয়, অনুরূপ কোনো প্রত্যাশা বরের সম্বন্ধে কোনো অনুষ্ঠানেই উচ্চারিত হয়নি। [এ পর্যন্ত বিয়ের যে মন্ত্র ও অনুষ্ঠানগুলির উদ্ধৃতি দেওয়া হল সেগুলি দশকর্মের জন্য নির্দিষ্ট বাঙালির, ধর্মজীবনে সুপ্রচলিত 'পুরোহিতদর্পন' গ্রন্থ থেকে উৎকলিত। ঈষৎ পরিবর্তিত ক্রম ও আকারে এগুলিই ভারতীয় হিন্দু বিবাহের বিভিন্ন পর্যায়ে ও অনুষ্ঠানে আচরিত হয়।]
.... নারীর এই হীনতার বোধ যেহেতু সমাজে বহুকাল ধরে পরিব্যাপ্ত সেইজন্যেই বিবাহের অনুষ্ঠানে ও মন্ত্রে এই প্রতিফলন। অতএব দুটি অসম মানুষের মধ্যে বিবাহ অনুষ্ঠিত হয়: উৎকর্ষ পুরুষের, ন্যূনতা নারীর। দাম্পত্যেও এর দীর্ঘ ছায়া পড়ে। লোকাচারেও এরই প্রতিবিম্ব। বিয়ে করতে যাবার আগে বর ও তার মায়ের মধ্যে একটি সংলাপ প্রচলিত। বরসাজে সজ্জিত, যাত্রায় উদ্যত ছেলেকে মায়ের প্রশ্ন: 'কোথায় যাচ্ছ বাবা?' বর: 'মা, তোমার দাসী আনতে যাচ্ছি।' তিনবার এই নাট্যাংশ অভিনীত হয়। শুধু যে বর, তার মা ও বাড়ির লোকেরা এটা বিশ্বাস করে তা-ই নয়, বধূ ও তার বাড়ির লোকেরাও এটা বিশ্বাস করে অর্থাৎ বধূটি যে শ্বশুরবাড়ির দাসী এবিশ্বাস বিবাহ অনুষ্ঠানের একটি দৃঢ়ভিত্তি। আগেই বলেছি, অন্নবস্ত্রের জন্যে বধূ স্বামীর ওপরে নির্ভরশীল তাই দাসী-ভৃত্যের মতই সে ভরণীয়া ভার্যা, তাকে খাওয়াতে হবে। [মধ্যযুগ পর্যন্ত ইংল্যাণ্ডে স্ত্রী স্বামীকে 'লর্ড' বলে সম্বোধন করত, এবং ভৃত্যও প্রভুকে ঐ সম্বোধনই করত। এই 'লর্ড' শব্দটির বুৎপত্তি হল, half-ward; half অর্থাৎ loaf বা রুটির জন্যে যে নির্ভরশীল। স্ত্রী এবং ভৃত্য ও ব্যাপারে একই পর্যায়ে পড়ে। সংস্কৃতেও 'ভৃত্য' শব্দ নিষ্পন্ন 'ভৃ' ধাতুর উত্তরে 'ক্যপ' প্রত্যয় দিয়ে, 'ভার্যা' হয় ভৃধাতুতে 'ন্যৎ' প্রত্যয় দিয়ে। অর্থ একই, ভরণীয়]
বধূটির কন্যা অবস্থায় এই অন্নঋণ ছিল পিতার কাছে, ঋণী ব্যক্তি বন্ধকরাখা বস্তুর মতই স্বাধীন নয়; তাকে দান করা যায় না। তাই বিয়ের আগে বাপের সঙ্গে মেয়েকে কনকাঞ্জলি নামে একটি নির্মম নাট্যাংশ অভিনয় করতে হয়। একমুঠো ধুলো বাপের হাতে দিয়ে মেয়ে বলে: 'সোনামুঠি নিয়েছিলাম, ধুলোমুঠি দিয়ে শোধ করলাম।' এ অনুষ্ঠান রূপকাশ্রিত, কারণ পিতার কাছে কন্যা ঋণমুক্ত না হলে তাকে সম্প্রদান করা যাবে না, তাই পিতৃকুলের ঋণ সে প্রতীকী ভাবে শোধ করে এমন মর্মান্তিক উচ্চারণে। এর মধ্যে নিহিত থাকে পিতৃকুল সম্বন্ধে তার সব দায়িত্বের অস্বীকৃতি। তিনদিন অশৌচ মেনে, চতুর্থীশ্রাদ্ধ করেই পাত্রান্তরিত বধূটি মৃত পিতা বা মাতার সম্বন্ধে সব কর্তব্য সমাধা করে।
========================================================================
বিবাহ মানে এখন আমরা বুঝি ঐক্যদাম্পত্য (monogamy) এক স্বামী, এক স্ত্রী। কিন্তু বহুপতিকতা আঞ্চলিকভাবে এখনো আছে, প্রাচীন কালেও ছিল। আর বহুপত্নীকতা তো সেদিন অবধি বেশ জমাট ভাবেই ছিল, আইন করে বন্ধ করা হল। প্রাচীনকালে বিত্তবান ব্যক্তির বিজ্ঞাপন ছিল পশুসম্পদ আর পত্নীসংখ্যা। শাস্ত্রে যখন বলে, সেই ব্যক্তিই ভাগ্যবান যার পশুর সংখ্যা তার স্ত্রীর সংখ্যার চেয়ে বেশী। [সমৃদ্ধং যস্য কনীয়াংসো ভার্যা আসন ভূয়াংসঃ পশবঃ --- শতপথব্রাহ্মণ ২/৩/২/৮] তখন সহজেই বোঝা যায় স্ত্রীর সংখ্যা কত ছিল। সাম্প্রদায়িকতার ঝাঁঝে আজ বলা হয়ে থাকে মুসলমানের দুর্নীতির একটা প্রমান হল, সে চারটে বিয়ে করতে পারবে, যদিও বাস্তব অভিজ্ঞতায় দেখি, খুব কম মুসলমানই চারটি স্ত্রীর স্বামী। এই সাম্প্রদায়িকতা-দুষ্ট উক্তি শুনল প্রথমেই মনে হয়: আর কুলীন ব্রাহ্মণের তো চার স্ত্রীতে কুলোতই না। বাঁধানো খাতা তল্পিবাহকের হাতে দিয়ে ঠিকানা খুঁজে খুঁজে ভিন্ন ভিন্ন স্ত্রীর বাড়িতে একরাত্রির অতিথি হয়ে শ্বশুরবাড়ির আতিথ্য, স্ত্রী-সম্ভোগ এবং যথাসম্ভব দক্ষিণা আদায় করে পরবর্তী স্ত্রীর ঠিকানা খুঁজে সেখানে হাজির হওয়া -- এই ছিল কুলীন ব্রাহ্মণের জীবিকা। এ সমাজের মানুষের মুসলমানের বহুপত্নীকতা নিয়ে বক্রোক্তি করবার কোনো অধিকার নেই। আইনের বলে এবং আর্থিক কারণে ঐক্যদাম্পত্যই এখন সমাজে বিবাহের একমাত্র রূপ।
গোষ্ঠী ও কৌম ভেঙে এল 'কুল' অর্থাৎ বৃহৎ যৌথ পরিবার, যেখানে একটি বিস্তৃত গৃহে বেশ কয়েক পুরুষ একত্র বাস করত, মনে হয় তখনই ঐক্যবিবাহ প্রবর্তিত হয়। তার বহু আগে বহু পুরুষ ও বহু নারী একত্র বাস করত, দাম্পত্য ছিল ক্ষণস্থায়ী সকল পুরুষেরই অধিকার ছিল কৌমের সকল নারীতে। পিতৃপরিচয় নিয়ে কোনো মাথাব্যথা ছিল না; এমনকি প্রাচীন প্রাগৈতিহাসিক যুগে যৌনমিলনের সঙ্গে সন্তান-জন্মের বৈজ্ঞানিক সম্পর্কটাই জানা ছিল না। এরই একটা রেশ থেকে গেছে মাতৃ-ধারায় প্রবাহিত পরিবারের গঠনতন্ত্রে, যেখানে সন্তান মাতৃপরিচয়ে অভিহিত হত, যেমন মহাভারতের যুগেও দেখি কৌন্তেয়, মাদ্রেয়, গাঙ্গেয়, রাধেয় ইত্যাদির মধ্যে। মানুষ যখন সন্তান-উৎপত্তির বৈজ্ঞানিক কারণটা জানত না তখন যেটা চোখে দেখতে পেত সেটা হল মায়ের গর্ভ থেকেই সন্তান আসে। কাজেই পিতৃপরিচয় তখন ছিল অনুমানসাপেক্ষ, মাতৃপরিচয় একেবারেই স্পষ্ট, তাই মাতার পরিচয়ে পুত্রের অভিহিত হওয়া খুবই স্বাভাবিক ছিল। তার অনেক পরে, সমাজে ব্যক্তিগত সম্পত্তি দেখা দিল, মুষ্টিমেয় কিছু মানুষের হাতে কৃষিবাণিজ্যজাত সম্পত্তি সঞ্চিত হতে লাগল। তখন সম্পত্তিমান পিতার পরিচয়ে পুত্রের পক্ষে অন্য একটি তাৎপর্য বহন করতে শুরু করল।
ঐতিহাসিকভাবে আদিম সমাজে নারী-পুরুষ সম্পর্ক ছিল যৌথ: একটি প্রজন্মের সব নারী ও পুরুষেরই অধিকার ছিল সেই প্রজন্মের সব নারীর ও পুরুষের সঙ্গে যৌন সম্পর্কে সম্পৃক্ত হবার। পরের ধাপে বাদ যায় ভাই বোনের যৌন মিলন। [সম্ভবত ঋগ্বেদের যম-যমী সংলাপের মধ্যে এই নিষেধের একটি ইঙ্গিত বিধৃত আছে -- ঋগ্বেদ ১০/১০] তার পরে, অনেক পরে এল ঐক্যদাম্পত্য; অন্য স্তরগুলির মত এই স্তরেও সম্পর্কের নির্ণায়ক ছিল অর্থনীতি। সাধারণ যৌথ গোষ্ঠী কৌমের সমবেত পশুধনে গোষ্ঠী এবং/বা কৌমের সাধারণ অধিকারের স্তরে এক প্রজন্মের নারী পুরুষের সাধারণ সম্পর্কে ছিল। পরে ভ্রাতা ভগিনীর যৌন সম্পর্ক নিষিদ্ধ হয়। তারপরে যখন ব্যক্তিগত সম্পত্তি দেখা দিল সমাজে, তখন ধীরে ধীরে 'কুল' ভেঙে ঐক্যদাম্পত্য দেখা দেয়। এক স্বামী ও এক বা বহু স্ত্রীর সংসার। এর পেছনে ক্রীতদাস বা দাসদের ভূমিকাও সক্রিয়। শ্রমসাধ্য কাজের ভার নারীর বদলে এসে পড়ল দাসের ওপরে। এতে নারী উৎপাদন ব্যবস্থা থেকে সরে এসে পরিবারে ক্রীতদাসীর ভূমিকা নিতে বাধ্য হল। মিল্ বলেন 'কোনো ক্রীতদাসই ততদূর পর্যন্ত এবং সম্পূর্ণভাবে ঠিক সেই ভাবে ক্রীতদাস নয় যেমনটা স্ত্রী'। অন্যত্রও এমন কথা পাই; একশো বছরেরও বেশি আগে এঙ্গেলস বলেছিলেন 'সমবেত উৎপাদন ব্যবস্থায় অংশগ্রহণ করা থেকে বিতাড়িত হয়ে স্ত্রী প্রথমে গৃহদাসীতে পরিণত হল। গার্হস্থ্য প্রকাশ্যে বা ছদ্মভাবে নারীকে দাসীতে পরিণত করার ওপরেই বর্তমান ক্ষুদ্র পরিবার প্রতিষ্ঠিত'।
ব্যক্তিগত সম্পত্তির আবির্ভাবের পরে সমাজে যে সব গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন ঘটতে লাগল তার মধ্যে একটা হল যে, সম্পত্তিমানের নতুন একটা শিরঃপীড়া দেখা দিল; তার সঞ্চিত সম্পত্তি সে তার বৈধ উত্তরাধিকারীর জন্যে রেখে যাবে। বৈধ মানে ঔরস পুত্র। অবস্থার বিপাকে অন্য নানারকম পুত্রও সম্পত্তিতে কমবেশী অধিকার অবশ্য পেত। [মহাভারত ১/১১১/২৮-২৯] দেখি পুত্র নানারকম হতে পারে: প্রধানত শুনি ঔরস, পিতার বীর্যে মাতার গর্ভে জাত। 'কানীন', কন্যাটির প্রাকবিবাহ জীবনের সন্তান, যেমন কর্ণ। 'সহোঢ়', যে সন্তানকে গর্ভে নিয়ে কন্যার বিবাহ হল। 'গৃঢ়োৎপন্ন' বিবাহের পরে গোপনে অন্যপুরুষের দ্বারা সঞ্জাত সন্তান। 'পুত্রিকাপুত্র' অপুত্রক পিতা এই শর্তে কন্যার বিবাহ দিতেন যে প্রথম পুত্রটিকে কন্যার পিতা আপন পুত্র বলে গ্রহণ করবেন। 'ক্রীত', অর্থ দিয়ে অন্যের যে সন্তানকে ক্রয় করা হয়েছে। 'দত্তক', অন্যের সন্তানকে তার অনুমতিক্রমে আপন সন্তানের পরিচয়ে তার স্থলাভিষিক্ত করা। 'স্বয়মুপাগত' যে বালক নিজেকে অন্যের কাছে বিক্রয় করে। 'পৌনর্ভব' হল নিয়োগের দ্বারা জাত বিধবার বা নিষ্প্রজ স্বামীর স্ত্রীর সন্তান -- এত রকমের সন্তানকে সমাজ স্বীকার করেছিল কারণ সমাজ চাক বা না চাক, এ সব সন্তান ছিল।
========================================================================
দাম্পত্য জীবন যদি যৌথ পরিবারে কাটাতে হয় তাহলে পরিবারে দৈনন্দিন জীবনের খুঁটিনাটি ও শ্বশুরবাড়ির লোকেদের মন্তব্য নিয়ে অশান্তি দাম্পত্য সুখশান্তি নষ্ট করে। যদি শ্বশুরবাড়িতে বধূটি মানবিক ব্যবহার পায়, তাহলে, দম্পতিটির পরস্পরের মধ্যে সম্পর্ক ভাল থাকলে, শান্তি থাকে। কিন্তু প্রতিবেশীদের প্রতিক্রিয়া বিরূপ হলে তার প্রভাবও দম্পতির জীবনে প্রতিঘাত সৃষ্টি করে। প্রতিবেশীদের মারফতে সামাজিক প্রতিক্রিয়াও এসে পৌঁছয় এবং তার প্রতিকূল হলে শান্তি নষ্ট হয়। প্রতিবেশীরা সমাজের প্রতীক, যে সমাজ অদৃশ্য থেকে অন্তরাল থেকে নিয়ন্ত্রণ করছে রাষ্ট্র। রাষ্ট্র বিত্তকৌলীন্য, পুরুষতন্ত্র, বর্ণবৈষম্যের মূল্য বোধে নির্মিত; এবং এইসব যেন কায়েম থাকে সে ব্যবস্থা নেপথ্য থেকে আইন, সাহিত্য, গণমাধ্যম সব দিয়েই প্রতিষ্ঠা করে।
========================================================================
সমস্যার মৌলিক উৎপত্তিস্থল দম্পতির একান্ত ব্যক্তিগত মানসিক সম্পর্কে। দুজনের শিক্ষাদীক্ষার মান -- প্রাতিষ্ঠানিক নয় -- যথার্থ শিক্ষার মানে যদি দুস্তর ব্যবধান থাকে তবে তা মানসিক সাহচর্যের পথে অন্তরায় হতে পারে। তেমনি অথবা হয়ত তার চেয়েও বেশি দুরতিক্রম্য হল রুচির ব্যবধান। ... কার্পণ্য ও উদারতার সংঘাত খুবই মর্মান্তিক। ... এছাড়াও আছে আদর্শগত ব্যবধান। একজন হয়ত কোনো রাজনৈতিক আদর্শে বিশ্বাসী, অন্যজন তার বিপরীত পন্থার অনুগামী, কিংবা দেশ বা সমাজে কল্যাণ সম্পর্কে সম্পূর্ণ উদাসীন। এ অবস্থার একের ঔদাসীন্য অপরকে তার সত্তার খুব গভীর স্তরেই আঘাত করে, কিংবা দুই বিরুদ্ধ রাজনৈতিক মতবাদের সংঘাত দুজনকেই করে। এ ধরনের বৈষম্য উপেক্ষণীয় নয়, বিশেষত যদি দুজনের বা একজনেরও আদর্শে বিশ্বস্ত আন্তরিক হয় তার জীবনের তাৎপর্যবোধের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গী হয়ে জড়িয়ে থাকে। এগুলো বেশিরভাগই ঘটে সম্বন্ধ করা বিয়েতে। ...
বেশ বেশি সংখ্যায় বিয়ে ভাঙে আর্থিক কারণে। অভাবে। অথবা প্রত্যাশিত সচ্ছলতার অভাবে। আজকের দিনে আয় সে অনুপাতে বাড়ছে না এবং সন্তানসন্ততি এলে প্রত্যাশিত ভাবে পারিবারিক ব্যয়ভার দুর্বহ বোধ হচ্ছে, তখন দেখা দেয় পরস্পরকে দোষ দেওয়ার প্রবণতা। প্রথমে আয় বাড়াবার চেষ্টা, তা ব্যর্থ হলে ব্যয়সংকোচের প্রয়াস এবং বর্তমান পৃথিবীতে যেহেতু সমস্ত গণমাধ্যমই ব্যয়সংকোচের পথটা বাৎলে চলেছে, তাই অচিরেই দুপক্ষই যেন দেখতে পায় ব্যয়সংকোচের পথটা একটা কানাগলিতে গিয়ে ঠেকেছে। এর ওপরে আছে, প্রতিবেশী ও পরিচিত পরিবারগুলির জীবনযাত্রার মানের সঙ্গে, চেতনে অথবা অবচেতনে, নিজেদের অবস্থার একটা তুলনার প্রয়াস যা প্রায়শই নিজেদের জীবনযাত্রার মান, অত্যন্ত উচ্চবিত্ত বাদে আর সকলের ক্ষেত্রেই যে ক্রমাগতই নেমে যাবে এই বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক প্রক্রিয়াটিকে স্বরূপে বোঝবার মত মুক্ত দৃষ্টি বেশিজনের থাকে না। ... আদর্শগত কোনো স্থৈর্য বা স্বল্পে সন্তুষ্ট হবার সহজাত, বা সাধনায় আয়ত্ত-করা ক্ষমতা যার নেই, এই পরিবেশে তার মর্মপীড়া বাড়বেই।
========================================================================
উচ্চবিত্ত মধ্যবিত্ত সমাজে নারী সম্পদ উৎপাদন ব্যবস্থার শ্রম থেকে অব্যাহতি পেয়েছে। এখন তার ওপর বর্তেছে সম্পদের উত্তরাধিকারী ভোক্তা উৎপাদন করার দায়িত্বটি।
========================================================================
১৭৯২ সালে মেরি হ্বলস্টনক্রাফট লিখেছিলেন 'আমি বিশ্বাস করি যে, পুরুষের একচ্ছত্র অধিকারের দাপট থেকেই নারীর স্বভাবে বহু ভ্রমপ্রমাদ জন্ম নেয়। ... স্বাধীনতা পেলে তার চরিত্র অনেক বেশি পরিপূর্ণতা পাবে।' এ অবজ্ঞা নানা প্রসঙ্গে বিয়ে করে, এবং দুঃখের বিষয়, নারী নিজেও এই বোধবিশ্বাসের পরিবেশেই লালিত হয়। বারেবারে শোনা যায় তাচ্ছিল্যের সঙ্গে উচ্চারিত 'মেয়েমানুষ' এবং গর্ব ও দম্ভের সঙ্গে উচ্চারিত 'পুরুষ'। ... কাজেই শুধুমাত্র অর্থনৈতিক স্বাতন্ত্র্য নারীকে এই বোধ দিতে পারছে না যে সে সংসারে পুরুষের সমকক্ষ। এর জন্যে চাই চেতনার মুক্তি। ... মহাভারতের বনপর্বে দ্রৌপদী সত্যভামাকে বলেছিলেন যে প্রত্যূষে উঠেই সারাদিন তিনি অবিশ্রাম গৃহকর্ম করে চলেন; তাঁর মধ্যরাতের বিশ্রাম পর্যন্ত দায়িত্বের যে ফিরিস্তি তিনি দেন, তার সঙ্গে মেলে তাবৎ ধর্মশাস্ত্রে গৃহিণীর দিনচর্যার নির্দেশ। এমন কথাও আছে যে নারী সর্বদাই গৃহকর্মে ব্যাপৃত থাকলে সে অন্যায়কর্ম থেকে নিরস্ত থাকে। তবে এমন ফিরিস্তি বাইবেলের ওল্ড টেস্টামেন্টে ও ইসমালিক শাস্ত্রেও ঠিক একই রকমের। এর মুলে সব প্রাচীন সমাজেই বিশ্বাস ছিল, যে নিরন্তন কাজের মধ্যে না থাকলে নারী দুশ্চরিত্র হয়ে যাবে, তাকে সে সুযোগ না দেওয়া তার চরিত্র-রক্ষারই একটা উপায়। কিন্তু দাম্পত্যে কাজের ভারের এই অসম বন্টন নারীকে শরীরে মনে পীড়িত করে এবং এর ফলে যে অশান্তির সৃষ্টি হয় তার কোনো প্রতিকার থেকে না। আরও ক্ষতি হয়: পুত্রকন্যারা বুঝে যায় গৃহকর্ম নারীরই এলাকা, অর্থাৎ ঐ অসাম্যের বিষয়টা সঞ্চারিত হয় পরবর্তী প্রজন্মেও।
========================================================================
একটা বিকল্প হচ্ছে, শিশুটি যাতে বেড়ে ওঠার পথে মোটামুটি অনুকূল একটা পরিবেশ পায় তার ব্যবস্থা করে দুজনের বিচ্ছিন্ন হওয়া। এখানে অন্য একটি প্রশ্নও থাকে ঐ দুটি নরনারী প্রথম বিবাহে সুখ পায়নি, যে কোনো কারণেই হোক বিয়েটা ভেতর থেকে যখন ভেঙে গেছে তখন কৃত্ৰিম অভিনয়ে সেটাকে টিকিয়ে রাখার চেষ্টা না করে সরাসরি প্রকাশ্যে ভেঙে দেওয়া এবং দুজনে সম্ভব হলে অন্য সঙ্গী বেছে নিয়ে দ্বিতীয়বার সুখ পাবার চেষ্টা করা। এখনো সমাজ একে ঐ দুটি মানুষের স্বার্থপরতার প্রমাণ হিসেবেই দেখে। সে দেখাটা ভুল। যখন বিধবাবিবাহ আন্দোলন হয় তখন তাঁর মূল মানবিক প্রেরণার উত্স কী ছিল? একটি নিরপরাধ নারীর জীবন যাতে পুনর্বার সুখের সন্ধান পায় তা-ই ত? সে নারীর বয়স চোদ্দ না চব্বিশ না চল্লিশ তা তো আলোচ্য ছিল না। সে সন্তানবতী না নিঃসন্তান তা-ও ত ভাবা হয়নি? তার জীবনটা যেন অকালে শুকিয়ে না যায় সে যেন দাম্পত্যসুখের সন্ধান পায় এই ছিল সে আন্দোলনের মূল প্রেরণা। অপরপক্ষে, কোনো বিপত্নীকের দ্বিতীয়বার বিবাহ করা নিয়ে সমাজ কখনোই কোনো মন্তব্য করেনি; বরং একথা বলেছে, স্ত্রীর মৃত্যুর পরদিনই তার কথা প্রশস্ত এবং বিধেয়। লোকে পোষা কুকুর বেড়ালের মৃত্যুতেও কয়েকদিন মুষড়ে থাকে, এ সমাজে স্ত্রীর স্থান গৃহপালিত জন্তুরও নীচে! কাজেই একবার নির্বাচনে ভুল হলে পুনর্বার নির্বাচন করার অধিকার থাকাই উচিত, প্রথমত এখনো অধিকাংশ ক্ষেত্রে প্রথমবার সঙ্গীকে নির্বাচন করে দেয় পরিবার, সেখানে পাত্র পাত্রীর, বিশেষত কন্যার মত প্রায় উপেক্ষিত। ফলে অন্তত মেয়েদের জন্যে ঐ দ্বিতীয়বার সুখের সন্ধান করার পথটা খোলা রাখা বিশেষ প্রয়োজন। মেয়েদের জন্যে বিশেষ করে বলছি এই কারণে যে, পুরুষের পক্ষে সে পথ বরাবরই খোলা থেকেছে। বিধিমতে বিবাহিত স্ত্রী সীতাকে রামচন্দ্র বলেছিলেন 'তোমাকে আমার আর প্রয়োজন নেই, তুমি যাও'। এখনো বাড়িবাড়ি বহু মেয়ে বাসন মাজতে আসে কারণ 'স্বামী নেয়না'। স্বামী না নেবার অধিকারটি পেয়েছে আমাদের 'মর্যাদা পুরুষোত্তম' রামের কাছেই। কারণ বলাই আছে, রামের মত আচরণ করবে, রাবণের মত নয়। [রামাদিবৎ প্রবর্তিতব্যং ন রাবণাদিবৎ] কাজেই স্বামীরা নিরপরাধ স্ত্রীকে মিথ্যে সন্দেহে ত্যাগ করার পরোয়ানা পেয়েছে খোদ রামচন্দ্রের কাছে; এবং অন্তত এব্যাপারে অসংখ্য পুরুষ রামের মতই আচরণ করে। এই পরিত্যক্তা স্ত্রীর দ্বিতীয়বার নতুন জীবনে সুখী হবার মৌলিক অধিকার আছে। বিশেষত, পুরুষ যেখানে হামেশা এক বউ ছেড়ে আবার বিয়ে কিংবা বিয়ে না করেই সংসার পাতে।
প্রায়ই প্রশ্ন ওঠে, বিয়ে ভেঙে যদি দ্বিতীয় সংসারেও সুখ না আসে তাহলে তৃতীয়, চতুর্থ, পঞ্চম এইভাবেই কি চলবে? এর উত্তরে বলা যায় আইন যখন বিচ্ছেদের পরে পুনর্বার বিয়ের অধিকার দিয়েছে এবং ক'বার বিয়ে করা চলবে তার কোন সংখ্যা নির্দেশ করেনি, তখনই তো বারেবারে সুখের সন্ধান করার অধিকার কায়েম হয়েছে। মুশকিল হল, এমন বহু নজির আছে যেখানে দ্বিতীয়, তৃতীয় বা চতুরবারে সঙ্গী নির্বাচনটি পাকাপাকি সুখের সন্ধান দিয়েছে এবং তার পরের যুগ্মজীবন তিরিশ চল্লিশ বছর অব্যাহত সুখে কেটেছে। এই নির্বাচনের মূল অধিকারটি সংখ্যাসীমা দিয়ে বাঁধতে গেলে এটা সম্ভব হত না। কেউ কেউ বলেন, আরও অনেক নজির আছে যারা বারেবারে পরীক্ষা নিরীক্ষা করেও কোথাও স্থিতিলাভ করেনি। তেমন অনেক নারী বহু পরীক্ষা নিরীক্ষায় ক্লান্ত হয়ে শেষ জীবনে কখনো বিষণ্ণ, কখনো প্রসন্ন মনে একক জীবনকেই মেনে নিয়েছে। এদের সমাজের বিরুদ্ধে কোনো নালিশ নেই, কারণ নিজের জীবন নিজের মত পরিচালনা করার স্বাধীনতা এরা সমাজের কাছে পেয়েছিল। সে পরিচালনায় সুখ হয়ত আসেনি, কিন্তু ঐ স্বাধীনতাটা ছিল তার মৌলিক অধিকার।
========================================================================
... ইদানীং বহু সংসারে দাম্পত্য কলহ বাড়ছে, সেটা হল সংসারে গৃহকর্ম একা মেয়েটিকেই সামলাতে হয়। উচ্চবিত্ত পরিবারের পক্ষে অত্যধিক পারিশ্রমিক দিয়ে লোক নিযুক্ত করে এবং গৃহকর্ম নির্বাহ করা সম্ভব। নিম্নবিত্ত পরিবারে ধরে নেওয়াই হয় যে বাইরে কাজ করলেও আর্থিক অসঙ্গতির জন্যে গৃহকর্মে বাইরের লোকের সাহায্য পাওয়া সম্ভব নয়; তাই সমস্ত চাপই বধূটির এবং একটু বড় ছেলেমেয়ের ওপরে পড়ে। ইদানীং বাড়িতে কাজের লোক পাওয়া প্রায় অসম্ভব। মধ্যবিত্ত যে টাকা দিতে পারে তাতে তো বটেই। অথচ মধ্যবিত্ত মানসিকতা ভৃত্যনির্ভর, কাজেই এখন বাইরে চাকরি করে যে বধূটি সে জানে বাড়ি ফিরে অধিকাংশ গৃহকর্ম তাকেই সমাধা করতে হবে। ... যত্রতত্র ভুল ইংরিজি বলে, বুঝে না বুঝে ইংরিজি ছবি দেখে, 'মামি ড্যাডি'র বকুনিতে বিগলিত যে অপসংস্কৃতিতে পুষ্ট আজকের মধ্যবিত্ত মানস, তার মধ্যে পাশ্চাত্য প্রভাবের সুস্থ দিকগুলি এখনো পৌঁছল না।
========================================================================
বিবাহ যদিও দুটি মানুষের ব্যক্তিগত সম্পর্ক, তবুও রাষ্ট্রও এতে সক্রিয় ভূমিকা নেয়। বিবাহ হল পরিবার সৃষ্টির সুস্পষ্ট উদ্দেশ্যে নারী ও পুরুষের মধ্যে একটি সংবিধান-সম্মত মিলন। এই কারণেই রাষ্ট্র এই মিলনে উৎসাহী এবং এটিকে নিয়ন্ত্রণ করার কর্তব্য নিজে স্বীকার করে নেয়। .... বিবাহ অর্থাৎ রাষ্ট্রসমর্থিত নারীপুরুষের মিলন থেকে সন্তান এলে একটি পরিবারের সূচনা হয়, যা ধীরে ধীরে পল্লবিত হয়ে বৃদ্ধিলাভ করে। অর্থনৈতিক, রাষ্ট্রনৈতিক ও সামাজিক একক সেই পরিবার; কাজেই তা যেন সমাজের নির্দিষ্ট ছকের মধ্যে প্রবর্তিত হয় সে স্বার্থ সমাজ তথা রাষ্ট্রেরই। বিবাহ রাষ্ট্রের পক্ষে প্রয়োজনীয়।
========================================================================
ফরাসী বিপ্লবের পরে যে সংবিধান রচিত হয় তার সম্বন্ধে এমন কথাও বলা হয়েছে যে সংবিধান কিছু ব্যক্তিকে অন্যদের চেয়ে বেশি অধিকার দিয়েছে, কিন্তু নারীকে কিছুই দেয়নি। .... এই ধরণের বৈষম্য পৃথিবীর সকল দেশে বহু জগ ধরে চলিত আছে অথচ রাষ্ট্র-সঙ্ঘের সমীক্ষা বলে 'পৃথিবীর জনসংখ্যার অর্ধেক নারী, এরা পৃথিবীর মোট শ্রম-প্রহরের দুই তৃতীয়াংশ পরিশ্রম সে-ই করে থাকে, পৃথিবীর উপার্জনের এক দশমাংশ ভোগ করে এবং পৃথিবীর সম্পত্তির এক শতাংশেরও কমের অধিকারিণী।'
========================================================================
সিমোন দ বোভোয়া এই প্রসঙ্গে চূড়ান্ত অত্যুক্তি করেছেন এই বলে যে, 'বলা হয় বিবাহ পুরুষকে খর্ব করে। এ কথা প্রায়শই সত্য, কিন্তু প্রায় সর্বদাই বিবাহ নারীকে ধ্বংস করে।'
========================================================================
... বহু বিকৃতিতে, স্বার্থসংকীর্ণ, অহমিকানিষ্ঠ সংঘাতে যুগে যুগে দাম্পত্য থেকে প্রেম অন্তর্নিহিত হয়েছে। পড়ে থেকেছে শুধু বন্ধনটি। যে হতে পারতো সহচর বা সহচরী সে হয়ে ওঠে কারা-প্রহরী।
========================================================================
... সমস্ত দাম্পত্যে নিষ্ঠা একনিষ্ঠতা ও দৃঢ়তার দায়টা দেওয়া হত বধূটির ওপরে, তার পাতিব্রত্য ছিল অপরিহার্য। তাকে সতী বধূ হতে হবে অথচ ঐ সতীর কোনো পুংলিঙ্গ প্রতিশব্দই নেই।
========================================================================
শরীর ও মন সমান প্রাধান্য পেলে তবেই দাম্পত্য সত্যিকার একটি দৃঢ় ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত হতে পারে, এবং এ ভিত্তির কোনো বিকল্প নেই।
========================================================================
অতিভোগ যে দাম্পত্যকে বিপথে নিয়ে যায়, সুখের বদলে দেয় সম্ভোগ, এ আজ ঘরে ঘরেই দেখা যাচ্ছে। প্রায়ই শোনা যায় জীবন যখন একটাই, তখন যতটা ভোগ করে নেওয়া যায় তার চেষ্টা করতে দোষ কী? দোষ প্রথমত, ঐ নগ্ন অতিলুব্ধতা মানুষের কুৎসিত একটি রিপু, যা অশুভ ও অশুচি। দ্বিতীয়ত, এই লোভের ভোগের আতিশয্যে মানুষ সেই সব কিছুকে হারাতে বসেছে যা জীবনকে অর্থপূর্ণ করে তোলে। প্রেম, আদর্শ, মানবিক মূল্যবোধ, সাধারণ মানুষের কল্যাণের জন্য তৎপরতা, নতুন সুন্দর এক পৃথিবী রচনার স্বপ্ন। কুবেরের সাধনা শ্রীকে পরাহত করছে, অতিভোগের লালসা দাম্পত্যকে কলুষিত করছে।
========================================================================