Thursday, 7 September 2017

মনুসংহিতা এবং নারী

মনুর চোখে শূদ্র যেমন অপূর্ণ মানব, নারীও তাই । মনুসংহিতার বহু শ্লোকে নারী ও শূদ্র একই সাথে উচ্চারিত । যা শূদ্রের জন্যে নিষেধ তা নারীর জন্যেও নিষেধ । তাদের জন্যে একই বিধি-বিধান ।

মনুর ধর্মশাস্ত্রের তাত্ত্বিক ভিত্তি ছিল কর্মবাদ ও জন্মান্তরবাদ । মনুর কালের আগেই কর্মবাদ বৈধতা পেয়ে গিয়েছিল । পরে তার সাথে যুক্ত করা হয় জন্মান্তরবাদের তত্ত্বকে । মনুর ধর্মশাস্ত্র এই দুই মতবাদকে আরও দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠা করে । এই জন্মে দেবতারূপ দ্বিজ ও পতির সেবায় ত্রুটি ঘটলে পরজন্মে শুভ্রও নারীকে আরও হীনপশুযোনিতে জন্ম নিতে হবে । ব্রাহ্মণ্যধর্মের কুটিল উদ্ভাবনে কর্মবাদ ও জন্মান্তরবাদের গোলকধাঁধা থেকে শূদ্র যেমন মুক্তি পায়নি, নারীও পায়নি ।

মনুসংহিতার মূল উদ্দেশ্য ছিল ব্রাহ্মণের শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিপাদন । সেই শ্রেষ্ঠত্ব প্রায় দেবত্বের সমপর্যায়ের । কিন্তু এখানে একটা প্রশ্ন থেকে যায় । নিজেরা ভূতলস্থ দেবতার মর্যাদা গ্রহণ করেও, কেন তারা নিজেদের জননী-জায়া-ভগ্নী-কন্যা-বধূদের দেবীর মর্যাদায় ওপরে তুললেন না ? কেন তাদের নামিয়ে দিলেন দাসীর সমপর্যায়ে ? মনু ব্রাহ্মণ নারী ও শূদ্রা নারীর মধ্যে কোনও পার্থক্য রাখেননি । মনু সব বর্ণের নারীর জন্যে একই বিধান রেখে গেছেন । মনু নিজেদের পরিবারের নারীদেরও হীন অবস্থানে নামিয়ে দিয়েছিলেন অন্য বর্ণের নারীদের সাথে । এতটাই ছিল মনুর নারী বিদ্বেষ । মনু শুধু ব্রাহ্মণ্য আধিপত্য নয়, পুরুষতন্ত্রও সুপ্রতিষ্ঠিত করে গেছেন । তাঁর ধর্মশাস্ত্র সেই আধিপত্যবাদের তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা ।

==================================================================
"মানবধর্মশাস্ত্র" মনুসংহিতা 

মনুসংহিতা সম্পূর্ণরূপে আচরণগত বিধি নির্দেশক শাস্ত্রগ্রন্থ । মনুসংহিতাকে বলা হয়েছে মানবধর্মশাস্ত্র । ভারতীয় সমাজ সংগঠনভুক্ত মানবসমষ্টির সব নরনারী জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত কীভাবে চলবে, কোন পরিস্থিতিতে নর-নারীর কী করণীয় আর কী বর্জনীয়, তাদের মৃত্যুর পর উত্তরাধিকারীরাই বা তাদের জন্যে কী করবেন, কোন স্খলন বা অপরাধের জন্যে কোন শাস্তি বা প্রায়শ্চিত্ত, সব ব্যাপারেই বিশদ বিধি-বিধান দিয়ে গেছেন মনু ।

==================================================================
মনুসংহিতা মানবীশাস্ত্র নয় 

বর্ণবাদে বিভক্ত ভারতীয় সমাজব্যবস্থায় নারীর সামাজিক অবস্থান কখনও মর্যাদার ছিল না । সব ধর্মশাস্ত্র, স্মৃতি পুরাণেই নারীকে দেখানো হয়েছে হীনজন্মারূপে । নারীকে স্থান দেওয়া হয়েছে শূদ্র ও পশুর সাথে । মনুসংহিতার বহু শ্লোকে নারী ও শূদ্র একইসাথে উচ্চারিত ।

সুঙ্গযুগ থেকে গুপ্তযুগ-এর কালে রাষ্ট্রশক্তির সহায়তায় প্রাচীনতর বেদ ও বেদোত্তর অনুশাসনগুলির নতুনভাবে বিন্যাসের প্রয়োজন দেখা দেয় । এই উদ্দেশ্যেই আনুমানিক এই কালপর্বে মনুসংহিতা সংকলিত হয় । কল্যাণী বন্দোপাধ্যায় মনে করেন, "এই সময় বিভিন্ন বিধর্মী গোষ্ঠীর আগ্রাসন এবং বেদবিরোধী বৌদ্ধধর্মের ব্যাপক প্রসারের ফলে হিন্দুধর্মের এক সংকটকাল উপস্থিত হয় । তাই হিন্দুধর্মকে পুনরুজ্জীবিত করার উদ্দেশ্যে রচিত হয় স্মৃতিশাস্ত্র অথবা ধর্মশাস্ত্র । যার অনুশাসন ছিল অপেক্ষাকৃত কঠোর এবং অনেক সময় নিষ্ঠুর ।"

কল্যাণী বন্দোপাধ্যায় মনে করেন মানবধর্মশাস্ত্র "মনুসংহিতার যুগেই নারীকে সামগ্রিকভাবে পুরুষের পদানত করে প্রায় পশুতে পরিণত করার কাজটি সম্পূর্ণ হয় । যদিও এর প্রেক্ষাপট আগেই কিছুটা তৈরী হয়েছিল ।"

অন্য একটি গ্রন্থে তিনি দেখিয়েছেন, "প্রাচীনকাল থেকে হিন্দুশাস্ত্রের অনুশাসন অনুযায়ী ভারতীয় আর্থসামাজিক কাঠামোতে সর্বত্র সাধারণভাবে নারীকে শূদ্রের এবং পশুর সাথে একাসনে বসানো হয়েছে । বৈদিক যুগেও এর কোন ব্যতিক্রম ছিল না । শতপথ ব্রাহ্মণে নারীকে শুধু শূদ্র নয়, কুকুর এবং কালো পাখির (কাক) সঙ্গে তুলনা করে সবাইকে "অনৃত" বা "মিথ্যা" বলে ঘোষণা করা হয়েছে । স্মৃতিশাস্ত্রের প্রধান প্রবক্তা মনুও নারীকে "মিথ্যার মতই অপবিত্র" আখ্যা দিয়েছিলেন । ভগবদগীতায় শ্রীকৃষ্ণ নিজেই যে চাতুর্বর্ণ্য সৃষ্টি করেছেন এ কথা বলার সময় প্রসঙ্গত আরও বলেছেন যে বৈশ্য, শূদ্র এবং নারী প্রভৃতি "পাপযোনি"রা তাঁকে আশ্রয় করেই পরমগতি লাভ করে । অর্থাৎ বৈশ্য, শূদ্র এবং নারী সবাই এক স্থানীয় এবং পাপী । পরবর্তীকালে অনেক পুরাণেও প্রায় একই কথা শোনা যায় । উদাহরণস্বরূপ আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম শতক থেকে খ্রিস্ট পরবর্তী পঞ্চম শতকের মধ্যে রচিত বায়ু পুরাণে বলা হয়েছে যে পাপী, বৈশ্য, স্ত্রী (নারী) ও শূদ্র যদি একটি "গোপন স্তব" শোনে, তবে তারা রুদ্রলোকে (স্বর্গে) যায় । অর্থাৎ  বৈশ্য, শূদ্র, নারী এবং পাপী সবাই পরস্পরের সাথে তুলনীয় এবং নিম্নস্তরের জীব (যারা সাধারণভাবে স্বর্গে যাবার অধিকারী নয়) ।

কল্যাণী বন্দোপাধ্যায় আরো দেখিয়েছেন, যে উপনিষদে শুধু দার্শনিক তত্ত্বই রয়েছে বলে মনে করা হয়, সেখানে আবার স্ত্রীর প্রতি স্বামীর সামাজিক অনুশাসন আছে যার সাথে তাত্ত্বিক দর্শনের প্রায় কোন মিল নেই । তিনি বৃহদারণ্যক উপনিষদের একটি শ্লোক তুলে ধরেছেন । "(প্রয়োজনে) স্ত্রীকে লাঠি বা হাত দিয়ে মারবে, " (৬।৪।৭) দেখা যাচ্ছে উপনিষদ শুধু দার্শনিক তত্ত্বের আকরই নয়, নারীর প্রতি অবমাননাকর বিধানও এতে আছে ।

======================

বেদ-উপনিষদে এত যে সব স্ততি নারীর, তার অবির্ভাবের, তার আত্মার, মনুসংহিতার কোথাও তার প্রভাব নেই । সেখানে নারী সম্পূর্ণরূপেই পুরুষের অধীন । তিনি পুরুষের অংশ নন । তার অবস্থান পুরুষের পদতলে । নারীকে মনুসংহিতা পাঠ করবার কিংবা শ্রবণের অধিকার পর্যন্ত দেননি মনু,

২/১৬ যার গর্ভাধান থেকে অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া পর্যন্ত বিধি মন্ত্র সহকারে উক্ত হয়েছে, এই শাস্ত্রে তার অধিকার জ্ঞাতব্য, অন্য কারও নয় ।

সুরেশচন্দ্র বন্দোপাধ্যায় 'যার' শব্দের ব্যাখ্যা দিয়েছেন 'দ্বিজ' বলে । আর 'অধিকার' বলতে তিনি অধ্যয়ন ও শ্রবণের অধিকার বলেছেন । পঞ্চানন্দ তর্করত্নের অনুবাদেও একই কথা লা হয়েছে । ব্রাহ্মণ্য সমাজসংগঠনে তারাই শুধু দ্বিজ যাদের জন্যে উপনয়নের বিধান রয়েছে । তারা শুধু পুরুষ, নারী নন । ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রিয় কন্যা হলেও নয় ।

==================================================================
নারীর শিক্ষার অধিকার শাস্ত্রসম্মত নয় 

মনু বেদকে অতিক্রম করেননি । মনুসংহিতায় বারংবার তা উচ্চারিত । মনু বেদমন্ত্রের রচয়িতা বেদকন্যাদের জানতেন না তা তো নয় । কিন্তু মনুসংহিতায় তিনি সেই বেদকন্যাদেরও বেদপাঠের অধিকার পর্যন্ত নেই বলে বিধান দিয়ে গেছেন ।

মনু মানবধর্মশাস্ত্রে নারীর জ্ঞানার্জন ও শিক্ষার অধিকারই তুলে দিলেন । তাদের জন্য কোনওরূপ সংস্কারের বিধান পর্যন্ত থাকল না । মনুর বিধান নারীকে সম্পূর্ণরূপে গৃহের অভ্যন্তরে ঢুকিয়ে দিল । নারীর বিবাহকে করা হল বাধ্যতামূলক ।নারীর জন্যে সব ধরনের শিক্ষা-দীক্ষা নিষিদ্ধ করে দেওয়া হল । তাকে বাধ্য করা হল স্বামী পুত্রের সেবা করে জীবনদান করতে । মনু বিধান দিলেন,

২/৬৭ স্ত্রীলোকদের বিবাহবিধি বৈদিক সংস্কার বলে কথিত, পতিসেবা গুরুগৃহে বাস এবং গৃহকর্ম তাদের (হোমরূপ) অগ্নিপরিচর্যা ।

নারীর জন্যে বিবাহ-ই হয়ে গেল সবচেয়ে বড় সংস্কার । পতিসেবা তুলনীয় হয়ে গেল গুরুগৃহ বাসের সাথে । আর গৃহকর্ম হল হোমরূপ অগ্নিপরিচর্যা । নারীর জন্যে আর কি প্রয়োজন ? মনু কিন্তু পুরুষদের জন্যে উপনয়ন ছাড়াও অন্যান্য জাতকর্মের বিধান রেখেছেন,

২/৬৫ ব্রাহ্মণের কেশান্ত সংস্কার ষোলো বৎসর বয়সে, ক্ষত্রিয়ের বাইশ বছর বৎসরে এবং বৈশ্যের চব্বিশ বৎসরে করণীয় ।

এখানে শূদ্র পুরুষের কথা নেই । মনুর কাছে শূদ্র কখনো পূর্ণমানব ছিল না । ... মনু যাদের কথা বললেন তারা সব দ্বিজপুত্র । কিন্তু দ্বিজপুত্রদের জন্যে যে সংস্কার ছিল বৈদিক উচ্চারণে ঋদ্ধ, দ্বিজকন্যাদের জন্যে তা ছিল অমন্ত্রক ।

২/৬৬ এক সকল সংস্কার স্ত্রীলোকের শরীর সংস্কারের জন্য যথাকালে ও যথাক্রমে অমন্ত্রক করণীয় ।

======================

মনুর আগে বেদ অধ্যায়ন ছিল শিক্ষার প্রথম পাঠ । মনুর বিধানে মনুসংহিতায় বেদপাঠের অধিকার নিষিদ্ধ হয়ে যায় । মনু বললেন,

৯/১৮ স্ত্রীলোকদের মন্ত্রসহকারে (জাতকর্মাদি) সংস্কার নেই --- এই ধর্মবিহিত । এরা (ধর্মের প্রমান রূপ শ্রূতি স্মৃতিরহিতত্ব হেতু) ধর্মজ্ঞ নয়, (পাপনাশক মন্ত্র জপ রহিতত্ব হেতু) মন্ত্রহীন এবং মিথ্যার ন্যায় (অশুভ) --- এই শাস্ত্রীয় নিয়ম ।

মনু নারীকে মিথ্যার ন্যায় অশুভ এবং অধর্মজ্ঞ মন্ত্রহীন বলে চিহ্নিত করলেন । শুধু বেদপাঠ নয়, অন্যান্য সব ধর্মশাস্ত্র পাঠও নারীর জন্যে নিষিদ্ধ করে তার প্রথাগত সব শিক্ষার পথ বন্ধ করার বিধান দিলেন । তাতে নারীর মানবিক বিকাশের পথ চিরদিনের জন্যে বন্ধ হয়ে যায় । মনু চেয়েছিলেন নারীর ওপর পুরুষের নিরংকুশ আধিপত্য । সে জন্যে অনেক কঠোর বিধানও তাই যুক্ত করতে হয়েছে মনুসংহিতায়, এর সৃষ্টিকর্তাকে ।

যে নারী বেদের যুগে বেপারংগমা ব্রহ্মবাদিনী হতে পারতেন, হোমে যার ছিল সহজ অধিকার পুরুষের অনুরূপ, মনুসংহিতায় তা নিষিদ্ধ হয়ে যায় । হোমে নারীর অধিকার স্বীকার করতে চাননি মনু,

১১/৩৬ কন্যা, যুবতী, অল্পবিদ্যাসম্পন্ন ব্যক্তি, মূর্খ, রোগাদি পীড়িত ব্যক্তি ও অনুপনীত ব্যক্তি হোম করবে না ।
১১/৩৭ এই (উক্ত) ব্যক্তিরা হোম করলে তারা এবং যার জন্য করে সে নরকে পতিত হয় । সুতরাং, হোতা হবেন শ্রৌতকর্মে প্রবীণ ও বেদে পারদর্শী ।

কন্যা ও যুব-নারীকে এখানে পংক্তিভুক্ত করা হয়েছে অল্পবিদ্যাসম্পন্ন ও অসুস্থ পুরুষদের সাথে । এতে অবশ্য কোনও অসংগতি নেই । মনু তা করতেই পারেন । কন্যাদের শিক্ষাই তো শাস্ত্রসম্মত ছিল না মনুর কাছে । তাদের তো মূর্খ হয়ে থাকা ছাড়া কোনও বিকল্প ছিল না । কন্যাদের কুমারী হয়ে থাকারও কোন বিধান নেই মনুসংহিতায় । বিবাহ-ই কন্যার পরমাগতি ।

==================================================================
বিবাহ প্রসঙ্গে মনুসংহিতা

মানবধর্মশাস্ত্র মনুসংহিতায় কন্যা-শিশুর জন্য বিবাহ-ই ছিল প্রথম উল্লেখযোগ্য সংস্কার । পুত্রের উপনয়ন না হলে তার দ্বিজত্বে উত্তরণ হত না । কন্যার জন্যে উপনয়ন ছিল বিবাহ । মনু ২/৬৬ । মনুর ধর্মশাস্ত্রে নারীর জন্যে বিবাহ ছিল বাধ্যতামূলক ।

======================

বেদ রচনাকালের যুগে আমরা ব্রাহ্মবাদিনী বিশ্ববারা, অপালা, বাক, লোপামুদ্রাদের দেখেছি, তাঁরা অবিবাহিতই ছিলেন । পতিলোক নামে স্বর্গলাভের জন্যে বিবাহ নামক অনুষ্ঠানের সাথে জড়িত হয়ে তাঁদের পুরুষের অধীনতাকে স্বীকার করে নিতে হয়নি । সংখ্যায় অল্প হলেও বেদের যুগে চিরকুমারীদের অস্তিত্ব ছিল । কিন্তু মানবধর্মশাস্ত্র মনুসংহিতা সেই পথ রুদ্ধ করে দিয়েছিল । তাই ধর্মশাস্ত্রের যুগে আমরা অপালা-বিশ্ববারা-বাককে খুঁজে পাইনি । কোনও ধর্মশাস্ত্রের সাথেই নারীর নাম যুক্ত নয় । মনু নারীর বিবাহ অত্যাবশ্যক বলেই নির্দেশ দিয়েছিলেন । মনু নারীর বিবাহের বয়স পর্যন্ত নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন,


৯/৯৪ ত্রিশ বৎসর বয়স্ক পুরুষ মনোরমা দ্বাদশবর্ষীয়া কন্যাকে বিবাহ করবে অথবা চব্বিশ বৎসর বয়স্ক পুরুষ আট বৎসর বয়স্ক কন্যাকে বিবাহ করবে । ত্বরাবান্ ব্যক্তি (অর্থাৎ যে এই বয়স সীমার কম বয়সে বিবাহ করে সে) গার্হস্থ্যধর্মে অবসাদ প্রাপ্ত হয় ।

======================

মনুর মনোগত বাসনা ছিল কন্যা ঋতুমতী হওয়ার পূর্বেই তাকে সম্প্রদান করা । কন্যা ছিল জনকের কাছে বস্তু সমতুল । যেমন ভূমি, পশু ও বস্তু দান করা যায় । কন্যা বস্তু বলেই বিবাহ নামক অনুষ্ঠানে তাকে সম্প্রদান করা হয় । বর বস্তু নয় বলেই তাকে সম্প্রদান করা চলে না । মনু কন্যার নিম্নতম বিবাহ বয়স আট বছরের কম হলেও তাকে সম্প্রদান করার বিধান দিয়ে গেছেন,

৮/৮৮ কন্যা বিবাহযোগ্যা না হলেও তাকে উৎকৃষ্ট, সুরূপ ও সবর্ণ বরের কাছে বিধি অনুসারে সম্প্রদান করবে ।

কোন কন্যাকে বিবাহ করা যাবে মনুসংহিতায় তার বিস্তারিত বিবরণ রয়েছে,

৩/৮, ৩/৯ কপিলাবর্ণ, অধিকাঙ্গবিশিষ্টা, রোগগ্রস্তা, লোমহীনা, অধিকলোমবিশিষ্টা, বাচাল, পিঙ্গ লবর্ণা, নক্ষত্র, বৃক্ষ, নদী, পর্বত, পক্ষী, সর্প, দাস --- এইগুলির নামধারিণী এবং ভীতিজনক নামযুক্তা কন্যাকে বিবাহ করবে না ।

৩/১০ যে অঙ্গহীন নয়, যার নাম সুখে উচ্চার্য, হে হংসগতি বা গজগামিনী, যার লোম ও কেশ কোমল, দন্ত ক্ষুদ্র, অঙ্গ মৃদু , সেই স্ত্রীলোককে বিবাহ করবে ।

৩/১১ যে কন্যার ভ্রাতা নেই বা পিতা অজ্ঞাত, বিজ্ঞব্যক্তি পুত্রিকা ধর্মশঙ্কায় তাকে বিবাহ করবে না ।

======================

মনুসংহিতায় নারীর নাম কীধরণের হবে তারও নির্দেশ দেওয়া রয়েছে,

২/৩৩ স্ত্রীলোকের নাম হবে সহজে উচ্চার্য, অনিষ্ঠুরতাবাচক, অনায়াসবোধ্য, সুন্দর, শুভসূচক, অন্তে দীর্ঘবর্ণযুক্ত এবং আশীর্বাদবোধক ।

এই নির্দেশ লঙ্ঘন করলে সেই কন্যা বিবাহ করার যোগ্যা বলে বিবেচিত হবে না - এই ছিল মনুর বিধান ।

মনুসংহিতার অন্য একটি শ্লোকে "বিবাহযোগ্যা কন্যার উপযুক্ত পাত্র পাওয়া না গেলে মৃত্যপর্যন্ত পিতৃগৃহে রেখে দেওয়া উচিত" বলে বিধান দিয়েছেন মনু,

৯/৮৯ বরং কন্যা ঋতুমতী হয়েও আমরণ (পিতৃগৃহে) থাকবে, তথাপি কখনও তাকে নির্গুণ বরের হাতে দিবে না ।

======================

মনু তো কন্যার বিবাহের বয়স পর্যন্ত নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন (৯/৯৪) । এমনকি 'উৎকৃষ্ট সুরূপ ও সবর্ণ বর পেলে কন্যা বিবাহ-যোগ্যা না হলেও তাকে সম্প্রদান করতে বলেছেন (৯/৮৮) । অর্থাৎ বরের বয়স যাই হোক, 'সগুণ' হলে, আট বছরের কম হলেও কন্যাকে বিবাহ দেওয়া চলে । অন্য একটি শ্লোকে (৫/১৫৪) মনু বিধান দিয়েছেন পতি দুশ্চরিত্র, কামুক ও গুণহীন হলেও তাকে লঙ্ঘন করা যাবে না । তাকে দেবতার ন্যায় সেবা করে যেতে হবে । কোনও নারী সেই কালেও দুশ্চরিত্র কামুক গুণহীন বরকে স্বেচ্ছায় বরণ করে নিত না । তাকে তুলে দেওয়া হত তার হাতে । নির্গুণ বরের হাতে সম্প্রদান করা হলে কন্যা যাতে স্ত্রীধর্মপালনে অবাধ্য না হয়, তাই মনুর এই বিধান । নির্গুণ বরের হাতে বিবাহযোগ্যা কন্যাকে সম্প্রদান না করে তাকে আজীবন পিতৃগৃহে রেখে দেওয়ার মনু-উপদেশ তাই আমাদের বিভ্রান্ত করে ।

======================

মনুর অনিন্দনীয় বিবাহ পদ্ধতি হচ্ছে মূলত দানাত্মক বিবাহ । দানাত্মক বিবাহে কন্যা যেন প্রাণহীন বস্তু, সম্পত্তির সমতুল, অথবা পালিত পশু । তাই দানের বিষয় কন্যাদান হল শ্রেষ্ঠ দান, 'মহাদান' । দানের শাস্ত্রীয় পরিচয় হল দেয় বস্তুতে নিজের স্বত্বের অবসান ঘটিয়ে পরের স্বত্ব উৎপন্ন করা ... । তাই বিবাহে কন্যার পিতৃস্বত্ব বিলুপ্ত হয়ে যায় । নারীর গোত্রান্তর হয় । 

কোনও শাস্ত্রীয় বিধানেই নারীর স্বতন্ত্র সত্বা স্বীকৃত নয় । মনুর শাস্ত্রেও সেই স্বীকৃতি নেই । শুধুমাত্র বিবাহের পর সন্তান জন্মদান করার জন্যেই নারীকে সৃষ্টি করা হয়েছে । সেই তার একমাত্র কাজ ।(৯/৯৬) 

==================================================================
নারীর ধর্ম : মনুর বিধান

মনু নারীকে কোনও রূপেই স্বাধীনতা দিতে চাননি । নারী সারাজীবন পুরুষের অধীনতা স্বীকার করে বেঁচে থাকবে জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত । কোনও রাখ-ঢাক না করেই মনু বলেছেন,

৯/২ স্ত্রীলোকদের (স্বামী প্রভৃতি) ব্যক্তিগণ তাদের দিনরাত পরাধীন রাখবেন, (অনিষিদ্ধ) রূপাদিবিষয়াসক্ত স্ত্রীলোকদেরও নিজের বশে রাখতে হবে ।

৯/৩ স্ত্রীলোককে পিতা কুমারী জীবনে, স্বামী যৌবনে ও পুত্র বার্ধক্যে রক্ষা করে; (কখনও) স্ত্রীলোক স্বাধীনতার যোগ্য নয় ।

৯/২ এরা রূপ বিচার করে না, (যৌবনাদি) বয়সে এদের আদর নেই, রূপবান বা কুরূপ পুরুষ মাত্রেই তার সঙ্গে সম্ভোগ করে ।

৯/৩ শয়ন, উপবেশন, অলংকার, কাম, ক্রোধ, কুটিলতা, পরহিংসা, মন্দ আচরণ -- এইগুলি স্ত্রীলোকের (স্বভাবগত করে) মনু সৃষ্টি করেছিলেন ।

২/২১৩ নারীদের স্বভাবই হল পুরুষদের দূষিত করা । অতএব পন্ডিতগণ স্ত্রীলোক সম্বন্ধে অনবহিত হন না ।

২/২১৪ সংসারে কাম ও ক্রোধের বশবর্তী বিদ্বান বা অবিদ্বান ব্যক্তিকে স্ত্রীলোক বিপথে নিতে পারে ।

মনু নারীদের এতটাই অবিশ্বাস করেছেন যে, জননী, ভগ্নী ও কন্যার সাথেও একাকী নির্জনগৃহে বাস করতে নিষেধ  করে গেছেন ঠিক পরবর্তী শ্লোকে,

২/২১৫ মা, বোন বা মেয়ের সঙ্গে শূন্যগৃহাদিতে পুরুষ থাকবে না । শক্তিশালী ইন্দ্রিয়সমূহ বিদ্বান লোককেও বশীভূত করে ।