Wednesday, 2 August 2017

নোট বাতিলের পরিণতি

পুঁজিবাদই কালো টাকার লাইফ লাইন - হরিলাল নাথ 

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর সোভিয়েত সমাজতন্ত্রের আবির্ভাব এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ফ্যাসিবাদের পরাজয়ের পর বিশ্বের দেশে দেশে মুক্তিসংগ্রাম দুর্বার হয়ে ওঠে এবং একে একে উপনিবেশগুলি স্বাধীন হতে শুরু করে । ফলে আগের মতো বিনা বাধায় অঢেল শ্রম ও সম্পদ শোষণ অসম্ভব হয়ে পড়ে । অবশিষ্ট বিশ্ব থেকে উন্নত পুঁজিবাদে শ্রম ও সম্পদের শোষণ নিয়ন্ত্রিত বা বাধাপ্রাপ্ত হবার ফলে পুঁজিবাদের বিকাশের গতি মন্থর হতে থাকে । বস্তুত ১৯৬০-র দশকের শেষ দিক থেকেই পুঁজিবাদী বিকাশের সংকট নতুন করে অনুভূত হতে থাকে ।

তখন পুঁজিবাদের ক্রমবর্ধমান সংকট থেকে মুক্তির পথ হিসেবে হাজির করা হয় নব্য উদারনীতিকে । অর্থাৎ পুঁজিকে বন্ধনহীন-বাধাহীন করতে হবে । একাজ অতীতের ঔপনিবেশিক শোষণের মাধ্যমে আর সম্ভব নয় । তাই প্রয়োগ শুরু হয় নব্য সাম্রাজ্যবাদী কৌশলে নয়া-উপনিবেশবাদের প্রয়োগ । জাতি রাষ্ট্র বা জনকল্যাণকামী রাষ্ট্রের ধারণাকে ভেঙে ফেলতে হবে । এক একটি দেশে খন্ড পুঁজির খন্ড শোষণ নয় । দেশের সীমান্ত তুলে দিয়ে পুঁজি-পণ্য-পরিষেবার অবাধ বিচরণের ব্যবস্থা করতে হবে সারাবিশ্বে । এভাবে 'আইনি' বা 'স্বীকৃতি' পথে পশ্চিমী পুঁজি নতুন করে বিশ্বজুড়ে দখলদারি কায়েম করতে পারবে । পশ্চিমী পুঁজি সারা বিশ্ব থেকে সস্তায় উপকরণ সংগ্রহ ও শ্রম শোষণ করে মুনাফার হার বাড়িয়ে নিতে পারবে । নব্য-উদারনীতি উন্নত পুঁজিবাদেরই সংকট মুক্তির নব্য ব্যবস্থা । বিশ্বব্যাঙ্ক, আই এম এফ, বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থাসহ পশ্চিমী নিয়ন্ত্রিত আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলির মাধ্যমে এই ব্যবস্থাকে সর্বত্র ছড়িয়ে দেবার প্রক্রিয়াই চলছে ।

নয়া-উদারনীতি পুঁজিবাদের ক্রমাগত ও ক্রমঘনীভূত সংকটজনিত বন্ধদশা থেকে মুক্তির নতুন দিশা । বিশ্বায়নের নাম নতুন মোড়কে শোষণের তীব্রতা ও ব্যাপ্তি বৃদ্ধির নতুন অভিমুখই উদারনীতি । এই ব্যবস্থা যথারীতি জাতি রাষ্ট্র ও কল্যাণকামী রাষ্ট্রের ধারণার পরিপন্থী । এই ব্যবস্থায় উৎপাদনে সরকারি হস্তক্ষেপ বা নিয়ন্ত্রণ চলে না । পুঁজি ও পুঁজিপতিদের অবাধ ও পূর্ণ স্বাধীনতার কথা বলে এই ব্যবস্থা । গোটা বিশ্বের সর্বত্র সব দেশে পুঁজির বন্ধনহীন প্রতিবন্ধকতাহীন অবাধ বিচরণ চায় এই ব্যবস্থা । সামাজিক নিরাপত্তা, জনকল্যাণ ইত্যাদি তুলে দিয়ে সমস্ত মানুষকে এবং গোটা সমাজকে পুঁজির সর্বগ্রাসী শোষণের মুখে ঠেলে দেওয়া হয় । জনস্বার্থে বা সমাজের স্বার্থে যেহেতু সরকারের দায়বদ্ধতা প্রত্যাহৃত হয়, তাই কর সংগ্রহের আর কোনো প্রয়োজন থাকে না । তখন কর হার কমা, কর ছাড়, কর বিধি শিথিল এই ব্যবস্থার অন্যতম বৈশিষ্ট্য হয়ে দাঁড়ায় ।

মানুষকে বোঝানোর চেষ্টা হয়, নব্য উদারনীতির নব্য ব্যবস্থায় কর্মসংস্থান সৃষ্টি, আয় বৃদ্ধি এবং উন্নয়নে রাষ্ট্র বা সরকারের আর তেমন কোনো ভূমিকা নেই । সেই দায়িত্ব পালন করবে ব্যক্তিগত পুঁজি বা বেসরকারি পুঁজি । যত বেশি পরিমাণে দেশি ও বিদেশি বেসরকারি পুঁজি বিনিয়োগ হবে, ততই কাজের সুযোগ বাড়বে, মজুরি বাড়বে এবং উন্নয়ন হবে । সরকারের প্রধান কাজ হবে বেসরকারি মালিকের হাতে পুঁজির পরিমাণ বৃদ্ধিতে সব রকমের সাহায্য করা । একাজে সরকার পাঁচ রকমভাবে সাহায্য করতে পারে । (১) বিত্তবান ও কর্পোরেটের কাছ থেকে কর বাবদ আয় যথাসম্ভব কমিয়ে । মুনাফা বা আয়ের ওপর কর কমলে তাদের উদ্বৃত্ত আয়ের পরিমাণ অনেক বেড়ে যাবে এবং সেটা ফের বিনিয়োগ করে আরও বেশি মুনাফা করতে পারবে । (২) জমি-খনিজ-বনজ ইত্যাদি জাতীয় তথা প্রাকৃতিক সম্পদের ওপর জাতীয় মালিকানা পরিবর্তন করে বেসরকারি মালিকানায় রূপান্তর । এর ফলে অমূল্য জাতীয় সম্পদ লুট করে যথেচ্ছ মুনাফা বাড়ানো যায় । (৩) শ্রমিকদের নিয়োগ, ছাঁটাই, মজুরির হার ইত্যাদির দায়িত্ব পুরোপুরি মালিকদের হাতে ছেড়ে দিতে হবে শ্রম আইন সংশোধন করে । একইভাবে প্রত্যাহার করে নিতে হবে যাবতীয় সামাজিক নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা । অর্থাৎ শ্রমিকদের কাজের ও আয়ের নিরাপত্তা যত অনিশ্চিত করা যাবে, ততই তাদের বেশি বেশি করে শোষণ করা সম্ভব হবে । (৪) সরকারের যাবতীয় সমাজকল্যাণমূলক প্রকল্প গুটিয়ে ফেলতে হবে । সরকার যদি শ্রমজীবী মানুষের মৌলিক চাহিদার কিছুটা সরবারহ করে সামাজিক প্রকল্পের মাধ্যমে, তাহলে শ্রমের বাজারে চাহিদা কিছু হ্রাস পাবে । তখন  বেসরকারি পুঁজির সস্তায় শ্রম পাওয়ায় ব্যাঘাত ঘটবে । অর্থাৎ সরকারকে হাত গুটিয়ে বসে থাকতে হবে, যাতে কোনো অবস্থাতেই শ্রমজীবীদের বেঁচে থাকার উপকরণ সরকারের কাছ থেকে ন্যায্যমূল্যে না পায় । তাদের সেটা জোগাড় করতে হবে শ্রমের বাজারে প্রতিযোগিতায় নেমে । অর্থাৎ যে যত সস্তায় যত বেশি শ্রম দিতে পারবে, তারই কর্মসংস্থান হবে । পুঁজি চায় শ্রমের বিপুল মজুটবাহিনী (বেকার) যাতে যেকোনো শর্তে তাদের শ্রম নিঙড়ে নেওয়া সহজ হয় । (৫) সব দেশের সীমান্ত উন্মুক্ত করে দিতে হবে, যাতে পুঁজি-পণ্য-পরিষেবা সর্বত্র বাজার দখল করতে পারে । এইভাবে জনগণের স্বার্থরক্ষার বদলে পুঁজির স্বার্থরক্ষার দিকে সরকারকে নিয়ে যেতে তবে । এটাই উদারনীতি । এ যুগের পুঁজিবাদের সংকটমোচনের একমাত্র দাওয়াই । পুঁজি ও শ্রমজীবীর স্বার্থ যেহেতু পরস্পর বিরোধী, তাই পুঁজির সঙ্কটমোচনের মানে শ্রমজীবীর সংকটবৃদ্ধি । বর্তমান পুঁজিবাদী বিশ্বের এটাই নির্মম বাস্তবতা ।

আজ উদারনীতির নামে বিনিয়োগ বৃদ্ধির নামে, জি ডি পি বৃদ্ধির নামে, কর্মসংস্থান বৃদ্ধির নামে দেশে দেশে উদারনৈতিক সংস্কারের কাজ ঢালাওভাবে চলছে । তারই পরিণতিতে ধনবৈষম্য ও সম্পদ-বৈষম্য হু হু করে বাড়ছে । প্রথম বিশ্বযুদ্ধ, বিশেষ করে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সমাজতন্ত্রের সঙ্গে পাল্লা দিতে গিয়ে পুঁজিবাদের আধারে আবির্ভূত জাতি রাষ্ট্র ও কল্যাণকামী রাষ্ট্রের বিকাশ ধন-বৈষম্য বৃদ্ধিতে কিছুটা লাগাম টানতে সক্ষম হলেও, এখন তা ফের তীব্র গতি পেয়েছে । বিশেষ করে সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক বিপর্যয়ের পর ধন-বৈষম্য অতীতের সব রেকর্ডকে অতিক্রম করে গেছে । সত্যিই এই বৈষম্য অভূতপূর্ব ও অভাবনীয় ।

সোভিয়েত ইউনিয়নের বিপর্যয় ও সমাজতন্ত্রের আপৎকালীন পশ্চাদপসারণের ফলে পুঁজিবাদের সামনে সবচেয়ে বড় ও কঠিন প্রতিবন্ধকতাটি দুর্বল হয়ে পড়ে । সেই সুযোগে পুঁজিবাদ তার মানবিক মুখোশটি খুলে ফেলে নতুন করে আগ্রাসী চেহারা নিয়ে আত্মপ্রকাশ করতে থাকে । দ্রুত ফিকে হতে থাকে বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক মূল্যবোধও । বুর্জোয়া গণতন্ত্রে বৃহৎ ও একচেটিয়া পুঁজির দাপট বাড়তে থাকে । স্বাভাবিকভাবেই তখন জাতি রাষ্ট্র বা জনকল্যাণকামী রাষ্ট্র গুরুত্ব হারায় । সামগ্রিক উন্নয়নে বা জনকল্যাণে অথবা সম্পদের পুনর্বণ্টনে রাষ্ট্র বা সরকারের দায় ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হয়ে যায় ।

আমরা জানি, পুঁজিবাদী উৎপাদন ব্যবস্থা শ্রমশোষণ ও উদ্বৃত্ত মূল্য আত্মসাৎ-র মাধ্যমে মুষ্টিমেয় বিত্তবানের হাতে পুঁজি ও সম্পদের কেন্দ্রীভবন ঘটায় । কিন্তু এই প্রক্রিয়া পুঁজিবাদী গণতন্ত্রের আধারে জনকল্যাণকামী ও জাতি রাষ্ট্রের আইন ও বিধি মেনে চললে পুঁজির কেন্দ্রীভবনের গতি খানিকটা হলেও নিয়ন্ত্রিত হয় । পুঁজির মালিকরা এই বিলম্বিত লয়ে সম্পদ বৃদ্ধিতে তুষ্ট নয় । তাই তারা আইন ও বিধি লঙ্ঘন করে অর্থাৎ কর ফাঁকি দিয়ে সম্পদ বৃদ্ধির গতি বাড়ায় ।

আধুনিক পুঁজিবাদের এই ব্যবস্থা কর ফাঁকি দেবার পথকে ক্রমাগত সুগম ও প্রসারিত করে চলেছে । নব্য পুঁজিবাদের অনুসারী সরকারগুলিও আইনকানুন ও কর আদায় ব্যবস্থাকে এমনভাবে পুনর্গঠিত ও শিথিল করছে, যাতে বিত্তবানদের ওপর করের বোঝা কমে, কর ফাঁকি দেওয়া সহজতর হয় এবং কর ফাঁকি দেবার বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ দুর্বল হয় । বস্তুত অনেক ফাঁকফোকর রেখেই তৈরি বা সংশোধন করা হয় কর আইন ও কর আদায় ব্যবস্থা । যাতে কর ফাঁকির বিরুদ্ধে সাজা দেবার সুযোগ বিশেষ না থাকে ।