Thursday, 28 July 2016

আম্বেদকর একটি সমাজতাত্ত্বিক পর্যালোচনা

ধর্ম সংস্কারক, সমাজ সংস্কারক, ব্রাহ্মণ্যবাদ বিরোধী, হিন্দু ধর্ম বিরোধী, অর্থনীতিবিদ, রাজনৈতিক নেতা, সংবিধানের মুখ্য স্থপতি, শিক্ষাবিদ - এই বিশেষণগুলির সবকটিই সত্য, কিন্তু এর কোনো একটিকে নিয়ে তাঁর পূর্ণাঙ্গ জীবনের রূপকে ধরা সম্ভব নয় ।


“Lost sights are never regained by begging and by appeals to the conscience of the usurpers but by relentless struggle’. তিনি মনে করেছিলেন ভারতের স্বাধীনতা মানেই ভারতের জনগণের স্বাধীনতা নয় । প্রথমটা যে দ্বিতীয়টাকে সুনিশ্চিত করবে এমন কোন কথা নেই । আর আম্বেদকর জনগণের স্বাধীনতার স্বাধীনতার ধারণাতেই বেশি আগ্রহী ছিলেন ।

রাজনৈতিক সংস্কার ও সামাজিক সংস্কারের মধ্যে আম্বেদকর সামাজিক সংস্কারের ধারণাকেই বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন । প্রকৃত সংস্কার কখনই কার্যকরী হবে না যদি না সামাজিক বিষয়টা অবহেলিত থাকে । তিনি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতেন যে অধিকার আইনের দ্বারা রক্ষিত হয় না - অধিকার রক্ষা হয় প্রধানত 'সামাজিক ও নৈতিক বিবেক' দ্বারা ।মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসকারী কালো মানুষদের কাছে মৌলিক অধিকারের কি গুরুত্ব আছে ? জার্মানীতে ইহুদি দমন হয়েছিল আইনী অধিকার সে দেশে সুপ্রতিষ্ঠিত থাকা সত্ত্বেও । ভারতে নীচু জাতিগুলির কাছেও তেমনি সংবিধান, মৌলিক অধিকার - এগুলি অর্থহীন কারণ রাজনৈতিক গণতন্ত্র সত্ত্বেও সামাজিক স্বৈরাচার চালু থাকতে পারে । তাই রাজনৈতিক ক্ষেত্রে গণতন্ত্র যদি সামাজিক ক্ষেত্রে গণতন্ত্রে দ্বারা পরিপূরিত না হয় তা হলে 'রাজনৈতিক গণতন্ত্র' ধারণাটিই অর্থহীন হয়ে পড়ে ।


"We must make our political democracy a social democracy as well. Political democracy cannot last unless there lies at the base of it social democracy. What does social democracy mean? It means a way of life which recognizes liberty, equality and fraternity as the principles of life.”


আম্বেদকর বলেছিলেন, "On 26.1.1950, we are going to enter a life of contradictions.”


দলিত সম্প্রদায়ের মধ্যে শিক্ষার আলো প্রবেশ করাতে হবে এবং আন্দোলনের জন্য তাদের সংগঠিত করতে হবে, যে তিনটি slogan তিনি দিয়েছিলেন তা হল 'educate, agitate and organize.' দলিত সম্প্রদায়ের জন্য আলাদা প্রতিনিধিত্বের কথা তিনি বলেছিলেন এবং কংগ্রেসের তীব্র বিরোধিতা সত্ত্বেও এর সপক্ষে ব্রিটিশদের সওয়াল করেছিলেন, শেষ পর্যন্ত ১৯৩২ সালে গান্ধী এবং আম্বেদকরের মধ্যে Poona Pact সম্পাদিত হয় যার মাধ্যমে কংগ্রেস দলিতদের জন্য আরও বেশি প্রতিনিধিত্বের ধারণাকে মেনে নিয়েছিল এবং যা ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনের মধ্যে স্বীকৃতি পায় । আম্বেদকর বলেছিলেন, "My criterion of my work is the welfare of my community. I have no other ambition. For that only, I cooperated with the Congress.” তিনি বলেছিলেন, “Whatever I have achieved, is entirely due to the strength of my community. I am proud to be born a Harijan.”


তাঁর মতে, হিন্দুরা টিঁকে রয়েছে সমস্যাগুলিকে এড়িয়ে গিয়ে - তার মুখোমুখি হয়ে সমাধান করে নয় । হিন্দু সমাজের প্রগতিশীলতার ধারণাকে তিনি তীব্রভাবে সমালোচনা করেছেন, কারণ তিনি মনে করেছিলেন যে সমাজ জাতি-ব্যবস্থা ও অসাম্যের ওপর নির্ভরশীল, তা কখনও সামাজিক ন্যায়কে প্রতিষ্ঠা করতে পারে না - সেই সমাজ কখনও প্রগতিশীল বলে পরিগণিত হতে পারে না ।


তিনি বলেছিলেন যে, হিন্দু সমাজ শূদ্রদের যে চোখে দেখে, নারীদেরও সেই একইভাবে দেখে - উভয়ের ক্ষেত্রেই সমাজ তাদের কোনো অধিকারকে স্বীকৃতি দেয়নি । হিন্দু বিবাহের নিয়ম হচ্ছে - 'polygamy for the man and perpetual slavery for the woman' । তাই নারীর অধিকারের প্রশ্নটি হচ্ছে দাসত্ব না স্বাধীনতা-এর কোনটি প্রাধান্য পাবে সেই প্রশ্ন ! বিবাহ বিচ্ছেদের অধিকার নিয়ে সেই সময়ে যে বিতর্ক চলেছিল সেখানে আম্বেদকর এক পরিস্কার stand নিয়েছিলেন । তিনি বলেছিলেন, যে বিবাহ বিচ্ছেদের বিষয়টি হিন্দু সমাজে প্রচলিতই রয়েছে । 'Shudras forming 90 p.c. of the population had customary divorce. Are we for 90 p.c. or for 10 p.c. of the high caste people?' আম্বেদকর বলেছিলেন, "হিন্দুসমাজের বর্ণাশ্রম ব্যবস্থা কেবলমাত্র পুরুষদের জন্য নারীর বর্ণাশ্রম নেই, কেন ? তারা কি মানব সমাজের বাইরে ? তারা কি গুণহীন ? হিন্দু শাস্ত্রকারদের মতে নারীমাত্রই শূদ্রাণী এবং তার কোন স্বাধীন সত্তা নেই । নারী সমাজের প্রতি এত বড় অসম্মান আর কোনো ধর্ম করেনি ।"


========================================================================

আর্যদের ভারতে পদসঞ্চারের সময় কোনো জাতিবিভেদজনিত প্রথা ছিল না । কিন্তু ব্যবসার ওপর বর্গীকরণ করবার প্রবণতা ছিল । ভারতীয় সাহিত্যে প্রথমে 'বর্ণ' শব্দের উল্লেখ ছিল, 'জাতি' শব্দের প্রয়োগ ঘটেছে অনেক পরে । 'বর্ণ' শব্দের প্রয়োগ মূলত গায়ের রঙ নির্ভর । ধর্মশাস্ত্রতে জাতি ও বর্ণের প্রয়োগ সমার্থক । এইখানেই ডঃ আম্বেদকরের আগমনের প্রস্তুতি ক্ষেত্রের বীজ নিহিত রয়েছে । বৈদিকযুগে আর্যসমাজে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় এবং বৈশ্যদের মধ্যে বর্গীকরণ ছিল না । ঋকবেদের যুগে শূদ্ররা তিরস্কৃতও ছিল না । আদতে ঋকবেদে ছিল তিনটি বর্ণ - ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় এবং বৈশ্য । উপনিষদের সময় থেকে চতুর্থ বর্গ তথা শূদ্র সম্প্রদায়ের নির্মিতি করা হয়েছে । উপনিষদের কালসীমা প্রায় খ্রিস্টপূর্ব ১২০০ থেকে ৬০০ পর্যন্ত । স্পষ্টত উল্লেখ্য, বর্ণ আর জাতি বিভাজনের নাম মানুষের অবনমন এবং সর্বাত্মক ক্ষেত্রে অধিকার থেকে বঞ্চিত হওয়ার প্রবণতা খুবই প্রাচীনকালজাত । গুনকেন্দ্রিক বর্ণব্যবস্থার রূপান্তরীকরণ এবং জন্মগ্রহণ কবে, কিভাবে কোন সালে হয়েছে, তার নিশ্চিত প্রমাণ সঠিকভাবে প্রত্যক্ষ নয় । আসলে এই প্রক্রিয়া হয়েছে অত্যন্ত ধীরে ধীরে । প্রকৃত জ্ঞান আর তর্কচেতনাকে বহিষ্কার করে ব্যক্তিগত স্বার্থসিদ্ধি লাভকেন্দ্রিক অনুভবের প্রহর থেকেই জন্মসূত্রকেন্দ্রিক জাতিব্যবস্থার প্রচলন হয়েছে । সমাজশোধনকারী 'মনুস্মৃতি' থেকে নবীন সমাজ ব্যবস্থায়  জন্মসূত্রে ব্রাহ্মণের শ্রেষ্ঠত্ব স্বীকৃত । সামাজিক বর্গীকরণ পুরোপুরি জন্মভিত্তিক ।  বর্গীকরণের জন্মসূত্রকেন্দ্রিকতায় শূদ্র আর অচ্ছুতের মানবিক অধিকারবোধ সম্পূর্ণ বিপর্যস্ত । ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছে তাদের অস্তিত্ব সুস্থ-মানবিকতা । কিন্তু বাস্তবে দেখা গেছে, মনুর পূর্বেই শূদ্র আর অচ্ছুতের অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়েছে । সমাজের তথাকথিত প্রচলিত নিয়মাবলি মনু ক্রমানুসারে শাস্ত্রবন্দী করে গেছেন । বিদগ্ধদের অনুমান, মনুর সময়সীমা খ্রিস্টপূর্ব ২০০ । সূচনাপর্ব থেকে 'মনুস্মৃতি' অনেক স্তরে বিন্যস্ত । গ্রন্থটির পূর্ণাঙ্গ রচনাকাল একটি নির্দিষ্ট সময়বন্দী না হয়ে খ্রিস্টপূর্ব ২০০ থেকে খ্রিস্টীয় ২০ পর্যন্ত বিস্তৃত । গৌতমবুদ্ধের জন্মকালীন সময়সীমা হল খ্রিস্টপূর্ব ৫০০ থেকে খ্রিস্টপূর্ব ৬০০'র মধ্যে । তথাকথিত যজ্ঞব্যবস্থা বা বর্ণবিভাজনের তীব্র বিরোধিতা করে মানবতাবোধের আদর্শে নিজের দর্শন তৈরি করেছিলেন বুদ্ধদেব । এখানে একটা কথা স্পষ্ট যে, কিছু মানুষের স্বার্থকেন্দ্রিক ক্রুরতার প্রভাবে তামাম পদদলিত মানুষ প্রায় তিন হাজার বছর থেকেই ক্রন্দনরত । বর্ণব্যবস্থার ভিন্নতর নির্বাচনী সূত্র ধরে বুদ্ধদেব 'সমতাবাদী ব্যবস্থা' স্থাপনের চেষ্টা করেছিলেন । কিন্তু এর স্থিতিশীলতা দীর্ঘস্থায়ী হয়নি । কেননা, বর্ণব্যবস্থায় এ যাবৎকাল প্রচলিত একদল মানুষের উদ্দেশ্যবোধ আর তথাকথিত নিরাপত্তা যে এক্ষেত্রে বিঘ্নিত হল; তাই ব্যক্তিগত স্বার্থসিদ্ধির প্রশ্নে বৌদ্ধধর্মকে স্বীকার করতে তারা দ্বিধাগ্রস্ত হল । আবার বৌদ্ধধর্ম এত তর্কশুদ্ধ আর মানবিক ছিল যে, তার বিরোধিতাও প্রায় অসম্ভব ছিল । তাই শ্রেষ্ঠ মূল্যবোধকে স্বীকার করে নিয়ে বৌদ্ধধর্মকে আত্মপক্ষের আনুকূল্যে প্রযুক্ত করা হয়েছিল । এখানেও যখন সম্ভব-অসম্ভবের প্রশ্ন এল, তখন হিন্দুধর্মকেই বৌদ্ধধর্মের অনুকূল করবার চেষ্টা করা হল । এই কারণেই 'শঙ্করাচার্য' 'প্রচ্ছন্ন বুদ্ধ' নাম খ্যাত ।


উচ্চবর্ণ নিম্নবর্ণকে ক্ষুদ্র মনে করত আর নিম্নবর্ণও হীনম্মন্যতায় ভুগত । বর্ণব্যবস্থায় প্রান্তিক শূদ্র এবং তার নিম্নে অবস্থানকারী শূদ্র সর্বদাই উপেক্ষিত, অপাংক্তেয় আর অপমানিত হত । ধর্মের ধুয়ো তুলে সমাজের সর্বক্ষেত্রেই তারা  অপাংক্তেয় ছিল । পৃথিবীর কোনো দেশে ধর্ম বা সর্বশক্তিমানের এদেশের নির্ভরতায় একটি সম্পূর্ণ বর্ণের এত ঘোরতর উপেক্ষা হয়নি । ভারতবর্ষেই এটি ঘটেছে । কোনো গোষ্ঠীকে বর্ণ বা জাতির নাম দিয়ে সমাজব্যবস্থার মূল ছাঁচ থেকে ক্রম-বহিষ্কারে স্বাভাবিক মানবিক অধিকারের বঞ্চনায় তৈরি করে নেওয়া হয় পূর্ণ গোলামিতে । ওই গোষ্ঠী নিরুপায় হয়ে গোলামির পরাধীনতায় সমর্পিত হয় । মানুষের সংবেদনশীলতা একমাত্র নির্ণীত হয় জ্ঞানের কারণে । শিক্ষাকেন্দ্রিক জ্ঞানের অভাবেই তাদের সংবেদনশীল সচেতনতা জন্ম নেয়নি ।


শ্রী জ্যোতিরাও গোবিন্দরাও ফুলে (১৮২৭ - ১৮৯০)  ব্যাক্তিত্ব, যিনি উপেক্ষিত ভারতীয় কৃষকসমাজের প্রতি ইংরেজ শাসকের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন । তাঁর স্থির ধারণা ছিল যে, ভারতীয় চাষীদের দুর্দশা-গ্রস্ততার অন্যতম কারণত্রয়ী হল, অজ্ঞানতা, অন্ধ-অনুগত্য এবং ধর্মান্ধতা ।


ভারতীয় সমাজসংস্কারের তিনটি সূত্র বাবাসাহেবের চিন্তাশীলতায় গৃহীত । সূত্র তিনটি হল - 'পড়ো', 'সংগঠিত হয়ে যাও' এবং 'সংঘর্ষ করো' ।

========================================================================